নীতি তুমি কার? নেচার না নারচার?
ভারতে যেহেতু নৈতিক বইপত্রের কমতি নেই, বা বলা ভালো পুঁথি গোছের যাই পাওয়া যায়, তাই বেশ “পুরনো চাল ভাতে বাড়ে”- মেনে নিয়ে নীতি বুঝতে বসে যাওয়া যায়। ফলে তার মধ্যে নৈতিকতাকে বোঝার চেষ্টা মানে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা। সেদিকে না গিয়ে হাঁটা দিলাম আবারও বিদেশী মনস্তাত্ত্বিকদের পড়াশোনা ও গবেষণার দিকে, তবে ভয় নেই তাদের গবেষণা এদেশেও হয়েছে –
“বৈজ্ঞানিক ও হিউম্যানিস্টদের একসাথে বসে আলোচনা করা উচিৎ যে সময় এসে গেছে নীতিকে দার্শনিকদের হাত থেকে নিয়ে শরীরবৃত্তীয় করে তোলার” ~ E.O. Wilson (1975)
“নৈতিকতার বাইরে বেরোনো মানে ভূমন্ডলের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া” ~Mary Midgley
মনের কাছে সবসময় শরীরের খবর না থাকলেও, শরীরের কাছে মনের খবর প্রায় সবই পাওয়া যায়। অচেতন বা Unconscious, যাকে গিরীন্দ্রশেখর বসু ‘নির্জ্ঞান’ বলছেন, তার মূল পরিচয়ই হল এমন অসংখ্য অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, চাহিদা, বিভিন্ন স্মৃতি, যা শরীরের কাছে থাকলেও মন খবর রাখে না। সে যেন শরীরের তুলনায় পলকা, বেশি দায়ভার নেওয়ার সক্ষমতা তার তৈরি হয়নি। এদিকে শরীর লক্ষ বছর আগের জঙ্গল-জীবনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ফলে শরীরবিদ্যার কাছে এসে ঠকতে হয়না ঠিকই, তবে নৈতিকতাকে বুঝতে গেলে যেন গোটা ভূমন্ডলকেই বোঝার চেষ্টা করতে হয়।
একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে Richard Shweder, Alan Fiske প্রমুখ নৃতত্ত্ববিদ, Shalom Schwartz এর মত সামাজিক মনোবিদ ও Frans De Waal এর মত প্রাইমাটোলজিস্টের বিভিন্ন গবেষণা ও লেখা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে Haidt ও Joseph — Moral Foundations Theoryর (MFT; গ্রাহাম, ২০১৩; হাইট ও জোসেফ, ২০০৪) কথা বলেন। এই তত্ত্ব নৈতিকতার পাঁচটি মূল ভিত্তির কথা বলে:
এক, প্রতিটি প্রাণীর মগজেই কিছু কিছু বিবর্তন-নির্ধারিত ছাপ (draft) থেকে যায়, যে ছাপের উপর অভিজ্ঞতার কালি পড়লে নিহিত আবেগ ও ব্যবহার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কলেজে পড়াকালীন এক বন্ধু আলোচনার আসরে বলেছিল, মানুষের চরিত্র — scratch card এর মত। স্ক্র্যাচিং ফয়েলগুলোর নীচের লেখার মতই আমাদের প্রত্যেকের কিছু জিনগত ব্যবহারের ভিত্তি প্রস্তুত আছে, কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়ে হয়ত নির্দিষ্ট একটা স্ক্র্যাচিং ফয়েল উঠে গেল, তখন তার নীচের বিবর্তন-নির্ধারিত নকশাগুলো ফুটে ওঠে।
“স্পষ্ট সামাজিক প্রবৃত্তি রয়েছে, সেই প্রবৃত্তির মধ্যে পিতামাতা ও অপত্যের প্রতি স্নেহও রয়েছে, এমন যেকোনো প্রাণীর মধ্যে, যদি সে বিবর্তিত হয়ে মানুষের মত হয়ে থাকে অথবা মানুষের কাছাকাছিও পৌঁছে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই তার মধ্যে বিবেক বা নীতিবোধের বিকাশ ঘটে থাকবে।”
~চার্লস ডারউইন, The Descent of Man (1982 [1871], pp. 71–2)
নিজেদের আশেপাশে দেখলে পিঁপড়ে, মৌমাছির মত দলবদ্ধ কীটপতঙ্গদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা স্পষ্ট দেখতে পাই। তাদের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলার যথাযথ পালনরীতি দেখা যায়, যেখানে দলের কাছে ‘স্ব’, তুল্য বিচারে অপ্রয়োজনীয়। Tajfel ও Turner এর Social Identity Theory অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির নিজের পরিচয়, আত্মসম্মানবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে দলের পরিচয় ও দলের মর্যাদার সাথে জড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দলের প্রয়োজনে নিজেকে কোরবানি দিতেও তার অসুবিধে হয় না, কারণ আদপে তার দলের বেঁচে থাকাই তারও বেঁচে থাকা। এরই সাথে জড়িয়ে থাকে altruism এর ধারণা। Daniel Batson এর মতে — ‘নিজের বাদে অন্য এক বা একাধিক মানুষ বা প্রাণীর মঙ্গলের জন্য কোনো প্রাণী যে প্রেষণা অনুভব করে ’, তা altruism। মৌমাছি সমাজের শ্রমিকরা নিজেদের কথা ভেবে নয়, বরং রাণী মৌমাছির অপত্যের যত্ন করে দলের কথা ভেবে, এবং দলের সুরক্ষার জন্য নিজেকে কোরবান করতেও পিছপা হয় না। আবার একই ব্যবহার দেখা যায় ফিঞ্চ ইত্যাদি পাখিদের মধ্যে, যারা alarm call এর মাধ্যমে শিকারি পশুদের আগমনবার্তা দলকে পাঠায়, যাতে তারা সময় থাকতে পালাতে বা শিকারি পশুর সাথে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতে পারে। কিন্তু এই ডাক শিকারির কাছে তার অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়, ফলে বাকিদের বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে বিপদে পড়ে। কিন্তু এমন এক ব্যবহার যা করতে গিয়ে কর্তা নিজেই বিপদে পড়ছে, তা এতকাল টিকে রইল কিভাবে? Waal এরও ব্যখ্যা দিয়েছেন। Altruism সাধারণত দু’ধরনের উদ্দেশ্য সাধন করে — যার একটিতে সে কেবলমাত্র রক্ত সম্পর্কযুক্ত প্রাণীদের অথবা নিজ গোষ্ঠীর সদস্যদের বাঁচানোর জন্য প্রেষণা দেয় (kin selection), অপরটিতে কেবলমাত্র সাহায্য করলে যদি ভবিষ্যতে তার পরিবর্তে সাহায্য মেলার সম্ভাবনা থাকে, তবেই তার জন্য প্রেষণা দেয় (reciprocal altruism)। ফলে দু’ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য আবারও স্ব-সংরক্ষণ ও স্বপ্রজাতির সংরক্ষণেই এসে ঠেকছে।
দুই, বিবর্তন কেবলমাত্র নৈতিকতার প্রাথমিক রূপরেখা দিতে পারে, তা পরিপূর্ণ রূপ পায় মানুষের নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে। আমাদের সংস্কৃতিতে ছোট থেকেই বড়দের সম্মান করতে শেখানো হয় — পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম, পা টিপে দিয়ে সম্মান দেখানো, উঁচু গলায় কথা বলাকে নিন্দা ইত্যাদির মাধ্যমে। ভিত প্রস্তুত হতে হতে মানুষটি প্রাপ্তবয়স্ক হলে সে বড়দের সবসময় সম্মান করে কথা বলার চেষ্টা করে, তাদের কাজকে সরাসরি প্রশ্ন করেনা, নাম ধরে ডাকেনা। কিন্তু যে সংস্কৃতিতে এমন নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়না সেখানকার ছেলেমেয়েরা বড়দের কেবল বয়সের খাতিরে আলাদা সম্মান দেওয়ার কথা ভাবেনা। তাদের নাম ধরে ডাকতে পারে, তাদের কাজকর্মকে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়, ইত্যাদি। কিন্তু বিবর্তনেও এর ছাপ আছে। যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়া হোক, অথবা খাবারের সিংহভাগ হোক, উঁচু পদের ক্ষমতাশালী প্রাণীই প্রথম তা বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। রিসাস বানর, শিম্পাঞ্জীদের সমাজ বিভিন্ন উঁচুনিচু পদে বিভক্ত। ফলে তাদের মধ্যে লঘু-গুরু ভেদে ব্যবহার পরিবর্তনেরও নজির রয়েছে। পূর্বনির্ধারিত ছাপের উপর সংস্কৃতি কাজ করলে তবে নৈতিক ব্যবহার তৈরি হয়। এতে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও গবেষণার দাবী রাখে।
“অধস্তন নেকড়েরা উচ্চপদস্থদের মুখের কোণ চেটে পরিষ্কার করে দেয় (…), রিসাস প্রজাতির বানরেরা নিজেদের পাছা এগিয়ে দেয় অথবা সব দাঁত বের করে হাসে, এবং শিম্পাঞ্জী ও মানুষেরা ঝুঁকে দাঁড়ায় অথবা শুয়ে পড়ে প্রণাম করে।”~ Frans De Waal (1996)
নীতির গুঁতো আদপে রসের গুঁতো
তিন, নৈতিকতার প্রথম ধাপ — intuition। Wundt যখন ‘affective primacy’ র ধারণা দেন, তখনও মনস্তত্ত্ব সদ্যজাত। জনাথন হাইট তার গবেষণায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে ‘evaluative flash reaction’ লক্ষ্য করলেন, তা যেকোনো পরিস্থিতিতেই কার্য-কারণ, যুক্তি-তর্কের বদলে ঘটনাটির (প্রশ্নটির, মানুষটির অথবা কাজটির, ইত্যাদি) অভিজ্ঞতা মাত্রেই (কখনও অভিজ্ঞতার এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে) তার সম্পর্কে প্রাথমিক রায় দিয়ে দিয়েছিল। সেই প্রাথমিক রায় দেওয়ার পদ্ধতিটি আবেগঘটিত (flashes of feeling), তবে তার প্রকৃতি স্নায়বিক প্রতিবর্ত-ক্রিয়ার মত। এই প্রতিক্রিয়া যেন —
“হঠাৎ চেতনায় অথবা চেতনার কোনো এক প্রান্তে এক অনুভূতির প্রবেশ, যাতে মনে হয় কোনো সমস্যার মীমাংসা করা হল (ভালো-খারাপ, পছন্দ-অপছন্দ, ইত্যাদি বিচারে) অথচ সেই মীমাংসায় পৌঁছনর আগের অনুসন্ধান পদ্ধতি, অর্থাৎ প্রমাণ জোগাড়, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্তে আসা, ইত্যাদির কোনো সজ্ঞান স্মৃতি নেই।”
যেন ছ্যাঁকা খেয়েই হাত সরিয়ে নেওয়ার মতনই, মন কিছু ব্যবহার অথবা কাজকে ‘ভালো-মন্দ’ / ‘পছন্দ-অপছন্দ’ ভাগে ভেঙে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বটে, যে বিস্তারিত ব্যখ্যাত দেওয়া যাবে, কিন্তু সজ্ঞান মন কিছুতেই তা দিয়ে উঠতে পারছেনা। হাইটের মতে এর মূলে রয়েছে ক্ষণস্থায়ী আবেগের প্রভাব। যার ফলে হাইট উন্ডটের ‘affective primacy’ কে এক্ষেত্রে ‘intuitive primacy’ বলছেন। Intuition শব্দটি আধিদৈবিক জ্ঞানের দিকে আঙুল দেখায় বারবার, যে জানার পেছনের কোনো কারণ নেই, ফলাফল দেখাতে পারেন না, শুধু বলতে পারেন যে “gut feeling বলছে এই উত্তরটাই হবে” “মন বলছে লোকটা ভালো না।” আরও বলছেন, কোনো সামাজিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রথাসিদ্ধ নিয়ম হয়ে মানুষের কাছে যদি অভ্যেসে পরিণত হয়, তবে তার উল্লঙ্ঘন হলেই মস্তিষ্ক একরকমের — negative affective flash reaction দেয়, যাকে বলা যায় — Moral Intuition। ফলে নৈতিকতার মূলে থাকা আবেগকে আলোচনায় তুলে আনা গেল যার primacy-কে মানুষের (অথবা তার পূর্বসূরীদের) বহুযুগের বহুস্তরীয় অভ্যাসের স্মৃতির লিখন হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলি আবেগসংক্রান্ত ক্রিয়ার জন্য দায়ী, তা অতিপ্রাচীন এবং এই অঞ্চলগুলি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতির অনুলিখনের কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি আকাশি, হলুদ, গোলাপি ইত্যাদি রঙে চিহ্নিত করে রাখলে, পরে একবার চোখ বোলালেই মনে পড়ে যায়। তেমনই জীবনের বিভিন্ন চ্যাপ্টারের স্মৃতি আবেগের বিভিন্ন রঙে চিহ্নিত করে রাখা থাকে। পরবর্তীকালে সেই চ্যাপ্টারের কোনোরকম তথ্য কমন এলে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলির উপর আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত হয় আর ওই রঙের আবেগ চড়চড় করে ওঠে। সবক্ষেত্রেই এই রঙিন আবেগ আমাদের flash reaction দিয়ে জানিয়ে দেয়, যা তুমি এককালে দাগিয়েছিলে, সে পরিস্থিতি এসেছে। বিজ্ঞানীদের মতে প্রাণীজগত এই রঙে দাগানো স্মৃতি জিনগত পরম্পরায় সঞ্চয় করতে থেকেছে, এবং তার আদিতম পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতা ও তাদের দাগানো রঙের স্মৃতি আজও মানুষসহ সকল প্রাণী তার দৈনন্দিন সমস্ত ব্যবহারে বহন করে চলেছে।
প্রকৃতিতে অসংখ্য রঙ এবং তাদের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, তেমনই আবেগতাড়িত অভিজ্ঞতাও অসংখ্য এবং ব্যক্তিবিশেষে তার রূপ ইউনিক। নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত নবরস (শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, অদ্ভুত, ও শান্ত), জীবতত্ত্ব ও বিবর্তনবাদীদের চিহ্নিত ৬টি বুনিয়াদী আবেগ— আনন্দ, দুঃখ, রাগ, ভয়, ঘেন্না, ও বিস্ময় (তালিকা পরবর্তী গবেষণার সাথে বেড়ে জুড়েছে — অবজ্ঞা, লজ্জা, গৌরব) ও মনস্তত্ত্ববিদ Plutchik-এর (1980) চিহ্নিত ৮টি প্রধান আবেগ (৬টির পাশাপাশি প্রত্যাশা ও শ্রদ্ধা), এই সমস্ত কিছুর প্রকাশ মুখ ও বিভিন্ন অঙ্গের পেশী সঞ্চালন, শব্দ, ও কাজের মাধ্যমে। এই সমস্ত বুনিয়াদী আবেগেরই মানুষ ও অন্য প্রাইমেটদের মধ্যে প্রকাশ একই ধরনের শারীরিক ও ব্যবহারিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে। ফলে ধরে নেওয়া যায় প্রাণীদের সামগ্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এই মৌলিক আবেগগুলির কার্যকালও বেশ দীর্ঘ।
Plutchik তার গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, পরিবেশের সমস্যা সমাধান না করে প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে, প্রাণী তার শরীরে বিভিন্ন আবেগ তৈরি করে, যা motivational signal-এর কাজ করে। এই সিগন্যালটির উপযোগিতা মূলত সেই আবেগের action tendency— অর্থাৎ ওই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার তৈরি করার (অথবা প্রয়োজনে তা থেকে নিজেকে বিরত রাখার) প্রবণতা। আবেগের প্রেষণায় যে ব্যবহার তৈরি হল, তা বারবার ঘটতে থাকলে একসময়ে অভ্যেসে পরিণত হয়। সহজ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় —বিপদ সংকেত বোঝা গেলে মগজ — ভয় তৈরি করবে, যা প্রাণীটিকে আনুষঙ্গিক পরিস্থিতি থেকে সরে যাওয়ার, অথবা পালিয়ে যাওয়ার প্রেষণা দেবে, ফলস্বরূপ তার সুরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। যদি উপযুক্ত যৌনসঙ্গীর খোঁজ পাওয়া যায়, তবে মগজ — ভালোবাসা অথবা গ্রহণ সংক্রান্ত আবেগ তৈরি করবে যা প্রাণীটিকে তার সঙ্গীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে, তার প্রতি মনোযোগ দিতে, তার খেয়াল রাখা, ও তার প্রতি যৌন আকর্ষণকারী ব্যবহার করতে প্ররোচিত করবে, ফলস্বরূপ প্রাণীটির যৌনমিলনের সম্ভাবনা বাড়বে এবং অপত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হবে। আবার এমন কোনো বস্তু যা শরীর বা মনের পক্ষে স্বাস্থ্যকর মনে করা হচ্ছেনা, তার প্রতি মগজ — ঘেন্না (ক্ষেত্রবিশেষে অবজ্ঞা, বিরক্তি, ইত্যাদি) তৈরি করবে যার ফলে বমিভাব, গা গুলানো ইত্যাদি শুরু হতে পারে, যাতে সজ্ঞানে বা নির্জ্ঞানে প্রাণীটি সেই ব্যক্তি-বস্তু-পরিস্থিতি থেকে সরে আসে। গবেষণাগারে ইঁদুরেরা কোনো খাবার খেয়ে একবার বমি করলে সেই খাবার তারা ভবিষ্যতে আর খায় না। ফলে ঘেন্নার এক সুদূরপ্রসারী ফলাফল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিগুলিকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কিছু শারীরিক (ক্রিয়া) ও ব্যবহারিক (অভ্যেস) উপকরণের সাথে জুড়ে দিয়ে পরবর্তী সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসরে কিছু ব্যবহারের প্যাটার্ন তৈরি করছে, যাকে আবেগের — ‘emotivational’ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মনোবিদ Ira J. Roseman। সেক্ষেত্রে নৈতিক আবেগ সৃষ্টির হলেও এই পদ্ধতিতেই ব্যক্তিচরিত্রের নৈতিক গুণ গড়ে উঠতে পারে।
নৈতিক অক্ষ যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের বা অপরের প্রতি শাস্তিমূলক আবেগ তৈরি করে, যার ফলাফল ঋণাত্মক, তখন — অবজ্ঞা, বিষন্নতা, ঘৃণা, লজ্জা, অপরাধবোধ, অনুতাপ ইত্যাদি তৈরি হতে পারে। এরই ওপারে রয়েছে করুণা, সহমর্মিতা, ক্ষমাশীলতা, শ্রদ্ধা, আশা, গৌরব, কৃতজ্ঞতা, ঔৎসুক্য, ইত্যাদি আবেগ যা শাস্তি না দিয়ে সাহায্যার্থে এগিয়ে যায়। এই সমস্ত আবেগকে নৈতিক আবেগ হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ব্যক্তির কোনো নির্দিষ্ট কাজ অপরের নৈতিক অক্ষে নিন্দনীয় হলে, শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে সেই ব্যক্তি এই অপরের চোখে নীচু ও অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়, ফলে তার সাথে সামাজিক অথবা মানসিক স্তরে কোনোরকম সম্পর্ক রাখা অপ্রয়োজনীয় ও সময়, যোগ্যতা, পুঁজি ইত্যাদির অপচয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রতি ওই অপরজনের মস্তিষ্কে উৎপন্ন আবেগটি — অবজ্ঞা। আমাদের সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে শ্রেণীর সংখ্যা অগুনতি, অবজ্ঞা আমাদের এই বহুধাবিভক্ত সংস্কৃতিতে সামাজিকতার অন্যতম জরুরী পাঠ, যা বিদ্বেষের হাইওয়েতে উঠিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফর্সা না কালো, রবীন্দ্রসঙ্গীত জানা আছে না নেই, কোনো ভাষায় বেশি স্বচ্ছন্দ, জামাটা ব্র্যান্ডেড না ফুটপাতের, আরো পড়াশোনা নাকি চাকরি নাকি ব্যবসা, বিয়ে করতে চাও কি চাওনা, MARVEL না DC, প্রতিটা প্রশ্নোত্তর পর্বে উত্তর যাই হোক, কোনো এক পর্যায়ে অবজ্ঞা আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে। দাঁড়াবেই। এরই উল্টোপিঠে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে নিজেকে উঁচু গণ্য করে অনুভূত আবেগ — গর্ব। যে ব্যক্তি অবজ্ঞার, বা ঘৃণার পাত্র, তার মধ্যে লজ্জা, অপরাধবোধ, দুঃখ ইত্যাদি জন্ম নেবে, যা তার হৃদয়ে সংস্কৃতির নৈতিক অক্ষের প্রাণপ্রতিষ্ঠার পূজো।
নৈতিক মেরুদন্ড
চার, গবেষণা এখনও পর্যন্ত নৈতিকতার পাঁচ ধরনের ভিত্তি বা foundation লক্ষ্য করেছে — care/harm, fairness/cheating, loyalty/betrayal, authority/subversion, purity/degradation। এর মধ্যে প্রতিটিই একেকটি কন্টিনিউয়াম, যার দুই প্রান্তের ব্যবহারগুলি একেকটি নৈতিক অক্ষের দুই পরস্পর বিপরীত মেরুকে নির্দেশ করে।
কোনো প্রাপ্তবয়স্কের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাদের দেখলে আমরা কিছু না ভেবেই তাদের কাছে এগিয়ে যাই, কিছু জানার আগেই আমাদের রাগ হয় ‘এইটুকু বাচ্চাকে একা ফেলে রেখে গেছে!’ এই দরদ, সহমর্মিতা, আর শেষে রাগের flash reaction আমাদের মধ্যে তৈরি হয় care / harm-এর নৈতিক ভিত্তির প্রভাবে। প্রাণীজগতে স্তন্যপায়ী শিশুদের স্বনির্ভর হতে অনেকটা সময় লাগে, যে সময়টা জুড়ে তাদের যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজন হয়। ফলে গোষ্ঠীর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যত্ন সংক্রান্ত ব্যবহার তৈরি হয়েছে, যা ব্যতীত গোষ্ঠীর উদ্বর্তন সম্ভব হত না। কিন্তু এখন যেকোনো প্রাণীর অপত্যদের প্রতিই এই ব্যবহার প্রদর্শিত হয়, এমনকি অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণী বা মানুষ শিশুসুলভ আচরণ করলে তাদের প্রতিও মানুষের করুণা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি তৈরি হতে পারে। মানুষের সমাজে পোষ্যদের অপত্যরূপ স্নেহ করার ইতিহাস দীর্ঘ, এবং এখনও বহু মানুষ অনলাইনে কুকুর ও বেড়ালদের ভিডিও দেখে দিনের অনেকটা সময় কাটান। এক বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায় বড়রা বা অন্য কেউ তাদের উপস্থিতিতে কাঁদলে, বা ব্যথা পাওয়ার আওয়াজ করলে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, জড়িয়ে ধরে, চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে, গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। বাড়ির আদরের পোষা কুকুরদের মধ্যেও এই ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। অনেক প্রাইমেটরাও শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্ক আছে এমন প্রাণীদের প্রতিই যত্ন দেখায়, খুব বেশি হলে একই গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের প্রতি এই ব্যবহার দেখাতে পারে, কিন্তু কখনই সেটা নিজের পরিবারকে বঞ্চিত করে নয়।
১৯৭৬ সালে ফ্লোরিডার উপকূল অঞ্চলে ৩০টি সিউডোরকা প্রজাতির সামুদ্রিক ডলফিনকে ছেড়ে দেওয়া হয় যাতে উপকূল থেকে সহজেই সমুদ্রের গভীরে তাদের স্বাভাবিক বাসস্থানে তারা ফিরে যেতে পারে। কিন্তু দেখা গেল, দলের সবথেকে বয়স্ক ডলফিনটি আহত থাকায় বাকিরা তাকে ঘিরে নির্দিষ্ট বিন্যাস বজায় থেকে অবস্থান করল তিনদিন ধরে। এই সময়কালে ১৩-১৫টি করে ডলফিন পালা করে আহত ডলফিনটিকে ঘিরে বিভিন্ন আওয়াজ করত। গবেষক সাঁতরে তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে দেখা যায় বারংবার বিন্যাসের সবথেকে বাইরের ডলফিনটি বিন্যাস ভেঙে বেরিয়ে আসছে ও গবেষককে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। US coast guard দের পক্ষে তিনদিনেও ডলফিনদের এই বিন্যাস ভাঙা সম্ভব হয়নি। তিনদিন পর বয়স্ক পুরুষ ডলফিনটি মারা গেলে বাকিরা ধীরে ধীরে বিন্যাস ভেঙে উপকূলের অগভীর জল ছেড়ে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে গিয়েছিল। গল্পটি পড়তে পড়তে আমার ছোটবেলায় দেখা একটি দৃশ্য মনে পড়ে যায়। মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা একজন প্রায় অচৈতন্য বয়স্কা, পড়শী থেকে আত্মীয়-স্বজনে ঘিরে রয়েছেন তাকে, কানের কাছে গীতা পাঠ করে শোনানো হচ্ছে। এই যত্ন, সহানুভূতি, সহমর্মিতা শুধুমাত্র গোষ্ঠীর (বা পরিবারের) শিশুদের প্রতি নয়, বরং তা যেকোনো ‘suffering’ এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমস্ত বয়সের সদস্যদের প্রতিই প্রদর্শিত হতে দেখা যায়।
“(…) সংকেত অথবা সামাজিক পরিচিতি থেকে যদি এমন ধারণা হয় যে কোনো নারী তার প্রজনন ক্ষমতার সুবিধা অন্য পুরুষকেও দিয়েছে (বা দিতে পারে) তবে সেই নারীকে বেছে নেওয়া যাবেনা। যে নারীর ব্যবহার বা সামাজিক পরিচিতি বিশ্বস্ততা, আনুগত্যর কথা বলে, তাকে বাছা উচিৎ। (…) — সতীত্ব — অর্থাৎ অতীতে যার যৌন অভিজ্ঞতা নেই। পাশাপাশি আরেকটি সংকেত হল লালনপালন করার ক্ষমতা — যা মাতৃত্বের উপযোগী দক্ষতা।”
~Buss (1995)
অর্থাৎ, যত্ন, যে ব্যবহারটি অপত্যের সুরক্ষার জন্য জরুরী, যা মূলত মাতৃত্বের সাথেই জড়িত তার পাশাপাশি বিবর্তন বলছে পুরুষের ক্ষেত্রে যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মুখ্য শর্তই হল — ‘সতীত্ব’, এবং তা লঙ্ঘিত হলে যে নৈতিক ভিত নড়ে যায়, তা হল — fairness / cheating। Cheating-কে Waal সংজ্ঞায়িত করছেন — “যতটা নেওয়া হয়েছে, তার থেকে কম দেওয়া ” হিসেবে। যেকোনো দলের ‘free rider’-দের মুখ্যত ‘cheater ’ হিসেবে ধরা হচ্ছে, অর্থাৎ এই অক্ষ অনুযায়ী তারা অসৎ বলে চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু নারী তবে কি নিচ্ছে যার পরিবর্তে তাকে সতীত্ব দেওয়ার কথা? Male chastity বা পুরুষের সতীত্বের মূল ধারণাটি হল নারীর তাকেই উপযুক্ত যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে, যে নারী এবং তার অপত্যকে খাবার, আশ্রয়, নিজস্ব ক্ষেত্র ও সুরক্ষার দিতে পারবে। যদি এই সম্পদগুলি অন্য কোনো নারী ও তার অপত্যের কাছে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে সেই পুরুষকে নারী বাছবে না। লক্ষ্য করা প্রয়োজন এই আলোচনার পরতে পরতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর গন্ধ রয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, যেমন কিছু রিসাস বানরের সমাজে পুরুষ সন্তান বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছলে গোষ্ঠী ছেড়ে সঙ্গী বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যত্র চলে যায়, সেই সমাজে মায়ের পদমর্যাদা অনুসারে সম্পদ প্রবাহিত হয়, তার জন্য মহিলাদের পুরুষসঙ্গীর উপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে না। তবু এই আলোচনা আজকের সমাজে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক কারণ এখনও যোনিচ্ছদ অটুট থাকার উপর অনেক মহিলার প্রজনন সম্ভাবনা ও স্বাস্থ্যকর বৈবাহিক জীবন নির্ভর করে থাকে। প্রসঙ্গত, গতবছর এক সাংসদের শিশুর জন্মপরিচয় নিয়েও জনসাধারণে যে আলোড়নের সৃষ্টি হল, তাও সন্দেহাতীতভাবে এই মডিউলেরই ব্যাপক প্রতিবর্ত-ক্রিয়া।
“সেই নারীর চেয়ে অধিক ঐশ্বর্যশালী আর কি আছে / যিনি সতীত্বের ন্যায় মহান শক্তিকে রক্ষা করতে পারেন?”
~থিরুভল্লুভর (‘তীরুকুরল’, চ্যাপ্টার ৬, [৩,০০০ BCE – ১,০০০ CE])
মনস্তত্ত্বের গেস্টল্ট মত অনুযায়ী কোনো দল বা গোষ্ঠীকে তখনই একক সত্তা হিসেবে চেনা যায়, যখন কোনো দলের সদস্যরা একসাথে চলাফেরা করে, হাসে-কাঁদে (common fate), একই ধরনের জামাকাপড় পরে, হাবভাব প্রকাশ করে (similarity), পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে থাকে (proximity), ও অন্য দলের সাথে স্পষ্ট দূরত্ব রেখে চলে (continuation with clear borders)। কোনো একটি দল হঠাৎ করে যখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মুখোমুখি হয়, তখন তারা নিজেদের মধ্যে একতা ও সংহতি বাড়ানোর জন্য এই সমস্ত নীতি অনুসরণ করে — নতুন প্রথা, লোকাচার, নৈতিক আদর্শ তৈরি করে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণার প্রচলন ও পালন করে, তাদের প্রতি ঘেন্না ও অবজ্ঞা তৈরি করে, দলকে ক্ষমতার শ্রেণীতে ভাগ করে এবং পুরনো ভেদাভেদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। হয়ত বিবর্তনের এই পর্যায়েই প্রাইমেটরা — authority / subversion ও loyalty / betrayal এর নৈতিক ভিত্তি মজবুত করে ফেলেছে।
“শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে ভিক্ষা করে খাওয়া সাধারণ ব্যপার, (…) এরা (রিসাস বানরেরা) যে সমাজে বাস করে সেখানকার উচ্চপদস্থরা অসহিষ্ণু। অধস্তনেরা সুরক্ষিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাশালীদের খাওয়ার পরিমাণ কেবল দেখে। এই প্রজাতিতে সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার অভ্যেস নেই। একইরকমভাবে ভিক্ষা ও ক্ষমতার এককেন্দ্রিকরণের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ঘটনাও নেই। (…) শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া দেখা যায়, রিসাস বানরের মধ্যে দেখা যায় না।”
~Frans De Waal (1996)
কোনো দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য হয়ে উঠতে গেলে যে বৈশিষ্ট্যগুলি গড়ে তুলতে হচ্ছে, তার জন্য প্রাণীজগতে ‘Proscriptive morality ’ তৈরি হতে দেখা যায়। দলের সাথে পরিবেশের ও অন্যান্য বিভিন্ন দলের নিয়মিত সংঘর্ষ যত বেড়েছে, দলের মধ্যে ভরসা ও বিশ্বাস তৈরির সুযোগ তত কমেছে, ফলে নিয়মসর্বস্বতা বেড়েছে এবং শাসক স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। নিয়ম না মানা হলে কঠিন শাস্তি। গ্রাহাম ও তার সহকর্মীরা MFT ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলছেন মানুষ বাদে অন্য প্রাইমেটদের বেশিরভাগের মধ্যেই নেতা হিসেবে যাদের দেখা যায়, তারা দলপতি কম, মাস্তানের ভূমিকা পালন করে বেশি।
“জিমো, বর্তমানে দলের আলফা পুরুষ (…) একবার ধরে ফেলেছিল তার প্রিয় মহিলার সাথে সোকো নামক এক কিশোর গোপনে যৌনতায় লিপ্ত। (…) সেই মহিলা জিমোর সাথে সেদিন কিছুতেই যৌন সংসর্গে রাজি হয়নি হয়ত সেই কারণেই (…) জিমো ধরার জন্য সোকোর পেছনে ধাওয়া করেছে, এবং সোকো আতঙ্কে চিৎকার করতে থেকেছে”
~Frans De Waal (1996)
এই ধরনের নৈতিক কাঠামোতে সামাজিক পরিচয় স্পষ্ট করতে যে কঠোর নিয়মাবলী চালু করা হবে, অবশ্যই তার প্রতি আনুগত্য সবথেকে বেশি গুরুত্ব পাবে, অন্যথায় নৈতিক হিংসাও (moral aggression – পুলিশ, সেনাবাহিনী) প্রয়োগ করা হতে পারে। এমন প্রতিটি আচরণ, যা দলের নির্ধারিত বিবাদের কেন্দ্রকে (“frontier”) অগ্রাহ্য করে, দলের নির্ধারিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে যায়, সেই আচরণকারীকে দল থেকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করা হতে পারে, এবং শাস্তি দেওয়া হতে পারে। সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে, যেখানে হিন্দু ধর্মের দেবদেবী সম্পর্কিত শৈল্পিক প্রকাশের প্রেক্ষিতে কৌতুকাভিনেতা ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘Chimpanzee Politics’ বইটিতে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে, যেখানে Puist নামের এক মহিলা শিম্পাঞ্জী ঝুঁকি নিয়ে তার পুরুষ বন্ধু Luit কে প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। পরে সেই প্রতিদ্বন্দ্বী Puist কে আক্রমণ করলে Luit কোনো সাহায্য করেনি। কোনোক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েই Puist রেগে Luit এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চিৎকার করতে থাকে ও মারামারি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আসলে নৈতিক হিংসা তো শুধুমাত্র রাষ্ট্রের হাতে নেই।
“কোনো ভদ্র মেয়ে রাত ৯টার সময় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না। ধর্ষণের জন্য একটা ছেলের তুলনায় মেয়েরা বেশি দায়ী।”- মুকেশ সিং (নির্ভয়া কান্ডের প্রধান আসামী; ‘India’s Daughter’)
নৈতিক ভিত্তিপ্রস্তর একবার স্থাপিত হলে, সেটিকে যতই বিলুপ্তির ঠেলার চেষ্টা হোক না কেন, তার ফসিল যতদিন ব্যক্তি বয়ে বেড়াবে, ততদিন সেই অক্ষের ভিত্তিতে নৈতিক আবেগ (এক্ষেত্রে রাগ) জন্ম নেবে ফলাফলস্বরূপ নৈতিক হিংসারও বিভিন্ন রূপ দেখা যাবে (দৃষ্টিভঙ্গি বিচার্য)।
চিকিৎসা ও মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতি চিরকাল আজকের মত ছিলনা (মানুষের মলমূত্র পরিষ্কার বাদে)। এইসমস্ত বর্জ্য থেকে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে যার সাথে মানিয়ে নিতে গিয়েই — Purity / degradation — এর নৈতিক ভিত্তির অবতারণা। এর দ্বিস্তরীয় বিরোধের মূলেই রয়েছে মানুষের শরীর ও শরীর সংক্রান্ত আচার। যে বর্জ্য থেকে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ হচ্ছে, যার ফলে জলজ্যান্ত মানুষ ও গর্ভস্থ ভ্রূণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তার বেশিরভাগই আসলে আসলে আসছে আমাদেরই শরীর থেকে। ফলে মাসিকের রক্ত — আঁতুড়ের রক্ত থেকে, যৌনমিলনের অসাবধানতায় মারণ রোগ ছড়াতে পারে, এমন ধারণার সাথে সাথে কার্য ও কারণ দুইই এসে স্থাপিত হচ্ছে এই শরীরেই। ফলে যাদের পক্ষে সম্ভব ছিল তারা শারীরবৃত্তীয় সমস্ত কাজের সাথেই এক অপবিত্রতার ব্যখ্যান জুড়ে দিতে পারলেন। কিছু মানুষ তখনও বাবুদের মল পরিষ্কার করে, পশুপাখির মল ঘাটে, শ্মশানে মড়া পোড়াতে গিয়ে মৃতদেহের ঘিলু-রক্ত-মূত্র-মল ঘাটতে হয়, দেশে মড়ক লাগলে মৃতদেহের মাংস খেতে বাধ্য হয় ইত্যাদি। ফলে সহজেই তাদের অপবিত্র বলে দাগিয়ে দেওয়া গেল। যেহেতু বেঁচে থাকতে নিজের শরীর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না, ফলে তৈরি হল শরীরকে পবিত্র করার বিভিন্ন ধর্ম ও লোকাচার (প্রায় এই একই পদ্ধতিতে এগোলো বছর দুয়েকের কোভিডবিধি পালন — এই শরীরই দোষী, এই শরীরই শিকার)। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচরণে পবিত্র জলের ব্যবহার (চরণামৃত) ও পাপ-পূণ্যের ধারণা। এক্ষেত্রে Ableism এর কথা না বললেই নয়। যেকোনো সমাজে সক্ষমতার মানদন্ডে শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গতা, বামনত্ব, অঙ্গবিকৃতি, ইত্যাদির শিকার মানুষদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে অক্ষম, অশূচি বলে। এদের জন্মের কারণ হিসেবে আলোচিত হয়েছে তাদের পূর্বসূরীদের ‘অপরাধমূলক যৌনাচার’ (আত্মরতি, সমকামিতা, অন্যের স্ত্রীর সাথে যৌনাচার, ইত্যাদি)। হাইট ও জোসেফের মতে পবিত্রতার মডিউল ট্রিগার হলে ঘেন্না তৈরি হয়, যা লিঙ্গ, শ্রেণী, জাতি ইত্যাদি বিভিন্ন বৈষম্যের বুনিয়াদী আবেগ (নারীর মাসিকের রক্তে ঘেন্না, নীচু জাত, কালো ও বাদামি গায়ের রঙকে নোংরা মনে করে ঘেন্না)। দলগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে যে ঘেন্না অপর দলের সাথে নিজের দলের স্পষ্ট সীমারেখা কেটে দিয়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কোনো সদস্যের সাথে নিজ দলের কারোর মিলনে সৃষ্ট অপত্য সেই বিভেদের ঘেন্না মাথায় অবাঞ্ছিত শান্তিচুক্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর যুগে যুগে যে ধরনের চারিত্রিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য সম্পদ আহরণ ও সুবিধাজনক বন্টনের ক্ষেত্রে উপযোগী বলে মনে করা হয়েছে, তার সাথে পবিত্রতার সংযোগ ঘটিয়ে প্রচার করা হয়েছে ব্যপকাকারে। ফলে একসময়ে কোনো এক গাঁয়ের পুকুরপাড়ে কোনো এক কুসুম যখন শরীরের কথা অকপটে বলে ওঠে, শশীডাক্তারের মতন লেখাপড়া জানা বিদেশ যেতে চাওয়া ভারতমাতার সুযোগ্য সন্তানের গায়ে তখন অপবিত্রতার ছিটে এসে পড়ে। সে তখন মনের পবিত্রতা খোঁজে।
আদিমতম সমাজের ক্ষেত্রে নিজের গোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক পরিসরের কথা মাথায় রেখে নৈতিক অক্ষ কেমন হতে পারে, তার অনুমান কিছুটা সরল। কিন্তু মাঝের প্রায় দশ হাজার বছরকালে পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকাই এত ভিন্ন মানে নিয়ে এগিয়েছে, যে শুধু সেটুকুই বিভিন্ন নৈতিক অক্ষের জন্ম দিয়েছে। তারপর সমাজে প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হয়েছে, নানাবিধ জীবিকা তৈরি হয়েছে, সম্পদ সঞ্চয় হয়েছে, তা ধরে রাখার বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হয়েছে। আবার সে সংক্রান্ত নীতিও গোষ্ঠীর তৎকালীন ভূগোল, আবহাওয়া, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, সমাজনীতি ও রাজনীতি অনুযায়ী পরিবর্তন হতে থেকেছে। আজ মানুষ জাতিগতভাবে প্রধানত মিশ্র। সেই মিশ্রণ জাতিগত নির্দিষ্টতা থেকে এতটাই দূরে চলে এসেছে যে তার আদিম জাতিগত পরিচয় কি, তা বহুস্তরে ঢেকে গেছে। জাতিগত পরিচয় যতই স্পষ্ট হোক, কোনো মানুষই তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবহীন একেকটি বুদবুদে বসবাস করেনা। ফলে অজান্তে হলেও পৃথিবী জুড়ে গত দশ হাজার বছরে যতরকমের নৈতিক অক্ষ তৈরি হয়ে থাকতে পারে, সেই সমস্তরকম অক্ষ আজকের মানুষের মধ্যে এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে মানুষ বা সমাজের পক্ষে তার নিজের নৈতিক অক্ষ নির্ধারণ এবং অপরের পক্ষে তার অনুমান, আর সরল নেই। সবচেয়ে বড় কথা নৈতিক অক্ষ নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রতিবার পলিবিন্যাসের সাথে সাথে যেমন পাললিক শিলায় একটি করে স্তর যোগ হয়, তেমনই প্রতিটি সামাজিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে মানুষের নৈতিক মেরুদন্ডে একটি করে হাড় যোগ হতে থাকছে। তবু, সামাজিক মনস্তত্ত্বের গবেষণা নৈতিক অক্ষের প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে। প্রাণীজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মানুষের মেরুদন্ড তো আর অস্থিনির্মিত হওয়ার কথা নয়, বরং নীতিনির্মিত হওয়ার কথা। অস্থি বেচারাকে তাও মাইক্রোস্কোপের নীচে দেখা যায়, নীতিকে দেখতে গিয়ে যাদের খামোখা রিসাস বানর, ডলফিন, মৌমাছি, থিরুভল্লুভর আর কত কি দেখতে হল, তাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। নীতির অস্থিও অক্ষত থাকুক, সাথে কলমের অস্থিও!
* বাংলা প্রবন্ধে ইংরাজী শব্দের আনাগোনা যদি পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে থাকে, তার জন্য কিছু দিকে নজর দেওয়া জরুরী। যেহেতু প্রবন্ধে আলোচিত প্রায় সমস্ত তত্ত্বই বিদেশী মনোবিদদের গবেষণার ফল, এবং মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার বিশাল অংশ জুড়ে আদপে রয়েছে সংস্কৃতি, তাই ভাষার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। কিছু শব্দ সেজন্য অনুবাদের চেষ্টা করিনি। Moral শব্দটির জন্য বাংলা শব্দভান্ডারে কতধরনের শব্দ রয়েছে তা সম্পর্কে প্রথমভাগে বিশদ আলোচনা রেখেছি। সেই প্রতিটি শব্দের উৎস, তার বহন প্রণালী ও বর্তমান পরিচয় ভাষাবিদ, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, ও মনোবিদদের আলোচনার বিষয়। সেই আলোচনা ব্যতিরেকে গুরুত্বপূর্ণ পারিভাষিক শব্দগুলির অনুবাদ করতে গেলে অনাবশ্যক তাড়া হয়ে যাবে।
**উদ্ধৃতি ও সংজ্ঞাগুলি লেখিকা দ্বারা অনুদিত
*****
তথ্যসূত্র :-
Barkow, J. H., Cosmides, L., & Tooby, J. (Eds.). (1995). The adapted mind: Evolutionary psychology and the generation of culture. Oxford University Press.
De Waal, F. B., & de Waal, F. (1996). Good natured: The origins of right and wrong in humans and other animals (No. 87). Harvard University Press.
Flack, J. C., & De Waal, F. B. (2000). ‘Any animal whatever’. Darwinian building blocks of morality in monkeys and apes. Journal of Consciousness Studies, 7(1-2), 1-29.
Gray, K., & Graham, J. (Eds.). (2019). Atlas of moral psychology. Guilford Publications.
Haidt, J., & Joseph, C. (2004). Intuitive ethics: How innately prepared intuitions generate culturally variable virtues. Daedalus, 133(4), 55-66.
Haidt, J., & Kesebir, S. (2010). Morality. In S. Fiske, D. Gilbert, & G. Lindzey (Eds.) Handbook of Social Psychology, 5th Edition. Hobeken, NJ: Wiley. Pp. 797-832.
Haidt, J. (2013). Moral psychology for the twenty-first century. Journal of Moral Education, 42(3), 281-297.
Hamlin, J. K., Wynn, K., & Bloom, P. (2007). Social evaluation by preverbal infants. Nature, 450(7169), 557-559.
Mason, M. E. (2018). The moral psychology of contempt. Rowman & Littlefield.
Niedenthal, P. M., & Ric, F. (2017). Psychology of emotion. Psychology Press.