-৯-
আজিকে বেবো আসিয়া যথারীতি তাহার হরেকরকম বকবকমের খাতা খুলিয়া বসিয়াছিল। তাহার কতিপয় মানদার কর্ণে প্রবেশ করিতেছিল, আর কর্ণের আড়ালে পড়িয়া থাকিতেছিল বেশ কিছু। কুট্টুস অতীব দুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে নিরন্তর জ্বালাইয়া মারে সে। লাফাইয়া, ঝাঁপাইয়া ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে মানদাকে। এই বয়সে সে আর উহার সহিত দৌড়াইতে পারে না। বেবো এতক্ষণে কুট্টুসকে লইয়া পড়িল। উহাকে ক্রোড়ে লইয়া কত যে বকিতে থাকিল, তাহার উত্তরে কুট্টুও না জানি তাহার মিহি কণ্ঠের মিয়াঁও লইয়া কী যে কহিল, তাহা উহারাই জানে। কুট্টুর সব চাইতে বদগুণ হইল সে দুদণ্ডও একা থাকিতে চাহে না। সে অদ্যাবধি পাঁচিল ডিঙ্গাইতে সক্ষম হয় নাই, ফলত উহার মাতা, পালক পিতা ঘুরিতে যাইলে এই গৃহের চৌহদ্দির মধ্যেই তাহাকে থাকিতে হয়। বহির্বাটির দিকে সে দুই একবার গিয়াছিল বটে, সেথায় অনেক অচেনা মানুষের ভয়ে সে সন্ত্রস্ত হইয়া পলাইয়া আসিয়াছে ভিতরে। এইখানেই সে স্বস্তি পায় সম্ভবত। আবার পরিচিত মানুষজন আর চেনা চৌহদ্দিতে বেশিক্ষণ থাকিলেও সে হাঁফাইয়া ওঠে। বাহিরে যাইবার জন্য মরিয়া হইয়া যায়। এই দোটানা লইয়াই মানুষ ইতস্তত হইয়া বিক্ষিপ্ত জীবন যাপন করে; বাকি সকল প্রাণীরাই বা ইহ নিয়ম বহির্ভূত হইবে কী করিয়া? তাহাদেরও প্রাণ রহিয়াছে, নিতান্ত ক্ষুদ্র হইলেও মন রহিয়াছে, মর্জিমাফিক চলিবার ইচ্ছা রহিয়াছে, সর্বোপরি ইহারা স্বাধীন, মনুষ্য রচিত কোনোবিধ নিয়মের অনুসারী নহে। উহাদের আটকাইবে কে? মানদা আজ স্থির করিল, কুট্টুসের পিছন পিছন দৌড়ানো সে বন্ধ করিয়া দিবে। সে তাহার মর্জি মাফিক থাকুক। নিতান্ত বিপদে না পড়িলে সর্বক্ষণ সে কুট্টুসের খেয়াল রাখিবে না।
বৈকাল হইতে না হইতে একখানি খাতা আর পেন্সিল লইয়া বেবো উপস্থিত। তাহার সাধের কিট্টিকে লেখাপড়া না শিখাইলেই নয়। মূর্খ হইয়া থাকিবে নাকি কিট্টি? সে বাঁচিয়া থাকিতে এই কাণ্ড ঘটিতে পারে না! অতএব এক ক্ষুদ্র মার্জার শাবকের হস্তে, মতান্তরে পদে, পেন্সিল গুঁজিয়া খাতায় আঁক কাটা শুরু হইল। এ এমনই এক দৃশ্য, একাধারে হাস্যের উদয় ঘটায়, অন্যদিকে আবার মায়ায় আচ্ছন্ন হইয়া যায় মন। মানদার মনে হইল, এই দৃশ্য যে না দেখিল, তাহার জীবন বৃথা। সে লোক ডাকিয়া দেখাইল কয়েকজনকে, মুখে আঁচল চাপা দিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার দম ফুরাইয়া আসিল বুঝি! শেষমেশ দেখা যাইল, কুট্টুস পেন্সিল লইয়া খেলিতে ব্যস্ত। বেবো বোধকরি পরিশ্রান্ত হইয়া চম্পট দিয়াছে। খোলা খাতার পাতাগুলি হাওয়ায় ফরফর করিয়া উড়িতেছে। খানিক বাদে বেবো আসিয়া বকাবকি শুরু করিল, ‘তোর লজ্জা নেই কিট্টি? পেন্সিলে পা দিয়েছিস! তোর বিদ্যা হবে না কচু হবে!’ এই বলিয়া গজগজ করিতে করিতে সে পেন্সিল লইয়া চলিয়া যাইল। অগত্যা কিট্টির পাঠ ও অধ্যয়নে এইখানেই ইতি পড়িল।
রাগে মানদারও ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলিতেছিল। হতচ্ছাড়া পাজী হাম্পটি পুনরায় প্রেম পিরিতির জালে পড়িয়াছে। এইবার এক সাহেব হুলো আসিয়া তাহাকে দিবারাত্র ডাকিতেছে। সেও আত্মহারা হইয়া তাহার সহিত কুকীর্তি করিয়া ফেলিয়াছে। উহাদের লাজ শরমের বালাই নাই? এই যে একখানি কচি সন্তান রহিয়াছে, উহার দেখভালের চিন্তা নাই? দায়িত্ব বলিতে কিছুই কি নাই উহাদের? এই কয়েক মাস হাম্পটি তাহার সন্তানের দেখভাল করিয়াছে মন দিয়া। হাম্পটির দায়িত্ব, কর্তব্য জ্ঞান দেখিয়া মানদা প্রীত হইয়া উঠিয়াছিল । সেই দায়িত্ব, কর্ত্তব্য একখানি সাহেব হুলোর ডাক শুনিয়াই ভাসিয়া যাইবে তাহা মানদার কল্পনায় ছিল না। দুই চারিদিনের স্ফূর্তি মিটিলেই সেই সাদা সাহেব ধাঁ হইয়াছেন। পোড়ারমুখী হাম্পটি পুনরায় পেট বাঁধাইয়া বসিয়া আছেন। হাম্পটির স্ফীত পেট দেখিয়া কপাল চাপড়াইতে ইচ্ছা হইতেছে মানদার। জাত-কূল-মান নাহয় নাইই থাকিল তোদের, নিজের শরীরের প্রতিও তো একটু নজর রাখিতে হয়! আর এই কুট্টু বাবুর দেখভালের কী হইবে? মা মা করিয়া সে আজিকেও হাম্পটিকে চক্ষে হারায়। আহারে! কুট্টুর প্রতি দুর্বলতা বাড়িয়া যাইল মানদার। মায়ায় ভরিয়া উঠিল মন। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করিল, আজীবন উহার দেখভাল সেইই করিবে যদ্দিন না বড় হইয়া সে আপন মর্ম বুঝিবে।
রাগে ঝনঝন করিতে করিতে কার্যে মনোনিবেশ করিল সে। বাসন নাড়ার শব্দ অধিক হইতেছে দেখিয়া মৈথিলী বামুন কহিল, ‘আজ মায়ের মন সুবিধের নেই মনে লয়’। না শুনিবার ভান করিয়া মানদা কোনো উত্তর করিল না। কোথাও কোনো গোপন রন্ধ্র হইতে এক উদাসী বাতাস বহিতে থাকিল রসুই ঘর জুড়িয়া। অনর্থক থমথমে হইয়া উঠিল চারিপার্শ্ব। আর তক্ষণই সেই অবরুদ্ধ বাতাসে তীব্র ঝঙ্কার তুলিয়া কোলাহল ভাসিয়া আসিল সুবিমল বাবুর ঘরের দিক হইতে। মানদা এবং আরও সকলে বুঝিল, আজ আর রক্ষা নাই। হঠাতই বড়মার কথা মনে আসিল মানদার। আজ বড়মা থাকিলে সুবিমলবাবুর এই অবস্থা হইত না। এই পরিবার ঋণের দায়ে জর্জরিত হইতেছে—ইহা আর দেখিয়া যাইতে হয় নাই বড়মাকে। বিষয় রক্ষা করিবার জন্য যে স্থির, প্রচণ্ড আর নিপুণ মানসিকতা লাগে, তাহার কোনোটাই সুবিমলবাবুদের নাই আর। ফোঁস করিয়া এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল মানদা। বড়মার মুখেই সে এই পরিবারের রাজকীয় কাহিনী শুনিয়াছে। ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি না থাকিলেও একখানি টাট্টু আছিল বড়মার শ্বশুর সূর্যকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের। যুবা বয়সে সেই টাট্টুর পিঠে চাপিয়া ছুটিতে যাইতেন তিনি। ইহা ছিল তাঁহার প্রাতঃকালীন ব্যায়াম। ঝড়ের বেগে যাইতেন আর শ্লথ গতিতে ফিরিতেন। টাট্টুকে দলাই মালাই করিয়া ছোলা খাইতে দিত মহারাজ। এই মহারাজ হইল এক ইয়া ষণ্ডামুশকো পালোয়ান। নেঙটি পরিয়া বাবুমশাইকে তৈল মর্দন করিত সে। ঘোড়ার দেখভালের দায়িত্বও তাহার উপর ন্যস্ত ছিল। তাহার সমান উচ্চতার এক বল্লম লইয়া সে সদর দরোজার সম্মুখে বসিয়া খৈনী ডলিত অবসরে। বিহারের মুঙ্গের জেলা হইতে সে বাল্যকালে এই গৃহে আসিয়াছিল। তথাপি ছাতু আর লৌটা সে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। কাঁসার চকচকে লৌটা ভরিয়া সে ঢকঢক করিয়া জল পান করিত। আর তাহার পূর্বে উবু হইয়া বসিয়া বগি থালায় পিঁয়াজ, মরিচ সহ এক থালা ছাতু মাখিয়া খাইত। তাহার এই খাদ্য, পানীয় গ্রহণের দৃশ্যটি ছিল তাহারই মতো বিরাট মাপের। শ্বশুরের ছেলে অর্থাৎ কিনা বড়মার সোয়ামি, বড়বাবু তক্ষণ ছিল এক বালক। তাহাকে স্কন্ধে লইয়া মহারাজ পাঠশালায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসিত। এমনকি মাহেশের রথ দেখিতেও সেই মহারাজের স্কন্ধই ছিল ভরোসা। একখানি ফিয়েট গাড়ি ছিল তাহাদের। সেই গাড়িতে চড়িয়া বড়বাবু যৌবনকালে বড়মাকে লইয়া কলিকাতায় থিয়েটার দেখাইতে লইয়া যাইতেন। গঙ্গাবক্ষে পানসি ভাড়া করিয়া পিকনিকেও যাইতেন কখনও বা। বড়বাবুর এই বিলাসবহুল জীবনের আয়োজন করিয়া রাখিয়াছিলেন তাঁহার পিতা সূর্যকান্ত বাবু।
সূর্যকান্ত বাবু বড় পুরোহিত ছিলেন। বড় অর্থাৎ পাণ্ডিত্যে, মানে এবং যশে। তাঁহার লিখিত পুঁথি হইতে পাঠ শিখিতে আসিত তাবৎ ব্রাহ্মণেরা। কোনো এক সময়ে এই গৃহেই তাঁহার এক টোল ছিল। পরে অবশ্য সেই টোল বন্ধ হইয়া যায় তাঁহার ব্যস্ততার কারণে। তিনি সংস্কৃত কালেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার লিখিত পুস্তক হইতে পঠন পাঠন হইত কালেজে। এইরূপ মানী সূর্যকান্ত বাবু রাজা প্যারীমোহনের গৃহে পৌরহিত্য করিতেন। রাজা স্বয়ং টাট্টু প্রদান করিয়াছিলেন তাঁহাকে। শুধু টাট্টুই নহে, পর্যাপ্ত অর্থ, জমি, সোনাদানা দান করিতেন রাজা তাঁহাকে। এমনকি এই গৃহে তাঁহার ব্যবহারের জন্য শ্বেত পাথরের টেবিল, ঝাড়লণ্ঠন, মেহগিনি কাঠের আলমারি, পালঙ্ক, বিশালাকায় গ্র্যান্ডফাদার ক্লক—কিছুরই অভাব রাখেন নাই রাজা। সেই ঘড়ি আজিও নিখুঁত সময় প্রদর্শন করে। প্রতি আধাঘন্টা অন্তর সেই ঘড়ি ঢং ঢং করিয়া সময় জানান দেয়। আর রহিয়াছে এক সাহেব-মেমের মূর্তিওয়ালা টেবিল ঘড়ি। দুই দিকে মাথা ঝাঁকাইয়া সেই ঘড়ি চলিতে থাকে সারাক্ষণ। শুধু প্রতি ঘণ্টায় সেই সাহেব-মেমের মূর্তি যুগল ঘুরিয়া ঘুরিয়া বল্ নাচ করে। তাহাদের নৃত্যের সহিত মনোহর বাজনাও বাজিতে থাকে। মানদা প্রথম যেদিন এই ঘড়ি হইতে নির্গত সাহেবমেমের নৃত্য দেখিয়াছিল, তাহার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। এমনও কাণ্ড ঘটে পৃথিবীতে!
বড়মার মুখেই শুনিয়াছে একখানি বালতি করিয়া সোনারূপার গহনা ভেট লইয়া আসিতেন তাঁহার শ্বশুর মহাশয়। শাশুড়িমাতাকে বড়মা দেখেন নাই। তিনি তাঁহার যৌবনকালেই পরলোক গমন করিয়াছিলেন। তথাপি সূর্যকান্ত বাবু পুনরায় দার পরিগ্রহণ করেন নাই। তিনি পুস্তক এবং পুঁথি লইয়াই বাকি জীবন কাটাইয়া দিয়াছেন। বিলাসিতায় তাঁহার মন ছিল না। অর্থ, সম্পদ যেমন প্রাপ্তি হইয়াছে, তেমনই দুই হস্তে বিলাইয়াও দিয়াছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদিগকে। এমনকি অচেনা, অজানা কেহ আসিয়া নাকি-কান্না কাঁদিলেও তাহাদের শূন্য হস্তে ফিরাইয়া দেন নাই। ফলে সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নাই। বরং তাঁহার সন্তানসন্ততি ও নিকট আত্মীয়দিগের বিলাসিতায় সেই অর্জিত সম্পদ ক্রমহ্রাসমান হইয়া এক সময়ে বিলীন হইয়া গিয়াছে। সঞ্চয়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা অথবা লগ্নী করিবার মানসিকতা এই বংশের কাহারও ছিল না। পরিশ্রম করিয়া অর্থ উপার্জন করিতে হয়, সেই জ্ঞানই বোধকরি ছিল না তাহাদের। না শিক্ষায়, না সম্পদে, সূর্যকান্ত বাবুর উচ্চতার কেহই নাগাল পান নাই। আজ তাই সুবিমলবাবুর এই দুর্দশা। অবশ্য তিনি নারীঘটিত কেলেঙ্কারি করিয়াছেন বিস্তর আর সেই হেতু প্রভূত পরিমাণ অর্থ দণ্ড দিতে হইয়াছে তাঁহাকে। ব্যবসায় মতি ছিল তাঁহার, উপার্জনও যে করেন নাই, তাহা নহে, কিন্তু মদ্য, মাংস ও নারী—এই ত্র্যহস্পর্শে তাঁহার সব্বোনাশ হইয়াছে। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী