প্লাস্টিকটা মাটিতে পাততেই পাশের বাসনের ছেলেটা চিৎকার করে উঠল। তপন কোন উত্তর না দিয়ে তুলে নিল, তারপর প্লাস্টিকটা আবার মাটিতে পেতে বড়থলির থেকে বইগুলো বের করে সাজাতে আরম্ভ করল। বাসনের ছেলেটা সেইদিকে তাকিয়ে থেকে বকে যাচ্ছিল। তপন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘তুমি মেলা করতে এসেছ, আমিও। অতো কথা ভালো লাগে না। ফুটের টাকা দুজনকেই দিতে হয়েছে। এরপর কিছু বলবার থাকলে কমিটির সাথে কথা বল, ডাকবো কি?’
কথাগুলো শুনে বাসনের ছেলেটা একটু দমে গেল। তপন তার নিজের আনা চটি বইগুলো রাখবার সময় আরেকবার বাসনের ছেলেটার দিকে তাকাল। কয়েকটা টিন কাটার বাসন, উপরটাতে রঙ করা আছে, এটাই পেতল কাঁসা বলে বিক্রি করবে। বেশ কয়েক বছর আগে একটা মেলাতে পাশে এমনিই একটা বাসনের লোক বসে ছিল।একটু বুড়ো ছিল তাই হয়ত সব কিছু খোলসা করে বলে দিয়েছিল। এমনকি বড় বাজারের কোথায় এই ধরনের নকল কাঁসা পেতলের বাসন পাওয়া যায় তাও জানিয়ে বলেছিল, ‘তুমিও লেগে পড়তে পারো, ভালো পরতা আছে।’ তপন তখনও এই বই বিক্রি করত। শুনে উত্তর দিয়েছিল, ‘ভেবে দেখব।’ শেষ দিন তপনকে একটা প্রদীপও দিয়েছিল, পয়সা নেয় নি। তপন বিনিময়ে একটা বই দিতে গেলে নিজে থেকেই পছন্দ মত একটা নিষিদ্ধ বই বেছে নিয়ে বলে, ‘বয়স বাড়ছে তো, এখন এই সব বই না পড়লে শরীরটা ঘুমিয়ে পড়বে।’
তিন দিনের মেলাতে সেই বছর দু’জন খুব হাসি মজা করেছিল।
–কি কি বই রাখো, শুধু চটি পানু? পড়বার, না ছবিও কিছু…
কথাগুলো শুনে তপন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাসনের ছেলেটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। তপন কথার কোন জবাব না দিয়ে নিজের মত করে সব বই সাজাতে থাকে। সেই সময় কানে আসে, “বাবা, ‘মা লক্ষীর ব্রত কথার’ পাশে ‘রঙিন রাত’ একটু ঠিক করে সাজাও, লোকে তো লজ্জায় পড়ে যাবে।”
-সবের কাস্টমার আলাদা, তাছাড়া ব্যবসায় আবার লজ্জা আছে নাকি ?
কথাগুলো গ্রামের ওষুধের দোকানের পলাশ একদিন ক্লাবের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলেছিল। বাপ ব্যাটা দুজনেই ওষুধের দোকানে বসে। তপন ওষুধ কিনতে গিয়ে নিজের কানে শুনেছে পলাশ ওর বাপের সাথে কণ্ডোম নিয়ে কি সব কথা বলছিল। পরে পলাশের মুখে শোনে কোন একটা কম্পানির কণ্ডোমে কি সমস্যা ছিল, সেটা নিয়েই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
কথাগুলো মুখে বলে দিলেও তপন নিজের ঘরে এই সব নিষিদ্ধ বইগুলো লুকিয়েই রাখে। সামনে রাখে ব্রতকথা আর বিভিন্ন গানের বই বা পাতলা গল্পের বই। ছেলেটা বড় হচ্ছে, পড়াশোনা সব ডকে উঠিয়ে দিয়ে সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা অন্য ব্যাপার। পাড়ার আনন্দ মাস্টার কয়েকদিন আগেই বলছিলেন, ‘ঠিক মত পড়লে এতদিন স্কুল ফাইনালটা পাশ করে যেত।’ কথাগুলো রত্না শুনেই উত্তর দেয়, ‘কবে থেকে বলছি একটা প্রাইভেট দাও, শুনলে? সব সময় শুধু কোথায় পাবো আর কোথায় পাবো? ছেলে কি এমনি লেখাপড়া শিখবে?’
তপন শুনে কোন উত্তর না দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে।
এইট পর্যন্ত কোন রকমে গিয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে এখন শুধু…। তাও বাপের পয়সার জোর থাকলে একটা কথা হত, মেলাতে এই বই বিক্রি আর এদিক ওদিক যা টুকটাক হয়, এই নিয়েই কোন রকমে সংসার চলছে। আজ আবার এক বন্ধুর সাথে মেলা দেখতে গেছে, বন্ধুর মামাবাড়ি না কোথায় যেন। এদিকে নেই ওদিকে শখ ষোল আনা। আর কয়েকটা দিন যাক, শহরের একটা গ্যারেজে কথা বলেই রেখেছে, সময় মত….। তপনের তাও সব সময় ভয় হয়, ‘এই বুঝি ছেলেটা এই সব নিষিদ্ধ বইগুলো পড়তে আরম্ভ করে!’
বইগুলো সাজিয়ে মেলার চারদিকটা একবার দেখে নেয় তপন। এবারের পজিসনটা ঠিক জুতের নয়। এক্কেবারে মাঠের শেষ, চারদিকে খান চার ঠ্যালাগাড়ি আর কয়েকটা ছোট দোকান। পাশেই আবার এই রকম একটা বাসনের দোকান, যদিও তারপাশে বসা মানে সব বাড়ির বৌ’গুলো আসবে, এটাই একটা ভরসা।
তপন সব ঠাকুর দেবতার বইগুলো উপরের দিকে সাজিয়ে রেখে তার পাশে পাশে ঘরোয়া আয়ুর্বেদ, গানের স্বরলিপি, বর্ণপরিচয়, ছোটদের ভূতের গল্প সাজিয়ে রাখে, বাকি বইগুলো রাখে এক্কেবারে নিচে।আরো কিছু বই রাখা আছে সঙ্গের একটা ছোট কালো ব্যাগে, এদের কাস্টমার আলাদা।
মেলাটা তখনো ঠিক জমে নি। রক্ষাকালি পুজোর মেলা সন্ধেবেলা থেকে পরের দিন ভোর বেলা পর্যন্ত চলে। দুপুরের দিকে সেরকম ভিড় নেই। তপন ঘড়ি দেখে, সাড়ে বারোটা বাজছে। চুপচাপ বসে থাকলে কেমন যেন খিদে পায়। তাও বেরোনোর সময় এক পেট ভাত গিলে এসেছে। রত্নার শরীরটাও ভালো নেই, কাল রাত থেকেই খুব সর্দি কাশি হয়েছে। তপন নিজের থেকেই টিফিন দিতে বারণ করে, ‘মাঝে কিছু একটা খেয়ে নেবো, শুনলাম রাতের দিকে মেলাতে খিচুড়ি খাওয়াবে।’
কথাগুলো বলে এলেও মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা নিয়ে এলেই ভালো হত। এখনও এক পয়সার বিক্রি নেই এর মধ্যে যদি ঘর থেকে টাকা দিয়ে খেতে হয় তার থেকে দুঃখের আর কিছু থাকে না। এরমধ্যে মেলা কমিটির লোক এসে দু’বার সব কিছু দেখে গেছে। একটা লাইট লাগানোর জন্য আলাদা করে টাকাও নিয়েছে। এতসব কিছুর পরে ঠিকঠাক বিক্রি না হলে… একবার সুবলের সাথে দেখা করতে হবে। ও ব্যাটাই তাকে মেলাটার সন্ধান দেয়। নিজে একটা ছোট জুয়ো বসায়। তপনকে বলেওছে, ‘শোনো, গাঁ হোক বা ছোট শহর, আমরা না থাকলে কোন শালার মেলা জমতো না।’
কথাগুলো তপন জানে, তারও অভিজ্ঞতা কম হল না। সেই কবে থেকে মেলা করছে। নিজের কাছাকাছি গাঁয়ে মেলা কম করলেও দূর গাঁয়ে নিয়মিত যায়। না হলে এতদিন ধরে এই গাঁয়ে রক্ষেকালি পুজোর মেলা হলেও নিজে সুবলের কথা শুনে এই প্রথম এসেছে।
তপন চোখ ঘুরিয়ে মেলাটাকে বোঝার চেষ্টা করে। গ্রামের এক রাতের মেলা হলেও বেশ বড়। নাগরদোলা, বুগিবুগি ছাড়াও অনেক ছোট বড় দোকান বসেছে। খাবারের দোকান তো অসংখ্য। তবে এতটা বেলা হলেও এদিকে লোক নেই।
-ও দাদা, এনেছ? আমি তাড়াতাড়িতে বোতল আনতে ভুলে গেছি।
বাসনের ছেলেটা জিজ্ঞেস করে।
তপন পিছনের একটা ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা ছেলেটাকে দেয়। বোতলটা ফেরত দেবার সময় বলে ওঠে, ‘জানটা ভালো নয়, কাল রাত অবধি গায়ে তাপ ছিল, রুকসারা আসতে বারণ করছিল, এতগুলান পেট, না এলে খাবো কি?’
তপন তাকে আর টিন কাটার বাসনের কথা বলতে পারে না। বেচারার শরীরটাও ঠিক নেই, এক্ষুণি লোকটা রেগে বলতে পারে, ‘তুমার কি, নিজে তো অসভ্য বই বিক্রি কর, তাতে আবার মুখে বড় বড় কথা।’
কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও মিথ্যে তো নয়। সব মেলাতে এই সব কাহিনীর বইই বেশি বিক্রি হয়। তপন যদিও মাঝে মাঝেই এটা ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, ‘ঠাকুরেরও বইও তো থাকে।’
সবাই সব কিছু বোঝে আর একটা মজার ব্যাপার হল কেউই প্রায় খুব বেশি দাম দর করেনা। কোন রকমে কিনে লুকিয়ে ফেলাটাই যেন উদ্দেশ্য। প্রথম প্রথম যারা এই সব বই কিনত তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু কল্পনা করবার চেষ্টা করত। বুড়ো থেকে স্কুলের ছেলে, খদ্দের কিন্তু প্রচুর। বহুদিন আগে একটা মেলাতে একটা মেয়েছেলে খদ্দের পেয়েছিল। ঘরের বউ, এই রকমই দুপুর দিকে এসেছিল। ঠাকুর দেবতার ব্রত কথার বই নাড়াচাড়া করবার সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ভালোবাসার পাঁচালি বই নাই?’ তপন বুঝে গেলেও জিজ্ঞেস করে, ‘প্রেমের শায়েরির বই?’
–আরে না, চটি বই, ওটাকেও পাঁচালি বলে।
-শুধু গল্প নাকি ছবিও…? তপন জিজ্ঞেস করে।
দুটো বই বের করতেই বউটা ছোঁ মেরে একটা বই তুলে সোজা নিজের ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। একটা পুণ্ডলি পাকানো নোট ছুঁড়ে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। বাকি টাকা ফেরতও নেয় নি। তপন একটু অবাক হয়। এমনিতে কম বয়সী মেয়েদের অনেকেই রগড় করে কয়েকবার চটিবই নিলেও বাড়ির বৌ সেই প্রথম।
-নাম কি?
-মোক্তার।
–কোন গাঁয়ের?
তপন মোক্তারের মুখে গাঁয়ের নাম শুনে নিজের গাঁয়েরও নাম বলে, বৌ রত্নার কথা বলে। তারপরেই মোক্তারের মুখে তার বড় সংসারের কথা শোনে। মেলা না থাকলে এদিক ওদিক বাসন নিয়েই ঘুরে বেড়ায়, তবে সেই বাসন মেয়েদের পড়ে যাওয়া চুলের বিনিময়ে দেয়। রত্নাও এই রকম চুল দিয়ে কয়েকটা বাটি নিয়েছিল। একদিন তার মুখেও ঐ টিন কাটার কথা শুনেছে। তপন আর সে কথা মোক্তারকে বলে না। তাকে বইগুলো দেখতে বলে পুরো মেলাটা এক চক্কর ঘুরতে বেরোয়, সুবলের সাথেও দেখা করতে হবে।
মন্দিরের পিছনে পাঁচটা বড় উনুনে খিচুড়ি চাপিয়েছে। মেলাটেলা না থাকলে তপন পাশের গাঁয়ের দোলগোবিন্দের সাথে রান্নার কাজেও লেগে যায়। সব্জি কাটা, জল ধরা, মাঝে মাঝে খুন্তি নেড়ে অসময়ে গরিবের ঘরে যা দু’পাঁচ টাকা আসে। তপন কিছু সময় রান্নার জায়গাতে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে। খিচুড়ি, একটা সব্জি, আর মনে হয় চাটনি ও পায়েস হবে। এক ড্রাম দুধ রাখা আছে। তার মানে রাতের খাওয়াটা ভালোই হবে, কিন্তু বিক্রি কেমন হবে?
মাঠে অল্প অল্প করে লোকজন বাড়ছে। তপন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নিজের রাখা বইগুলোর কাছে আসতেই দ্যাখে মোক্তার একটা বই হাতে নিয়ে পড়ছে। তপন কাছে যেতেই মুচকি হেসে বলে, ‘যা বই এনেছ এখানেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, শেষ বেলাতে একটা বই নেব।’
সূর্য ডোবার সাথে মেলাতে ভিড় হয়ে যায়। তপনের বিক্রিও টুকটাক করে ভালোই হয়। ব্রতকথা পাঁচালির পাশে সেই সব নিষিদ্ধ চটি বইগুলোরও তো খদ্দের অনেক। অন্যান্য মেলার মতই এই মেলাতেও বিভিন্ন বয়সের খদ্দেররা এলেও একটু বয়স্কদের সংখ্যাটাই বেশি। কমবয়সীরা এসেই বইগুলো এদিক ওদিক সরিয়ে জিজ্ঞেস হাল্কা করে জিজ্ঞেস করে, ‘শুধু ছবির কিছু নেই?’ তপন তখনই তার একটা গোপন থলি থেকে বেশ কয়েকটা বই বের করে বলে, ‘পিছনের দিকে এসে দেখে নাও।’ এই সব বইগুলো বিক্রি করলে কিছুটা পরতা হয়। এগুলো তো কেউ দাম দর করে না। তপনের মুখেও হাসি ফোটার সাথে ঘরেও ভাত ফুটতে আরম্ভ করে। যত ভিড়, তত বিক্রি।
রাতের দিকে বাড়িতে একবার ফোন করে রত্নার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করবার সময় শোনে, ছেলে তখনো বাড়ি ফেরেনি। মনে মনে রেগে গেলেও রত্নার উপর ঝাঁঝিয়ে ওঠে না, একা মেয়ে মানুষ এক্ষুনি ভাবতে বসবে। তপন শান্তভাবেই বলে, ‘আসবে, বন্ধুদের সাথে গেছে তো…’
রাতে মেলাতে শুধু মাথা আর মাথা। এতগুলো মাথার মাঝে কি ছেলেটাও আছে?
হঠাৎ মেলার একদিক থেকে একটা হাল্কা চিৎকার শোনা যায়। মেলার সব জটলা সেখানে গিয়ে জড়ো হয়। তপন আর মোক্তার সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে আবার ব্যবসাতে মন দেয়। একটা লোকের মুখে শোনে মেলাতে কোন এক মেয়েকে কয়েকটা ছেলে কি সব খারাপ কথা বলেছে। সেই নিয়েই ঝামেলা। ছেলেগুলোকে মেলা কমিটি ধরে রেখেছে, ডেঁপো ছেলে সব, একটার পকেটে কি সব বাজে ছবির বইও পেয়েছে।
তপন একটু ঘাবড়ে গেলেও ক্যানভাসিং আরম্ভ করে, ‘মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা, মেয়েদের ব্রত কথা.. শেষবেলায় এক্কেবারে জলের দামে…’
–ও দাদা, এবার একটু বোসো, সারাদিন বিক্রি তো কম করলে না। আমার জন্যে একটা বই রাখবার কথা মনে আছে তো?
সত্যি অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোক্তারের কথাগুলো শুনে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘আছে, আছে, ঐ কালো ব্যাগটা থেকে যে বইটা ভালো লাগবে নিয়ে নাও, পরিবারের জন্যে কিছু নেবে নাকি? কোন গানের বই?’
তপনের সাথে প্রথম দিকে একটু খিঁচিমিচি লাগলেও তারপর বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। একবার চপমুড়িও খাওয়ায়, তপনের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খায়। মেলাতে পাশের লোকের সাথে মিলমিশ না করলে হবে?
-আচ্ছা, দাদা তোমার বাড়ির সবাই জানে?
তপন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ছেলেটা কালো ব্যাগটা থেকে বই বাছছে। ঘর, ছেলে, বউ, বইয়ের থলি লুকানো সবকিছু মনের ভেতরে ছোটাছুটি করলেও মুখে কোন উত্তর না দিয়ে কেবল একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে।
মন্দিরের ওদিকটাতে তখন বেশ ভিড়। তপন শুনতে পেল বলিদান হচ্ছে, ‘জয় মা জয় মা’ আওয়াজের সাথে ঢাকের আওয়াজে চারদিকটা আরো গমগম করে ওঠে। আর কিছু সময় পরে খিচুড়ি খাওয়ানো শুরু হয়ে গেলেই লোকজন পাতলা হতে আরম্ভ করবে। তপন আস্তে আস্তে বইয়ের থলিটা গুছোতে যাবে হঠাৎ কয়েকজন লোক হুড়মুড় করে তপনের সামনে এসে বইগুলো ঘাঁটতে আরম্ভ করে। তারপর ভেতর থেকে একটা নিষিদ্ধ বই হাতে তুলে চিৎকার করে ওঠে, ‘এই সব বই তুই বিক্রি করিস? এটা ঠাকুরের মেলা আর তুই এখানে তুই এই সব বই বিক্রি করে নোংরামো করছিস। তোদের মত লোকের জন্যেই মেলাতে এই রকম ঘটনা ঘটল।’
এত জায়গায় মেলা করেছে কিন্তু কোনদিন এমনভাবে কেউ কিছু বলেনি। তপন খুব ঘাবড়ে যায়, কোন উত্তর দিতে পারেনা, বলতে পারে না, ‘আমি তো ব্রতকথাও বিক্রি করি।’ একটু পিছিয়ে কালো থলিটার ওপর বসে যায়। ওটা হাতে এলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। মোক্তার কিছু সময় চুপ করে নিজের বাসনপত্রগুলো সরিয়ে পিছনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
ভিড়ের থেকেই একটা লোক কয়েকটা বই নিয়ে ছিঁড়ে পাতাগুলো আকাশে উড়িয়ে দেয়। তাদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে যায় ব্রতকথা, ঠাকুরের পাঁচালির সাথে আরো কিছু শায়রী ও রোমান্টিক বই এমনকি কয়েকটা নিষিদ্ধ বইও। শুধু কালো ব্যাগের ভিতরে থাকা আরো নিষিদ্ধ বইয়ে হাত পড়ে না। তবে তপনের পিঠে ঘাড়ে কয়েকটা চড় চাপ্পড়ও পড়তে আরম্ভ করে। ও মাথাটা দু’হাত দিয়ে ধরে মাটিতে মুখটা রেখে বইয়ের প্ল্যাস্টিকের উপরে শুয়ে কোন রকমে নিজেকে আর বইগুলোকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। কানে আসে লোকগুলো চিৎকার করে বলছে, ‘আজ ছেড়ে দিলাম, এই মেলাতে আর কোনোদিন দেখতে পেলে এক্কেবারে পুঁতে দেব।’
অতগুলো লোকের পায়ের ধুলো মোক্তারের বাসনেও লাগে। এক গা ধুলো মেখে তপন যখন মুখ তোলে তখন তার পাশে পিছনের ঝোলা আর মোক্তার ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না। মোক্তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাসন গুছিয়ে থলিতে ভরবার সময় গজগজ করতে থাকে। তপনের খুব খারাপ লাগে। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নেয়, ‘টাকার ব্যাগটা আছে।’
ঠোঁটটা জ্বলছে, পিঠে আর ঘাড়ে খুব ব্যথা। মেলায় ভিড় এক্কেবারে পাতলা হয়ে যায়, নানা রকমের মিলেমিশে যাওয়া আওয়াজের মাঝেও তপনের কানের কাছে কিছু সময় আগের সেই কথাগুলোই ভনভন করতে থাকে। হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করে, আর দাঁড়াতে পারে না। ভেতর থেকে একটা, একটা চাপা কষ্ট বের হয়ে আসে। এতো ভিড়ের মধ্যেও এই প্রথম নিজেকে খুব একা মনে হয়। ছড়ানো বইগুলো ব্যাগের ভরবার সময় হঠাৎ মনটা হু হু করে ওঠে, বসে থাকতে পারে না। ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। মোক্তার তার কাছে এসে পিঠে হাত দিতেই তপন তাকে ধরে আরো জোরে কেঁদে ওঠে।
-খুব লেগেছে দাদা, জান খারাপ লাগছে, পানি খাবে ?
তপন উত্তরে বলতে পারে না তার ঠিক কোথায় লাগল। কিছু সময় আগে বই লুকিয়ে রাখবার কথা জিজ্ঞেস করলে তখন তপন উত্তর দেয় নি। এখনও জিজ্ঞেস করতে পারে না, ‘আচ্ছা, আমার ছেলেটা সত্যিই এই মেলাতে আসেনি তো? সব কিছু তার চোখের সামনে ঘটলে…? আমাকে চিনতে পেরে গেলে !’
প্রচ্ছদঃ সায়ন্তনী দাশগুপ্ত
*****