মৈথুনতত্ত্ব – রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

মৈথুনতত্ত্ব মানুষের প্রাচীন বিশ্বাসগুলোর একটা, বুঝলি তো! শুধু ভারতে নয়, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যেও তুই এটা দেখতে পাবি।

এই ধারণাটা বোধহয় কৃষিজীবী সমাজ থেকে এসেছে, নারে!

হুম, কৃষিজীবী সমাজেই মৈথুনতত্ত্বকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র, দর্শন গড়ে উঠেছে বটে কিন্তু সেটা আর্যরা আসার বহু আগে!

তাই! তাহলে শিবলিঙ্গের ধারণাও সেখান থেকেই! সেটাও তো প্রোডাক্টিভিটিরই সিম্বল..

অনেকক্ষণ থেকেই কথা হচ্ছে লালন আর পার্থজিৎ-এর মধ্যে। ওরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একজন ইতিহাসের, অন্যজন সংস্কৃতের। দেখা হলে দুজনে কোনো না কোনো তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় বসে যায়। বিজয়ার মনে হয় ওদের তত্ত্বময়-জীবন! দুটো ইয়ং ছেলে দেখা হলে কোথায় খেলাধুলা, সিনেমা, বন্ধুবান্ধব, বিশেষ বন্ধু এসব নিয়ে আলোচনা করবে, তা না! সারাক্ষণ তত্ত্ব কপচাচ্ছে! শুনতে শুনতে বিজয়ার মাথা ধরে যায়! মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলেদুটো স্বাভাবিক তো! অবশ্য কাকেই বা বলে স্বাভাবিক! তার মানদণ্ডই বা কি! আর ঠিকই বা করে দেয় কে! ঠিক থাকলেই বা শুনছে কে! ভেড়ার পালের বাইরে যে হাঁটল সেই কি…তাহলে তো সে নিজেও…

ভাবনাটা মাথায় আসতেই সরিয়ে দিল বিজয়া। এসব পুরনো কথা নিয়ে আর খুব মাথা ঘামায় না বিজয়া। শুধু আলগোছে হাসির মতো একটা বেহিসাবী দুঃখ লেগে থাকে তার মনের প্রান্তে…

হরপ্পায় একটা নারী মূর্তি আবিষ্কার হয়েছিল, জানিস তো! অদ্ভুত দেখতে! একজন নগ্ন নারী একটা সীলের ওপর দুপাশে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আর তার যোনি থেকে একটা লতা বেরিয়ে আসছে। তার মানে বুঝতে পারছিস!

বুঝতে পারছি।

যোনিটাই আসলে এখানে সিম্বল। বুঝলি তো!

ছান্দোগ্যে আছে জানিস তো,

‘যোষা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিদ্ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরর্চির্যদন্তঃকরোতি তে অঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ।।

তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি।।’

এর মানে?

এর মানে হল, নারীই হল যঞ্জীয় অগ্নি, তার উপস্থ হল সমিধ। আর ওই আহ্বানই হল ধূম। যোনিই হল অগ্নিশিখা। প্রবেশক্রিয়া হল অঙ্গার, রতি সম্ভোগ হল স্ফুলিঙ্গ। এই অগ্নিতে দেবতারা রেতর আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়।

তার মানেই বোঝ, উৎপাদনশীলতার সঙ্গে নারী কিভাবে জড়িত। তুই যে শিবলিঙ্গের কথা বলছিস ওটা অনেক পরবর্তীকালে পিতৃতান্ত্রিক সংযোজন। তার অনেক আগে থেকেই বরং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে আদিবাসী সমাজে হুদোম দেবতার পুজো হয়।

বাবা! তোরা হুদোম উৎসবের কথাও জানিস!

তুমি জান নাকি মা!

সে আর জানব না! আমার মামাবাড়ি তো উত্তরবঙ্গে। ওখানেই শুনেছি।

তাই?? কিরকম হয় সেই উৎসব??

সে এক বিচিত্র ব্যাপার! ডিমটোস্টের থালাদুটো বিছানায় রাখতে রাখতে বলে বিজয়া। এঁটো কাঁটার সংস্কার এ বাড়িতে নেই বললেই চলে। বিজয়া ভাবে যেদিন থেকে লালন কে পেটে ধরেছে সেদিন থেকেই সব সংস্কার গঙ্গায় ভাসিয়েছে সে।

প্লেট রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওরা মহা আনন্দে খেতে শুরু করেছে! আর বিজয়াকে খোঁচাচ্ছে হুদোম উৎসবের গল্প শোনার জন্য।

বিজয়া বলে, হুদোম উৎসব পালন হয় রাতে, অন্ধকারে। শস্য প্রার্থনা করে নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে মাঠে নামে। ওদের হাতে থাকে একটা হাঁড়ি আর লাঠি। লাঠিটা দিয়ে হাঁড়িটার ভিতরে আওয়াজ করে। তারপর ওই অন্ধকারেই নারী পুরুষের মিলন হয় জমিতে। এতে শস্য ভালো হয় বলে বিশ্বাস!

বাঃ দারুণ তো, আবার দেখ পার্থ, শাকম্ভরী দুর্গা সেও তো শস্যদেবীরই আরেক রূপ। বা ধর কলাবউ, সেও তো শস্যবধূ…

তা আজ তোদের আলোচনাটা কি নিয়ে!

কিছু না কাকিমা, ক্লাসে সেদিন কাফিদা বাউলতত্ত্ব পড়াচ্ছিল। খুব অদ্ভুত ভাবে দেখলাম বাউলের দেহাত্মবাদ আর আদিবাসী সমাজের মৈথুনতত্ত্ব কত জায়গায় মিলে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আবার মিলে যাচ্ছে সহজিয়া বৈষ্ণব সাধনা, বৌদ্ধদের তন্ত্রসাধনা।

শুধু কি তাই! আদম-ইভের নিষিদ্ধ ফলভক্ষণ, ব্রহ্মা-সরস্বতীর একশ স্বর্গীয় বছর যাপন, চীনে ইয়াং আর ইয়িন এর মিলন… এই সবেরই ফলশ্রুতি এই বিরাট সৃষ্টি।

বিজয়া এতক্ষণ ওদের আলোচনা শুনছিল। বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণও করছিল। কিন্তু এবার সে চুপ করে উঠে পড়ে। বিজয়া উঠে পড়াতে ওরা দুজনও কিছুটা সময়ের জন্য চুপ করে যায়। লালনই তারপর ডেকে ওঠে, মা চলে যাচ্ছ কেন?

যাই এবার। ক্লাস আছে তো আমার। তোদের মতো বাঙ্ক করলে চলবে!!

লালন খানিকক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর এই দৃষ্টিটাকেই বিজয়া ভয় পায়। ওর কাছে কিছু লুকোবার উপায় নেই। এইটুকু বয়স! কিন্তু কথা টেনে বার করে নিতে ওস্তাদ!

বিজয়া আর দাঁড়ায় না। একটু তাড়াহুড়ো করেই ক্লাসে বসে যায়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। চারিদিকে শুধু মৃত্যু মিছিল।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ছাদে হেঁটে বেড়ানো বিজয়ার অভ্যেস। চারদিকের বাড়িগুলোর আলো একে একে নিভে যাচ্ছে। চারপাশটা নিঝুম হয়ে যাচ্ছে। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে… এমন সময় একলা হয়ে যাওয়া যায়। এমন সময় মনে হয় এই অনন্ত আকাশ আর তার মুখোমুখি বিজয়া। আর কেউ নেই! কোথাও নেই। এমন একলা মুহূর্তেই হয়তো তো সে এসে দাঁড়াবে! বলবে দিদিমণি, মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া কি এতই সোজা! সে যে বড় সাধনার!

সে তো তোমাদের কাছে! তোমরা যে মানুষ খোঁজ না। মনের মানুষ খোঁজ। আর আমি যে ভালোবাসা খুঁজি, প্রেম খুঁজি।

ও দিদি, ওই ভালোবাসাই বলো আর প্রেম বলো, ওসব অন্য কারো সঙ্গে হয়নিকো। ওসব শুধু মনের মানুষের তরে।

বলেই সে গান ধরবে, ‘অজান খবর না জানিলে কিসের ফকিরী

যে নূরে নূরনবী আমার তাঁহে আরশে বারী’

বুঝলে দিদিমণি, এ হোল আল্লাহর আলো। সেই আলো থেকে নূর। সেই নূর থেকে নবীর নূর; তায়ে জগৎ সৃষ্টি। সেই নূরের দেখাই যে চায় গো!!

তা সে নূরের দেখা কেমন করে পাবে তুমি??

শুনেই গান ধরেছে অক্ষয় বাউল

‘আল্লাহর বান্দা কিসে হয় বল আজ আমায়

খোদার বান্দা নবীর উম্মত কী করিলে হওয়া যায়।।’ ও দেখা পাওয়া যায়নি গো! কোটিতে একজন পায়। আমাদের লালন সাঁইজি পেয়েছিলেন গো! লালন সাঁইজি… বলতে বলতে কপালে হাত ঠেকিয়ে আবার একতারায় সুর তোলে অক্ষয়

‘আমি নূরের খবর বলি শোনরে মন

পাক নূরে হয় নবী পয়দা খাক নূরেতে আদমতন।।’

সেদিনও চারপাশ এমনি নিঝুম হয়ে এসেছিল। সোনাঝুরির হাট সেই কখন ভেঙে গেছে। বাউলের দল এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধূম ওড়াচ্ছে। একতারায় মিঠে সুর তুলছে আলতো… সোনাঝুরির খাদ বেয়ে একটানা বয়ে চলেছে বর্ষার ছোটো ছোটো জলস্রোত… অন্ধকারে দু একটা জোনাকি সম্বল। তারই মাঝে অক্ষয় বাউলের হাত ধরেছিল বিজয়া।

তোমার ডেরায় আমায় নিয়ে যাবে?

হে হে হে! তাই হয়নি কোন দিদিমণি! একলা বটে মানুষ আমি! আমার ডেরায় যাবে কো নি!

একলা কেন! তোমার সাধন সঙ্গিনী নেই?

লা বটে! এখনো হয়নিকো!

তবে এবার হোক না অক্ষয়!

বিজয়া শিউরে উঠল! পিছন থেকে লালন এসে এমন করে কাঁধে হাত রেখেছে! কি রে!

কি করছ মা! লালন মায়ের আঙুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে দেয়।

এই তো রে একটু হাঁটছি।

হাঁটছ কোথায়! তুমি তো আবার সেই পুরনো কথা…

বিজয়ার চোখ দুটো অন্ধকারে চকচক করে। এখনি বুঝি আলো চলকে পড়বে।

মা, তুমি কাঁদছ!

না রে, এমনিই…

লালন মায়ের পাশে চুপ করে দাঁড়ায়। অনেক দূরের দিকে যেন ওর দৃষ্টি। বিজয়ার মতো ও ও যেন কাকে খুঁজছে! যদি সে দেখা দেয়। বিজয়া কতদিন এমন অন্ধকারে লালনকে দেখে চমকে উঠেছে। সেই এক চেহারা, চকচকে কালো গায়ের রঙ আর উজ্জ্বল দুটো চোখ। অক্ষয় চলে গিয়ে রেখে গেছে তার স্মৃতি। বাপ-ছেলের এমন মিল সহজে চোখে পড়ে না। অথচ এই মিলের জন্যই লালনকে ছোট থেকে কত হেনস্থা হতে হলো।

বিজয়ার অমন ফর্সা চেহারা আর ছেলেটা দেখো।

আরে জাতবেজাতের ছেলে তাই তো হবে! কোথাকার কোন বাউল-আউল… তার জন্য জীবনটা শেষ করল।

মামারবাড়িতে, স্কুলে, আত্মীয়মহলে এই ছিল লালনের পরিচয়। রোগা কালো ছেলেটা যেন বিজয়ার জীবনে মূর্তিমান উপদ্রব। ও সরে গেলেই বুঝি কালো মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠবে। যে বাবা একমাত্র বিজয়ার পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছিল সেও লালন পড়া ভুল করলে এক একসময় বলে উঠত কোন বাপের ছেলে দেখতে হবে তো!

বাপহীন, বংশপরিচয়হীন, জাতহীন, সৌন্দর্যহীন লালন এভাবেই বড় হয়েছে। কতবার যে ওর স্কুল চেঞ্জ করতে হয়েছে। শুধুমাত্র মানবিকতা ওর ধর্ম বলে। শুধুমাত্র ওর বাবার কোনো পরিচয় নেই অথবা ও অবৈধ বলে। স্কুলে ওর বন্ধু নেই, পাড়ার ছেলেমেয়েরা ওর সঙ্গে মেশেনা। একা একা থাকতে থাকতে এক একটা সময় লালন ফুঁসে উঠত, ‘কেন তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছিলে! আমার ভাগ্যে এতটা অপমান লিখে দেওয়ার অধিকার তোমায় কে দিল!’

-এভাবে বলে না লালন। তুই আমার ছেলে। আমার পরিচয়ই তোর পরিচয়। কার সাধ্যি তোকে অপমান করে!

-কোন দুনিয়ায় থাক তুমি! প্রেম, ফ্যান্টাসি, রোম্যান্টিসিজম দিয়ে জগৎটা চলে না। সেই ছোট থেকে তোমার জন্য আমি কোণঠাসা হয়ে গেছি, তুমি দেখতে পাও না!!

-লালন, যারা তোকে অপমান করে, কোণঠাসা করে আসলে তারাই অন্ধ রে! তুই বড় হ, বুঝবি তোর রক্তে গৃহী আর সন্ন্যাসীর বিরল মিলন। দুটো প্রেমিক মানুষের মিলন। সামাজিক কোনো চাহিদাহীন, স্বার্থপরতাহীন শুধু মনের মানুষকে খোঁজার আর্তি। সেই পবিত্র মুহূর্তে তুই জন্মেছিস লালন।

-আমি এসব তত্ত্বকথা শুনতে চাই না। চাই না শুনতে। তোমার উদারতা প্রকাশের জন্য তুমি আমার জন্ম দিয়েছিলে! তুমি কত মহান তা বোঝানোর জন্য!

বিজয়া এইসব কথার সামনে বাক্যহারা হয়ে যেত। কি দিয়ে যে লালনকে সে তার অসহায়তা বোঝাবে! জীবনের কাছে সে যে কেবল সৎ থাকতে চেয়েছিল। যাকে ভালোবেসেছে দিনের পর দিন, যার গান শোনার জন্য সোনাঝুরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে, একদিনের জন্যে হলেও সেই প্রেমকে উপেক্ষা করতে পারেনি বিজয়া। সে তো উদাসীন। বাউল; একদিন সে মনের মানুষের খোঁজে আবার পথে নেমেছে। হারিয়ে গেছে বিজয়ার জীবন থেকে। কিন্তু বিজয়া যে তার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে সেই মানুষকেই তার মনের মানুষ জেনেছে। তাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। পেয়েছে লালনকে।

আজ অবশ্য লালন অনেক শান্ত। পড়াশোনা করছে। ইউনিভার্সিটিতে একটা উন্মুক্ত প্রান্তর পেয়েছে ও। বন্ধুদের কাছে ওর অ্যাকসেপটেন্স তৈরি হয়েছে। এখন ও বিজয়াকে অনেকটাই বোঝে। বোধহয় আগের আচরণের জন্য রিপেন্ট করে। মা’র একলা জীবনের একমাত্র সঙ্গী এখন লালন।

ছাদের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওরা মা ছেলে দুজনেই আজ এসব ভাবছিল। মা, তুমি এখনো খুঁজে বেড়াও? এই যে প্রত্যেক মাসে তুমি যাও? কত প্রত্যন্ত প্রান্তরে? কত অসুবিধে ভোগ করে? এখনো খোঁজ মা?

বিজয়া অদ্ভুত হাসে। যাকে পাওয়ার নয় অথচ যাকে খোঁজাই ভবিতব্য তার খোঁজ করছে সে। মনের মানুষের খোঁজ তো তেমনই। বিজয়া এই ঘোর বর্ষায় গান গায়, ‘যা না চাইবার তাই আজি চাই গো! যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো!’

আর লালন ভিজতে থাকে।

প্রচ্ছদঃ রেশমী পাল