প্রাক-কথন
“শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”
মন বলতে মগজ, মানসিক রোগ, পাগলামো, নিউরোসাইকিয়াট্রি, ডান্স থেরাপি, ইত্যাদি ভারী ভারী কথা পেরিয়ে মানিকবাবুর এই কথাটিতে এসে দাঁড়াতে খানিক সময় লাগে। অথচ অন্ধকারের উপস্থিতির অর্থ আলোর অভাব, এই সরল বিপরীতের যুক্তিতে ভর করে শরীর-মনের দ্বিত্বের চশমা দিয়েই মনকে জানা শুরু মানুষের। তবে আরো এক জটিল জিজ্ঞাসা লেখক এখানে মনের ভেতর দিয়ে এলিয়ে দিয়েছিলেন, যা নৈতিকতার প্রশ্ন। ন্যায়দন্ডের গুঁতোয় শরীর বাতিল হলো, মন পরল উৎকৃষ্টতার মুকুট।
মন, মনন, বা মানসিকতা প্রায় সভ্যতার আদিযুগ থেকেই মানুষের জীবনদর্শনের অন্যতম আলোচ্য বস্তু। শরীর-আত্মা, শরীর-মন — এই দ্বিত্বের চশমায় শরীর হল সেই বস্তুগত একক, মন যার অদৃশ্য চালিকাশক্তি। ভাবতে যতই বায়বীয় মনে হোক না কেন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতন পরিসরে একে নিয়ে আসতে হলে মনকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হয়। মনোবিদেরা বহুযুগ ধরে তাই করে চলেছেন। বিশেষ করে সমাজে নৈতিকতার মতন বিষয়কে যখন বৈজ্ঞানিক পরিসরে দেখার প্রয়োজন পড়ে, তখন প্রশ্ন ওঠে, কোন মাপকাঠিতে বিচার করা হবে? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমাজের গঠন ভিন্ন হওয়ায়, ভিন্ন পরিবেশের মানুষদের ধারণার পার্থক্যের ফলে সময়ে সময়ে মনের অস্তিত্ব বিচারের মাপকাঠি নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হয়েছে। বস্তুর ভর পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় এক হওয়াতে সমস্যা নেই, কিন্তু মনের ভর নির্ধারণ করাই ঝঞ্ঝাটের, তায় সর্বত্র তার ধ্রুবকত্ব প্রমাণ তো প্রায় অসম্ভব এক প্রচেষ্টা। এহেন একটি জিনিস যখন সামাজিক নিয়ামকের নিরিখে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়, তখন তাও কিছুটা স্বস্তি মেলে বটে, কিন্তু প্রশ্ন পরিবর্তন হয়না।
মাপার প্রশ্নটি বুনিয়াদী স্তরের প্রশ্ন। মাপতে গেলে প্রথমেই জানতে হচ্ছে কি মাপতে হবে, কোন পদ্ধতিতে মাপতে হবে, কোন একক, আর কোন যন্ত্রের মাধ্যমে মাপতে হবে। কিন্তু প্রথম প্রশ্নেই এসে ধাক্কা খেতে হচ্ছে। মনের এমন কোন বস্তুত্ব আছে, যাকে যন্ত্রের মাধ্যমে মাপা সম্ভব? এই পর্যন্ত এসেই বিরতি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই বুনিয়াদী স্তরের প্রশ্নগুলির একপ্রকার উত্তর তৈরি করে তবেই মনোবিদ্যার যাত্রা শুরু হয়েছে। যেহেতু মন, soul অথবা psyche নামক বস্তুটি পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রামাণ্য একক বস্তু নয়, সেক্ষেত্রে নৈতিকতাও তেমন নয়, তাই আপাত দৃষ্টিতে এর বিভিন্ন প্রকাশকে — ব্যবহার, আচরণ, ও প্রভাবকে প্রামাণ্য ধরে তার পরিমাপের মাধ্যমেই মনের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হয় — অন্ধের হস্তিদর্শন!
নৈতিকতা কি?
“নৈতিকতার প্রশ্ন আসলে হর্ষ ও বিষাদের প্রশ্ন। এই কারণেই আমরা একটা পাথরের প্রতি নীতিসম্মত আচরণ করতে দায়বদ্ধ নই। যখন আমাদের আচরণ অপরদের ভালো বা খারাপভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে, নৈতিকতার প্রশ্ন তখনই প্রযুক্ত হয়।”
– Sam Harris (2006; Letters to A Christian Nation থেকে লেখিকার দ্বারা অনুদিত)
প্রায় প্রতিটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিই ‘গো’-এষণার শুরুর দিকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের পাশাপাশি তৎকালীন দর্শন ও সাহিত্য থেকে কাঠামো আমদানী করে। দড়ির ধারণা ছিল বলেই সেই বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা গেল, যা পরে হাতির লেজ বলে জানা যাবে। এক্ষেত্রে দড়ি সমাজে এবং রাষ্ট্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। যুগ যুগ ধরে সাহিত্য ও দর্শনের আলোচনায় নিয়মনীতির আলোচনা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু চেতনার চর্চা পরীক্ষাগারে আসার কয়েক দশকের মধ্যেই মনোবিদেরা এক গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন — সহজাত প্রবৃত্তি ও নৈতিক মানদন্ড মানুষের মন ও আচরণের উপরে কিভাবে এবং কতটা গভীর প্রভাব ফেলেছে। মানুষের যে নিত্য ব্যবহার, তা কি জন্মগত? নাকি এই ব্যবহার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে তৈরি হয়? যদি একটি ক্লাসরুমের ৪০ জনের মধ্যে ৩৫ জন শিক্ষিকার উপস্থিতিতে চুপচাপ থাকে বাকিরা নয়, তাহলে কি এই ৩৫ জনের ব্যবহার সহজাত প্রবৃত্তিগত ব্যবহার, ও বাকি ৫ জনের ব্যবহার অস্বাভাবিক? নাকি এই ৫ জন আসলে মানুষের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিকেই অনুসরণ করছে, আর বাকি ৩৫ জনের ব্যবহার আসলে ক্লাসরুমের নিয়মনীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার ফলে তৈরি হয়েছে? কোন ব্যবহারকে কিভাবে দেখলে মানুষের মন ধরা পড়বে পরীক্ষাগারে? কার প্রভাব পড়েছে কিভাবে বোঝা যাবে? এই দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি আমরা সমসাময়িক বিভিন্ন তত্ত্বে দেখতে পাই (যেমন, ফ্রয়েডের বিখ্যাত তত্ত্বে ইদ ও সুপারইগোর দ্বন্দ্ব)। প্রথম সামাজিক মনোবিদ হিসেবে বিংশ শতকের শুরুতেই যিনি উঠে এলেন, তার কথায় স্পষ্টভাবে উঠে এল এই দ্বন্দ্বের আলোচনা,
“সামাজিক মনোবিদ্যার বুনিয়াদী সমস্যা হল ব্যক্তি যে সমাজে জন্মেছে, সেই সমাজের তাকে নৈতিকতার পথে নিয়ে আসা, যেখানে ব্যক্তির নিজের স্বার্থকেন্দ্রিক ও নৈতিকতার সাথে সম্পর্কবিহীন প্রবণতা তার পরার্থকেন্দ্রিক প্রবণতাগুলির তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী”
— উইলিয়াম ম্যাকডুগল (১৯০৮; লেখিকা দ্বারা অনুদিত)
একদিকে ঝুঁকে হলেও ম্যাকডুগাল নৈতিকতার আলোচনাকে সামাজিক মনোবিদ্যার আলোচনার প্রধান দিক হিসেবে গণ্য করলেন। যার মাধ্যমে এই দ্বন্দ্ব থেকেই মনোবিদ্যার পরিসরে নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে, যার বেশিরভাগই আসলে গ্রীক চিন্তাবিদদের ধারণার সুদূরপ্রসারী ফসল। কিন্তু সমাজে নৈতিকতার ইতিহাস যে আরও পুরোনো, তা বলার অবকাশ রাখেনা। মানুষের দলবদ্ধ জীবনযাপনের শুরুর সময় থেকেই নৈতিকতা তার চর্চার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে এবং কমন এরার বহুযুগ আগেই তা লিখিত জ্ঞানের আওতায় চলে এসেছে। এই লিখিত পরিসর থেকেই যখন উপাদান সংগ্রহ করে এই শাখায় আলোচনা শুরু হয়েছে, দেখা যাক আমরাও সেই লিখিত পরিসরের শব্দ থেকেই আলোচনায় এগোতে পারি কিনা।
নীতি, কর্তব্য ও অন্যান্য
‘নৈতিক মনোবিদ্যা’ — শাখাটির নামের দিকে তাকালেই আমরা প্রথম যে শব্দটি পাই — ‘নৈতিক’, অভিধান সেই নৈতিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে — ‘শ্রেয়োনীতিক’, ‘ধার্মিক’, ‘সচ্চরিত্র’ ইত্যাদি বিশেষণের সাহায্যে। বিশেষণগুলির দিকে আরও খানিকক্ষণ দেখলে খুব সাধারণ কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে। ‘শ্রেয়’? কে বা কারা শ্রেয়, কার তুলনায় শ্রেয়? মহাভারত বলছে যা দ্বারা ধনপ্রাপ্তি ঘটে তাই ধর্ম। যদি তাই হয়, তবে যিনি তার নিজের জীবিকার প্রতি মননশীল, তিনি ধার্মিক অর্থাৎ একাধারে নৈতিকও। আরও গোলমাল বাঁধে — ‘সচ্চরিত্র’ -র কাছে এসে। ‘সৎ’+‘চরিত্র’ মানুষটি কে? যার সত্তা রয়েছে, নাকি যে অধমের ঘোষিত বিপরীত? তাহলে এই উত্তমটি কে, আর অধমটিই বা কে? বিশেষণ তো চিরকাল বিশেষণ ছিল না, তার গায়ে ক্রিয়ার ছাপ থেকে যায়, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব বা উত্তম-অধমের ধারণা ক্রিয়ার বদলে ক্রিয়ার মাত্রার কাছে নিয়ে যায়, যার মাপকাঠি আর কেবলমাত্র শব্দটি থেকে অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। নীতি — শব্দটির ব্যখ্যা আবার আমাদের আরেকটু বড় পরিসরে এনে দাঁড় করায়। ন্যায়-অন্যায়, কর্তব্য-অকর্তব্য বিচার ও নির্ধারণের উপায় হল নীতি, অর্থাৎ কিছু সূত্র যা আমাদের সহজেই কর্তব্য-অকর্তব্য, ন্যায়-অন্যায় বিচারে কাজে লাগবে। এই সূত্রগুলি — কিছু উপদেশ বা জ্ঞান হতে পারে, প্রণালী বা পদ্ধতি হতে পারে, প্রথা হতে পারে, এবং নির্দিষ্ট দক্ষতা বা বিদ্যা হতে পারে যা দস্তুরমত শিক্ষা করার প্রয়োজন। এই সূত্রগুলির উদ্দেশ্য সমাজের হিত বিধান করা। তাহলে এই কর্তব্য-অকর্তব্য বিচারেরও লক্ষ্য সেই একই — সমাজের হিতবিধান। কিন্তু প্রশ্ন তার পরেও থেকে যায়, সমাজের হিতবিধানের নির্ধারক কি, কে, বা কারা?
‘Moral’ Psychology
মরাল সাইকোলজির — Moral -র ইতিহাসও খুব আলাদা নয়। Moral – শব্দটির প্রাচীন ফরাসিতে ব্যবহার শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, কিন্তু এটি সিসেরো, ৪৪ BCE তে অ্যারিস্টটলের রচনা থেকে ethikos — অনুবাদ করতে গিয়ে প্রথম ব্যবহার করেন। অ্যারিস্টটলের ethikos শব্দটির উৎস ethos, যার অর্থ আচরণগত চরিত্র এবং স্বভাব। অ্যারিস্টটলের মতবাদ মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিক দর্শনের কথা বলে। যেখানে মানুষের ব্যবহার, অভ্যেস ও চরিত্রের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে নৈতিকতার প্রসঙ্গ। ইউডেমোনিয়া, যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় — মানব জীবনের উন্নতি, সুখ ও সমৃদ্ধি, তাকে মানবজীবনের আদর্শ স্তর হিসেবে গণ্য করে তা প্রাপ্তির জন্য কিছু সূত্র ও উপকরণের কথা বলেছিলেন অ্যারিস্টটল। তার বক্তব্য ছিল সদ্গুণের চর্চাই এই ইউডেমোনিয়া প্রাপ্তির মূল উপকরণ (যদিও তিনি বিত্ত, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ইত্যাদিকেও অন্যতম উপকরণ হিসেবে ধরেছিলেন)। আবার স্টোইসিজমের ধারণা অনুযায়ী সদ্গুণের চর্চাই এই ইউডেমোনিয়া প্রাপ্তির একমাত্র উপকরণ, বাকি সবরকম বস্তুভিত্তিক বিষয় থেকেই নিজেকে সরিয়ে আনা প্রয়োজন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এখানে প্রশ্ন ছিল, — নৈতিক হওয়ার জন্য আমার কেমন হয়ে ওঠা উচিৎ? (How should I be?) যে প্রশ্ন কয়েক শতকের মধ্যে বিবর্তিত হয়ে দাঁড়াল — আমার নৈতিক হয়ে ওঠার জন্য কি কি করণীয়? (What should I do?) এই অবস্থান থেকে Moral – শব্দটির আগমন। শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ — mos থেকে, যা — প্রথা, আচার-আচরণ, ব্যবহার, অভ্যেস, এবং কখনও কখনও ভাব, স্বভাব বা প্রকৃতিকেও নির্দেশ করে। অর্থাৎ নৈতিকতার আলোচনায় সে যুগের দার্শনিকেরা সামাজিক কাঠামোর প্রথা ইত্যাদির পাশাপাশি, ব্যক্তিবিশেষের স্বভাব, আচরণ, ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই moral থেকেই আঠারোশ’ শতকে morale শব্দটি উঠে এসেছে, যার সাথে দলগত মনোবল, নিষ্ঠা, উদ্যম, ইত্যাদির ধারণা ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। Morality শব্দটির অর্থ হিসেবে ‘জিতেন্দ্রিতা’, ইঙ্গিত করে ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের প্রতি। আবার এই ইন্দ্রিয়ের ধারণা আমাদের ফেরত নিয়ে যায় সহজাত প্রবৃত্তির আলোচনায়, যাকে নিয়ন্ত্রণের ভার ন্যস্ত থাকছে নৈতিকতার উপর।
এই অবধি আলোচনার পর প্রশ্ন ওঠে — সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ছে কেন? উত্তরের কাছে পৌঁছতে হলে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে অনেকগুলো বছর পেছনে যেতে হবে। আত্মরক্ষা দল গঠন করার জন্য যথেষ্ট কারণ হলেও, দীর্ঘস্থায়ী দলবদ্ধতার জন্য কেবলমাত্র ওই একটি উদ্দেশ্য যথেষ্ট হয়নি। শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ও অন্যান্য প্রতিকূলতা মানুষকে দলবদ্ধ হয়ে থাকতে বাধ্য করেছে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দলে আন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অথচ বিবর্তনের ইতিহাসে মানবশরীরের দুর্বলতা চোখে পড়ার মত। এই দুর্বলতার দরুন মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে চিরকাল। দলবদ্ধ জীবনে মানুষ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রকৃতির পাশাপাশি অন্যান্য জাতি ও প্রজাতির প্রাণীদের সাথে প্রতিযোগিতার সুযোগ পেয়েছিল, যা তার প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। দলবদ্ধ জীব হিসেবে লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পরিণাম দলের সদস্যদের প্রাণের আশঙ্কা, খাদ্যাভাব, ইত্যাদি। দলের ক্ষতির অর্থ দলের সদস্যদের ক্ষতি। দলের সদস্যদের আন্তঃসম্পর্ক ও পরস্পর সংযোগ (Group Cohesion) যত ভালো হয়, ততই দলের মধ্যে বোঝাপড়া সহজ হয়, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ে, ততই দল হিসেবে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রফেসর হাইট (২০১২) বলছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব যে শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে খাটে এমন নয়। দলগত স্তরেও প্রতিযোগিতা চলে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে। দল হিসেবে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা, বিভিন্ন পর্যায়ে দলের এবং দলের সদস্যদের প্রাকৃতিক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয় যার ফলে মানুষের দলবদ্ধ আচরণের প্রবণতা reinforced হয় ও এই আচরণের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে আত্মরক্ষার তুলনায় দল, জাতি, বা পরিবারের সুরক্ষা মানুষের কাছে অনেক বেশি লাভদায়ক হয়ে ওঠে।
কিন্তু বিবর্তনের প্রবাহ তো একরৈখিক নয়। সভ্যতার সিঁড়ি চড়ার অন্যতম দিক ছিল সম্পদ আহরণ। গ্রুপ কোহেশনের ধারণায় মানুষের কৌমের গঠনের সাথে মৌমাছি বা পিঁপড়ের দলবদ্ধতার কিছু বুনিয়াদী পার্থক্য ছিল। সম্পদ দলবদ্ধ প্রচেষ্টায় অর্জন করলেও মৌমাছিদের মতন দলের মানুষেরা একই রানীর বা একই যুগলের সন্তান ছিল না, ফলে জন্ম অনুযায়ী উপদলে বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। ফলে যে সম্পদ দলগত সম্পদ, তা মুখ্যত দলের হলেও, তার মধ্যে আরও বিভাজনের সম্ভাবনা ছিল। যদি ব্যক্তিগত সুরক্ষাকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলির মূল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে দলগত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের চেষ্টাও ঘটছে। এই ধরনের সদস্যদের প্রফেসর হাইট — free rider নামে চিহ্নিত করেছেন। ফ্রি রাইডার (সম্পদ আহরণে যথেষ্ট ভূমিকা না থাকা সত্ত্বেও সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা নেওয়া) প্রকৃতির সদস্যদের কাছে ব্যক্তিগত স্তরের প্রাকৃতিক নির্বাচন দলগত স্তরের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু সম্পদ যথেষ্ট পরিমাণ জমা হতে থাকলে, ব্যক্তিগত স্তরে নির্বাচনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে, ফলে দলে ফ্রি রাইডারদের সংখ্যা বাড়ে এবং সহযোগী সদস্যদের সংখ্যা কমতে থাকে। তখনও মানুষ কৌম পরিসরেই থাকার ফলে, বিভাজনের অর্থ ছিল সরাসরি দলের সকলের বিপদের আশঙ্কা। ফলে দলের পক্ষে এই — Free-rider Problem এর সমাধান করতে না পারলে দলের অভ্যন্তরে সহযোগিতার মাত্রা কমে এবং দলগত প্রাকৃতিক নির্বাচনের স্তরে গিয়ে দলটির অবলুপ্তির আশঙ্কা থেকে যায়। মানব সমাজের বিবর্তনের এই ধাপেই প্রয়োজন হয়েছিল সহাবস্থানের কিছু নিয়মনীতি প্রণয়ন করার। দল গঠন ও বজায় রাখার জন্য সদস্যদের একটি সাধারণ উদ্দেশ্য অথবা নিয়মাবলী থাকা প্রয়োজন, যাকে ঘিরে দলের সকল মানুষের আচার-আচরণ পরিচালিত (নিয়ন্ত্রিত) হতে পারে। সেই কারণেই মনোবিদ জনাথন হাইটের কথা অনুসারে বলা যেতে পারে, “মানুষ লিখতে শেখার পরপরই নৈতিকতা, আইন ও ধর্ম নিয়ে লিখেছে”।
গভীর জঙ্গলের কোন একটি অংশের মাটি খুঁড়লে আমরা প্রচুর শিকড় পাই, কিন্তু সেই শিকড়গুলির দিকে কেবল তাকিয়েই বলা সম্ভব হয়না, কোন শিকড়টি কোন গাছের। মাটি থেকে যেমন গাছ পুষ্টিরস নেয়, তেমন প্রচুর রাসায়নিক ফেরতও দেয়। কেবল সেই অংশের মাটির দিকে তাকিয়েও বলা সম্ভব না কোন গাছের অবদানে পাশের কোন গাছ স্বাস্থ্যবতী অথবা ফলবতী হল। দলের বিবর্তনের ইতিহাসও তেমনই লাখ লাখ বিষয়ের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে তৈরি হয়েছে। ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় তার নিজস্ব অতীত, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, ইত্যাদি থেকে অর্জিত জ্ঞানের সাথে জুড়তে থাকে দলের অন্যদের ইতিহাস, যেকোনো সময়ের ও নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে দলের সামগ্রিক চলন, সামাজিক স্তরে ব্যক্তিদের প্রত্যেকের সাথে সামগ্রিকভাবে দলের এবং ব্যক্তিদের আন্তঃসম্পর্ক, এই সমস্ত কিছু। তারও পরে যুক্ত হয় দলের বাইরের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, যা আসলে সেই দর্শকের দলের সংস্কৃতির ফলস্বরূপ তৈরি হয়েছে অথচ প্রভাবিত করতে পারে উদ্দিষ্ট দলের অভিযোজনকে। এই বিস্তীর্ণ পথের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের কাছে নৈতিকতার অবস্থানও একই সাথে অভিযোজিত ও পরিবর্তিত হতে থেকেছে। এখনও পর্যন্ত মানবসভ্যতার যে ইতিহাস লিখিত হয়েছে, সেই ইতিহাসের প্রায় ৯০ শতাংশই অধিকার করে থেকেছে নির্দিষ্ট সভ্যতা, ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, তাদের বিস্তার ও পতন। এই প্রতিটি সময়ের সাহিত্য, ও প্রামাণ্য দলিলপত্র সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার ও শাসন পদ্ধতির চিহ্ন বহন করছে। শাসিতকে না জানলে শাসনের যে অসুবিধে, কখনও কখনও তা নিজেকে চেনার চেয়েও বড় দায়, যা এড়ানো অসম্ভব। প্রতিটি রাজশক্তিকে তাই তার প্রজাকে জানতে হয়েছে। কৌম পরিসরে দলবদ্ধ হয়ে থাকা প্রজার মনকে (ব্যবহারকে) সে বুঝতে চেয়েছে তার কৌমের রীতিনীতির মাধ্যমে। শাসকের মগজ যখন কৌমের (বা গোষ্ঠীর) বাইরে থেকে কৌমকে বোঝার চেষ্টা করেছে, তখন এই রীতিনীতিই তাদের কাছে সেই কৌমের চরিত্রের পরিচায়ক হয়ে থেকেছে। এইখানেই এসে আমাদের এষণার লক্ষ্যবস্তু খানিক বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, কারণ কৌমের বিকাশ পৃথিবীর একেক প্রান্তে একেকরকম। মূল ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের ফলস্বরূপ খাদ্য-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-জীবিকাগত পার্থক্যের মধ্য দিয়ে যেমন যেমন বিভিন্ন কৌমের বহুবিধ বিকাশ হয়েছে, তা তেমনই বহুবিধ রূপে রীতিনীতি হিসেবে সংযোজিত হয়ে থেকেছে কৌম পরিসরে। এই রীতিনীতি জ্ঞান হিসেবে মার্জিত ও পরিশীলিত হয়ে কখনও এসে ঢুকেছে অভিজাত সম্প্রদায়ের শিক্ষার পরিসরে, কখনও যুদ্ধের প্রস্তুতিক্ষেত্রে, কখনও শাসনপদ্ধতিতে, ফলে নিজের দলের সহজতর পরিচালনার কাজ থেকে শুরু হয়ে, নিয়মনীতির যাত্রাপথ এসে ঠেকেছে রাষ্ট্রনীতি আলোচনার পরিসরে।
তবে Moral – শব্দটির বিস্তার শুধুমাত্র চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে, চিন্তাবিদদের পক্ষে সংগত কারণেই শুধুমাত্র নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করেই থেমে যাওয়া সম্ভব হয়নি, এমনকি আইন প্রণয়নও এই কাজে যথেষ্ট ছিল না। গোষ্ঠীর পর্যায়ের বিবর্তনের শিক্ষা নতুন সমাজের ক্ষেত্রে সব সময় আদর্শ ছিল না। তবে আদর্শ নাগরিক গড়ে উঠবে কেমন করে? আদর্শ নাগরিকের গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করা। শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের আদিম ধারাগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা গল্পকথা। এই গল্পকথা কখনও যাত্রা, নাচ ও নাট্যরূপে, কখনও নীতিকথামূলক গল্প হিসেবে মানুষের কাছে এসে পৌঁছেছে। Moral শব্দটি সেই নীতিকথার চিহ্নও বহন করছে।
ন্যায়
ন্যায় — শব্দটির আলোচনা ব্যতীত নৈতিকতার আলোচনা অসম্পূর্ণ। প্রধানত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই এই শব্দটি সমাজে নৈতিকতার একটি কাঠামো তৈরি করে যেটি অনেকাংশে শাসকের নৈতিকতার কাঠামোর উপরে নির্ভর করতে পারে। যতদিন শাসক নিজেও কৌমের অংশ ছিলেন, ততদিন প্রথার আশ্রয় নেওয়া গেছে, কৌম পরিসরের প্রথা ভাঙলে হয়ত ‘গাওবাহার’ হতে পারত, কিন্তু সাম্রাজ্যের অন্তর্গত নিয়মগুলিকে কৌমের নিয়মের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে হল। সবক্ষেত্রে যে শাসকের নিয়মই খাটল, এমনও নয়। প্রভাব ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীগুলি নবগঠিত রাষ্ট্রের পরিসরে কখনও কখনও তাদের নিজস্ব নীতিকাঠামো বজায় রাখতে সক্ষম হলেন। নবগঠিত সাম্রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক খুলতে শুরু করল, জাতির সংমিশ্রণ ঘটায় প্রজা তৈরি হতে থাকল যাদের আনুগত্য আর নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠীর তুলনায় রাষ্ট্রের শাসকের প্রতি তৈরি হল, এক গোষ্ঠীর উপর আরেক গোষ্ঠীর নিয়ম চাপল, জাতির মিশ্রণে নতুন প্রথা তৈরি হল, রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব ভারসাম্য বজায় রাখতে নতুন নিয়ম তৈরি করতে হল। যাপন আর জীবনের দূরত্ব যত বাড়ল, গলায় ফাঁস ততই আঁটো হল। ফলে রাষ্ট্রে অন্যায় করলে শাস্তি প্রাপ্য। বিভিন্ন গল্পকথায়, ভগবান, রাজা ও ব্রাহ্মণকে শাস্তি দিয়েও দেখিয়ে দেওয়া হল (শাসককে শাস্তি দেন ঈশ্বর; ঈশ্বর কষ্ট পেয়ে দেখিয়ে দেন কেউই এই নিয়মের বাইরে নেই), এই ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা কারোর জন্যই পরিবর্তনশীল নয়। সেটা আঙুল কেটে নেওয়া, পাথর খাওয়া, চোখ খুবলে নেওয়া থেকে মৃত্যুদন্ড অবধি হতে পারে।
এই ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা বর্তমান সমাজে এতটাই বদ্ধমূল, যে নৈতিকতার প্রশ্নে সর্বপ্রথম আমরা ন্যায়ের ধারণাকেই দড়ি হিসেবে ধরে চিন্তা শুরু করি। পঞ্চাশের দশকে নৈতিকতার হাতিকে প্রথম যিনি পরীক্ষাগারে নিয়ে উপস্থিত করলেন, সেই আমেরিকান মনোবিদ ও শিক্ষাবিদ লরেন্স কোলবার্গ ন্যায় বা justice এর ধারণাকেই লক্ষ্যবস্তু করলেন। শিশু ও কিশোর বয়সীদের কাছে তিনি একটি নৈতিক দ্বন্দ্ব রাখলেন (moral dilemma ; “should Heinz steal the drug?“), যেখানে তাদের কাজ হলো, নীতিবিষয়ক যুক্তির সাহায্যে দ্বন্দ্বের সমাধানে পৌঁছনো। মনোবিদ্যার চর্চার পরিসরে দীর্ঘকাল যাবৎ নৈতিকতার আলোচনার মুখ্যবস্তুই ছিল তার এই গবেষণা।
হৃদয়, না মগজ — কে দায়ী?
আজ একবিংশ শতকে বসে সামাজিক মনোবিদ্যার শাখা হিসেবে নৈতিকতার আলোচনা যখন শুরু হয়, তখন ছাত্রছাত্রীরা লরেন্স কোলবার্গের গবেষণার মধ্য দিয়েই শুরু করেন। তার গবেষণা নৈতিকতার চিন্তাগত দিকটিকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তারও অনেক আগে সামাজিক মনোবিদ্যার প্রথম টেক্সটবই লিখেছিলেন উইলিয়াম ম্যাকডুগাল যেখানে নৈতিকতার বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়। উনবিংশ শতকের শেষভাগে ইউরোপে ‘ভদ্রলোক’ এর চরিত্র সংক্রান্ত যা যা ধারণা প্রচলিত ছিল, সেই ধারণাগুলির সাথে তিনি আবেগ ও আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের বিরোধ লক্ষ্য করছিলেন। যেখানে স্টোইসিজমের মত — “the wise and good man should seek to eradicate the emotions from his bosom” , কান্টের মতে, ”the wise and good man, should be free from desire” (উইলিয়াম ম্যাকডুগল, ১৯০৮)। এই ধারণাগুলি থেকে দুটো জিনিস লক্ষ্য করবার মত। প্রথমটি হল আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে নৈতিক ছাঁকনির প্রয়োগ। হৃদয় বলতে প্রচলিত ধারণায় আমরা বুঝি আবেগ ও তার প্রকাশ, কিন্তু এক্ষেত্রে নৈতিকতার দরুন সেই হৃদয় থেকেই আবেগকে ঝেড়ে ফেলার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হল মানুষের চরিত্রের সাথে তার নৈতিকতার (বা নৈতিক সিদ্ধান্তের) একীকরণ। মানুষের কার্যকলাপের সাথে চরিত্রের সরাসরি সম্পর্ক থাকছে না, বরং মানুষের ক্রিয়াকে, তার আবেগকে, সেই মানুষের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, অনুষঙ্গ, উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে দেখে তাকে ভালো বা খারাপ চরিত্রের লেবেল দেওয়া হচ্ছে। চরিত্রের এই নৈতিক ছাঁকনি ও তার মান্যতা কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়ার বস্তু নয়, কারণ এর উপরেই নির্ভর করবে সমাজে সেই ব্যক্তির সম্মান, ও স্বচ্ছলতা। ফলে এর শিকড় গভীরে হতে বাধ্য।
১৮৯০ তে উইলহেল্ম উন্ডট — “affective primacy” (ঘটনার সময়সরণী অনুযায়ী যে ঘটনাটির আগে ঘটছে তাকে চিহ্নিত করা হয় প্রাইমেসি শব্দটির মাধ্যমে; অ্যাফেক্ট শব্দ দিয়ে ক্ষণস্থায়ী আবেগকে চিহ্নিত করা হয়) বলে যা চিহ্নিত করলেন, তা আশির দশকের ‘Affective Revolution’ এর সময় থেকে তা আবার আলোচনার মধ্যমণি হয়ে ফিরে এলো। নৈতিকতার বিবর্তনগত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই affective primacy ই নৈতিকতার প্রধান উপকরণ, যার কিছু প্রাথমিক রূপ আজ থেকে প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর আগেই (শিম্পাঞ্জি ও বনোবোর ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়) মানুষের পূর্বপুরুষদের মধ্যে স্থায়ী (ও সক্রিয়) হয়ে গিয়েছিল। তারই বিবর্তিত রূপ আজ আমরা মানুষের মধ্যে দেখতে পাই। প্রফেসর হাইট তার গবেষণায় কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রচলিত গঠন অনুযায়ী অনৈতিক কিছু বক্তব্যের (“Slap your father on the face”) মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। তাদের প্রতিক্রিয়ায় নৈতিক অভিজ্ঞতার একটি ক্রম তিনি লক্ষ্য করলেন। বক্তব্যগুলির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল একটি — স্নায়বিক ‘flash reaction’ যা কেবল পছন্দ ও অপছন্দের সাদাকালো পার্থক্য নির্দেশ করে দিচ্ছে। এরপর ব্যক্তি তার সেই পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী চিন্তা ও যুক্তির মাধ্যমে নিজের উত্তর সাজাচ্ছেন, ও ব্যখ্যা করছেন (প্রফেসর হাইটের – Social Intuitionist Model এর প্রথম ধাপ, যেখানে তিনি affective primacy কে intuitive primacy বলছেন)। এমনকি, ব্রেইন স্টাডিজও বলছে নৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনর জন্য মস্তিষ্কের যে অংশ কাজ করে (অনুবাদ – নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মস্তিষ্কের যে অংশে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়), সেই — ventromedial prefrontal cortex ই সামাজিক ব্যবহার নির্ধারণেও কাজ করে, এবং amygdala নামক অংশটির প্রতিক্রিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। এই অ্যামিগডালার মূল কাজ আবার ঘটনা বা স্মৃতিকে আবেগগত বিভাগে ভাগ করা (মূলত – ভয় ও রাগবিষয়ক), reward processing বা পুরষ্কার ও তদসংক্রান্ত ধারণা প্রস্তুত করা। এই সমস্ত তথ্যকে পাশাপাশি রাখলে মনে হয় হৃদয় ও মগজ তাহলে একসাথে কাজ করে তবেই নৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছয়।
নীতিশিক্ষা বড় শিক্ষা
আজকের সামাজিক ব্যবহার এমনকি নিজের সাথে ব্যবহারও এত গভীরভাবে নৈতিকরসে সম্পৃক্ত, যে স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহার আর নৈতিক ব্যবহার, চরিত্র আর সুচরিত্রের অর্থের মধ্যে আর আমরা পার্থক্য নিরূপণ করতে পারিনা। মানুষের সমাজ, বিবর্তনের ইতিহাস, ও অপরাধের ধারণা ইত্যাদির পরিসর থেকে যে জ্ঞান উঠেছে, তা এতই সুচারুভাবে শিক্ষার পরিসরে এসে নাগরিক আদর্শকে প্রভাবিত করেছে, যে একজন ব্যক্তি যখন তার যৌনপরিচয়ের স্বাধীন প্রকাশের স্বীকৃতি দাবী করছেন, ও প্রশ্ন করছেন তার শয্যাসঙ্গী কে হবে তাতে রাষ্ট্রের বা সমাজের কোন হস্তক্ষেপ কিভাবে চলতে পারে, তখন আমরা সমাজ হিসেবে এই ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা একীকৃত অথচ বহুমুখী নৈতিক স্তরগুলি আলাদা করে আর চিহ্নিত করে উঠতে পারছিনা। একেকজন একেকটি স্তরের খাতিরে flash reaction দিচ্ছি, অথচ তার সামগ্রিক ছবিটা কিছুতেই আমাদের চোখে পরিষ্কার হচ্ছে না।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনার পাশাপাশি যে বিষয়গুলির উপরে জোর দেওয়া থাকে, তার অন্যতম মূল স্তর হল আদর্শ ব্যবহারের সূত্র (নৈতিক ব্যবহার; আদর্শ ছাত্রছাত্রী কেমন হবে)। নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা, আদর্শ আচরণের শিক্ষা শিক্ষকদের শ্রমনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে তা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়। রাজা ও সম্রাটদের শাসনকালে শাসকশ্রেণীর শিক্ষার অন্যতম অংশ ছিল নীতিশাস্ত্রের শিক্ষা। মুদ্রা ও বিনিময়ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মানুষের চরিত্র ও সম্ভোগ, সমস্ত ক্ষেত্রের কিছু আচরণের রীতিনীতি রচিত ও বিস্তৃত হয়েছিল। তার পাশাপাশি পালাগান, যাত্রা, নাটক, ছড়া, গল্পগাথা, ইত্যাদির মাধ্যমে জনের মাঝে ছড়িয়েছে চরিত্রের আদর্শ। উপাসনাস্থলগুলিতে পৌরহিত্য করেছেন যারা, তাদের উপদেশে থেকে গেছে নৈতিকতার ও আদর্শ আচরণের বটিকা। মহিলা ও পুরুষের ভূমিকার পার্থক্যের কথা, তাদের ভিন্ন আদর্শের কথা, চাষীর গৃহস্থালি কেমন হলে ফসল ফলবে, কেমন হলে ফলবেনা, নারী কেমন হলে সন্তান হবে, কেমন হলে হবেনা, ইত্যাদি কত-না চরিত্রাবয়ব শিক্ষা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, নগরে, পৌঁছেছে রাজসভা থেকে গৃহস্থের পাকশালায়, বিছানায়। প্রাচীন এই নৈতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের আচরণ। কিন্তু তার বাইরেও কিছু কিছু সূত্র এখনও গোদা করে লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়। ফুল পঞ্জিকার ‘টিকটিকি পতনের ফলাফল’ ও অর্শ-ফিসচুলার ওষুধের প্রতিবেদনের পাশেই হয়ত পাওয়া যাবে বেশ কিছু বিধিনিষেধের তালিকা — মঙ্গলবারে দাড়ি কামালে ‘আয়ুক্ষয়’, রবিবারে করলে ‘ধনহানি’, প্রতিপদে কুমড়ো-তৃতীয়াতে পটল-অষ্টমীতে নারকেল খাওয়া বারণ, অষ্টমী-চতুর্দশী-অমাবস্যা-পূর্ণিমা-সংক্রান্তি এই পঞ্চপর্ব্বদিনে ‘স্ত্রী-তৈল-মৎস্য-মাংসাদি সম্ভোগ নিষিদ্ধ’। প্রতিটি নিষেধের ক্ষেত্রেই বলা রয়েছে না মানা হলে স্বাস্থ্য ও ধর্ম্মের হানি হয়। এই শিক্ষাতেই হয়ত তড়িঘড়ি রান্নাবান্না সেরে সেজেগুজে রামায়ণের পালা দেখতে আসা বছর ঊনিশের বৌটি মায়ের দিব্যি কেটে নিজেকে বলেছে এবং তারপর থেকে নিজেকে বলে বলে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছে, বরের, দেবরের কথা না শুনে দোরের বাইরে পা রাখলেই বিপদ। যদি তারও সীতার মতনই অবস্থা হয়? (চলবে)
তথ্যসূত্র
Haidt, J. (2007, 09 21). MORAL PSYCHOLOGY AND THE MISUNDERSTANDING OF RELIGION. Retrieved from Edge Org: https://www.edge.org/conversation/jonathan_haidt-moral-psychology-and-the-misunderstanding-of-religion
Haidt, J. (2007). The New Synthesis in Moral Psychology. Science, 998-1002. doi:10.1126/science.1137651
Harris, S. (2006). Letter to a Christian Nation.
Jonathan Haidt, S. K. (2010). Morality. In D. T. Susan T. Fiske, Handbook of Social Psychology, Volume One (pp. 797-832). Hobeken, NJ: Wiley.
TED. (2012, March 14). Jonathan Haidt: Religion, evolution, and the ecstasy of self-transcendence [Video]. YouTube. https://www.youtube.com/watch?v=2MYsx6WArKY