আমরা প্রতিদিন মেয়েটিকে দেখার জন্য জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের মেস বাসাটার ঠিক উল্টোদিকে কতগুলো উঁচু দালানের সারি। সেসব দালানে বসবাস শহরের উঁচুস্তরের পেশাদার মানুষদের। আমরা একমনে দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, সেখানকার মানুষের উন্নত জীবনযাপনের কথা। আমাদের মনে হত, ওরা এই পৃথিবীর ঈশ্বর আর ঈশ্বরদের উঁচুতলায় থাকাটাই বেশ মানায়। আর আমরা এক-দেড়শ গজ দূরে দাঁড়িয়ে উঁচু দালানের মানুষগুলোর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
এটা আমার কাছে ঠিক পরিস্কার নয়, বাড়িটা সপ্তম ছিল না-কি অষ্টম। তবে আমি মনে করতে পারি সেটা কোনোভাবেই দশ নাম্বার দালান অতিক্রম করবে না। এরকম একটি দালানের তৃতীয় তলার জানালার দিকে আমরা সবসময় একটা কৌতূহল নিয়ে তাকাতাম। বলা যেতে পারে এটা ছিল আমাদের রুটিনমাফিক কাজ। প্রতিদিন ভাতঘুমের পর আমাদের সিনিয়র বোর্ডারগণ অফিসে ছুটে যেত, কিছু স্কুল মাস্টার ছিলেন তারা আলস্যে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়তেন আর আমরা গুটিকতক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক তাকিয়ে থাকতাম সেই জানালার দিকে। যতক্ষণ না মেয়েটি জানালার হাট খুলে কিনারায় এসে দাঁড়াত, আমরা মেয়েটিকে নিয়ে বিভিন্ন গল্পে মেতে থাকতাম। মাঝেমধ্যে মেয়েটির সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের ভেতর তর্ক লেগে যেত। অথচ আমরা ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতামনা।
আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পরিচিত সুন্দরী বান্ধবী ছিল, যে কোনো আলাপের সূত্র ধরে পরিচিত মেয়ের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। তবে আমরা ঠিক জানিনা, এত মেয়েদের ভীড়ে জানালার সেই মেয়েটি একসাথে কেন এতগুলো ছেলের হৃদয় দখল করেছিল। বিকেলের শেষ আলোর সময় পশ্চিমে মুখ তুলে যখন মেয়েটি তাকাত তখন ওর মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ত পবিত্র আলো। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুধু ওর দিকে তাকিয়েই থাকতাম। আমরা দিকশূন্য হতাম, স্বাভাবিক বোধশক্তি হারিয়ে অন্যরকম চিন্তায় ডুবে যেতাম, সেই ফাঁকে মেয়েটি সেখান থেকে দ্রুত চলে যেত আর রেখে যেত অদ্ভুত এক মায়া, একবুক হাহাকার আর দারুণ বিস্ময়। আমরা সারা সন্ধ্যা মেয়েটিকে নিয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিতাম। আমাদের কেন যেন মনে হত, মেয়েটি নিঃসঙ্গ এক মানুষ, ওর বিষণ্নতায় ভরা মুখখানি বিকেলের আলোর দিকে তাকিয়ে কিছুটা উজ্জ্বল করে নেয়।
তিন বছর আগে আমি যখন এই মেসবাসায় আসি, তখনও জানালাটা মাঝেমধ্যে খোলা দেখতাম। আর সেই জানালায় আমাদের চোখে পড়ত মোটা আর মধ্যবয়সী স্থূল দেহের এক নারীকে, যে শরীরের ভারে জানালার কাঠের ওপর ভর দিয়ে পশ্চিমের দিকে তাকাত। তার চেহারায় ছিল পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সুস্বাদু খাবারের উজ্জ্বল রোশনাই। আমরা তার আঁটসাঁটবাঁধা চওড়া গলার কামিজের বুকের কাছে স্থূল মাংস দেখে হেসে গড়াগড়ি খেতাম। কিন্তু কে জানত, কদিনের মধ্যেই জানালাটা আলোয় ঝলমল করে উঠবে, মধুর মত মিষ্টি হয়ে উঠবে মেসবাসার ছেলেগুলোর প্রতিটি বিকেল।
কদিন বাদেই জানতে পারলাম, নির্জন ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দী থাকার চেয়ে মেয়েটার জীবন কম কিছু নয়। সারাদিন গৃহপরিচারিকার কাজ শেষে বিকেলে ঘণ্টাখানেকের জন্য ও জানালার কাছে আসে। একটা নীল ওড়নায় ঢাকা থাকে ওর মুখ। আমরা দূর থেকে ওকে ইশারা করে শিস বাজাতাম আর অপেক্ষা করতাম ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখার জন্য। এভাবেই প্রতিদিন মেসবাসার উঠানে আমাদের মেয়েটিকে দেখার আসর জমে উঠত। মনে হত, দূর থেকে আমরা মেয়েটির সঙ্গে নির্বাক গল্প করে সময় কাটাচ্ছি। তবে প্রতিদিন আমি মেয়েটির গৃহপরিচারিকার দুঃসহ জীবন আর বেদনাময় অভিজ্ঞতার কথা মনে করে ব্যথিত হতাম। নিঃশব্দ কান্না আমার বুকের ভেতর শ্বাসরোধ করে দিত আর কি যেন এক অলৌকিক ভাবনা মাথায় এসে ভর করত- যদি আমি জ্বীনের বাদশা হতাম, তাহলে মেয়েটিকে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে বের করে নিয়ে আসতাম।
একদিন সেই জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বিকেল হলেই অপেক্ষা করতাম – কখন সেই জানালাটা খুলে মেয়েটি আলোর দিকে মুখ তুলে তাকাবে! আমাদের অপেক্ষা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসত অথচ জানালা খোলাই হতনা। তবু আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওকে কল্পনা করে কাটাতাম- সেই নীল ওড়নায় ঢাকা মুখ। মেয়েটিকে নিয়ে আমার কল্পনা অদ্ভুত রূপ নিতে থাকল আর আমি ওকে ভেবে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। প্রত্যেকবারের উত্তেজনার সময় সুযোগ পেলে মাস্টারবেট করার জন্য মেসঘরের পেছনে যেতাম। আমি ঠিক জানিনা, আমার মত এভাবেই অন্য কেউ মেয়েটিকে কল্পনা করত কিনা! মেসবাসার পেছনদিকটা ছিল পরিত্যক্ত। গাছের শেকড়গুলো পেটমোটা অজগরের মত পড়ে থাকত আর লতাগুল্মের ভেতর থেকে আসত পোকামাকড়ের গুঞ্জন। আমি সেখানে দাঁড়িয়েই মাস্টারবেট করে মেয়েটির প্রতি সাময়িক অনুভূতি ভুলে আসতাম।
আমরা জানালাটা খোলা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে থাকলাম কিন্তু যত দিন গড়িয়ে যায় আমাদের মনে হতে থাকে, যেন চিরদিনের জন্য জানালাটায় বন্ধ হওয়ার সিলমোহর পড়েছে। আর ঠিক সেসময় মিডিয়া প্রচার করল, পুব দেশের উহান রাজ্য থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরণের অদৃশ্য ভাইরাস। আর সেই খবরে দু’একদিনের ব্যবধানে চোখের সামনে চেনা পরিবেশটা কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি অফিস, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার বন্ধ হল, এমনকি পাড়ার দোকানগুলোর ঝাঁপ পড়ে গেল আর মানুষগুলো দূর-দূরান্তের জেলা শহরে পায়ে হেঁটে রওনা হল। কেননা, সরকার ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে জল আর সড়কপথের সমস্ত যান চলাচল । রাস্তা-ঘাটে পুলিশের কড়া পাহারা। শুরু হয়েছে অ-ঘোষিত লকডাউন।
মেসবাসার সবাই যে যার বাড়ি চলে গেল, অথচ আমি ঠিক জানিনা, কোন অদৃশ্য টানে আমি একা আটকা পড়ে গেলাম ! প্রথমদিন কোনো একভাবে কেটে গেল, দ্বিতীয় দিন সারাক্ষণ সেই বন্ধ জানালার দিকে চেয়ে রইলাম। আমার হাতে কোনো কাজ ছিলনা, বিকেল থেকে রাত অবধি বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিলাম। রাতে বাইরের পৃথিবীটা নিঃসাড়, অন্ধকার। সেটা আমার কল্পনা না-কি সত্যি জানিনা তবে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেই যেন মেয়েটির ছায়া দেখতে পেতাম। মধ্যরাতে সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে মেসবাসার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলাম। আর সারারাত কল্পনা করলাম মেয়েটিকে।
তৃতীয় রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে হঠাৎ দুঃস্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি তাকিয়ে দেখলাম, পুরো মেসবাসাটা চারিদিকে ঘুরছে। নিজেকে সামলে কোনোভাবে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি, সেই সুরম্য দালানের সারি ঘুরতে ঘুরতে আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, বুড়ো নারকেল গাছ আর মেসবাসার পাঁচিল শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, গলাকাটা কোনো মানুষের আর্তনাদ মেসবাসার অভেদ্য নীরবতা ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। হয়তো আমার রুম থেকেই ওই আর্তনাদটা জেগে উঠছে অথচ আমি শত চেষ্টা করেও শুনতে পারছি না। মনে হল, আমি আর জীবিত নেই। আমি কাঁপতে কাঁপতে পানি খেলাম। আমার মনে হল, একা থাকার কারণে হয়তো এটা আমার কল্পনার কারসাজি। মস্তিষ্ক আমাকে অন্যপথে পরিচালিত করছে আর আমি বিভ্রান্তের মত দুঃস্বপ্নের ঘোরে আটকে গেছি। আমি চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। বিদ্যুত চলে যাওয়ার পর পুরো পৃথিবীটা যেন ঢাকা পড়ল মৃত্যু জগতের অন্ধকারে। তখন অতি মৃদু গলায় একটা ডাক শুনতে পেলাম। সেই সুরম্য দালানগুলোর সারি থেকে ভেসে আসছে চিকন এক নারী কণ্ঠ। মনে হল, সেই কণ্ঠটা আমার বহুদিনের চেনা। যখন আমি জানালায় দেখা মেয়েটিকে কল্পনা করতাম তখন অলক্ষ্যে ওরকমই কণ্ঠ শুনতে পেতাম। যেন সমুদ্রে ভেসে যাওয়া অসহায় মানুষের মত মেয়েটি কাউকে ডাকছে। বাইরে শিরশির করে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে আর আমি ভয়ে যতটা সম্ভব জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় ভাঁজ হয়ে শুয়ে রইলাম। তখন রাস্তায় বাঁশিতে ফুঁ দিল পাহারাদার।
কেমন এক নেশার টানে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, রাতটা কিভাবে কেটে গেল জানিনা। সকালে উঠে দেখি চারপাশের সবকিছু ঠিকঠাক কোথাও এতটুকু পার্থক্য নেই। উঠানে নেমে সেই জানালার দিকে তাকালাম আর আমি বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতে পারছিলাম না। জানালার পাল্লাদুটো খোলা, হঠাৎ জানালা থেকে পর্দাটা যাদুর মঞ্চের মত নিঃশব্দে সরে গেল। ভেতর থেকে যেন বের হচ্ছে ঈশ্বরের প্রেরিত আলো। আমি চোখের সামনে দেখছি, মেয়েটি দু’হাত নেড়ে আমার দিকেই ইশারা করছে। দূর থেকে মনে হল ওর পরিপাটি করে ঘোমটার মত প্যাঁচানো ওড়নাটা ঠিকঠাক নেই যেমন ওকে আগে দেখতাম।
আমি ওকে ইশারা করলাম, আর বোঝাতে চাইলাম- তোমার যদি ফোন নাম্বার থাকে তাহলে সেটা কাগজে লিখে ছুঁড়ে দাও। কিন্তু দূর থেকে ও কতটা বুঝল জানিনা। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, মেয়েটি ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার কথা ইচ্ছার মত একটা কাগজের টুকরা অনেকগুলো ভাঁজ করে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল । আমি ওর ফোন নাম্বারটা পেয়েই দ্রুত কল করলাম।
আমি ওকে উদ্ধার করতে উঁচু দালানের তৃতীয় তলায় গেলাম। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজায় বড় বড় তালা ঝুলছে। কোনোটার সামনেই কমদামী স্পঞ্জ কিংবা বার্মিজ জুতো নেই। বাড়িটা পরিত্যক্ত শ্মশানের মত ফাঁকা আর ভুতুড়ে। ওর কথা অনুযায়ী ফ্ল্যাটের তালাটা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙলাম। যখন ও দরজা খুলে বেরিয়েএল আমি দেখলাম- ওর বাম গালের নিচে লম্বালম্বি একটা কাটা দাগ। দাগটা দেখে যে কারো মনে হতে পারে ওটা সুন্দরের মাঝে বসানো নিখুঁত অলংকার। সবকিছু জেনে খুব আহত হলাম। আমার ভাবতেও কষ্ট লাগল যে, ভাইরাসের অতিমারী থেকে বাঁচার জন্য ওর মালিক মেয়েটিকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রেখে পরিবার নিয়ে গ্রামে পালিয়েছে। আর মেয়েটিকে ফেলে গেছে তাদের দামী দামী জিনিসপত্তর পাহারা দিতে।
মেয়েটিকে নির্বিঘ্নে আমার মেসবাসায় নিয়ে এলাম। ও গোসল করল, চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে শুকানোর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। আমি তখন নির্বাক তাকিয়েই রইলাম ওর দিকে। মেয়েটির মেদহীন সুন্দর একটা শরীর, চোখের ভেতরের সাদা অংশের চিকন শিরাগুলো লাল হয়ে আছে। কেমন একটা কান্না কান্না ভাব আর ওর গালদুটো ফোলা ফোলা। পুরো বিকেল ও আমার বিছানায় উপুড় হয়ে নেশাতুরের মত ঘুমিয়ে রইল। ওর ঘুমিয়ে থাকা সময়টুকুতে মনে মনে ওকে নিয়ে কতকিছু কল্পনা করলাম। একসময় ও ঘুম থেকে জেগে উঠল আর চোখ ডলতে ডলতে বলল, ওর নাম শিরিন। ওর চোখের পাতায় রাজ্যের ক্লান্তি আর শরীরটা ভীষণ দুর্বল।
আমি পাশে বসে ধীরে ধীরে ওর জীবনের গল্পের খণ্ডাংশ শুনলাম। আমার মনে হতে লাগল, এমন নির্বিঘ্ন পরিবেশে মেয়েটিকে পাওয়ার জন্যই হয়তো আমি মেসবাসায় থেকে গেছি। কিন্তু মহামারীর এই সময়ে একটি যুবতী মেয়ে নিয়ে এখানে থাকাটা মোটেও নিরাপদ নয়। এখন ও কোথায় যেতে চায় আমি শিরিনের কাছে জানতে চাইলাম।
শিরিন বলল, আপনার যেখানে ইচ্ছা, যতদূর সম্ভব আমাকে নিয়ে চলে যান, এই বীভৎস জীবন একদম মূল্যহীন। আমি আপনার জীবনটা সুন্দর করে দেবো।
মনে হল, মেয়েটা সংসারী হতে চায়। বাঁধনে বেঁধে ফেলতে চায় আমার দুরন্ত যৌবন। শিরিনের সৌন্দর্য আমাকে এতটাই মুগ্ধ করল তাতে এ মুহূর্তে আমি ওর যে কোনো প্রস্তাব মেনে নিতে পারি। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এতদিন যে ছিল আমার কল্পনা, চোখের সামনে সে এখন বাস্তব। জীবনে এর চেয়ে বড় আশ্চর্যের আর কি হতে পারে!
আমি মনে মনে ওকে কামনা করতাম, হয়তো ভালোও বাসতাম। তবে আমি ঠিক জানিনা, সেটা ভালোবাসা ছিল না-কি অন্যকিছু। সন্ধ্যায় যখন ওকে জানালার কিনারায় দেখতাম, তখন আমি উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতাম। আমার যৌনানুভূতি জেগে উঠত। আর আমি চুপ করে অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
রাতের দমকা হাওয়া শুকনো পাতাগুলোকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল, রাত গভীর হতে না হতেই আকাশ থেকে নামতে শুরু করল জলের ধারা, ঠিক যেন বর্ষাকালের বৃষ্টি। কোনো বাতাস নেই, আকাশে কড়কড় শব্দ নেই শুধু ঝুমঝুম করে অঝোর ধারায় জল ঝরছে। আমি শুনতে পেলাম, বৃষ্টি আর বাতাস মিলে জানালার বাইরে খুব করুণ গলায় কাঁদছে। আমি শিরিনের হাত ধরলাম। হাতটা খুব ঠাণ্ডা আর মসৃণ। মনে হল, বাইরের ওই ঝুমঝুম বৃষ্টির মত আমার বুকের ভেতর বড় বড় জলের ফোঁটা পড়ছে। আর একপুকুর জল নড়াচড়া করছে বুকের ভেতর। আমাদের অপেক্ষার সময়টা বিরক্তির ছিলনা। কারণ আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে নিঃশব্দে কথা বলে যাচ্ছি। আমাদের চোখের ভাষা ছিল অভিন্ন আর মনে হচ্ছিল আমরা একজন আরেকজনের কথাগুলো সহজেই বুঝে ফেলতে পারি। রাত আরেকটু গভীর হতেই বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল, মেঘগুলো দু’দিকে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ল কলঙ্কিত চাঁদ। আমরা প্রায় মানবশূন্য শহর ছেড়ে সুদূর দক্ষিণে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।
মেসবাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমে আকাশের দিকে তাকালাম, তারপর ধর্মরাজিক হাইস্কুলের সামনের রাস্তা পেরিয়ে ডানের পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। নিশি রাতে প্রতিদিনের চেনা পথটা কেমন যেন অচেনা লাগল আমার কাছে। জাঁকজমকহীন রাস্তাটা ঘুমন্ত শিশুর মত বিশ্রাম নিচ্ছে, রাস্তার দু’পাশের বন্ধ স্টলগুলো যেন পম্পেই শহরের দোকানপাট। অথচ দিনের আলোতে এখানে মানুষের গায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে যায় মানুষ। সড়কের উল্টোদিকে দু’টো ক্ষুধার্ত কুকুর দুর্গন্ধে ভরা ডাস্টবিনের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। দূরে, অন্ধকার শূন্যতায় কিসের যেন ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। বিপরীত দিকের তেরছা গলি থেকে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সড়কের ওপর টর্চের আলো ফেলল এক পাহারাদার। সে আমাদের একঝলক দেখে নিল তারপর কী মনে করে টলতে টলতে চলে গেল সামনের দিকে। আমরা কমলাপুর রেলস্টেশন পার হয়ে প্রথমবার পুলিশের জেরার মুখে পড়লাম।
আমি ঠিক জানিনা, পুলিশ কীরকমভাবে মানুষকে জেরা করে। আর আমার এ বিষয়ে কোনো পূর্বাভিজ্ঞতাও নেই। আমার চোখ-মুখ দিয়ে অস্থির আগুন বেরোচ্ছে। মনে হল, এ মুহূর্তে আমি একজন শক্তিহীন জড় পদার্থ মাত্র। আমাদের প্রয়োজন এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে যে কোনো উপায়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। শিরিন আমার সঙ্গে থাকার কারণেই হয়তো অস্থির সময়টুকুতে দম নিয়ে দাঁড়াতে পারছি আর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছি। দুইতারাবিশিষ্ট অফিসার লোকটি আমাদের সামনে এসে জিগ্যেস করল, কী পরিচয়?
ভয়ঙ্কর এক আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করছে আর ভেতর থেকে কমে আসছে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা। আমার গলার স্বর ক্রমশ নিচু হয়ে এল,একটা খুসখুসে বিরক্তিকর কাশি গলার ভেতর নড়াচড়া করতে লাগল। আমি কাশিটাকে চেপে রাখার প্রাণপনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। মনে হল, যে কোনো মুহূর্তে খপ করে আমার হাত চেপে ধরবে অফিসার। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকজন লোকের সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ করে অফিসার আমাদের বাম হাতের ইশারায় চলে যেতে বলল। আর আমার মনে পড়ল গ্রামদেশি এক আত্মীয়ের তরমুজের জাহাজের কথা। সমুদ্রতীরবর্তী দক্ষিণের জেলা থেকে ব্যাপারীরা ঢাকায় তরমুজ নিয়ে এসেছে। ওরা ফতুল্লার পাইকেরী বাজারে তরমুজ বিক্রি করে খালি জাহাজ নিয়ে গন্তব্যে ফিরে যাবে। আমরা সেই তরমুজের জাহাজে চড়ে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী আমাদের গ্রামে যাওয়ার চিন্তা করলাম।
সামনের পয়েন্টে আবারও পুলিশের জটলা দেখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। শিরিন আমার জামাটা খামচে ধরে পেছনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল গলার ভেতরে শক্ত একটা দলা আমার কণ্ঠ রোধ করে দিচ্ছে। একটা হিমেল চোরাস্রোত বয়ে গেল শরীরের ওপর দিয়ে। আমরা একটা উঁচু দালানের পেছনে পরিত্যক্ত জায়গা খুঁজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর সেখানে তিন চারজন মেয়েমানুষ ধান্দা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে বাসি সুঘ্রাণ, পরনে টাইট ফিটিং জামা আর স্তনগুলো ঝুলে আছে পেটের ওপর। লক ডাউনের পর ওদের মধ্যে অনেকেই হয়তো গ্রামে ফিরে গেছে, যাদের যাওয়ার মত জায়গা নেই ওরা ফুটপাথে সবজির দোকান দিয়ে বসেছে। এসবের কিছুই যাদের জোটেনি, ওরা গলাগলি করে বিভিন্ন দালান আর পার্কের পেছনের আড়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে গেছে খদ্দেরের আশায়। আর যেহেতু এসব করার ওদের লাইসেন্স নেই, হঠাৎ পুলিশ এলে অল্পকিছু মালকড়ি খাওয়াতে হয়। আর পুলিশ ওদের না দেখার ভান করে চলে যায়। তবে লক ডাউনের কারণে পঙ্গপালের মতো যৌনপিপাসুরা এখন আর পরিত্যক্ত জায়গাটিতে আসেনা। ওদের কোমর আর শরীরের ব্যথাটা ক্রমশ নিভে যেতে থাকে আর ওরা যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি সতেজ। আমার পকেট হাতিয়ে ওরা খুচরো টাকাগুলো ছিনতাই করল, শিরিনের সামনেই আমার হাত ধরে টানাটানি করল। তারপর রুচিহীন ভাষায় কিছুক্ষণ গালাগাল দিয়ে ক্ষান্ত হল। কম বয়সী আর পাতলা কিসিমের মেয়েটি ওর বুকের কাছে আমাকে টেনে নিয়ে বল- “কিছু করতি চাইলে কইরে নে মগা, আমরা বিনি কামে পয়সা নিই না।“
আমি বলার মত কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।
তখন উত্তেজিত কণ্ঠে আরেকটি মেয়ে বলল- “হালা নয়নশুর আইছে কোত্থিকা!”
আমি সামনের ফাঁকা পথের দিকে তাকিয়ে মেয়েগুলোর উদ্দেশে বললাম- “পুলিশ!”
আর তখনই হিজড়ার মত মরদা মেয়েটি আমার পিঠে চাপড় মারতে মারতে বলল-“খেত্তর!”
আমরা মেয়েগুলোর কবল থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে বামের পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। দেখলাম, দূরে একটা ইলেক্ট্রিক খাম্বায় হলুদ বাতির নিচে পোকামাকড়গুলো আত্মাহুতি দেওয়ার প্রস্তুতির নিচ্ছে। ফাঁকা সড়কের ওপর বসে আছে পিছমোড়ে বাঁধা তিনজন যুবক। কয়েকজন পুলিশ ওদের পাছায় বাটাম দিচ্ছে আর চুরিচামারির ফিরিস্তি জানতে চাইছে। লকডাউনে যেসব পরিবার গ্রামে চলে গেছে তাদের কোন কোন ফ্ল্যাট সাফাই করেছে ওরা। ওদের চিৎকার দেখে যে কেউ বলবে ওরা অপেশাদার। হঠাৎ ওদের ভেতর থেকে একজন শরীর ঝাঁকিয়ে হাঁচি দিয়ে উঠল। তখনই ধুপধাপ বুটের আওয়াজ তুলে দৌড়াতে লাগল পুলিশগুলো। আমরা সুযোগ বুঝে দ্রুত সটকে পড়লাম সেখান থেকে।
মূল সড়ক থেকে বের হয়ে আমরা আবাসিক এলাকার ঘিঞ্জি পথ ধরে আগাচ্ছি। সুযোগসন্ধানী নিশাচর মানুষগুলো হয়ত ঘাপটি মেরে ওত পেতে আছে কোথাও। পথিকের আশায় অপেক্ষা করা ছিনতাইকারীর দল কোথায় লুকিয়েছে কে জানে! আর আমরা ঠিক জানিনা, দোলাই পাড়ের মোড়টা কোন পথে গেলে সামনে পড়বে। আমরা সুবেদার ঘাট হোটেল আল রাজ্জাকের অপরপ্রান্তে একটা পুরোনো দালানের আড়ালে দাঁড়ালাম। শিরিন জানাল ওর ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, আর এক্ষুণি ওর প্রস্রাব করা প্রয়োজন। আমি একটা গ্যাস রাইজারের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শিরিনকে সুযোগ দিলাম আড়ালে ছোট্ট কাজটা সেরে আসার জন্য। কাছেই চল্টাওঠা একটা ওয়ালের সাথে লাগানো ছিল জলের ট্যাপ। শিরিন জল খেয়ে আর মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওর মাথার উসকোখুসকো চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে কপালে পড়ছে , ভেজা মুখে খেলা করছে ইলেক্ট্রিক লাইটের ক্ষয়ে যাওয়া আলো। শিরিন যে কোনো সাধারণ মেয়েদের তুলনায় লম্বা আর পাতলা দেহ ওর। বুকটা অ-গঠিত না-কি সত্যিই ছোট বোঝা যায় না। আমি ক্রমশ ওর শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম আর মুহূর্তেই উত্তেজিত হতে থাকলাম। কিছুটা অসহিষ্ণুভাবে ওর শরীরটা স্পর্শ করলাম। তাতে ওর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না; ও মৃত মানুষের মত নিশ্চল।
“খুব অন্যায্য কিছু করে ফেললাম বোধ হয় তোমার সাথে।“ আমি ওকে বললাম।
শিরিন কপালে বিব্রত ভাঁজ নিয়ে বলল “ন্যায্য আর অন্যায্য বলে কিছু নেই আমার কাছে। আমি জানিনা আপনি কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন। তবে আমার কাছে সত্য হল এই, মুখোশের আড়ালে প্রত্যেক পুরুষই সমান। আপনি হয়তো জানেননা, আমিও বিবাহিত ছিলাম , সংসার করেছিলাম এক মধ্যবয়সীর সঙ্গে। আমার অভিজ্ঞতা হল, একজন পুরুষ তার আচরণগুলো অজান্তেই প্রকাশ করে নারীর কাছে। আপনার জানা নেই, আমার দাম্পত্য জীবনের বিগতকালগুলো ছিল উঁচু-নিচু জমিনের মত অসমান।“
আমি শিরিনের মুখের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকালাম। ওর সম্পর্কে আমার একটা ধারণা মিথ্যে হয়ে গেল সামান্য সময়ের ব্যবধানে। আমি ভেবেছিলাম ও কুমারী আর ওর বয়সটাও কম অথচ ওর জীবনটা উত্থান পতনের নানা জটিলতায় ভরপুর। আমি ওর থেকে বিস্তারিত শুনতে চাইলাম। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল, এই মুহূর্তে কোনো কিছু বলার মত ইচ্ছে ওর নেই। আমরা বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ শুনে আবাসিক এলাকার গলির ভেতর হাওয়া হয়ে যেতে লাগলাম। নির্ঝঞ্ঝাট রাত্রিকালীন হাওয়া দুপাশের বাড়ির বারান্দার কাপড়গুলো নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পেটের দায়ে তাড়িত দু’একটা কুকুর ছাড়া আশেপাশে আর কোনো প্রাণীর স্পন্দন নেই। ডান এবং বাম গলির মুখে কোথাও চোখে পড়ল বাঁশের দেয়া বেষ্টনী। আবার কোথাও চিকন লাঠির মাথায় লাগানো রয়েছে লাল কাপড়ের নিশান।
গেন্ডারিয়া আজগর আলী লেন পার হতে হতেই আকাশের শেষ তারাটি মিটমিট করতে করতে নিভে গেল। পুবাকাশে ফুটে উঠল ভোরের প্রথম আভা। মাথার উপর ঘুমভাঙা কাকগুলো ডেকে উঠল কা-কা করে। আমাদের চোখে পড়ল রাস্তায় উবু হয়ে শুয়ে থাকা এক মধ্যবয়সী পুরুষের নিথর দেহ। লোকটার ঘাড় একদিকে কাত করা, তার মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে কফ আর ফেনার মত জল। তার পায়ের কাছে একটা কাগজ তাকে পেঁচিয়ে ধরছে। আমরা সামান্য দূর দিয়ে লোকটিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম।
ফতুল্লা শ্মশানঘাটে এসে বুড়িগঙ্গার কিনারে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখলাম, ভোরের পবিত্রতায় ভেসে যাচ্ছে নদীর জল আর কোলাহলহীন ওপারের রাস্তা। আমরা ঘাটে ভেড়ানো তরমুজের জাহাজটা খুঁজে বের করলাম। পথে দেখা সেই নিশ্চল মানুষটির মত বুড়িগঙ্গার জলের ওপর বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে জাহাজটা। ওটার নিতম্বের ওপর অন্তর্দহন ইঞ্জিন। আমাদের মত আরেকটি পরিবার অপেক্ষা করছে জাহাজে ওঠার জন্য। সম্ভবত ওরাও আমাদের মত চোরাইপথে দক্ষিণে যাবে।
জাহাজে ওঠার পর দিনের কুসুম আলোতে শিরিনকে নতুনভাবে দেখলাম। ভোরের পবিত্র আলোয় ওর মুখে প্রশান্তির ছায়া পড়ছে। আমি ঠিক জানিনা, এর আগে ওর নদীপথে যাত্রা করার অভিজ্ঞতা আছে কি-না! আমি বোবা প্রাণীর মত অনেক্ষণ ধরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তরমুজের জাহাজের পেটের ওপর গর্তের মত একটা চারকোণা খোন্দল। খোন্দলের নিচে পুরনো চাটাইয়ের ওপর অবিন্যস্তভাবে বিছানো পুরু একটা কাঁথা। বিছানার চারপাশে লালা শুকানো কয়েকটি ডিমের খোসা আর বাজারে না বিকোনো কয়েকটা অচল তরমুজ। দক্ষিণে যাওয়ার অপেক্ষারত পরিবারটি খোন্দলের পুরু কাঁথার ওপর যাতক নিয়েছে। আমি শিরিনকেও খোন্দলের ভেতর যেতে বললাম। কিন্তু মনে হল, তিন সদস্যবিশিষ্ট পরিবারটি সেখানে সংসার পেতে বসেছে। তাদের একপাশে বসে আছে থুত্থুরে এক বুড়ি আর সদ্য গোঁফের রেখা গজানো তার নাতি। পাশে পেটে হাত চেপে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে ছেলেটির মা। নিঃশব্দে অতি সংযতভাবে কাঁদছে মহিলা আর তাতে বিধ্বস্ত দেখাল তার মুখের মানচিত্র। আমরা জাহাজের ছাদের ওপর বসে প্রকৃতির অপার সৃষ্টির দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইলাম।
“আমি তোমার সেই স্বামী আর সংসারের কথা জানতে চাই,” শিরিনকে বললাম।
শিরিন হাত উঁচিয়ে আমাকে নদীর দু’পাশের ইটভাটার চিমনির ধোঁয়া ওড়ার দৃশ্য দেখাল। বোঝাতে চাইল, ওর বিগত জীবনটা ছিল চিমনির ধোঁয়ার মত অপবিত্র আর কালো।
একটা গরিব পরিবারে বেড়ে ওঠা শিরিনের জীবনটা ছিল অতি সাধারণ। বাবা ছিল নেশার ঘোরে অন্ধ। যখন ওর ষোলো বছর বয়স ওর মা ওকে মধ্যবয়সী এক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিল। লোকটি শিরিনকে ঢাকায় নিয়ে এল তারপর সস্তায় পাওয়া যায় এমন একটি কলোনী বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করল। লোকটি দেখতে ছিল লিকলিকে আর তার পেশা ছিল রিক্সা চালানো। সে প্রতিদিন খুব ভোরে বের হত আর বিকেলে ঘামে গোসল করে বাসায় ফিরত। স্বামীর অনুপস্থিতির ফাঁকে শিরিনের কাছে ভিড়ত উঠতি বয়সের কয়েকজন সুদর্শন যুবক। তারা ওই কলোনীর আশেপাশের-ই বাসিন্দা। প্রথম প্রথম ও নিজেকে গুটিয়ে রাখত তারপর একটি ছেলের রহস্যময় হাসির কাছে হার মানতে হল ওকে। শিরিন এখানে ওখানে ঘুরতে যেতে লাগল ছেলেটির সঙ্গে। এর কিছুদিন পর ওর পরিচয় হল দ্বিতীয় যুবকের সঙ্গে। সে ছিল লম্বা আর মন ভালো করার মত সুদর্শন। শিরিন সেই ছেলেটিকেও সময় দিতে লাগল। কয়েকদিনের ব্যবধানে শিরিন দেখা পেল আরেকজন যুবকের। সে ছিল ব্যক্তিত্ববান আর আবেগপ্রবণ, জ্ঞান-গরিমা দেখলে যে কেউ মনে করবে ছেলেটি অন্তত একশ বছর পৃথিবীতে বেঁচে আছে। ছেলেটি এতটাই শান্ত ছিল যে, যে কেউ তাকে দেখলে মনে করবে ঢেউহীন স্তব্ধ এক পুকুর। ছোট ছোট শব্দে গুছিয়ে সে কথা বলত। শিরিন সেই যুবককেও সময় দিতে লাগল। এভাবেই যুবক ছেলেগুলোর সাথে মিশতে মিশতে শিরিন বহুদিনের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক পৃথিবীর সাথে পরিচিত হল। প্রতিদিন মুখোমুখি হতে লাগল অজানা সব অভিজ্ঞতার। একসময় ওর কৌতূহল হল ছেলেগুলোর অন্দরমহল ঘুরে দেখার। আর তাতেই অতি দ্রুত একটা চোরা ফাটলে আটকা পড়ে গেল। শিরিন প্রথমবার শরীর বিনিময় করল তৃতীয় ছেলেটির সঙ্গে। ও বুঝতে পারল, এতদিন শারীরিক আনন্দ বলতে যা কিছু পেয়েছে তা ছিল নারকেলের ফোফরার মত। শরীরের প্রকৃত আনন্দ বলতে যা বোঝায় তা ও কোনোদিন পায়নি। পক্ষান্তরে তৃতীয় ছেলেটির প্রথম সংস্পর্শ ছিল স্বর্গের মতোই আনন্দদায়ক আর সুন্দর। তারপর ঘনিষ্ট হল প্রথম ছেলেটির সঙ্গে। ও বুঝতে পারল চলমান জীবনটা অসম্ভব রকম রঙিন। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে ও বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াত যখন দেখত ওর স্বামী গোঁয়ারের মত পরিশ্রম করে গায়েগতরে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরত।
দ্বিতীয় যুবক ছিল সৎ আর বাচাল। সে শিরিনকে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে যেত আর দুপুরের পর এটা ওটা উপহার দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিত। ছেলেটা ছিল দয়ালু এবং কথা প্রসঙ্গে প্রশংসা করত হাড়জিরজিরে রিক্সাওলার। দ্বিতীয় যুবক কখনোই ওর শরীরের দিকে ফিরে তাকাত না। হয়ত এ কারণেই না-কি কে জানে, শিরিন সেই ছেলেটিকেও নিজের ঘরে ডেকে এনে সেক্স করার জন্য উস্কাতে লাগল। একটা ঘোর আর রহস্য উন্মোচনের জন্য দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল শিরিন।
এটুকু শুনে আমি শিরিনকে জিগ্যেস করলাম, “এসবের ফাঁকে কখনো কি তোমার স্বামীর অভাব বোধ করেছ?”
শিরিনের স্মৃতির জগত ওকে পেছন থেকে আরো পেছনে নিয়ে যেতে লাগল। যেন বেদনার একটা মায়াজাল তৈরী হল ওর বুকের ভেতর। ও মাথা নেড়ে বলল, “দ্বিতীয় ছেলেটিকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। বাচালের মত বকবক করে ছেলেটি হঠাৎ থেমে যেত। তারপর গলার স্বরটা নরম করে আফসোস করত আমার জীবনের জন্য। অথচ শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে সে প্রায়ই এড়িয়ে যেত। আমি একথা নিশ্চিত বলতে পারি, বিছানায় দ্বিতীয় ছেলেটির সঙ্গে আমি সবচেয়ে সুখী ছিলাম। সে আমাকে গ্রহণ করতে চাইত না অথচ তার সঙ্গে আমি পালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমি রাজিও করিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু একজন নিরপরাধ সহজসরল মানুষকে একা ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার জন্য প্রতিরাতে আমি বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতাম। আমার স্বামী ছিল এতিম আর ওর কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিলনা। লোকটা মধ্য বয়সী বলে সবসময় আমার কাছে মানসিকভাবে পীড়িত থাকত। শুনেছিলাম, ও আরেকটা বিয়ে করেছিল আগে। সেই বউ সম্পর্কে কখনো কোনো কিছু জানা হয়নি। প্রতিদিন দুপুরে আমি দ্বিতীয় যুবককে পালিয়ে যাওয়ার তারিখ দিতাম আর রাতে শরীরের ব্যথায় কাতরানো স্বামীর অবস্থা দেখে খুব মায়া লাগত। লোকটি একটু আরাম পেতে আমাকে জড়িয়ে ধরত। খুব অস্বস্তি লাগলেও না করতে পারতাম না। সকালে মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ত আমার। তখন প্রথম অথবা দ্বিতীয় ছেলের সঙ্গে ঢাকা শহরের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। প্রথম এবং তৃতীয় যুবক প্রতিদিন সুযোগ খুঁজতো পরিচিত ফ্ল্যাট বাসার। এসব কাজে ওদের পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল, সহজেই জোগাড় করে ফেলত কাঙ্ক্ষিত স্থান। আমি একেকদিন একেক বাসায় যেতাম আর মুখোমুখি হতাম নতুন নতুন অভিজ্ঞতার। ওরা ছিল চতুর আর পারদর্শী। প্রতিদিন আমাকে নতুন নতুন কৌশল শেখাত আর সঙ্গমের সময় নির্লজ্জের মত বুনো আচরণ করত। আপনি বিশ্বাস করবেন কি-না আমি জানিনা, সেসবের সাথে আমি আগে কখনো পরিচিত ছিলামনা। আমিও ধীরে ধীরে নির্লজ্জ হতে হতে তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে শিখে গেলাম।
আমরা কখনো সেক্স করে তৃপ্ত হতাম আবার কখনো অতৃপ্তি নিয়েই বের হয়ে আসতাম। ফেরার সময় দেখতাম, ওরা ফ্ল্যাটের লোকটির হাতে কড়কড়ে নোট গুঁজে দিত। টাকা পেয়ে লোকটি আমাদের বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানাত।
আমি জানি, এ মুহূর্তে আপনি আমাকে নিয়ে মনে মনে কি ভাবছেন। তবে আপনি যা কিছু ভাবেননা কেন, তাতে কিছু যায় আসে না আমার। সত্য তো সত্যই। আমি সেটা আপনার কাছে এই ভোরের আলোর মত স্পষ্ট করলাম। এটা জানেন তো, বিবেকের তাড়না বড় কষ্টের। এসব তাড়নায় মানুষ ধ্বংসের পথ বেছে নেয়। আমি ছেলেগুলোর সাথে মিশে মিশে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইতাম। কিন্তু নিয়তির এমনই বিধান, শেষ পর্যন্ত আমার স্বামীই আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেল। একটা বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারালো লোকটা। ওর মৃত্যুতে আমি বাঁধনহারা পাখির মত মুক্ত হয়ে গেলাম। তখন আমি এতটাই নিঃসঙ্গ ছিলাম আর অস্তিত্বের ভয় আমাকে এতটাই তাড়া করত যেন আমি এক অন্ধকার প্রান্তরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে যতদূর চোখ যায়, একটা প্রদীপের আলোও কোথাও নেই। তখন আমি মরা দেহের মত নিশ্চল, মৃত্যু ঘটেছে আমার শরীরের সবটুকু খিদের। এসব কারণেই আমি স্বামীর মৃত্যুর পর সেই ছেলেগুলোর সাথে আর দেখা করিনি। এমনকি সেই দ্বিতীয় ছেলেটির সঙ্গেও না, যাকে আমি হয়তো ভালোবাসতাম। একটা মৃত্যু আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেল। আর আমিও নিজেকে ধ্বংসের পথ থেকে ফিরিয়ে আনলাম। তারপর এক আত্মীয়ের সহায়তায় চলে এলাম সাহেবদের বাসায়। আপনি বিশ্বাস করবেন না হয়তো, প্রতি রাতে আমার স্বামীর শরীরের ব্যথায় কাতরানোর দৃশ্যটা আমার এখনো মনে পড়ে। বালিশে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে বোবার মত কাঁদি। অথচ ও বেঁচে থাকতে প্রতিদিন আমি নতুন নতুন সুখ খুঁজতাম।
লকডাউনে পরিবারের কর্তাটির আমাকে একলা রেখে যাওয়ার আরো একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, একটা ঘৃণ্য আর অমানবিক উদ্দেশ্য । লক ডাউনের কড়া পাহারা ভেদ করে, কিছুটা বিকল্প উপায়ে লোকটা দু’বার বাসায় এসেছিল। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন সে ঘরে ঢুকে তার বিশেষ কোনো দামী জিনিসপত্তরের দিকে একবারও তাকায়নি বরং দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়ে দু’পায়ের মাঝখানে ভেড়ার শিংয়ের গুঁতোর মত ঢুঁসো মারছিল। তার নোংরা, বিবর্ণ নখগুলো দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছিলো আমার নরম শরীর।’’
আমি আশ্চর্য হলাম, জগতে কতকিছুই না হয়, মানুষ যৌন খায়েস মেটাতে কত রকমের বুদ্ধি খাটাতে পারে! তরমুজের জাহাজ মোক্তারপুর ব্রীজ পার হবার পর পুব দিকে আমাদের চোখে পড়ল গাছ-গাছালির দেহরেখা। আমি তরমুজ ফাটিয়ে ফালা করে শিরিনের হাতে দিলাম। আমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরমুজের জলের লালচে ধারা। আর ওদিকে খোন্দলের ভেতর পেট ব্যথায় কাতরাচ্ছে সেই মহিলা। তার শাড়ী থেকে পুরু কাঁথার ওপর গড়িয়ে পড়ল তরমুজের লাল ধারার মত রক্তের সরু রেখা। ব্যাগ থেকে লুঙ্গি বের করে দৃশ্যটা আড়াল করল তার ছেলেটি। হঠাৎ বুড়ির একটা হাঁচির শব্দে ঝনাৎ করে কেঁপে উঠল তরমুজের জাহাজ। তাতে মনে পড়ে গেল প্রতিদিন টিভিতে করোনার আপডেটে অ্যানাউন্স করা মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার কথা। আমরা ভয়ে ভয়ে জাহাজের আহ্নির দিকে এগিয়ে গেলাম। পশ্চিমে জনমানবহীন রৌদোজ্জ্বল মেঘনার চর শুয়ে শুয়ে খুনসুটি করছে বহুদূরের আকাশের সাথে। মনে হল, শূন্যপথে তা দিতে থাকা সোনালী ডানার চিলটি বুঝি ওই প্রেমেরই অনুঘটক। হাতে ধরে থাকা তরমুজের ফালাদুটো রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়া প্রাণীর মত যন্ত্রণায় ধুঁকছে। আমি শিরিনের মুখের দিকে তাকালাম আর শিরিন আমার মুখের দিকে। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের নিচে শুধু ভেসে রইল মধ্যাহ্ন উত্তাপের স্তব্ধতা!
*****
প্রচ্ছদঋণ : ইন্টারনেট