||প্রাককথন||
ছদ্মজীবনী। অভিধানে এমন শব্দ নেই। অভিধানে না থাকলেও মানুষের জীবনী বা আত্মজীবনী কমবেশি ছদ্মজীবনী ছাড়া কিছু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে নিজেও জানে না, সে যেটাকে জীবন ভাবছে, সেটা আসলে ছদ্মজীবন। ছদ্মবেশ, ছদ্মনামের মতো সে নিজেই এই ছদ্মজীবনকে ধারণ করে, কিন্তু সেটা তার বোধে পৌঁছয় না। তা-ই সকলে তার এই ছদ্মজীবনকেই যেমন তার আসল জীবন ভাবে, সে নিজেও তা-ই ভাবে।
উপন্যাসের মূল তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র শুভ মিত্র কিন্তু তার ছদ্মজীবন সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। তার ‘তথাকথিত’ শয়তানের মতো অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। রয়েছে স্বতন্ত্র জীবন-দর্শন। সে বোঝে এবং স্বীকার করে যে সে ষড়রিপুর আজ্ঞাবহ দাস ছাড়া কিছু নয়। সকলে যখন শিকড়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সে লীলাচ্ছলে অস্বীকার করে সমস্ত শিকড়ের বন্ধন। তাকে সঙ্গ দেয় দেশ-কাল-মানুষ। নৈতিক বোধ এবং আধ্যাত্মিক গভীরতারহিত পাশবিক জীবনকে আশ্লেষে গ্রাস করে শুভ, অথবা পাশবিক জীবন আশ্লেষে আত্মসাৎ করে শুভকে। সে কিন্তু পালাতে চায় না, পলায়ন তার অভিধানে নেই। সে যে-পঙ্কসলিলে অবগাহন করেছে, তা থেকে উঠে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই, ঘৃণার আগুনে দহিত হতে চায় সে। সে হেলায় মাড়িয়ে যায় ‘নিকষিত হেম’সম প্রেমকে। সে তার পরিণতির জন্য ঘটনাচক্র বা ঘটনাক্রমকে দোষারোপ করলেও স্বখাতসলিল গমন যে তার নিজস্ব অভিলাষ, তা অস্বীকার করে না। তার মাধ্যমে যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এক চরম সত্য— ব্যক্তি-মানুষের জীবন যতই নিয়তিতাড়িত হোক না কেন, তা অনেকাংশে কিন্তু মানুষের নিজস্ব নির্মাণ।
এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।
আসলে আলাদা ধরনের গঠনবিন্যাস, বিষয়বস্তু, পটভূমি এবং শৈলী (form, content, plot & style) সমন্বিত এক পরীক্ষামূলক (experimental) উপন্যাস ‘ছদ্মজীবনী’, যা পাঠকের সামনে জীবনের মতোই প্রহেলিকাময় বলে প্রতিভাত হতে থাকে।
শুরু হচ্ছে উপন্যাস ছদ্মজীবনী। এই সংখ্যায় প্রথম পর্ব।
শীতার্ত উপসংহার।। উলঙ্গ রাজা
আমি মারা গিয়েছি।
কর্মে ময়সনের দ্বিচক্রবাহী রথে অপেক্ষমান ধর্মাবতার আমাকে অবলোকন করছেন। তাঁর কাছে এ সংবাদ অপ্রত্যাশিত। তাঁর অন্তরাত্মা এই নির্ভেজাল সত্য ঠিক গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ তাঁর মনে হচ্ছে কোথাও যেন রয়েছে প্রত্যাশিত পরিসমাপ্তির স্বাভাবিকতা।
ধর্মাবতারের দ্বিধা দেখে মনে হচ্ছে উনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন কেশবপুরের ত্রাস বোকারু ডাকাতের কথা। বোকারুর জন্য কত রাত-প্রহরার আয়োজন, কত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন, কত ভীরু নিশিযাপন। অথচ সেই বোকারু কিনা একদিন বিকালবেলা নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে মরিয়া জনতার হাতে পড়ল এবং দুম করে তার ভবলীলা সাঙ্গ হল। আমার ব্যাপারটাও অনেকটা সে রকমই।
ধর্মাবতার ভাবছেন দাপটের সঙ্গে বেঁচেছে বটে শুভ মিত্র! পকেটে রেস্ত আর অন্তরে ইচ্ছা থাকলে সাধারণ মানুষের জীবনও কতটা ভোগের হয়ে উঠতে পারে তারই আধুনিকতম উদাহরণ শুভ। সে যেন কালাপাহাড়। সমাজ বলে যে পৃথিবীতে কোনও বস্তু আছে বা আদৌ ছিল বা আদৌ থাকতে পারে— শুভ তার বেপরোয়া জীবনযাপনে তা বারেবারে অস্বীকার করেছে। কিন্তু মজার বিষয়, লোকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েও ‘ছিঃছিঃ’ করেনি, গভীরে কোথাও আফশোস করেছে।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অনুচ্চারিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কে এই শুভ মিত্র?
আমার মৃদু হাসি থেকে তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর প্রশ্নের জবাব। তাঁর স্মরণে এল শুভ মিত্র একজন দালাল। জমি কেনা-বেচা তার পেশা। ক্রোড়পতি। প্রথম জীবনে কিছুদিন দু’ হাজার টাকা মাইনের সরকারি চাকরি করেছে। একসময় লেখালিখি করার প্রবল শখ ছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। অর্থের অভাবে ডাক্তারি পড়া হয়নি। ভাগ্যিস! ডাক্তারি করলে সে আর কত বেশি দুর্নীতি করতে পারত? বিশেষ করে গ্রামের একজন চালচুলোহীন খেতমজুর পরিবারের ছেলের পক্ষে ওইরকম হোয়াইট কলার জবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে কতটাই বা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া সম্ভব ছিল?
সুন্দরের পূজারি ধর্মাবতার আমার অবিমিশ্র সৌন্দর্যবোধ স্মরণ করে চক্ষু নিমীলিত করলেন।
আমার মনে পড়ল আমি শিল্পী ছিলাম না। আমি কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান গাইনি, চিত্রকলায় সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলিনি, কণ্ঠসঙ্গীতে সৌন্দর্যের মূর্চ্ছণা ধারণ করিনি— তবুও আমি সৌন্দর্যের পূজারি। আমার মতো এভাবে সৌন্দর্যের পূজা করতে খুব কম মানুষ-ই পেরেছে। প্রেমরূপ পূজা নয়, কামরূপ পূজা। আমি সৌন্দর্যের সন্ধান করেছি, সৌন্দর্যকে উদ্ধার করেছি, সৌন্দর্যে অবগাহন সেরেছি। অভিজ্ঞ জহুরির মতো সৌন্দর্য চয়ন করে এনে আমার নিজের জীবনে তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। আমার জীবনটাই সৌন্দর্যভোগ অথবা সৌন্দর্যের উপভোগ। কিন্তু সৌন্দর্য শিকার করলেও আশ্চর্যজনক ভাবে আমি কখনও সৌন্দর্যের শিকার হইনি। আমি হরিণী-সৌন্দর্যকে ভালবেসেছি, কিন্তু তাতে আটকা পড়িনি। আধেয় ছেড়ে আধারে আমি নিজেকে সমর্পণ করিনি, তাতে লীন হইনি। আমি মূর্তির পূজা করিনি, মূর্তরূপের পূজা করেছি। আমি শ্মশানভস্মে শবসাধনা করে করাল কালিকার সন্তুষ্টিসাধন করিনি, আমি সৌন্দর্যের তন্ত্রসাধনায় দেহরূপ করোটি পাত্রের সৌন্দর্য-সঞ্জাত আসব কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছি।
সৌন্দর্য আমার নেশা, সৌন্দর্য আমার ধ্যান। আমার সাধনা সৌন্দর্যের অনুধ্যান। আমার জীবনটা একাধারে সৌন্দর্যের খোঁজ এবং সৌন্দর্যের ভোজ।
ধর্মাবতার সুস্মিত নয়নে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে ভাবলেন— কিন্তু শুভ তো নিজে এতটুকু সুন্দর ছিল না! অবশ্য সুস্বাদু মাংসের জন্য সুন্দর হরিণ শিকার করে যারা, তাদের সুন্দর হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলে নিজেকে সুন্দর হতে হবে— তাঁর খেলাঘরে তো এমন নিয়ম নেই। বরং নিজে অসুন্দর হলেই বোধহয় সৌন্দর্যকে সবথেকে বেশি গ্রহণ করা যায়। মাটি যত বেশি শুকনো হয়, তত বেশি জলধারণ করতে পারে। সুন্দর অসুন্দরের কবলে পড়লে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, ভয় পেতে থাকে। এই ভীরুতাই কিন্তু সৌন্দর্যকে আরও বেশি মোহনীয় করে তোলে। আর সৌন্দর্য তো কোনও কালেই কোনও গুণ নয় যে, সাহসী হলে তাকে বেশি ভাল মানাবে।
আমার মৃতদেহের পাশে উপবিষ্ট আমার ধর্মপত্নী রমাকে অবলোকন করার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মাবতারের স্মরণে এল রমা-আমার গত রাতের সাক্ষাৎপর্ব। রমা এবং আমার বেডরুম আলাদা। সেটাই প্রত্যাশিত এবং সেটা আমাদের দু’জনের জন্য সুবিধাজনকও বটে। আমি শুয়ে পড়েছিলাম। দরজাটা ভেজানো থাকলেও লক করা ছিল না। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি রমা! স্মরণাতীত কাল পরে। আমি কিছু বলার আগেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত গলায় রমা বলে উঠল, না, এটা তুমি করতে পারো না!
না করতে পারার মতো কী করেছি আমি?
নিজের সন্তানের সঙ্গে এই পাপ তুমি করতে পারো না। স্বয়ং ঈশ্বরও তোমার এই ব্যভিচার ক্ষমা করবে না।
সন্তান… পাপ… ব্যভিচার— এসব কী বলছ তুমি! কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।
তুমি ভাবছ কিছুই আমি জানি না! তুমি শুভমিত্রাকে পড়াশোনার জন্য কেন বাইরে পাঠাতে চাওনি? বারবার আমার চেষ্টাকে কেন তুমি বানচাল করে দিয়েছ? ভাবছ, আমি কিছু বুঝি না!
আমি তোমার একাকিত্বের কথা ভেবে শুভমিত্রাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইনি। এ কথা তো আমি তোমাকে আগেও বলেছি।
চুপ করো। আমার একাকিত্ব, না, তোমার লালসা? তোমার নোংরা, ঘৃণ্য মনোবৃত্তি? ভাবছ, আমি কিছুই বুঝি না। কত মিথ্যা আর তুমি আমাকে বলবে? কত ভুল আর বোঝাবে? তোমার পায়ে পড়ি, নিজের মেয়ের এই সর্বনাশ তুমি কোরো না! নিজের মেয়েকে অন্তত নিষ্কৃতি দাও!
দ্যাখো, এ নিয়ে আগেও আমাদের কথা হয়েছে। তোমাকে আমি বলেওছি তোমার এসব আলতু-ফালতু অভিযোগ অমূলক। তোমার ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এ ব্যাপারে আমাকে তুমি চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারো। তা আজকে হঠাৎ আবার কী হল, এত রাতে এসব নিয়ে নতুন করে তুমি অভিযোগ জানাতে এসেছ?
আসলে আমার খুব শখ হয়েছে তো তাই অভিযোগ জানাতে এসেছি! আর বিশ্বাস! তোমাকে? তোমার মুখে বিশ্বাস কথাটা শুনলে আমার কেমন গা ঘিনঘিন করে ওঠে, বমি-বমি পায়। দোহাই তোমার, তুমি আর তোমাকে বিশ্বাস করার কথা বোলো না!
আমাকে বিশ্বাস না করো ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমার মেয়েকে তো বিশ্বাস করো! তাহলেই তো আর কোনও চিন্তার কারণ নেই।
সত্যিই চিন্তার কোনও কারণ থাকত না যদি ওর শরীরে তোমার রক্ত না বইত।
কেন, ওর শরীরে তো তোমার রক্তও বইছে!
কিন্তু আমার শরীরে যে আমার মা… তোমার মিসেস চৌধুরীর রক্ত বইছে!
নিজের মা সম্পর্কে এমন কথা বলতে তোমার লজ্জা করছে না?
লজ্জা! আমার? আমার লজ্জার আর কী রেখেছ তুমি! মা-মেয়ের সম্পর্কের পবিত্রতা নষ্ট করে তাকে নির্লজ্জভাবে বেআব্রু করে দিয়ে এখন তুমি লজ্জার কথা বলছ!
অনেক-অনেকদিন পর রমার প্রতি এক সুতীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছিলাম আমি। সেই কারণে কিনা জানি না, যে আমি কোনওদিন রমার কোনও অভিযোগকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি, সেই আমি রমাকে শুভমিত্রা সম্পর্কে আমার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করলাম।
বুঝতে পেরেছি রমা, শুভমিত্রাকে এখন আমার সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটাতে দেখে তোমার মাথায় আবার এসব ছাইপাঁশ ঢুকতে শুরু করেছে। আমি বলছি শোনো, তোমার যেটাকে আমার প্রতি শুভমিত্রার টান-ভালবাসা বলে মনে হচ্ছে, সেটা কিন্তু আসলে ওর নিখুঁত ক্যালকুলেশন ছাড়া কিছু নয়। এটা নিশ্চয়ই জানো যে ও গোড়া থেকেই খুব হিসেবি আর নিজের কিসে সুবিধা হয় সেটা ও তোমার-আমার থেকে বেশি ভাল বোঝে। এখন ওর ফ্যাশনেবল লাইফস্টাইল লিড করতে গেলে প্রয়োজন বিভিন্ন দামি জিনিস। আর সেগুলো আদায়ের জন্য আমাকে যে হাতে রাখা দরকার, এটা না বোঝার মতো বোকা শুভমিত্রা নয়। তাই ইদানিংকালে ও আমার কাছে একটু বেশিই আসছে। এতে তোমার দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু ওর তোমার এত কাছে ঘেঁষার সুযোগ যদি তুমি নাও! তোমাকে আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই।
না, এটা কক্ষণও হতে পারে না। স্বয়ং শয়তানও আমাকে শুভমিত্রার দিকে এক পা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
কিন্তু তুমি ওইভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসছ কেন! তোমাকে দেখে আমার ভয় করছে। আমি এখন আসছি।
আমাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল রমা। ঘরের মেঝেতে শূন্য আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিছুক্ষণ পর বিছানায় ফিরে এসে আমার কেমন যেন মনে হল ব্যাপারটা এমন নয় তো যে আমাকে নয়, আসলে নিজেকে ভয় পেয়ে দ্রুত পদক্ষেপে নিষ্ক্রান্ত হল রমা!
রমার প্রতি আমার আকর্ষণ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মাবতারের অন্তর্দৃষ্টিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে আঠারো বছর বয়সী সুতনুকা রমার মোহিনী রূপ। তিনি বাইশ বছর পিছিয়ে দেখতে থাকেন চব্বিশ বছরের আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি আঠারোর রমার সঙ্গে।
রমা ছিল আমার ছাত্রী, যার গৃহশিক্ষক হিসাবে আমি তিনবছর আগে নিযুক্ত হয়েছিলাম। আমার বিয়ে বাজারি ভাষায় প্রেম করে, আসলে নয়নলোভন সৌন্দর্যের তপ্ত সান্নিধ্যে নিজের কচি শুক্রের তেজকে আইনসম্মতভাবে প্রশমিত করার জন্য।
অবশ্য এক প্রতিশোধস্পৃহার ছকও আমাকে নিঃসন্দেহে তাড়িত করেছিল। সৌন্দর্য-গমনের হাতেখড়ি আমার আগেই হয়েছিল। সেখানে আমি ঘাতকের ভূমিকায় ছিলাম না, আমাকে শিকার করা হয়েছিল। সে সময়ই আমি উপলব্ধি করেছিলাম এই একটা ক্ষেত্রে প্রকৃত আনন্দ পেতে গেলে শাসক হতে হয়, প্রভুত্ব জানতে হয়। এ পূজার মন্ত্র আত্মলোপ নয়, এ পূজার মন্ত্র সূক্ষ্ম আত্মা ব্যতিরেকে স্থূল শরীরের সুদৃঢ় জাগরণ। এ পূজার উপাসককে তুলসীমঞ্জরীর পবিত্রতা ভুলতে হয়, রতিমঞ্জরীর সাধনা করতে হয়।
ধর্মাবতারের ভ্রূ কুঞ্চিত হল যখন তাঁর চোখে ভেসে উঠল বছর চল্লিশের ঘাই হরিণীর কবলে পড়া শুভ কী ভাবে ব্যবহৃত হতে হতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চল্লিশের আত্মজাকেই ব্যবহার করতে শুরু করল। তিনি উপলব্ধি করলেন এ তো তাঁরই লীলা! শিকার যখন শিকারি হয় তখন সে তার শিকারকে আরও বেশি লেজে খেলায়— ঠিক যে ভাবে অত্যাচারিত আত্মা অত্যাচারের নয়া নয়া প্রকরণ উদ্ভাবন করে অত্যাচারকে আরও বেশি টক-ঝাল-মিষ্টির একটা থকথকে জম্পেশ মন্ড করে তোলে। আর নিজে ভাবে শিল্পসম্মত উপায়ে সে উপভোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে।
আমার প্রাথমিক সাফল্যই বুঝিয়ে দিয়েছিল ভবিষ্যতে আমি আরও কী কী উপহার দিতে চলেছি। বিয়াল্লিশের স্বামীহীনা এবং ষোলোর অনূঢ়াকে আমি আপন জাদুদন্ডের প্রতিভাস্পর্শে একইসঙ্গে অ্যাবরশন টেবিলে এনে হাজির করাতে সক্ষম হয়েছিলাম— যদিও আলাদা নার্সিং হোমে। আমার শিকারিকে মাত্র দু’ বছরের মধ্যেই বুঝিয়ে ছেড়েছিলাম মৃগয়াক্ষেত্রে কে আসল শিকার আর প্রকৃত অর্থে কে তার নির্মম, পেশাদার শিকারি।
ধর্মাবতার স্মরণ করলেন কলেজে পড়াকালীন শুভ যখন মেঘ না চাইতেই জলে হাবুডুবু খাচ্ছিল, তৎকালীন সময়ে তার মানসিকতাকে। কারও সারল্য যে সমবেত জনের তথাকথিত স্মার্টনেসের খপ্পরে পড়ে কেমন র়্যাগিংয়ের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, সে অভিজ্ঞতা তার কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় বিভূতিবাবুর কাছে টিউশন পড়তে গিয়ে হয়েছে। তাদের ব্যাচটায় ছিল সাতজন মেয়ে এবং একা শুভ। তার দশা যে অভিমন্যুর মতো হয়নি তার কারণ বোধহয় তার বাবা-মা অর্জুন-সুভদ্রা ছিল না, আর তার ব্যাচমেটরাও ছিল না সপ্তরথীভুক্ত কোনও মহারথী। সহজ সারল্যে শুভ মেয়েগুলোর সঙ্গে কথা বলত। একদিন ঋতুপর্ণা বলে একটা মেয়ে খুব আন্তরিকভাবে তার কাছে জানতে চাইল, হ্যাঁ রে শুভ, তোদের ওখানে অনেক নারকেল গাছ আছে? শুভ বলল, হ্যাঁ, আমাদের ওখানে বেশ ভালই নারকেল গাছ আছে। সেই শুনে পাশ থেকে সঞ্চিতা টিপন্নী কাটল, হ্যাঁ, সেটা তো ওর মাথার চুল দেখলেই বোঝা যায়। আর এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শুভকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে সবক’টা মেয়ে হাসতে হাসতে একে ওপরের গায়ে ঢলে পড়ল। শুভ সেই যে পরেরদিন থেকে চুলে তেল মাখা বন্ধ করে দিল আর কখনও চুলে তেল দেয়নি।
শুভ দেখত কলেজে তার সঙ্গে যে সব বিবাহিত মেয়েরা পড়ে, তারা যেন শুধু বিবাহিত বলেই সকলের একটু বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। তার মনে হত, যে অভিজ্ঞতার জন্য কলেজের সকলের সাগ্রহ প্রতীক্ষা, সেই অভিজ্ঞতায় তাদের প্রত্যক্ষ সংযোগের চিহ্ন-লাঞ্ছিত কারণই মেয়েগুলোকে একটু আঁশটে করে তুলেছে— আর সেই আঁশটানিটাই হয়ে উঠেছে তাদের চৌম্বকক্ষেত্র। মনে মনে সে না হেসে পারেনি— এরা যদি গলদা চিংড়ি হয়, তাহলে সে পাকা মাগুর!
ধর্মাবতার রোমাঞ্চিত হলেন শুভর এক বিশেষত্বর পরিচয় পেয়ে। সে প্রথম থেকেই কখনও কারও কাছে ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও মুখ খুলত না। সে প্রচার পছন্দ করত না। প্রদর্শনে তার কোনও আগ্রহ ছিল না, তার যত আগ্রহ সব ময়দানে নেমে খেলাতে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার তার জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, সেটাকে তার ভীষণ স্বাভাবিক মনে হত এবং তার মধ্যে একটা আক্ষেপ সবসময় কাজ করত যে, তার জীবনে নাটকীয় কিছুই ঘটে না। আর এই আক্ষেপই তাকে তাড়িয়ে বেড়াত এক তৃষ্ণা থেকে আর এক তৃষ্ণায়। কেউ তাকে বলে দেয়নি কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর উপলব্ধি, ‘তৃষ্ণা শান্তি নহে, তৃষ্ণা বাঢ়ে নিরন্তরে’।
আশু বিপদ থেকে উদ্ধার লাভ করার পর ঘাই হরিণী বুঝতে পারল আমি অনেক আগেই তাকে মাত করে দিয়েছি। আর কোনও উপায় না পেয়ে সে আমার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে বলল, শুভ, তুমিই আমাদের মা-মেয়ের বন্দোবস্ত করো।
আগ্রহী হয়ে উঠলেন ধর্মাবতার। তিনি যা ভেবেছেন তাই। শুভ এমন মওকা ছাড়ার পাত্র নয়। সে বলল, তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব আমার। আমি থাকতে তোমাদের কোনও চিন্তা নেই।… কিন্তু এটা নিশ্চয়ই তোমার কাছে এতদিনে পরিষ্কার— আমি পৃথিবীতে কারও গোলাম হয়ে থাকবার জন্য জন্মাইনি। তোমার ওমন সর্বগ্রাসী ছলা-কলা পর্যন্ত যেখানে আমাকে গোলাম করে রাখতে পারেনি, সেখানে দশটা-পাঁচটার সরকারি চাকরির গোলামি আমার দ্বারা অসম্ভব।… আমি ঠিক করেছি বিজনেস করব। আর… তার জন্য যে ক্যাপিটাল লাগবে সেটা জোগাবে তুমি। কিন্তু বিজনেসটা সোললি আমার হবে এবং বিজনেসের প্রফিটটা পুরোপুরি আমার পকেটেই ঢুকবে। কি, রাজি কি না বলো? অবশ্য তোমাদের দেখভালের কোনও ত্রুটি আমি করব না। হুঁ… স্পেশাল ট্রিটমেন্ট থেকেও দু’জনের কেউ-ই বঞ্চিত হবে না! আর… আমার স্পেশাল ট্রিটমেন্ট যে কতটা স্পেশাল, সে এক্সপিরিয়েন্স তোমার থেকে বেশি আর কার হয়েছে! মিসেস চৌধুরী যে রাজি হতে বাধ্য এটা ততদিনে সে বুঝে গিয়েছিল।
আমি বুঝলাম ঘাই হরিণী ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু ফাঁদ কেটে বেরনোর কোনও উপায় নেই।… আমি দু’-বছর আগে তার পাতা ফাঁদে আটকে পড়ে প্রথম প্রথম— যখন মায়ের মুখ খুব মনে পড়ত— ছটফট করেছি, ফাঁদ কেটে বেরনোর চেষ্টা করেছি। প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই ভেবে মর্মান্তিক গ্লানি বোধ করেছি। কিন্তু নিষ্ফল চেষ্টায় যেন আরও বেশি ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি। আর তারপর… কেমন নেশার কবলে পড়ে কবে যে নিজেকে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছি তার আর খোঁজ করিনি। চিত্রার অমন পূত-পবিত্র ভালবাসাকে কেমন এতটুকু মর্যাদা দিইনি! ওর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করছি বুঝতে পেরেও নিজেকে সরিয়ে আনতে পারিনি। কিসের মোহে আটকে পড়ে যে নিজের এমন সর্বনাশ করলাম, কী এমন মোহ যে, তা থেকে আর সারাজীবন উদ্ধার পেলাম না— নশ্বর দেহ ছেড়ে যাওয়ার সময়ও তা রহস্যই রয়ে গেল!… আটক ঘাই হরিণী মিসেস চৌধুরী যখন বুঝল ফাঁদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও আশা নেই, সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। এমনকি রমার সঙ্গেও কোনও পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করল না। প্রায় কুড়ি ভরি সোনার গয়না এবং একটা জমি বিক্রি করে সে দশ লাখ টাকা আমার হাতে তুলে দিল।
বিয়ের পরে পরেই রমা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, কী ব্যাপার বলো তো, হুট করে জমি-গয়না বিক্রি করে মা তোমার হাতে নগদ দশ লাখ টাকা দিয়ে দিল! আর শুধু তাই নয় আমাকেও তোমার হাতে তুলে দিল! এ যেন সেই অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা তুলে দেওয়া। কিন্তু কেন! মা কেন এমন করল তা সত্যিই কিন্তু আমার মাথায় ঢোকে না!
আমি রহস্যপূর্ণভাবে হেসে বলেছিলাম, আমার কাছে যে জাদুদন্ড আছে!
তুমি মজা করছ করো। কিন্তু কারণটা আমার সত্যিই ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে। আমার মায়ের মতো এমন উচ্চ বংশজাত, উচ্চ শিক্ষিত মহিলা তোমার মধ্যে কী এমন দেখেছিল, যাতে এমন সিদ্ধান্ত নিল?
দ্যাখো, এ প্রশ্নের উত্তর তোমার মা-ই ভাল দিতে পারবে। কারণ সিদ্ধান্ত তো আমি নিইনি, তোমার মা নিয়েছিল। সুতরাং, প্রশ্নটা তুমি তোমার মাকেই কোরো, আমাকে এখন নিষ্কৃতি দাও।
এর কিছুদিন পর রমা নিজে থেকেই জানাল, বুঝলে, মাকে আমি প্রশ্নটা করেছিলাম। কিন্তু মা কোনও পরিষ্কার উত্তর তো দিলই না, উল্টে আমার ওপর রেগে গিয়ে বলল, আমার বিষয়-সম্পত্তি আমি কী করব, না করব, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ ব্যাপারে আমি কাউকে কোনও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই!
আমিও মাকে সহজে ছাড়িনি। সমান তেজ দেখিয়ে বলেছি, কে বলেছে তুমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নও? আমাকে কৈফিয়ত যদি না-ও দাও, দাদাকে তো কৈফিয়ত দিতে তুমি বাধ্য।
তোমার সে দাদা কখনও বিদেশ থেকে ফিরলে তো!
তুমি জানলে কী করে?
আমার সিক্সথ সেন্স বলছে।
তোমার সিক্সথ সেন্স বলছে, না তোমার কীর্তিকলাপ দাদার মনে যে ঘৃণা জাগিয়েছে, সে সম্পর্কে নিঃসংশয় চিত্ত হওয়ায় এ কথা তুমি এত নিশ্চিত হয়ে বলছ!
তোমার যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! ভুলে যেয়ো না তুমি আমার মেয়ে। ইচ্ছা করলে তোমাকে আমি সমস্ত সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত করতে পারি।
সত্যিই কি সেটা তোমার পক্ষে করা সম্ভব! আমার বাবার সম্পত্তিতে তোমার যতটা অধিকার, ততটা অধিকার আমার এবং দাদারও।
বটে! কে বলেছে তোমার বাবার সম্পত্তি? কান খুলে আজ শুনে রাখো, সমস্ত সম্পত্তি তোমার বাবা আমার নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছে।
দাদা এ খবর জানে!
জানে হয়তো। তবে আমি নিজে মুখে রমিতকে জানাইনি। তোমার বাবার কাছ থেকে শুনলে শুনে থাকবে!
তবে মিসেস চৌধুরীর দিল বটে! দেওয়ার ব্যাপারে কখনও কোনওদিনই এতটুকু কৃপণতা করেনি! দিতে পারতও বটে! সবাই তো চাইলেও এ ভাবে ভরিয়ে দিতে পারে না। যাকে বলে একেবারে জমিদারি মেজাজ! ওর পূর্বপুরুষ যে এক সময় জমিদার ছিল, ওর শরীরে যে জমিদারের রক্ত বইছে তা ওর প্রতিটা আচরণ থেকে ফুটে বেরত।
মজার কথা, দশ লাখ টাকা দামে জমিটা আমার মাধ্যমেই বেচা-কেনা হল। তা থেকে তিন লাখ টাকা দালালি খেলাম আমি। ক্রেতা জমিটা বারো লাখ টাকায় কিনলেও মিসেস চৌধুরীর হাতে পৌঁছল দশ লাখ টাকা। বাকি দু’ লাখ টাকা পকেটস্থ করলাম আমি। আর ক্রেতাকে এই জমিটা করে দেওয়ায় ক্রেতার কাছ থেকে পেলাম আরও এক লাখ টাকা। এটা ছিল আমার জীবনে প্রথম দালালি। আর এই প্রথম দালালিতেই এমন লাভের মুখ দেখলাম যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম— জমির দালালি-ই হবে আমার ভবিষ্যতের পেশা। এই কারবারেই আমি তেরো লাখ টাকা ইনভেস্ট করলাম। অশুভ তেরো শুভর জন্য হয়ে উঠল সৌভাগ্যসূচক। অন্য যে বিজনেসের কথা ভেবেছিলাম, তা লাটে তুলে দিয়ে জমি কেনা-বেচার ধান্দাই হয়ে উঠল আমার ধ্যান-জ্ঞান।
ধর্মাবতার দেখছিলেন শুভ কী ভাবে কারবারের স্বার্থে নিজেকে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিতে লাগল। চাকরিটা অবশ্য সে তখনও ছাড়েনি। যেমন ছাড়েনি চিত্রাকে। তার সমস্ত পার্থিব চাহিদা মেটাচ্ছিল ঘাই হরিণী এবং রমা। সেই অর্থে চিত্রার কাছে তার কোনও স্থূল চাহিদা ছিল না। তবু কোনও এক অলখ টানে চিত্রার সঙ্গে সে এই অপার্থিব সম্পর্ক বজায় রাখতে ভীষণ আগ্রহী ছিল।
চাকরি যখন তার কাছে আর বাধ্যতা রইল না, সে সেটাকে ছাড়ার ব্যাপারেও উদগ্রীব হল না। তার প্রথম পাওয়া চাকরি বলে সেটাকে কেন্দ্র করে তার একটা অন্য রকম ভাল লাগা ছিল। কিন্তু গোলামি ব্যাপারটা তার এত অপছন্দের ছিল যে, সেই ভাল লাগাটা আর অত বেশি গুরুত্ব পায়নি। তবুও গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চাকরি করতেই হবে এই বাধ্যবাধকতার বাইরে এসে তার চাকরিটার প্রতি এক নতুন মায়া তৈরি হল। সেই মায়া থেকে এবং খাস কলকাতায় চাকরির সূত্রে মহানগরকে আরও বেশি চেনা-বোঝা-জানার সুযোগ পাওয়া যাবে—সেই স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সে আরও বছর চারেক ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে চাকরি করেছে। তার মধ্যেই দালালিতে সে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছে। একদিকে— জমি বিক্রি করছে যারা, সেই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারে তার যাতায়াত বাড়ল; উল্টোদিকে— যে সমস্ত বর্ধিষ্ণু পরিবার জমি কিনছে, তাদের অন্দরমহলেও সে প্রবেশাধিকার লাভ করল। সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে মানুষের নোংরামো দেখে মানুষের মুখোশধারি শয়তানদের সে চিনতে শুরু করল। সে নিজের চোখে দেখল সামান্য অর্থের জন্য পয়সাওয়ালা মানুষও কেমন সব করতে পারে! যার অর্থ নেই অথচ জমি আছে, সে-ও কেমন জমিকে অর্থমূল্যে বদলে নেওয়ার জন্য লালায়িত হয়! তার মনে পড়ত তাদের পরিবারের কথা। তাদের সংসারে না-ছিল অর্থ, না-ছিল জমি। অথচ ছিল স্থিতি, ছিল শান্তি। তারা আর্থিক মাপকাঠিতে দরিদ্র ছিল, কিন্তু অন্তর্জগতে গরিব ছিল না।
অবশ্য সে যে এই প্রথম প্রকৃত গরিব-মানসিকতা দেখল তা নয়। আর্থিক দুরবস্থার সম্মুখীন না-হওয়া এক শ্রেণির ধান্ধাবাজ, অন্তরে গরিব মানুষকে সে স্কুল জীবন থেকেই চিনে এসেছে। স্কুলে সায়েন্স এক্সকারশনে যাওয়ার জন্য যে সামান্য মূল্য ধার্য হত, সেটুকুও যাতে না-দিয়ে মুফতে যাওয়া যায়, তার জন্য দোতলা বাড়ির বাইকে চাপা ছেলেকে সে দেখেছে, নিজেকে গরিব প্রমাণ করার জন্য ইনকাম সার্টিফিকেট এনে হাজির করতে। অথচ তার নিজের ক্ষেত্রে ছেলে পড়িয়ে টাকা জোগাড় করতে হলেও সে কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিতে চায়নি নিজের গরিবিয়ানা। সে শুধু বোঝার চেষ্টা করেছে, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করে’ছ মহান’ পঙক্তিটির তাৎপর্য।
তাই ব্যঙ্গের হাসি হেসে সে তথাকথিত গরিবের চোখের জল মোছানোর কর্তব্য সাধন করতে লাগল, আবার একযোগে বড়লোকের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্বও নিল। সে নিজেকে অর্থের স্রোতের মধ্যে আবিষ্কার করল। মিসেস চৌধুরী দেখল আর দেরি করাটা ঠিক হবে না। শুভর ওপর থেকে তার বিশ্বাস উঠতে শুরু করেছিল। সে বুঝেছিল শুভ তাদের একদম পথে বসানোর আগে কিছু একটা করে তাকে আটকাতেই হবে। তাই সে শুভকে প্রস্তাব দিল তার একমাত্র মেয়ে রমাকে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য। সে চাইছিল রমার সঙ্গে শুভর বিয়েটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিতে। বিয়ের মতো সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে নিজের মেয়ের মাধ্যমে তাকে সে বাঁধবে ভেবেছিল।
আমি আবার মনে মনে হাসলাম। হায় রে মূর্খ নারী! তোমার রূপ এবং শরীরের ফাঁদে আমাকে আটকাতে না-পারার ব্যর্থতা সত্ত্বেও তুমি কী করে এমনটা ভাবতে পারলে! তোমার মাথায় কেন এটা ঢুকল না যে, আমি কোথাও আটকে পড়ব বলে জন্মাইনি। আমাকে কোনও বাঁধনে বাঁধা যায় না, কোনও নিয়ম দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
রমাকে বিয়ে করতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। কারণ ততদিনে একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, চিত্রার সঙ্গে আমার ঘরবাঁধা সম্ভব হবে না। আমি চাকরি পাওয়ার আগে এই কাঠবেকার আমার হাতে চিত্রাকে সহজে তুলে দেবে না বলে,আমাদের সম্পর্ক মাত্র চার বছর গড়াতে না গড়াতেই, ওর পরিবার অন্য জায়গায় চিত্রার বিয়ের জন্য দেখাশোনা চালু করে দিয়েছিল এবং চিত্রাও সামান্য অপেক্ষাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে নিমরাজি হয়েছিল। আলোর ইশারা দেখতে না-পেলে মানুষ বুঝি একটু তাড়াতাড়িই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি চাকরি পাওয়ার পর চিত্রা অবশ্য অনেক শক্তপোক্ত হয়ে আমার জীবনে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ওর আগের সিদ্ধান্তকে আমি ভুলতে পারিনি। দ্বিতীয়ত চিত্রাকে আমার এই পূতিগন্ধময় জীবনে জড়ানোটা ঠিক হবে না। চিত্রা হয়তো, হয়তো কেন সত্যিই, আমার এই সিদ্ধান্তকে বুঝে উঠতে পারেনি। ও ভেবেছিল আমি ওকে নিদারুণ ভাবে ঠকাচ্ছি। কিন্তু আমি যে নিজের কাছে কেমন ঠকে গিয়েছি, এটা যদি ও বুঝতে পারত তাহলে ও এতটা কষ্ট পেত না, আমার জন্য ওর কষ্ট হত। সেই যে চিন্ময়ের কাছ থেকে ও — আমার রমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে— জানল তারপর শত চেষ্টা করেও এ জীবনে আর চিত্রার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা সম্ভব হল না। আমি শুধু যোগাযোগ হলে ওকে জানাতাম, চিত্রা, আমি তোমার প্রেমকে কখনও অমর্যাদা করিনি আর করিনি বলেই আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। জীবনের প্রথম প্রেমকে কেউ ভুলতে পারে না চিত্রা। তাই আমিও আমাদের প্রেম এবং তোমাকে কখনও ভুলব না।
শাশুড়ি হওয়ার পর ঘাই হরিণীর মনে হয়তো সাময়িক কোনও পরিবর্তন এসে থাকবে। সে আর আমার ভোগে লাগতে চাইছিল না। অবশ্য বিয়ের মাস ছয়েক আগে থাকতে আমিও মহিলার শারীরিক সান্নিধ্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু গৃহপ্রবেশের রাতের অভিজ্ঞতা আমাকে এমন রোমাঞ্চিত করেছিল আমি কিছুতেই আর সামলে-সুমলে রাখতে পারছিলাম না। হয়তো তবুও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজের প্রকৃতিকে বশে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম। আর রমা তো ছিলই! কিন্তু যখন দেখলাম মহিলা— শুধু আমার শাশুড়ি হয়েছে বলে— সংকোচবশত দূরে সরে থাকতে চাইছে, তখন নিজের নিয়ম নিজে তৈরি করার বাধ্যবাধকতায় মহিলাকে— অজগর যেভাবে ছোট ছাগলছানাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে গ্রাস করে — নতুন উৎসাহে একটু একটু করে গিলতে লাগলাম। শাশুড়ির নববধূসুলভ প্রাথমিক লজ্জা দেখে আমার কাছে বিষয়টা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠত।
এটা আশ্চর্যের হলেও সত্যি মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে রমা আমাদের বিয়ের পরও অন্ধকারে ছিল। কিন্তু সে না-থাকা সত্ত্বেও চৌধুরী বাড়িতে আমার এত ঘন ঘন যাওয়া এবং অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা থেকে রমার কিছু একটা মনে হল। তার উপর কানাঘুষো তো ছিলই। সরলমতি বলেই সে এতদিনে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। অন্য কেউ হলে কবেই দু’য়ে দু’য়ে চার করে ফেলত। রমা একদিন আমাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাল। কিন্তু রমার ঘোরতর সন্দেহ এবং অভিযোগ— মায়ের সঙ্গে তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো?— আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছিল। আমার খুব রঙ্গ লাগত যখন আমি দেখতাম চল্লিশের যে অভিজ্ঞ মহিলা আমাকে বাঁধতে পারেনি, তার মেয়ে হয়ে কিনা আঠারোর অনভিজ্ঞা আমাকে বাঁধবে বলে ভাবছে!
ধর্মাবতার অনুভব করলেন শুভ দালালিতে নেমে—রোজগার শুরু করার দু’বছরের মধ্যেই— বুঝে নিয়েছিল বর্তমান সময়ে টাকা থাকলে এ দুনিয়ায় সব পাওয়া যায়। মানুষ যেন বড়লোকের পায়ে আনুগত্য প্রকাশের জন্য কুঁইকুঁই করছে। মায়া-মমতা-স্নেহ-ভালবাসা-প্রেম— এগুলো অবশ্য টাকা থাকলেও পাওয়ার ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু টাকা থাকলে তবু এগুলো পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু টাকা না থাকলে এগুলো পাওয়ার সম্ভাবনা দিনে দিনে কমে আসছে। আগে মানুষে-মানুষে— বিশেষ করে সংসারের মধ্যে— পারিবারিক সম্পর্কের ভিত যখন অনেক মজবুত ছিল তখন এই সুকোমল অনুভূতিগুলো অর্থমূল্যে বিবেচিত হত না। স্ত্রী স্বামীকে অকারণেই ভালবাসত, স্বামী স্ত্রীর প্রতি প্রেম অনুভব করত, বাবা-মা স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানের প্রতি স্নেহবৎসল হত, ভাই-বোনের মধ্যে বেহিসেবি মায়া-মমতার প্রকাশ লক্ষ করা যেত। মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, সহমর্মিতা অনুভব করে সমব্যথী হত।
মানুষ যত স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়েছে, আধুনিকতার নামে যত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দিয়েছে, সমাজে সম্পর্কের গিঁট তত আলগা হয়েছে। আর সেখান দিয়ে শুভর মতো মানুষের প্রবেশাধিকার সহজসাধ্য হয়েছে। সম্পর্কহীন বা ফোঁপড়া সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা একক মানুষের ভোগপ্রবৃত্তিও আর সীমায়িত থাকতে চায় না, কোনও বন্ধন তাকে আটকে রাখতে পারে না। শুভরা তাদের কাছে আসার আগেই তারা যেন এরকমই কাউকে পাশে পাওয়ার জন্য উদগ্র অপেক্ষায় দিনাতিপাত করতে থাকে। অর্থ থাকুক আর না-থাকুক তাদের মতো অভাবী সত্যিই কেউ হয় না।
সুতরাং আমি এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের মতো আমি ভোগের শাসন চালাতে লাগলাম। সত্যি বলতে কী, অনেক চেষ্টা করেও যখন আমি আর চিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিনি তখন আমি নিজের জন্য আর কোনও বন্ধনরজ্জুর অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। আমি মা-বাবাকে ছেড়েছি, চিত্রাকে হারিয়েছি, নিজেকে জ্বালিয়েছি। আমি সব… সব ভোলার জন্য মোহিত সৌন্দর্যৈ অবগাহন করেছি।
তবে চল্লিশের মহিলা এবং রমার সৌন্দর্য আমার মধ্যে যে সৌন্দর্যবোধ তৈরি করে দিয়েছিল তাতে আমি তন্বী সুন্দরী ছাড়া অন্য কোনও দিকে তাকাতাম না। আমার মনের মতো না হলে আমি তাকে কোনও গুরুত্বই দিতাম না। অনেকেই নিজেকে আমার কাছে উজাড় করে দিতে চেয়েছে, কিন্তু আমি সেদিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করিনি। অথচ নিজের পছন্দের সুন্দরী হলে আমি আর কোনও কিছু নিয়ে দু’বার ভাবিনি। মা-মেয়ে, শাশুড়ি-বউমা, বউদি-ননদ, দুই জা, দুই বোন — এসব আমার ক্ষেত্রে কোনও বাধা হয়নি। বরঞ্চ এইরকম ক্ষেত্রে আমার ভাল লাগার মাত্রাটা যেন অনেক বেড়ে গিয়েছে।
ধর্মাবতার মূল্যায়নের মাপকাঠি প্রলম্বিত করলেন। দেখলেন শুভ কারও সঙ্গে নিমকহারামি করেনি। কোথাও জোর-জবরদস্তি করেনি। সে ধর্ষক নয়। অবশ্য তাকে ধর্ষক নয় বলাটাও ঠিক হবে না। কারণ সে কোনও ব্যক্তি নারীকে ধর্ষণ না করলেও সমাজকে ধর্ষণ করেছে।… কিন্তু সে কী করবে! সমাজ ধর্ষিত হয়েও প্রতিবাদের পথে হাঁটে না, প্রতিরোধে শক্তি প্রদর্শন করে না, নিন্দায় মুখর হয় না। উপরন্তু পুরো বিষয়টা ম্যারিটাল রেপের মতো মুখ বুজে চুপচাপ সহ্য করে; রশোমনের দোহাই, হয়তো উপভোগও করে!
শুভর সবথেকে বড় গুণ সে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েনি।… এমন দেবদুর্লভ গুণের অধিকারী মানুষ সহজে চোখে পড়ে না। এটাই হয়তো তার তথাকথিত সাফল্যের সবচেয়ে বড় রসায়ন।… সে মোহ দ্বারা চালিত হলেও মোহের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। অবশ্য এর কারণও আছে। তার রূপের মোহ যথেষ্ট, প্রেমের কোনও মোহ নেই। চিত্রার অতলস্পর্শী ভালবাসা তার ভালবাসা ধারণের অমৃতকলস এমন কানায় কানায় পূর্ণ করে রেখেছিল, সেখানে দীর্ঘদিন আর অন্য কারও প্রেম প্রবেশাধিকার পায়নি। অবশ্য অমৃতা জীবনে আসায় ভালবাসা এবং প্রেমের পার্থক্য সে প্রথম উপলব্ধি করে। আর তখনই সে বুঝতে পারে রূপের মোহে সে ছুটে গিয়েছে এক নারী থেকে আর এক নারীতে কিন্তু প্রকৃত প্রেম তার জীবনে আসেনি বলে সে প্রেমের মোহে কোনও নারীতে আটকে থাকেনি।… এটা আশ্চর্যের বিষয়— সে কোনও দিন বারবনিতা সঙ্গ করেনি, এসকর্ট সার্ভিস নেয়নি! ঘরের বধূ, ঘরের কন্যা ছাড়া তার অন্য কিছুতে রুচি হয়নি। তার পছন্দের নারী শরীরে সে একাই রাজ করেছে। অবশ্য তাদের স্বামী থাকলে সে বেচারারা একটু-আধটু প্রসাদ পেলেও পেয়ে থাকতে পারে! তা-ও সেটা তার অলক্ষ্যে বা অজান্তে। কারণ শুভর বিশেষত্ব এই যে, তার মেয়াদে তার চাষের জমিতে সে অন্য কারও প্রবেশাধিকার একদমই সহ্য করে না। যেখানেই সে দেখেছে তার অধিকৃত শরীরক্ষেত্রে সে একক দখলদার থাকছে না, সে তৎক্ষণাৎ সেই ক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছে। পরে প্রয়োজনে ডাকলেও তার আর সাড়া পাওয়া যায়নি।
আর যারা আমার চাষযোগ্য জমি হয়ে থেকে গিয়েছে, আমি তাদের দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। অবশ্য তাদের আমি রক্ষিতা করে নিজের কাছে এনে রাখিনি, সংসার থেকে সরিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখিনি। নিজের সংসারে রেখেই তাদের আমি যথেচ্ছ ভোগ করে গিয়েছি। তাদের অর্থে মুড়ে রেখেছি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি। ফলে পরিবারের অন্যান্য লোক মুখ খুলতে পারেনি। অন্য সদস্যদের বিরোধ প্রদর্শনের ন্যূনতম প্রচেষ্টা সুযোগ-সুবিধাপুষ্ট মেয়েটির প্রতিরোধেই কার্যত খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে। আলাদা করে আমাকে আর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরো পরিবারের এই অসহায়তা আমাকে অসম্ভব তৃপ্ত করেছে।
আমি কোনও সংসার ভাঙিনি। শুধু পারিবারিক বন্ধনের কাঠামোকে ভিতর থেকে ঘুণপোকার মতো একটু একটু করে নষ্ট করে দিয়েছি; সম্পর্কের ভিতকে নড়িয়ে দিয়েছি। আমি কোনও নারীকে জীবনে গ্রহণ করিনি, সকলকে অধিগ্রহণ করেছি। আমার উপর ভার হিসাবে চাপবে, সে সুযোগ আমি কাউকে দিইনি। ভারগ্রহণ না করেও আমি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছি— যে দায়িত্ব পালন সংসারের লোকও করে না, বা পেরে ওঠে না।
প্রলম্বিত মাপকাঠির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন ধর্মাবতার। দেখতে পেলেন শুভ কয়েকশো মানুষের কর্মদাতা, অন্নদাতা। অবশ্য সে শুধু দান করেই ক্ষান্ত হয়নি, সে গ্রহণও করেছে। সে মস্ত বড় গ্রহীতা — মানুষের মস্তিষ্ক, মেরুদন্ড এবং কোমল অঙ্গ দু’হাত ভরে গ্রহণ করেছে। সে লজ্জা পায়নি, সংকোচ করেনি, বিনয় দেখায়নি। দেখায়নি ঔদ্ধত্য, করেনি দাবি। তার দানের বিনিময় হিসাবে সবই স্বাভাবিক নিয়মে তার কাছে ফিরে এসেছে। সে-সব প্রত্যাখ্যান করে সে মহান সাজতে চায়নি। বরঞ্চ পৃথিবীর যা কিছু ন্যাকা মহত্ব তা দুর্বার জীবনচর্যায় চরম অহমিকার সঙ্গে সে দু’পায়ে মাড়িয়ে গিয়েছে, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সে নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছে— কোথাও কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিস্পর্ধা নেই কেন! স্বেচ্ছার রাজত্ব, স্বৈরাচারের সাম্রাজ্যবিস্তার কী ভাবে এত নিষ্কন্টক হতে পারে তা তার মাথায় ঢোকেনি।
ধর্মাবতার আগ্রহী হলেন এটা দেখে যে, কী অনায়াস দক্ষতায় গ্রাম সমাজের প্রধান তিনটি স্তম্ভ — বারোয়ারি, ক্লাব, পার্টিতে শুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। বারোয়ারিতে সাধারণ সদস্য থেকে শুরু করে সে সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছে। অর্থের বলে বলীয়ান হয়ে একের পর এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। কলকাতার দল এনে দশরাত্রি যাত্রার আসর বসিয়েছেএবং সেটাকে বারোয়ারির বাৎসরিক মিলনমেলা করে তুলেছে। কোনও পুজো ছাড়াই ইংরেজি বছরের শুরুতে দশদিন দিনেরবেলা খেলাধূলা, খাওয়া দাওয়া, মেলা আর রাতেরবেলা বিনা পয়সায় অপেরা পার্টির যাত্রা দেখার সুযোগ করে দিয়ে সে বারোয়ারির সকলের প্রশংসাধন্য হয়েছে।
ক্লাবের যে দুর্গাপুজো টিমটিম করে হত, যার প্যান্ডেলকে বলা হত শশাভাড়া, সেই দুর্গাপুজোকেই থানার অন্যতম সেরা পুজোয় পরিণত করেছে সে। পুজোর বাজেট আশি-নব্বই হাজার থেকে একলাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পনেরো-ষোলো লাখ টাকা। তার মধ্যে চোদ্দো-পনেরো লাখ টাকা সে নিজে দিয়েছে, কোথাও কোনও কার্পণ্য করেনি।
ভাসানের দিন শোভাযাত্রায় বেরিয়ে ডিজের তালে তালে ছেলেদের তান্ডবে লাস্যের লীলা ছড়িয়েছে মেয়েরা। উদ্দাম মাদকতায় তারা ভেঙেছে সব বাঁধ, চুটিয়ে উপভোগ করেছে মুক্তির স্বাদ। এতদিনের অবদমিত সংরাগকে এই প্রথম তারা বন্ধনহীন উল্লাসে উদযাপন করতে পেরেছে। শুভ মিত্রের নামে উঠেছে জয়ধ্বনি।
ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় সে ফুটবলের গোল্ডকাপ, ক্রিকেটের বত্রিশ দলীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে। আয়োজিত হয়েছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, গ্র্যান্ড ফিস্ট— ছুটেছে মাংস এবং মদের ফোয়ারা। খরচের সিংহ ভাগই বহন করেছে শুভ।
সে নিজে যাত্রাপালা লিখে নির্দেশনার জন্য দক্ষ নির্দেশক জোগাড় করেছে। তারপর সেই যাত্রাপালায় নায়কের ভূমিকায় নিজে অভিনয় করেছে। এমনকি সে বাংলা সিনেমার প্রযোজক হওয়ারও হিম্মত দেখিয়েছে। টালিগঞ্জের নায়ক-নায়িকা-পরিচালক গ্রামে শুটিং করতে এসেছে। গ্রামের মানুষকে সে সুযোগ করে দিয়েছে রূপালি পর্দার দূরের নক্ষত্রদের কাছ থেকে দেখার।
সে ক্লাবে এবং বারোয়ারিতে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা পরিষেবার বন্দোবস্ত করেছে। ক্লাবের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স কেনার ব্যাপারে সকলে যাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তার জন্য বিরাট লটারির আয়োজন করেছে।
এইভাবে আখেরে আমার পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত হয়েছে, জমি হয়েছে মজবুত। কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি আমি আসলে এইভাবে গ্রামসমাজকে নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে তাৎক্ষণিক আধুনিকতার মোড়ক চিনতে শিখিয়ে ভিতর ভিতর তার বুননকে আলগা করে দিয়েছি।
সাহিত্যিক হয়ে উঠতে না পারার অদ্ভুত এক ব্যর্থতাবোধ থেকে আমি বইমেলা আয়োজক কমিটির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছি। শুধু আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা ট্যারা চোখে তাকিয়েছে। মধুলোভী শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ পদলেহন করতে শুধু বাকি রেখেছে। অযোগ্য অসংখ্য স্তাবক পরিবৃত আমি বইমেলায় দাপিয়ে বেড়িয়েছি। একদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষদের আগমনে বইমেলা ঋদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে আমার অঙ্গুলি হেলনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। আড়াল থেকে আমিই কলকাঠি নেড়েছি। সঞ্চালিকা থেকে আরম্ভ করে বাচিক শিল্পী, নৃত্য শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী— সব একা হাতে আমিই ঠিক করেছি। আমার ইচ্ছা করেনি বলে প্রথিতযশা স্থানীয় সাহিত্যিক বইমেলায় আমন্ত্রণ পর্যন্ত পাননি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চ অলঙ্কৃত করেছেন দ্বিতীয় সারির লেখক, কিন্তু কিছু যোগ্য লেখক আমার গুড বুকে না-থাকার কারণে ব্রাত্য রয়ে গিয়েছেন।আমার অপছন্দের নাট্যদল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমতি পায়নি। বইমেলার দিনগুলোতে আমার সৌন্দর্যপূজা অন্য মাত্রা পেয়েছে। সকলের চোখের সামনে যে সুন্দরীরা ডানা মেলে উড়ে বেরিয়েছে, সেই তারাই আমার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে — আহ্বান জানানো মাত্রই— অনুষ্ঠান মঞ্চের পিছনে, গ্রিনরুমে নির্মিত মধুনিলয়ে জন্মদিনের পোশাকে নিজেদের মেলে ধরেছে। যথেচ্ছ সংরাগে, সম্ভোগে আমি স্বেচ্ছাচারী অহংকে তৃপ্ত করেছি। বইমেলা হয়ে উঠেছে আমার রংদার জীবনযাপনের একজিবিশন হল এবং আমার স্বৈরাচারী জীবনের ডকুমেন্টারি ফিল্ম।
ধর্মাবতার চমৎকৃত হলেন শুভর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়ে। রাজনীতির ময়দানে ক্ষমতায় থাকা দলকে একসময় সে ঢালাও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। আবার গদি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আগের অবস্থান থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে ক্ষমতায় আসা দলকে অপর্যাপ্ত রসদ জুগিয়েছে। কোনও পার্টি-ই তাকে ঘাঁটায়নি। উল্টে যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে তাকে সুরক্ষায় মুড়ে দিয়েছে। শুধু স্থানীয় স্তরেই নয়, পার্টির ওপর মহল পর্যন্ত শুভর সাহায্যের হাত পৌঁছে গিয়েছে। পরিবর্তে অনেক উঁচু স্তর থেকেই তার জন্য নিরাপত্তা বলয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। সে তার দালালির ফাঁদে ফেলেছে ছোট-বড় উদ্যোগপতি তথা শিল্পপতিদের। তার লম্বা হাতের সৌজন্যে তারা প্রাপ্য প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রতারিত হয়ে তারা ভেবেছে প্রশাসনকে জানালে সুরাহা হবে। সেই আশায় প্রশাসনের সহায়তা প্রার্থনা করতে গিয়ে তারা চাক্ষুষ করেছে শুভ মিত্রের ক্ষমতা। তারা দেখেছে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্তা এবং আইন রক্ষকেরা শুভর মেহফিলে যোগ দিয়ে তাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তারা শেষ অবলম্বন হিসাবে বিচার ব্যবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু সেখানে যে আঠারো মাসে বছর! মহামান্য আদালত পরিচালিত শম্বুক গতির বিচারব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারা পাততাড়ি গোটাতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে। শুভকে ছাড়া উচিত হবে না ভেবে তাদের মধ্যে কয়েকজন সুপারি কিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছে এবং যোগাযোগ করেছে। কিন্তু সেখানে গিয়েও তারা দেখেছে শুভ মিত্রর নুন খাওয়া লোকজনদের। শুভর অর্থে পরিপুষ্ট লোকেরা সেখানেও ঘোরাফেরা করছে এবং ছড়ি ঘোরাচ্ছে। দু’-একজন তাকে নিজের হাতে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেও শুভর ক্ষমতা এবং প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ দেখে শেষমেশ পিছু হটেছে।
রাজনৈতিক দল আমাকে নেতা হিসাবে দলে বরণ করে নেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করেছে, আমাকে নেতৃত্বে দেখতে চেয়ে অনেক করে ধরেছে। কিন্তু ওই যে— আমাকে কোথাও আটকে রাখা যায় না। আমি কোনও দলে আটকে পড়তে চাইনি। আমার বিবেচনায় রাজনীতি যেমন সত্য এবং জঙ্গম, রাজনৈতিক শক্তিও তেমন সত্য এবং পরিবর্তনশীল; কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। তাই কোনও একটি দলে নাম লেখানো খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। অবশ্য দলবদল চাইলেই করা যায়! কিন্তু ওসব ঝুটঝামেলার মধ্যে আমি জড়াতে চাইনি। আমার বুদ্ধিতে আমি বুঝেছি রাজনীতির ক্ষেত্রে দলের থেকে দলীয় সমর্থকের গুরুত্ব বেশি। সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল নিজেদের তহবিল ভরানোর জন্য যত না আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যবহার করে, অর্থশালী ব্যক্তি নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার তাগিদে এবং আখের গোছানোর জন্য রাজনৈতিক দলকে তার থেকে বেশি ব্যবহার করে।বিশেষ করে তাদের মতো যারা ভাসমান সমর্থক, রাজনৈতিক দল তাদের তুরুপের তাসের মতো ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলের এই বাধ্যবাধকতাকে যাতে আমার সুবিধার্থে ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেই কারণে আমি কোনও দলে নাম লেখাইনি। আর কোনও পার্টির তকমা পিছনে পড়ে গেলে শুধু সেই দলের সমর্থকদেরই সমর্থন পাওয়া যায়, কিন্তু আমার যে প্রয়োজন আপামর জনগণের সমর্থন! কোনও জায়গায় আমার প্রতি যেন কেউ বিমুখ হয়ে না-পড়ে। আমি যেখানে যাব সেখানকার সমস্ত আলো যেন আমি শোষণ করে নিতে পারি। কোথাও যেন আমাকে অবাঞ্ছিত না-মনে হয়।
শুভর অফিসের দিকে ধর্মাবতার বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, তার অফিসটা সত্যিই একটা দেখবার মতো জিনিস! অফিস তো নয়, যেন অপ্সরার মেলা! একস্থানে এত সুন্দরীসমাবেশ সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। ষোলো থেকে আরম্ভ করে মধ্য চল্লিশ পর্যন্ত সুদর্শনাদের চয়ন করে এনে তাদের জন্য যেন হারেম তৈরি করে রেখে দিয়েছে! সুন্দরী হওয়াটা যে কতবড় যোগ্যতা শুভর অফিসে যোগ না-দিলে তাদের অজানা থেকে যেত। সেই অর্থে কোনও কর্মদক্ষতা না-থাকা সত্ত্বেও তাদের যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা, বেতন দেওয়া হয়, তা তারা অন্য কোনও জায়গায় কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু বিনিময়ে… সেই… সেই স্বেচ্ছা সমর্পণ! তা সে কী আর করা যাবে! ‘কত হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল’!
নিজেদের নিয়ে সুখী, নিজেদের অবস্থানে খুশি মানুষ রাজনীতি সচেতন হয় না। সুতরাং, শুভর অফিসে কোনও রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেনি। পরাক্রমশালী সম্রাটের সাম্রাজ্যে সম্রাট এবং তার অনুগামী ছাড়া আর যারা থাকে তারা সাধারণ প্রজা— সেখানে কোনও রাজনৈতিক শক্তি কখনও পুঞ্জীভূত হয় না। শুভ-সাম্রাজ্যে অবশ্য কোনও অনুগামীরও স্থান নেই, সেখানে শুধুই শুভ মিত্র। সেখানে সে-ই রাজা, তার নীতিই রাজনীতি। সেখানে সে-ই প্রথম এবং শেষ কথা।
আমি শেষ দিকে হোটেল ব্যবসাতে ঢুকেছিলাম। আসলে মানুষ বিলাস-ব্যসন-ভোগের জন্য যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে, সেগুলোকে সে নিজের কুক্ষিগত করতে চায়। শহরের বিভিন্ন নামি-দামি ক্লাবের সভ্য হওয়ার সুবাদে সেখানকার লাইফস্টাইল, ভোগের অযুত আয়োজন আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে নাইট ক্লাবের নৈশ জীবনের মৌতাত আমার মনে আলাদা রোমাঞ্চ এনে দিত। রিসর্টের নিরালায় হারিয়ে যেতেও আমার খুব ভাল লাগত।তবুও… কী একটা অতৃপ্তি বোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত, মনে হত কিছুতেই জীবনকে চেটেপুটে উপভোগ করতে পারছি না। তাই নিজের সম্প্রসারিত ব্যবসাক্ষেত্রে ভোগের আরও আরও নিত্য নতুন আয়োজনে নিজেকে ঢেলে দিতাম।… আমার হোটেলে আমি নিজের জন্য একটা স্পেশাল স্যুইট বানিয়েছিলাম, যেখানে প্রবেশ করলে আমার অমরাবতীতে পৌঁছানোর অনুভূতি হত।
আমার অন্তরে জাগ্রত অমরাবতীর বাসনায় ধর্মাবতারের প্রশস্ত ললাটে কুঞ্চন পরিলক্ষিত হল। তিনি মনশ্চক্ষে অবলোকন করলেন সেই স্যুইটে অনাঘ্রাতা কুমারীদের নিয়ে গিয়ে তাদের কৌমার্য হরণের দায়িত্বে আমি কী ভাবে নিজেকে সমর্পণ করতাম। এই স্পেশাল স্যুইটের আমি নামকরণ করেছিলাম ‘ফার্স্ট এক্সপিরিয়েন্স’। এমন যথোপযুক্ত নামকরণ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। আমি যে কেমন রসিক নাগর ছিলাম তা আমার দেওয়া এই নাম থেকে ধর্মাবতার বুঝে নিলেন এবং উপলব্ধি করলেন স্পষ্ট বার্তা দিয়ে নির্লজ্জতাকে আমি কোন স্তর পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। তিনি পুনরায় সুস্মিত হতে চেয়েও অনভিজ্ঞাদের কথা স্মরণ করে ভাবগম্ভীর হয়ে উঠলেন।
ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে শুভর কর্মজীবন এবং সামাজিক অবস্থান অবলোকনে ব্রতী হলেন ধর্মাবতার। তিনি এতটুকু বিস্মিত হলেন না কর্মক্ষেত্রে শুভর সাফল্যের পরিচয় পেয়ে। সাফল্য সম্পর্কে অসফল মানুষের ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা-ই হোক না কেন, সফল মানুষের সাফল্য কিন্তু অনেকাংশেই স্বনির্মিত— তার মেধা-মনন-অভিলাষ-উদ্যম-শারীরিক ও মানসিক শ্রমের যোগফল। ভাগ্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ছাড়া আর কিছু নয়; রাজমুকুটে তা কোহিনুর মণি। কিন্তু মুকুটটা মানুষকেই নির্মাণ করে নিতে হয়।
যে কোনও কাজ সহজে বুঝে ফেলতে শুভর জুটি মেলা ভার ছিল। সহজে বুঝে ফেললে কী হবে, কার্য-সম্পাদনের সময় শুভর কিন্তু কোনও তাড়া থাকত না। ধীরে-সুস্থে-গুছিয়ে কাজ সে এমনভাবে করত, যা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশ সঠিক বলে পরিগণিত হত। তার উপর যে কোনও কাজ নিয়ে ছিল তার অসম্ভব খুঁতখুঁতানি। কোনও কাজ নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পেত না।
সাব-রেজিস্ট্রার পার্থসারথি মুখার্জীকে রেজিস্ট্রি অফিসের বড়বাবু বিবেক দাস একবার বলেছিলেন, স্যর, কী ব্যাপার বলুন তো, আপনাকে তো রেজিস্ট্রির সময় সব খুঁটিয়ে না দেখে কখনও কাগজে সই করতে দেখি না, কিন্তু শুভ মিত্রের কাজ হলে দেখি আপনার আর কিছু দেখার বালাই থাকে না, আপনি সব চোখ বুজে সই করে দেন! পার্থসারথি মুখার্জী মুচকি হেসে বলেছিলেন, বিবেকবাবু, আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা আসলে কিন্তু পুরোপুরি তা নয়। হ্যাঁ, টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমরা কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নই! কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু সেই লেনদেনটাই ফ্যাক্টর নয়, আসলে কাজের ব্যাপারে শুভ মিত্র টু মাচ সিরিয়াস আর প্রফেশনাল এবং টপ টু বটম পারফেকশনিস্ট। তাই ওর কাজে চোখ বুজে সই করলে ফেঁসে যাওয়ার অন্তত কোনও সম্ভাবনা থাকে না। আর সেটা বুঝি বলেই চোখ বুজে সই করি, বুঝলেন বিবেকবাবু!
শুধু রেজিস্ট্রি অফিস নয়, শুভ মিত্রের মাধ্যমে হাতবদল হওয়া জমির ক্রেতা-বিক্রেতা কাউকেই কখনও কোনও অকারণ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়নি। এমনকী বিএলআরও অফিসে জমির কনভার্সন-মিউটেশন মায় পরচা বের করে দেওয়া— সমস্ত দায়িত্ব সঠিক লোককে দিয়ে করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও কোনও কসুর করেনি শুভ মিত্র। সবচেয়ে বড় কথা তার নিজের করা অথবা দায়িত্ব নিয়ে কাউকে দিয়ে করিয়ে দেওয়া কোনও কাজে কখনও কোনও অসুবিধা দেখা দেয়নি বা অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে যাকে বলে ‘ডিসপিউট অ্যারাইজ’ করা, তা ঘটেনি।
শুভ মিত্র যে কাজের ছেলে তা যে কেউ সহজে বুঝতে পারত। তাই সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর প্রথমে তাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়ার কথা, সেই দায়িত্বভার তুলে না দিয়ে, দু’এক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্নকে দিয়ে যে কাজ করানোর কথা, সেই কাজের দায়িত্ব সরকারি দপ্তরের আধিকারিক তার হাতে তুলে দেয়। দায়িত্ব নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে শুভ খুব সহজেই তার অভিজ্ঞ ‘সিনিয়র’কে ছাপিয়ে যায়। এবং সেটা তার অথবা অফিসের সকলের কাছেই খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
সুতরাং কাজের সুবাদে শুভ মিত্রকে যারা চিনত, তাদের কাছে তার একটা আলাদা সম্মান ছিল। তাদের কাছে শুভ মিত্র ছিল একাধারে কর্মদক্ষতা এবং সাফল্যের আর এক নাম। তার সোশ্যাল স্টেটাস তার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, তার হাই লেভেল কানেকশন। তারা কেউ তার পাতি সামাজিক অবস্থান নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আসলে তারা হয়তো শিক্ষা-দীক্ষা-প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সমাজের মাথা হওয়ার যোগ্যতা রাখত, কিন্তু সেই বেগার খাটনিতে তাদের কোনও আগ্রহ ছিল না। তাদের যত আগ্রহ ছিল কেবল স্বার্থসিদ্ধিতে আর সেখানে শুভ মিত্রের সঙ্গে তাদের সমাজ-নিরপেক্ষ যোগাযোগই বেশি সুবিধাদায়ক বলে মনে হত। আর যাদের সমাজ নিয়ে মাথা ঘামানোর বাইরে সেই অর্থে কোনও কাজ ছিল না, সেই সাধারণজন ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ হিসাবে শুভর যে মূল্যায়ন করেছিল তা-ই তার সামাজিক অবস্থান নির্মাণ করে দিয়েছিল। তবে তা শুভর পক্ষে মোটেও সম্মানজনক বা সুখকর ছিল না। কিন্তু তা জানা সত্ত্বেও সে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিল না। সে একটা সহজ সত্য জানত। লোকে তাকে যা-ই ভাবুক না কেন, তথাকথিত সমাজ তাকে যে চোখেই দেখুক না কেন, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা যে-চৌম্বকক্ষেত্র, তাকে অস্বীকার করার উপায় কোনও ব্যক্তিমানুষ বা সমাজ— কারও নেই। ধর্মাবতার মুচকি হেসে ভাবলেন, ভাগ্যিস শুভ মিত্র তার চতুর্দিকে কোনও জ্যোতির্বলয় কল্পনা করেনি!
শুভ এবং তার সাম্রাজ্যের উথ্থান মানুষকে চমকে দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রসারণে মানুষ এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সেটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম বলে পরিগণিত হচ্ছিল। কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে কয়েকশো কোটি টাকার মালিক শুভ মিত্র চল্লিশে পৌঁছনোর আগেই জাগতিক উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। তারও যে পতন হতে পারে এটা সকলের কাছে অকল্পনীয় ছিল।
ধর্মাবতার খেয়াল করলেন আসলে শুভর কোনও কিছুই আর মানুষের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হত না। কোনও মহিলাকে তার-ই স্বামীর জমিতে বাড়ি করে দিয়ে সেই বাড়ির-ই বেডরুমে তাকে যথেচ্ছ ভোগ করা, আবার তার-ই মেয়েকে গাড়ি কিনে দিয়ে সেই মেয়ের সঙ্গে গাড়িতেই শরীরী খেলায় মেতে ওঠা— সব-ই লোকজনের কাছে খুব স্বাভাবিক ঠেকতে আরম্ভ করেছিল। শুভর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট ছিল কোনও ব্যাপারে এতটুকু লজ্জিত না হওয়া। লজ্জা বলে কোনও শব্দ তার অভিধানে প্রবেশাধিকার পায়নি। কিন্তু সে দেখেছে, তার নির্লজ্জতাকে সমাজ ধিক্কার জানায়নি। সমাজও তার মতো নির্লজ্জ হতে চেয়েছে। হতে পারলে গর্বে বুক ফুলে উঠেছে, আর না পারলে তার প্রতি ঈর্ষায় অম্লশূলে ভুগেছে।
আমার একটিই মেয়ে। আমার একমাত্র ফসল। আমি কিন্তু প্রথম যৌবনে চিত্রার গর্ভে আমার পুত্র সন্তান কল্পনা করে গল্প পর্যন্ত লিখেছি। তার নামকরণ ঠিক করেছি— শুভম। কিন্তু চিত্রাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় আমার সেই স্বপ্নকে আমি গলা টিপে মেরেছি। অন্য কারও গর্ভে আমি শুভমকে আনতে চাইনি। তাই ছেলে না-হয়ে মেয়ে হওয়ায় আমি আন্তরিক খুশি হয়েছি। আর কোনও চান্স নিইনি। অথচ আমি কত জমি যে চাষ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোথাও ভুল করেও বীজ বপন করিনি। আমি কখনও কোনও ফালতু সমস্যা তৈরি করতে চাইনি। আইনি ঝামেলায় ফেঁসে যাওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি যাতে ভবিষ্যতেও তৈরি না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থেকেছি। আমার যৌবন উপভোগের যৌবন, আমার জীবন উদযাপনের জীবন। তা যাতে কোনও ভাবে বাধাপ্রাপ্ত না হয় তার জন্য আমি প্রথম থেকেই সচেষ্ট থেকেছি।
ধর্মাবতার আশ্চর্যান্বিত হলেন শোকসন্তপ্ত রমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শোক ছাড়িয়ে তার মধ্যে কোথাও একটা ভার লাঘবের স্বস্তি তাঁর নজর এড়াল না। চিন্তিত ধর্মাবতারের পর্যবেক্ষণে উঠে এল গূঢ় তথ্য। শুভ-রমার একমাত্র মেয়ে আর কয়েকমাস পরে ষোলোয় পা দেবে। তাদের সেই মেয়ে শুভমিত্রা অসাধারণ সুন্দরী, ডানাকাটা পরী। রমা ভয় পেতে শুরু করেছিল। কারণ শুভকে তার মতো খুব কম মানুষ-ই চেনে। রমা খোঁজ-খবর করতে আরম্ভ করেছিল যে, শুভ এখন কোন বয়সের সুন্দরীদের নিয়ে বেশি মত্ত হয়ে রয়েছে। জেনে আতঙ্কিত হয়েছিল— ষোলো থেকে মধ্য-চল্লিশ— সব বয়সের সুন্দরীরাই তার নেকনজরে রয়েছে এবং সকলের প্রতি সে একইরকম আকৃষ্ট। রমার নিজের কথা মনে পড়েছিল। ষোলোতেই তো শুভ তাকে প্রথম গেঁথেছে। কিন্তু তার যদি সায় না থাকত তাহলে কি শুভ তাকে এত সহজে শিকার করতে পারত! তাই শুভমিত্রাকে যদি সফট টার্গেট না-হতে দেয়, তাহলে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হলেও হতে পারে। রমা এর আগে অনেকবার ভেবেছে—শুভর সঙ্গে তার যে এই বৈবাহিক সম্পর্ক, আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ করে সে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু তার মায়ের পরিণতি দেখে সে ভয় পেয়েছে। ভেবেছে একক নারীর জীবন অভিশপ্ত! শুভর সঙ্গে থেকে তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদে যে কোনও কাজ হবে না সে জানে। কিন্তু শুভকে ছাড়াটা তার নিজের পক্ষে কতটা ঠিক হবে বুঝতে না-পারায় সে অদ্ভুত এক দোদুল্যমানতার মধ্যে আটকে পড়েছে। কিন্তু মায়ের প্রাণ বলে কথা! তাই প্রতিবাদ ব্যর্থ হবে জেনেও সে— কোনও দিন কিছু না বললেও— এই প্রথম প্রতিরোধের দেওয়াল গড়ে তুলতে চেয়েছে। শুভমিত্রাকে আগলে আগলে রাখতে চেয়েছে। গোপনে চেষ্টা করেছে মেয়েকে হোস্টেলে বা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়ে মানুষ করার। যদিও তার সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। মেয়ে বাবাকে ভীষণ পছন্দ করে বুঝে সে আরও ভয় পেয়েছে… সে নিজে একসময় শুভকে যেমন পছন্দ করত, তার মেয়ের পছন্দও যেন তেমনধারা। এই প্রথম রমার রাতের ঘুম ছুটেছে। তার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে দেখে সে হতাশ হয়েছে। অবসন্ন ক্লান্ত দু’চোখে ঘুম নেমে এলেও সৌন্দর্যের পূজারি শুভ, সৌন্দর্যের আধার হিসাবে শুভমিত্রাকে পূজা করছে— এমন দুঃস্বপ্ন দেখে তার সে ঘুম ছুটেছে।
ধর্মাবতার গভীর পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হলেন শুভ মারা গিয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু। সে খুন হয়নি, কোনও দুর্ঘটনার কবলে পড়েনি, আত্মহত্যার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সে খুব স্বাভাবিক ভাবে, কাউকে বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে, কোনও রকম ভোগান্তি সহ্য না করেই, মস্তিষ্কে আচমকা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মারা গিয়েছে। অবশ্য এত বড় অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স কেউ আশা করেনি, তাই চারিদিকে এই মৃত্যুবার্তা ছড়িয়ে পড়লেও তা অপ্রত্যাশিত মৃত্যুসংবাদ হিসাবে রাষ্ট্র হয়েছে। যদিও কেউ কোথাও আন্তরিক কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হয় না। স্ত্রী রমা প্রাথমিক শোকের অভিঘাত কাটিয়ে উঠে গভীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। মেয়ে শুভমিত্রা থমকে গিয়েছে। জীবনে এই প্রথম এক অন্যরকম নতুনের সাথে পরিচয়ে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। পরিচিত জনেরা এক এক করে সব আসতে আরম্ভ করেছে। উপস্থিত সকলের অধিকাংশই চুপচাপ ঘটনাক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে অবশ্য কানাঘুষো ছাপিয়ে দু’-একজনের মৃদু কণ্ঠস্বর যে ভেসে আসছে না তা নয়। কেউ অবশ্য মিথ্যার পরাজয়, সত্যের জয় বলে যে মন্তব্য করছে এমন নয়।
আমার আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বুঝতেও পারছিলাম না কোন বাধায় এখনও আটকে রয়েছি। আমি চোখ বুজলাম। আর চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম আমার বাড়িতে ঢোকার মুখে একজন বৃদ্ধা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন তাকে ঘিরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। আরে! এ তো আমার মা! আর পিছনে যে বৃদ্ধ বসে কপাল চাপড়াচ্ছে সে তো আমার বাবা! কতদিন পর মা-বাবাকে দেখলাম। অদ্ভুত এক স্নিগ্ধ ভাললাগায় ভরে গেল আমার প্রজ্জ্বলন্ত অন্তঃস্থল। আঃ, কী গভীর প্রশান্তি!
আমি মা-বাবার জীবন উপান্তে তাদের সঙ্গ দিইনি। দিইনি বলছি কেন, দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করিনি। স্বেচ্ছাকৃত অবহেলা-অনাদর-অবজ্ঞায় ভুলে থেকেছি তাদের। চরম অবহেলিত হয়েও তারা কিন্তু তাদের সন্তানকে ভুলতে পারেনি। এত উপেক্ষা সত্ত্বেও আমাকে শেষ দেখা দেখবে বলে ছুটে এসেছে। আমার মধ্যে ফিরে এল সেই কষ্ট, মায়ের জন্য যে কষ্ট আমি পেয়েছিলাম খুব শৈশবে। কতই বা বয়স তখন আমার! বড়জোর চার-পাঁচ হবে। সেই আমার জীবনে অন্যের কষ্টে প্রথম কষ্ট পাওয়া। হয়তো বা শেষও। আমি আর মা মায়ের মেজো মাকে নিয়ে মামারবাড়ি যাচ্ছিলাম। মায়ের মেজো মা আমাদের বাড়ি এসে কয়েকদিন ছিল। বয়স্ক মহিলা। একা তো আর ফিরতে পারবে না। তা-ই বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে যাওয়া আর কী! মামারবাড়ি ঢোকার আগে তখন বেশ কিছুটা মাটির রাস্তা পায়ে হেঁটে পেরতে হত। বর্ষাকাল। বৃষ্টি পড়ছে। সাবধানে পা টিপে না চললে আছাড় খাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আর ঠিক সেটাই ঘটল। দু’হাতে দু’জনকে ধরে যথাসম্ভব সতর্ক হয়ে হাঁটতে থাকা মা একসময় আর সামলাতে পারল না। পা পিছলে যাওয়ায় মা একটু টাল খেল আর মায়ের হাত ফস্কে মেজো মা পগারের ধারে পড়ে গেল। বাড়ির ঠিক সামনেই। সেই পড়াতেই মেজো মা-র পা ভেঙে গেল। বাকি জীবন মেজো মা ভাঙা পা নিয়ে শয্যাশায়ী হয়ে কাটিয়ে দিল।
মাকে সেদিন মামারবাড়িতে কে কী বলেছিল জানি না। মা চুপচাপ একটানা কেঁদে যাচ্ছিল। এমনভাবে কাঁদতে মাকে আমি আর কখনও দেখিনি। মাকে কাঁদতে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমারও কান্না পাচ্ছিল। তবে সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম কি না আমার আজ আর মনে নেই।
মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। এ কী! মা যে দেখি আবার সেই সেদিনের মতো কেঁদে চলেছে। আমার পক্ষে আর নিজেকে সামলানো সম্ভব হল না। মা, মা গো, বলে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কান্নায় ভেসে ছটফট করতে করতে বারবার বলতে থাকলাম, মা, মা গো, পারলে তোমার এই অযোগ্য সন্তানকে ক্ষমা করে দিয়ো তুমি…! জানি না কখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে এসেছে!
ধর্মাবতারের রথে উঠে পাড়ি দেব বলে মনস্থির করার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ধর্মাবতার এবং তাঁর দ্বিচক্রবাহী শকট অন্তর্হিত হল।
নিজেকে ভারশূন্য বোধ করায় তাকিয়ে দেখলাম আমি ভাসমান। নীচে নজরে পড়ল কলামন্দির মঞ্চ। ঠিক দেখছি তো! চোখ কচলে দেখলাম, হ্যাঁ, ঠিকই দেখছি। কলামন্দিরে চিত্রাকে নিয়ে একসময় এতবার গিয়েছি যে না-চিনতে পারার কোনও কারণ নেই। আমি নিজেকে দেখতে পেলাম পিছনের রো-তে চিত্রার পাশে বসে আছি। বাইশ বছর পরে চিত্রার সঙ্গে আমার এই দেখা। চিন্ময় চিত্রাকে আমার সিদ্ধান্ত বিষয়ে জানানোর ঠিক আগের দিনে আমরা আজ পৌঁছে গিয়েছি। ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি আমার কোনও একটা কথা শুনে চিত্রার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। আমি… সেই সেদিনের শুভ মুগ্ধ চোখে তাকালাম চিত্রার দিকে। তাকিয়ে মনে হল ড্রেস-সেন্স সম্পর্কে ফান্ডা আছে বটে মেয়েটার! ক্যাজুয়াল পোশাকেও কী ভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয় সেটা যেন ওর কাছে জলভাত। আজকেরটা যদিও প্রি-প্ল্যানড। গতকালই ঠিক হয়েছিল আজ সন্ধ্যায় কলামন্দিরে আসার প্রোগ্রামটা। তবুও কোনও বাড়তি সাজের প্রয়োজন মনে করেনি চিত্রা। অফ হোয়াইট সাদা তাঁতের শাড়ি। শাড়ি জুড়ে সবুজ-কালো জলচুড়ি। পাড়ের একদিক হলুদ, অন্যদিক কালো। গলায় সরু চেন— পাথরটা এডি সেটিং। কানেও এডির টব। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। খোঁপা বাঁধা চুলে যুঁই-এর মালা। আর ঠোঁটে হালকা মেরুনের ছোঁয়া। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা এই সামান্য অ্যাক্সেসরিজ আর মেক-আপেই ফাটাফাটি লাগছে চিত্রাকে। সিম্পলি সুপার্ব!
আরে ওই যে রোদের মধ্যে আলো-ছায়ার মতো খেলা করছে— ওটা অমৃতা না! আমি হাত বাড়িয়েও কিছুতেই ছুঁতে পারছি না কেন? কই, কোথায় গেল অমৃতা? আবারও কি সে রোদে মিলিয়ে গেল!
আমার চোখে সব অন্ধকার হয়ে গেল কেন…! না, এই তো আবার দেখতে পাচ্ছি। কী ওগুলো…? পোস্টারের মতো দেখতে লাগছে না! হ্যাঁ, তাই তো, চারিদিকে কারা যেন পোস্টার সেঁটে গিয়েছে, আর দেখছি তাতে বড় বড় করে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা রয়েছে— ‘শুভ মিত্র অমর রহে’। এ বার আর ধর্মাবতার নয়, আমি সুস্মিত হলাম।
ভাসমান অবস্থায় আমার স্মরণপথে এলেন মেঘবাহন ইন্দ্র। আর দেবরাজের কথা মনে আসতেই দেখলাম আমি আস্তে আস্তে ময়ূরে পর্যবসিত হচ্ছি। সহস্রাক্ষতে রূপান্তরিত হওয়ায় আমার পক্ষে আর উড্ডীয়মান থাকা সম্ভব হল না। এক সুরম্য ভবন সংলগ্ন নয়নাভিরাম উদ্যানে নামতে বাধ্য হলাম। উদ্যান দূরত্ব থেকে যত মনোরম বলে প্রতিভাত হচ্ছিল, নৈকট্যে তা অনেকাংশে অনাকর্ষক বলে প্রতীয়মান হল। অবশ্য এমনটাই স্বাভাবিক। দূর থেকে আকাশনীল নিসর্গ শ্রীছায়া ফেলে নিবিড় সমুদ্রে। কিন্তু সাগর-স্নানে ঘোলা জলের নোনা স্বাদ সেই নান্দনিক সৌন্দর্যবোধের উপভোগ্যতা ব্যাহত করে। বাস্তবিক আমি জীবনে কাছ থেকে কোনও সৌন্দর্য দেখিনি। প্রিয় নারীর সঘন আলিঙ্গনে হাঁসফাঁস করেছি, কামনার দ্যুতি ছড়ানো রমণ-শরীর সৌন্দর্য অবলোকনের অবকাশ দেয়নি। চিত্রাকে রমণ-দূরত্বে চাইনি বলে এবং অমৃতাকে রমণ-নৈকট্যে প্রার্থনা করিনি বলে আজও তাদের সুন্দর দেখি। নির্মিত দূরত্বের কারণেই তাদের সৌন্দর্য অবিমিশ্র। সংস্পর্শের নৈকট্যে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেই আমি তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছি। যতটা কাছে এলে কোনও কিছু আর সুন্দর বলে প্রতিভাত হয় না, ততটা কাছ থেকে তাদের সৌন্দর্য আমি কখনওই অবলোকন করতে চাইনি। উদ্যানের মধ্যে দেখলাম উচ্চাবচ প্রস্তরস্তূপ। স্মৃতিপটে জাগরুক হল শত অহল্যার প্রস্তরীভূত দেহবল্লরী। কিন্তু স্মৃতিজলে অবগাহন করবার পূর্বেই এক কৃষ্ণসর্প ফণা বিস্তার করে আমার স্মৃতির সরণিতে এসে দাঁড়াল। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হওয়ার সাথে সাথে সেই বিষধর ফণীকে বদলে যেতে দেখলাম মিসেস চৌধুরীতে। ঘাই হরিণীর সৌন্দর্যে মোহিত হওয়ার পূর্বেই এক জাদুপুরুষ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রথম দর্শনে তাঁকে আমার মনে হল নটসম্রাট। গভীর পর্যবেক্ষণে বুঝলাম আমার সে ধারণা ভ্রান্ত। আসলে নীলাভ অঙ্গবস্ত্র এবং ময়ূরকন্ঠী উত্তরীয় পরিহিত ধর্মাবতার ২.০ স্পর্শ-দূরত্বে আমার জন্য ভোজ্যবস্তু নিয়ে অপেক্ষারত। আর আমি কী না কী ভাবছিলাম! অবশেষে আমি ভীষণ আশ্বস্ত বোধ করলাম। কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হল চরাচরে ধ্বনিত ‘ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি , ওঁ শান্তি’ বৈদিক মন্ত্র।
হৈমন্তিক বিষণ্ণতা।। ক্যাথারসিস
গা থেকে রোদটাকে কিছুতেই তুলতে পারছি না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করলাম। সফল না হয়ে ভাবলাম যাক গে যাক, রোদ আপনা-আপনিই সরে যাবে, এ তো আর জন্মদাগ নয় যে চিরকাল থেকে যাবে। তবুও আমার রোদ… কোনও আলো আর সহ্য হয় না। আমি যেখানে অন্ধকারের প্রতিমূর্তি সেখানে আমার ওপর কেন রোদ পড়বে! আমাকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য জোরালো কৃত্রিম আলো আমার মুখের ওপর ঝলসে উঠলে বলার কিছু ছিল না। তা বলে প্রাকৃতিক আলো— রোদ— তা-ও আমার মুখে নয়, যা আমি দেখতে পেতাম না— একদম হাতে এসে পড়বে, যা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে!
মানুষকে শাস্তি না দেওয়াটাও যে কতবড় শাস্তি তা কেউ বিবেচনা করে না। অন্যায় করলাম— অন্যায় নয়, অপরাধ— পাপ— সবাই জানল, অথচ কারও কোনও প্রতিক্রিয়া হল না! সবাই হেসে হেসে কথা বলল, মঞ্চে উপবিষ্ট হলাম, সংবর্ধনা দেওয়া হল, কর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। কর্মের পিছনে কর্মী মানুষটার পাপ নিয়ে কোথাও কোনও নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করা হল না!
জেসাস ক্রাইস্ট— বাংলায় জিশু খ্রিস্ট— তোমার কি দিন গিয়াছে? বাইবেল মোতাবেক তুমি পাপ না করেও পাপীদের হাতে ক্রুশবিদ্ধ হলে আর আমার হাল দেখো! আমি পাপী হয়েও পুণ্যাত্মাদের হাতে সম্মানিত হচ্ছি! না প্রভু, তাহলে তো তোমার দিন যায়নি। এ তো দেখি তোমার সার্থক পুনরুজ্জীবন। মানুষ ঘৃণা করতেই ভুলে গেল!
কিন্তু প্রভু, সেই যে দুর্বোধ্য বাণী— ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’— তার-ই বা প্রয়োগ কোথায়! এখানে আমরা সবাই পাপ এবং পাপীকে প্রশ্রয় দিই, সবকিছুই আমাদের কাছে আজ খুব স্বাভাবিক। আমরা এসব নিয়ে ভাবি না। আমাদের আরও অনেক গুরুগম্ভীর ভাবনা রয়েছে, তা নিয়েই আমরা ভাবিত।
আমি চাই সবাই আমাকে ঘৃণা করুক। সেই ঘৃণা, যা আমাকে সর্বক্ষণ দগ্ধ করবে, দগদগে ঘায়ের মতো আমার অন্তরে জাগ্রত থাকবে, যা থেকে উপশমের কোনও উপায় থাকবে না, যা আমার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে আমাকে এতটুকু শান্তি পেতে দেবে না। আমার চেতনায় সঞ্চারিত হোক নিজেকে ঘৃণিত বোধ করার সেই সুতীব্র যন্ত্রণা, যা অন্তরে অনুভূত হওয়ায় ক্লাস নাইনের ছাত্রী কাশ্মীরা ক্লাসের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আমার শিক্ষক বন্ধু সুবিমলকে— সে যখন ক্লাসে গিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল যে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিবর্তে আমাদের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা লালন-পালন করা উচিত এবং অসাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের বিকাশ ঘটানোই আশুকর্তব্য— বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘আপনারা তো আমাদের ঘৃণা করেন, স্যর?’ আমি চাই সবাই আমার পাপকে ঘৃণা করুক। পাপী হিসাবে আমাকে আরও বেশি ঘৃণা করুক। বিবেকের দংশন-টংশন আদিখ্যেতা ছাড়া কিছু নয়। অপর মানুষের অবিমিশ্র ঘৃণাই পাপীর উপযুক্ত পাওনা। তার ঘৃণ্য জীবন যাপনের কথা চতু্র্দিকে রাষ্ট্র করে, তাকে পদে পদে অপমান করাই হওয়া উচিত তার একমাত্র প্রাপ্তি। কিন্তু আমি খুঁজেও কোথাও সেই নির্ভেজাল ঘৃণা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় আনতে পারিনি। তবে কি নিষ্কলুষ ভালবাসা নেই বলে তার বিপ্রতীপে অকৃত্রিম ঘৃণা নেই!
আমি আমার বিরুদ্ধে সত্য কথা বলার মানুষ খুঁজছি অনেকদিন। সেই রকম মানুষ যার আমার সঙ্গে কোনও লেনদেন নেই, আমাকে সত্য কথা বললে যার স্বার্থ এতটুকু বিঘ্নিত হবে না, যার আমাকে নিয়ে কোনও ভয় নেই, পরে আমাকে কাজে লাগবে বলে যার হিসেবি মাপজোক নেই।
আমার কিছু মাতাল বন্ধু আছে। তারা আমাকে বন্ধু ভাবে কি না জানি না, কিন্তু আমার তাদের বন্ধু ভাবতে বেশ লাগে। তারা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু — কেউ প্রাইমারি স্কুলের, কেউ-বা হাই স্কুলের। তারা প্রথম থেকেই মাতাল হবে বলে জন্মেছে, না নির্দিষ্ট কারণে মাতাল হয়েছে তা নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। কিন্তু ঘটনা হল বর্তমানে তারা বেহেড মাতাল।
সেই পাঁড় মাতালদেরই একজন হল কানু। সে যাকে বিয়ে করেছে, সেই সাগরী তার থেকে বয়সে অনেক বড় এবং তার ছোট কাকার প্রাক্তন প্রেমিকা। প্রেম মানে পারস্পরিক সহযোগিতায় শরীরের খিদে মেটানোর বন্দোবস্ত আর কী! এ ধরণের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন, তাই সাগরীর সঙ্গে কানুর কাকার নয়, বিয়ে হল কানুর। কানুর ছোট খুড়িমা যতদিন পর্যন্ত না পাড়া হাট করে পঞ্চায়েতে যায়নি, ততদিন পর্যন্ত অবশ্য সাগরী চাচা-ভাতিজা দু’জনকেই সামলাচ্ছিল—চাচাকে চোদ্দো আনা, ভাতিজাকে দু’আনা।
এদিকে কানু আগে থাকতেই মদ ধরেছিল, বিয়ের পর তা আরও বেড়ে গেল। মদ ছেড়ে যে বউকে আশ্রয় করবে, তেমন কপাল নিয়ে তো সে আর এই পৃথিবীতে আসেনি!
শোনা যায় চাচাবঞ্চিত সাগরীর দুবলা কানুর ওপরেও আর রুচি নেই। কিন্তু পাঁড় মাতাল হলেও কানুর তো আর সাগরীর শরীরের প্রতি টান এতটুকু কমেনি। তাই কানু সাগরীকে কাছে টানতে চায়, খিদে মেটাতে চায়। কিন্তু চাইলে হবে কী! কানু এবং সাগরীর শারীরিক সক্ষমতার এতই তফাত যে, কানুর পক্ষে জোর-জবরদস্তি ম্যারিটাল রেপও সম্ভব নয়। তাই কানুর জীবনের অন্তিম বিলাস হল মদ এবং একমাত্র মদ।
সেই কানু আমাকে দু’-একবার বলেছে, শুভ, কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমি দাঁড়িয়েছি। ভেবেছি, মাতাল তো, সত্য উচ্চারণ করে আমার মুখোশ খুললেও খুলতে পারে।… আমি জানতে চেয়েছি, কী ঠিক হচ্ছে না?
কানু বলেছে, না, সবাইকার সামনে বলব না, আলাদা বলব।
আমি আশান্বিত হয়ে বলেছি, না, সকলের সামনেই বল।
না, বলব না। আমরা এক ক্লাসে পড়তুম না! তুই তো আমার বন্ধু, বল… বন্ধুর সঙ্গে সব কথা কি সবাইকার সামনে বলতে আছে?
কানুর এ রকম টনটনে জ্ঞান দেখে আমি বিরক্ত হয়েছি। বলেছি, না, তুই আমাকে বন্ধু মনে করিস না। বন্ধু বলে ভাবলে আমি এই যে তোকে বলতে বলছি, তা সত্ত্বেও তুই বলছিস না কেন?
কী, আমি তোর বন্ধু নই? বলে কানু আমাকে চমকে দিয়ে সকলের সামনে আমার দু’গালে পটপট করে চুম খেয়েছে। সকলে খুব মজা পেয়েছে, উল্লসিত হয়েছে। এদিকে আমি ভেবেছি, কানুকে কোনওদিন একা পেতে হবে।
অনেকদিন পর সেই সুযোগও এল। গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে একরাতে দেখি কানু দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। বাড়ি থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে। বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। গাড়ি থামিয়ে কানুকে ডেকে বলেছি, উঠে আয়।
কানু আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে, লক্ষ করেছে কিছুক্ষণ, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার মনে হল এই প্রথম কেউ ঘৃণায় আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। কানুর চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। বললাম, কানু, তুই আমাকে যত পারিস ঘৃণা কর। ঘৃণা কর। ভাবলাম, ঘটনাটা প্রকাশ্য দিবালোকে জনতার মাঝে ঘটলে আমি গাড়ি থেকে নেমে কানুর পায়ে মাথা ছোঁয়াতাম।
কিন্তু এ কী! কানু যে আমার গাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। জড়ানো গলায় বলছে, কে… শুভ?… আমি একদম চিনতে পারিনি ভাই… আমাকে একটু নিয়ে যা… বি…? নিয়ে চলনা রে, শুভ…
গাড়িতে টলতে টলতে যা হোক করে উঠে আমার পাশে বসেছে কানু। চোখ বুজে থাকা কানুকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এই যে মাঝে মাঝে আমাকে বলিস, কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, শুভ? তা, আমার কোন কাজটা তোর ঠিক বলে মনে হয় না, কানু?
কানু আমার কথা শুনল কি না কে জানে! শুনলেও তার মাথায় কতটা ঢুকল, কে জানে! দেখলাম চোখ বুজে বিড়বিড় করে কী সব বকছে। একটু খেয়াল করতে, শুনতে পেলাম বলছে, মা-বাবার মতো কেউ হয় না… মাকে ছেড়ে বউকে ধরা… বউ কি আর নিজের হয়?… শাল্… লা…। কানুর কথা জড়িয়ে বন্ধ হয়ে গেল। আমি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, আমি কী ঠিক করছি না? হঠাৎ চোখ খুলে কানু একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবলাম কানু নিশ্চয় এবার আমার পাপ… আমার অপরাধের কথা বলবে। কিন্তু কিছু না বলে কানু আবার চোখ বুজে ফেলল। আমি হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম।… খিক্ খিক্ হাসির শব্দে কানুর দিকে চেয়ে দেখি ও আমার দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে। আমি মুখ ফেরাতে বলল, তুই প্রচুর রোজগার করিস, বল… তোর কোনও অভাব নেই, বল… কিন্তু… কিন্তু…। কিন্তু কী? কিন্তু… কিন্তু, তুই আমাকে মদ খেতে কোনওদিন দশটা টাকাও দিলি না!… বল… তুই-ই বল… এটা কি তুই ঠিক করছিস? আমার ইচ্ছা করল চলন্ত গাড়ি থেকে লাথি মেরে কানুকে ফেলে দিই। শাল্-লা, এইটা তোর চোখে আমার ভুল? এদিকে আমি শালা কত আশা নিয়ে তোর ঘৃণার সপাট থাপ্পড়ের প্রত্যাশায় এতদিন বসে আছি! বিশ্বাসঘাতক কোথাকার একটা!
বাসু আর এক মাতাল। মুম্বইয়ে থাকে। জুয়েলারি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। আমার সঙ্গে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিল। দেশে এলে মাঝে মাঝে দেখা হয়। দেখা হলেই বলে, তুই, অরিত্র, বিকাশ কেমন সব মানুষ হয়েছিস। আর আমাকে দেখ। মানুষ হতে পারলাম না।
বাসুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোর সত্যি মনে হয় আমি মানুষ হয়েছি? সেদিন বাসু মদে চুর। তাই মনে হয় সত্যি কথা বলে ফেলেছিল। বলেছিল, পয়সা থাকলেই এ দুনিয়ায় মানুষ, আর পয়সা না থাকলেই সে মানুষ নয়। স্বভাব-চরিত্র দিয়ে কি আজকাল আর মানুষের বিচার হয়? আমি ভাবলাম বাসু আমাকে বেশ কড়া ওষুধ দিচ্ছে।… ও বাবা, কোথায় কী! বাসুর কথা আগ্রহ নিয়ে আর একটু শুনে বুঝতে পারলাম ও পড়েছে ওর বউকে নিয়ে!
বাসুর বউ ওকে পাত্তা না দিয়ে যৌবনের আশ মেটায়। কম বয়সের ডবকা বউ, তার দোষটাই বা কী! এক তো বাসু এখানে থাকে না। তার উপর সংসারে টাকা-পয়সাও ঠিকমতো পাঠায় না, বউ-মেয়েকে নিয়েও যায় না মুম্বইয়ে। দু’-দুটো মেয়ে—একটা চোদ্দো, একটা পনেরো। তিরিশ না পেরোনো বাসুর বউকে অভাবের সংসার টানতে হয়। দু’পয়সা রোজগারের জন্য সে জুয়েলারি কাস্টিংয়ের কাজ করে। কিন্তু সেই কাজে ক’টাকাই বা পাওয়া যায়! তাই সংসারের অভাব এবং সঙ্গসুখের অভাব মেটানোর জন্য সে সবচেয়ে সহজ রাস্তাটাই ধরেছে। এমনকি মেয়ে দুটোও মায়ের পথ অনুসরণ করেছে। ছোটটা দিদির আগেই শরীরী খেলায় অভ্যস্ত হয়ে কিশোরী উদরে একটা বীজ পর্যন্ত বপন করেছিল। সবদিক বিচার-বিবেচনা করে চারাগাছ হওয়ার আগেই অবশ্য সেটিকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। বাসুর পরিবারের এ ইতিহাস আমার অজানা নয়। আমার ধারণা ছিল পরিবারের এই অবস্থার জন্যই বাসু মাতলামি করে বলে আমার সামনে যুক্তি খাড়া করবে। কিন্তু আমার সেই ধারণাকে পাত্তা না দিয়ে সে-সব কিছু আলোচনা না করে বাসু আবার সেই ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, সে মানুষ হয়নি। তার জন্যই সব নষ্ট হয়ে গেছে। কোথায় গেল তার বউয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা! বাসুকে আর আমার সহ্য হল না। দূর, দূর, এ কি একটা মানুষ! যে কারণ থাকা সত্ত্বেও নিজের বউকে ভিতর থেকে ঘৃণা করে উঠতে পারল না সে করবে আমাকে ঘৃণা! এই মাতালের আশায় আমি বুক বাঁধছি!
সুরেশ কৃষ্ণভক্ত হয়েছে। ওদের ধর্মীয় সঙ্ঘের স্থানীয় শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদেও উঠে এসেছে। সংগঠনের কাজে ওকে জেলায় এবং জেলার বাইরেও যেতে হয়। সুরেশ আমার বাল্যবন্ধু। ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ার সময় আমরা একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখতে গেছি। ক্লাসে পাশাপাশি বসে মানুষ এবং অপরাপর প্রাণির জন্ম রহস্য নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছি। সে-সব বিষয় নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছি এবং আলাপ-আলোচনা চালিয়েছি। জীবন বিজ্ঞান দু’জনেরই ছিল প্রিয় এবং তাতে ভাল মার্কসও পেতাম। ওরা ছিল পাঁচ ভাই-বোন। সেখানে আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা-মা আমার জন্য কিছু করতে পারুক না-পারুক, একটা বড় সংসার এবং তার দায়ভার কিন্তু আমার মাথার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। আমি সবসময় ভেবে বিস্মিত হয়েছি দুই সুস্থ-সবল সাধারণ নিরক্ষর নারী-পুরুষের পক্ষে কোনও রকম জন্ম নিরোধক ব্যবহার না-করেও এক সন্তানে স্থিত থাকা কী ভাবে সম্ভব হল! অবশ্য এর জন্য বাবার তুলনায় মায়ের কৃতিত্ব অনেক বেশি। কোনও রকম অশান্তি না-করে মা যেভাবে পুরো বিষয়টা সামলেছিল তা ভাবা যায় না। সংসার বড় করে ফেলায় সুরেশের বাবার পক্ষে একার রোজগারে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই মাধ্যমিক না দিয়েই সুরেশ মুম্বই চলে যায় জুয়েলারি কাজ শিখতে। একটা সময় আমাদের এখানকার অধিকাংশ ছেলেই জীবিকা নির্বাহের জন্য মুম্বই যেত। মুম্বইয়ে একবার কাকার কাছে বেড়াতে গিয়ে জাভেরি বাজারে— কাকার দোকান থেকে বেরিয়ে— সন্ধ্যাবেলায় একটু রাস্তায় নেমেছিলাম। নাস্তার সময় বলে হবে হয়তো— সেই সময় এতজন পরিচিত ছেলের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল যে, দেশে থাকতে সন্ধ্যায় এতজনের সঙ্গে দেখা হয় না। ইদানীং অবশ্য সব আরবে যায়। সুরেশ মুম্বই থেকে আরবে যায় এবং সেই মধ্য-প্রাচ্যেই ওর মধ্যে এই পরিবর্তন আসে। আরব থেকে ও আমাকে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠাত। আমি যখন পাপের পাঁকে নিজেকে ডোবাচ্ছি, সুরেশ তখন নিজেকে পুণ্যের সোপানে উন্নীত করছিল; অথচ আমরা জীবন শুরু করেছিলাম প্রায় একই জায়গা থেকে। ওর চিঠি পড়ে আমি ওর জীবনধারার পরিবর্তন বুঝতে পারতাম। ঈর্ষা হত। কিন্তু আমার মতো পাপীর পক্ষে এর বেশি আর কী হতে পারে! আমার পাপের পথে গমনকে কি আর রোধ করতে পেরেছিল সুরেশ? না, সেটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল? ও আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে, মাঝে মাঝে দেখা হয়। দেখা হলে ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকি। আমার জীবন যাপনের কোনও কিছুই ওর কাছে অজানা নয়। তাই আমার এই পাপের পঙ্কে নিমজ্জন দেখে ওর পক্ষে ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া খুব স্বাভাবিক, বিশেষ করে ও এখন যে উচ্চ মার্গে নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং সফল ভাবে নিজেকে সেখানে ধরে রেখেছে। আমিও আন্তরিক ভাবে চাই সুরেশ আমাকে ডেকে ভর্ৎসনা করুক, ঘৃণার চোখে দেখুক। কিন্তু ওর চোখে দেখি ক্ষমাসুন্দর সহিষ্ণুতা। সেখানে ঘৃণার কোনও লক্ষণ নেই। আমি বুঝে যাই সুরেশও তার মানে আমার কাজে লাগবে না।
শয়তান কেমন দেখতে আমি জানি না। তবে নিশ্চয়ই ভীতিপ্রদ কিছু। কিন্তু ঘৃণ্য কি, যাকে দেখলেই গা, হাত-পা, মন রিরি করবে, ঘিনঘিন করবে? লোকে যে সবসময় ঘৃণা থেকে ভয় পায় তা তো নয়; বিপরীতে ভয় থেকে ঘৃণা করে, তা-ও নয়। আসলে ভয় এবং ঘৃণা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। মানুষ সাপকে ভয় পায় কিন্তু ঘৃণা করে না। আবার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে ঘৃণা করে কিন্তু ভয় পায় না। স্বার্থপর দৈত্যকে শিশুরা ভয় পেয়েছিল তার কর্কশ স্বরের আওয়াজে। ভয় ধরানো চেহারার জন্যও নয় কি? স্পষ্ট না-বলা থাকলেও সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
শিশুরা সরলমতি। সত্য বলে মিথ্যা বলতে শেখে না বলে। কিন্তু তারা কি ঘৃনা করতে পারে? তারা ভয় পায়, কোনও কোনও মানুষের ঘৃণ্য আচরণের জন্য তাকে নিয়ে আতঙ্কে ভোগে, সরল প্রাণে এমন ক্ষত তৈরি হয় যে, সারাজীবনে তার উপশম হয় না, কিন্তু তারা ঘৃণা করতে শেখে না। আমার চেহারা শোভন সুন্দর না হলেও ভয়াল ভয়ঙ্কর কিছু নয়। সুতরাং শিশুরা ভয়ও পাবে না। আর ঘৃণা করার প্রশ্নই ওঠে না! তাই শিশুদের কাছেও আমার ওয়াক ওভার নিশ্চিত।
তাহলে কে আমাকে ঘৃণা করবে! মায়েরা? বলা হয় মায়েদের মতো পবিত্র কিছু এ পৃথিবীতে হয় না। সন্তান-স্নেহ, বাৎসল্য রস-ই মাকে পবিত্র ধামে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই পাক পবিত্র মায়েদেরও তো ইদানীং দেখি না। দুধের শিশুকে বেবি সিটারের ভরসায় ছেড়ে অনেক মা-ই তো আজকাল আমার মতো পাপী-তাপীর সঙ্গে রাসলীলা করে বেড়ায়। আর অপরের সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য মাঝে মধ্যে সন্তান নিয়ে আদিখ্যেতা করে। মা হওয়াটাকে ব্যবহার করে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর কাজে। কেউ কেউ তো আবার নিজের সন্তানের পিতা কে সেটা পর্যন্ত ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। সরমার ক্ষেত্রে তো তেমনটাই ঘটেছিল। সে নাকি নিজে আজও বুঝতে পারে না কার ঔরসে সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। আমার সঙ্গে অবশ্য তখন তার লীলা শুরু হয়নি। প্রথম যেদিন মেলা থেকে ফেরার পথে সান্ধ্য প্রকৃতি এবং মেলার আনন্দঘন পরিবেশ আমার মধ্যে আসঙ্গলিপ্সা জাগিয়ে তুলেছিল, সেদিন সরমা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে ধরতে আমাকে তার সব কথা বলেছিল। সেদিন যেন সে কোনও গোপনীয়তাই আর রক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমবাগানে ঝরে পড়া শুকনো পাতার ওপর আমরা পরপর বিছিয়ে দিয়েছিলাম জ্যাকেট, কার্ডিগান, সোয়েটার, শাল। তারপর মাঘের কনকনে শীতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারায় ভরা আকাশের নীচে নগ্ন শরীরে নিজেকে মেলে ধরে সরমা। রমণতৃপ্ত হতে হতে সে কত কথাই না বলেছিল সেই সন্ধ্যায়! সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে তার যেমন মাথা ব্যথা ছিল না, তেমন সন্তান নিয়েও যে তার খুব ভাবনা ছিল এমন নয়। অবশ্য এই মায়েরাই বোধ হয় ঠিক। যে মায়েরা সমস্ত স্বার্থত্যাগ করে তিলে তিলে সন্তানদের মানুষ করে, তাদের পাওনা তো সেই চরম অবহেলা নচেৎ বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু অধুনাতম মায়েরা যে আমাকে ঘৃণা করবে না বরঞ্চ আমাতে আকৃষ্ট হবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সুরাং, হে মাতৃকূল, তোমরাও আমার উপকারে আসবে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকানেক দেশ দীর্ঘদিন বৈদেশিক শাসনাধীন ছিল। বিদেশি শক্তিকে ‘বাবা-বাছা’ বলে বুঝিয়ে-ভালবেসে কোনও দেশ-ই কিন্তু তাদের কবল থেকে মুক্তি লাভ করেনি। পরাধীন দেশগুলিতে— বৈদেশিক শাসন-শোষণের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণের মাধ্যমেই— প্রধানত যুবশক্তি জাগ্রত হয়েছে। আর তাদের মারো অথবা মরো নীতির প্রয়োগেই এক এক করে প্রতিটা দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যা কিছু অন্যায়, যা কিছু স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচারের পদধ্বনি, যা কিছু ঘৃণ্য তার বিরুদ্ধে দেশকাল নির্বিশেষে ঘৃণা পোষণ করেছে যৌবন। ঘৃণাই তাদের আদিশক্তি এবং চরম শক্তি। তাই আশাহত না হয়ে আমি যুবসমাজের দিকে মুখ ফেরাই।
কারণ আমার মনে পড়ে যায় আমার প্রথম যৌবনের কীর্তিকলাপ। অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা নিয়ে কীভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নেমে প্রতিস্পর্ধা হয়ে ওঠার সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম। আমাদের এখানে ছিল দেশি মদ হিসাবে তাড়ি-চুল্লুর ঠেক। একাধিক। সেগুলোতে সকাল থেকে লোকের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমরা মজা করে বলতাম জল অফিস। কিন্তু সেই জল অফিস থেকে মালিক ছাড়া কারও কোনও রোজগার হত না। উল্টে রোজগারের সিংহভাগই সেখানে খুইয়ে আসত গ্রামের একটা বেশ বড় সংখ্যক মানুষ। অনেক পরিবার তো এই জল অফিসের কল্যাণে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, এই তাড়ি-চুল্লুর ঠেককে কেন্দ্র করে নানা অসামাজিক কাজকর্ম বেশ থাবা গেড়ে বসেছিল। এই নরক গুলজারের কারণে আশপাশের পরিবেশ হয়ে উঠেছিল বিষাক্ত-পূতিগন্ধময়। কিছু একটা করার প্রয়োজন অনুভব করছিল সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত অন্তরের কোন তাড়নায় আমি এগিয়ে গেলাম জানি না। তবে আমি একা ছিলাম না। অনেকেই নিঃসংশয় চিত্তে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমাদের একটা সুবিধা ছিল— তৎকালীন রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো তখনও অর্থলাভ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজেদের সম্পূর্ণ বিকিয়ে দেয়নি। অবশ্য থানা-পুলিশ সম্পর্কে সেকথা জোর গলায় বলা যেত না।
তাই তাড়ি-চুল্লুর ঠেক ভাঙতে আমরা যখন এগিয়ে গিয়েছিলাম আমরা জানতাম কোনও রাজনৈতিক দল আমাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না, কিন্তু পুলিশি- সহায়তাও আমরা পাব না। উল্টে পুলিশি-ঝামেলায় আমরা ফেঁসে যেতে পারি। তা সত্ত্বেও কর্তব্যকর্ম থেকে আমরা এতটুকু পিছু হটিনি। যদিও উপরি পাওনা হিসাবে আমাদের কপালে সত্যিই জুটেছিল থানা-পুলিশের ঝক্কি-ঝামেলা।
আর আমাদের পাড়ার ক্লাবে যে ডাক্তার বসত সেই প্রশান্ত করের ব্যাপারে প্রথম প্রতিবাদের সুর তো আমার কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছিল। শিশুদের চিকিৎসার আড়ালে প্রশান্ত ডাক্তার মায়েদের যেসব প্রশ্ন করত কিংবা তাদের বুক দেখানোর জন্য এবং তা নিজের হাতে স্পর্শ করার জন্য যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করত তা আমার শুধু ঘৃণ্য বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছিল প্রতিবাদযোগ্যও। পাশে পেয়েছিলাম বেশ কিছু তরুণ যুবাকে। প্রতিবাদে যে কাজ হয় তার প্রমাণ পেয়েছিলাম প্রশান্ত ডাক্তারকে পাততাড়ি গোটাতে দেখে।
তবে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে অনেক মৌমাছির হুল আহ্বান করে আনছি বুঝতে পেরেও আমি নিজেকে সংযত করতে পারিনি। আসলে প্রতিবাদও একটা নেশা, বিশেষ করে অমলিন যৌবনে। আর সেই নেশা থেকেই হয়তোবা ধাড়াবাড়িতে এবং লিচুতলায় নিয়মিত মদ-জুয়ার আসর বসা এবং মধুচক্র পরিচালিত হওয়ার খবরে আমি প্রলয়ঙ্কর মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলাম। এর জল অবশ্য অনেকদিন ধরে অনেকদূর গড়িয়েছিল। যৌবতেজে বলীয়ান আমি অবশ্য সেসবকে পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি।
কিন্তু মাত্র একটা প্রজন্মের তফাতে আজকের যুবাদের এ কী হাল দেখি! এত স্বার্থান্ধ তো সংসারী মানুষও হয় না। খালি নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার তাল। সংসারী মানুষ তবু নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্যও ভোগের ভাগ রেখে দেয়। এরা তো দেখি শুধু নিজের ভাগ নিয়েই মেতে আছে। পোশাক পরিবর্তনের মতো এরা সহজেই দু’বেলা প্রেমিক-প্রেমিকা বদলায় অথবা অনায়াস দক্ষতায় যৌনসঙ্গী বদলে নেয়। নষ্ট দাম্পত্যেও স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখলে স্বামী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এরা কিনা নিজের প্রেমিকাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়, বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে এনে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অথবা নেশা না করেও দিনের পর দিন গণধর্ষণ করে। আদিখ্যেতা করে আবার এর নাম দেয়— গ্রুপ সেক্স। এই গ্রুপ সেক্সের-ই এক প্রকরণ মেট সোয়াপিংয়ের কবলে পড়েছিল সরমা। একরাতে দেবু তার প্রেমিকা কবিতাকে নিয়ে পিন্টুদের বাড়ি হাজির হয়। সে রাতে পিন্টুর বাবা-মা বাড়ি ছিল না। মদের নেশায় নয়, সুস্থ মস্তিষ্কে দেবু পিন্টুকে প্রস্তাব দেয়, সরমাকে ডেকে পাঠা। আজ আমরা পার্টনার বদলা-বদলি করে শোব। পিন্টু বলে, বেড়ে বলেছিস দোস্ত। তা আমরা চারজনে এক ঘরেই থাকব, না আলাদা-আলাদা ঘরে শোব? সে-সব পরে ঠিক হবে। তুই আগে সরমাকে নিয়ে আয়। মিনিট দশেক পর সরমা পিন্টুর সঙ্গে হাজির হয়ে দেখে দেবু আর কবিতা ইতিমধ্যে গিলে বসে আছে। সরমাকে ঢুকতে দেখেই দেবু বলে ওঠে, ওই তো আমার আজকে রাতের মেরে জান আ গায়া! ফালতু আর দেরি করে কী লাভ, ইয়ার! রাতে সেই তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে… পিন্টু, তুই কবিতাকে নিয়ে এ ঘরে থাক… আমি… সরমাকে নিয়ে পাশের ঘরে যাচ্ছি। সরমার মাথায় প্রথমে কিছু ঢুকছিল না। এরা এসব বলছে কী! সে প্রথমে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। হাসির আওয়াজে মুখ তুলে সে দেখে পিন্টু আর কবিতা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছে, দেবু মিটিমিটি তার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের রকম-সকম দেখে তার মনে হয় এসব ব্যাপার বাকি তিনজনের কাছে নতুন নয়। কিন্তু তার কোনও বক্তব্য শোনারও যে প্রয়োজন আছে, সে বোধ-ই এদের নেই। পুরো বিষয়টা কল্পনা করে তার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, গা-গোলাতে লাগে। এই অবস্থায় কী করবে ভেবে ওঠার আগেই সে দেখে দেবু তাকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে পাশের ঘরের বিছানায় ফেলেছে এবং তারপর মাঝখানের দরজাটা পর্যন্ত ভেজানোর কোনও প্রয়োজন বোধ না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। খোলা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চোখ পড়তে সরমা দেখতে পায় কোনও সময় নষ্ট না করে পিন্টু এবং কবিতাও বিছানায় চলে গিয়েছে। কেউ লাইট অফ করার কথা পর্যন্ত ভাবেনি। টিউবলাইটের ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলোয় সব কতই না সহজে ঘটে যাচ্ছিল! এমন অভিজ্ঞতা প্রথম তো, তাই সরমা কিছুতেই সহজ হতে পারছিল না। তার শরীরে-মনে বাধা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তার প্রাথমিক বাধা-বিপত্তিকে এতটুকু পাত্তা না দিয়ে দেবু তাকে যথেচ্ছ ভোগ করে যাচ্ছিল।
যুবসমাজের সমস্ত দায়বদ্ধতা, সার্বিক আস্ফালন সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়। এরা না নিতে চায় কারও দায়িত্ব, না পালন করতে চায় দেশ ও দশের প্রতি কর্তব্য। এরা কোনও গঠনমূলক কর্মোদ্যোগেও ঝাঁপাতে পারে না। এদের আরাধ্য দেবতা ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটস এবং মাদক দ্রব্য। মাদক গ্রহণকে এরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। নামিদামি মাদক-সঙ্গ হয়ে উঠেছে একাধারে এদের স্টেটাস এবং সেক্স সিম্বল।কোনও রকম মূল্যবোধকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে যথেচ্ছাচারে ব্রতী হওয়াকে এরা ভাবে আধুনিকতা। এদের মধ্যে কোনও পাপবোধই নেই। এরা পাপ-পুণ্যের তফাত-ই বোঝে না। এদের মস্তিষ্ক ইনসটিংক্ট তাড়িত, তা বোধচালিত নয়। এদের কাছে আমি তাই পূজ্য, কোনও মতেই ঘৃণ্য নই। আমি-ই এদের আইডল, এরা আমার ভক্ত। এদের কাছে আমি আইকনিক ফিগার। এরা আমার ঘাঁতঘোঁত জেনে আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায়। অগত্যা যৌবতেজে দগ্ধ হওয়ার অবাস্তব কল্পনা আমাকে ছাড়তে হয়। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ঠাকুরের বাণী— এদের চৈতন্য হোক।
তাহলে কি আমার প্রতি ঘৃণা পোষণের কোথাও কোনও আশা-ভরসা নেই! আমি অপশন খুঁজতে থাকি। পেয়েও যাই। মনে হয় আমি যাদের সঙ্গে পাপ করেছি ফিরে যাই তাদের কাছে। আমার মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তান-বন্ধু-জনগণ-দেশের কাছে।
ম-বাবা কখনও আমাকে নিয়ে খুব ভাবিত ছিল বলে মনে হয় না। সন্তান নিয়ে যে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে, এমন বোধ-ই তাদের ছিল না। তারা ভাবেইনি আমি পড়া বন্ধ করে কাজে লেগে যাই। তার কারণ কিন্তু শুধু এটা ছিল না যে, পড়াশোনায় মাথা ভাল বলে সকলে আমার প্রশংসা করে বলত, পড়াশোনা ছাড়িয়ে যেন কাজে না-লাগিয়ে দেওয়া হয়। আসলে আমি কী করব, না-করব সেটা ছেলেবেলা থেকে সম্পূর্ণভাবে আমার হাতেই ছিল। মা-বাবা কোনও দিন তাতে হস্তক্ষেপ করেনি। হস্তক্ষেপ যে করা যায় বা করতে হয় এটাই তাদের ধারণার বাইরে ছিল। মা-বাবা অবশ্য ছিল চোখ থাকতে অন্ধ— লেখাপড়া শেখেনি। শেখেনি বলাটা ভুল হবে, অভাবের সংসারে শেখার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তথাকথিত অশিক্ষিত হয়েও সন্তান মানুষ করার সবচেয়ে আধুনিক এবং যথাযথ পদ্ধতি তারা না জেনে-বুঝেই পালন করেছে। সন্তানের কাছে তাদের প্রত্যাশা কখনওই খুব বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু তাদের অবচেতনে নিশ্চয়ই এ-ভাবনা ছিল যে তারা যেমন সন্তানকে কষ্ট করে হলেও খাইয়ে-পরিয়ে বড় করেছে, ছেলেও বৃদ্ধাবস্থায় তাদের দেখভাল করবে। ছেলের কাছে ঠিক দাবি নয়— এটা ছিল তাদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু ছেলে তাদের সেই আশায় জল ঢেলে দিলেও তারা ছেলেকে দোষী প্রতিপন্ন করে শাপ-অভিশাপ দেওয়ার কথা ভাবেনি। অদ্ভুত ব্যাপার—মা-বাবা যত না আমাকে ঘৃণা করছে, তার থেকে বেশি দুষছে নিজেদের কপালকে। কখনও আক্ষেপ করছে আমার মতো সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য। নিজেকে মৃতবৎসা ভেবে মা সান্ত্বনা খুঁজতে চাইছে, বাবা আশ্রয় খুঁজছে পরম পিতার শরণে।
শেষবার জমিজায়গার কাগজপত্র আনতে গিয়ে মা-বাবার কাছে শুনে এসেছি আক্ষেপোক্তি। মা আমার হাত ধরে বলেছে, খোকা, তুই কেন এমন করছিস বল তো? তোর তো এত ভাল মাথা। তুই কত কম বয়েস থেকে কত কিছু বুঝিস। আর এটা বুঝিস না, তোর নিন্দে শুনলে আমার কত কষ্ট হয়, কত খারাপ লাগে! তোর কী হয়েছে বাবা? তুই কেন এমন পাগলের মতো ছটফট করে বেড়াচ্ছিস? তুই কী চাস? তোর কীসের অভাব? তুই কেন এমন করে বেড়াচ্ছিস বাবা? হয়তো সবাই মুখে বলে না কিন্তু আমি বুঝি কেউ তোর সম্পর্কে ভাল কিছু ভাবে না, বলা তো দূরের কথা! এতে আমাদের যে কী কষ্ট, কী লজ্জা তা তুই কোনওদিন বুঝবি না!
বাবা কোনওদিন আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আমাকে বলা মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে বারবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে দেখে ভাবলাম কিছু বলবে। বলল, তবে আমাকে নয়, মাকে। চুপ করো, ওকে এসব বলে কী হবে!
তুমি চুপ করো, আমাকে বলতে দাও। ও এরকম অজ্ঞানের মতো কাজ করে চললে আমাকে বলতেই হবে। তার ওপর ওর মেয়ে এখন বড় হয়েছে। আমাদের মুখ তো কোনওদিন চাইল না, এবার অন্তত মেয়েটার মুখ চেয়ে ঠিক রাস্তায় ফিরুক।
হঠাৎ আমার মাথার চুলে বিলি কেটে মা বেশ চিন্তিত গলায় বলল, খোকা, তোর চুল এত পাতলা হয়ে গেল কবে? তোর মাথা ফাঁকা দেখার কথা আমি যে ভাবতে পারি না।
কেন!
ছ’মাসে তোর মুখে ভাতের সময় তোকে ন্যাড়া করে দিয়েছিলুম। খেলতে খেলতে তোর সেই ন্যাড়া মাথায় চাপড় মেরেছিল বুবু। আর তার পরদিন থেকেই তোর মাথা ফুলে গিয়েছিল। যমে-মানুষে টানাটানি। হাজরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কাঁচ ঘেরা তুলোর বাক্সের মধ্যে তিনদিন রাখতে হয়েছিল তোকে। তারপর থেকে কোনওদিন আর তোকে ন্যাড়া হতে দিইনি আমি। এমনকী তোর দাদু মরে যাওয়ার পরও তোকে ন্যাড়া করাইনি। তার জন্য অবশ্য কম কথা শুনতে হয়নি!… থাক ওসব কথা। তুই অন্ততএকটু ভাল থাক খোকা। আমাদের কপালে যে কী আছে সে তো দেখতেই পাচ্ছি!
আমি চলে আসছিলাম। বাবার একটা কথা কানে যেতে থমকে দাঁড়ালাম। এ সবই আমাদের পাপের ফল!
সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, তোমাদের পাপের ফল?
বাবা নয়, জবাব দিল মা। জীবহত্যা কি পাপ নয়, বাবা?
জীবহত্যা! তোমরা কবে আবার জীবহত্যা করলে?
তোর জন্মের ছ’বছরের মাথায় পৃথিবীতে যে আসতে চাইছিল, তোর মুখ চেয়ে, অভাবের সংসারে দু’জনকে মানুষ করতে পারব না ভেবে তাকে পৃথিবীতে আসতে না দেওয়াটা কি জীবহত্যার পাপ নয়? অবশ্য ওই একবারই, এ ভুল আমি আর দু’বার করিনি। নিজেকে সামলেছি আর তোর বাবাকে আটকেছি। অবশ্য এসব কথা আর তোকে বলে কী হবে! নিজেকে সামলানোর বুদ্ধি তোর ঘটে থাকলে তো!
স্ত্রী কপাল চাপড়াচ্ছে সময় থাকতে আমার আসল রূপ চিনতে পারেনি বলে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যখন প্রতিহিংসা চরিতার্থতা করা এবং কাউকে বেঁধে রাখার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেখানে বেশি কিছু আশা না-করাই ভাল। কিন্তু রমার সাথে যে আমি অন্যায় করেছি এ বিষয়ে আমার নিজের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তার মায়ের পাপের শাস্তি আমি তাকে দিয়েছি। তার মাকে ঘৃণা করে আমি রমাকে সারা জীবন মর্মান্তিক কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য করেছি। মিসেস চৌধুরীর ইচ্ছাতে সায় দিয়ে আমি নিজের মা-বাবা, বাড়ি ছেড়ে রমাকে নিয়ে অন্য জায়গায় সংসার পেতেছি অথচ দোষারোপ করেছি তাকে। ক্ষেপামি করে নিজে মা-বাবার কাছে আর ফিরিনি, কিন্তু লোকে জেনেছে রমা-ই আমাকে ফিরতে দেয়নি। এমন স্বামীকে যে কোনও স্ত্রীর ঘৃণা করা স্বাভাবিক। তা না করে রমা এখন রক্তচাপ বাড়াচ্ছে কোনটা বেশি লাভদায়ক—বিয়েটা টিকিয়ে রাখা, না বিবাহ বিচ্ছেদ— সেই সিদ্ধান্তহীনতায়।
সন্তান কি ভাবছে, আমি তার বায়োলজিকাল ফাদার ছাড়া আর কিছু নই, তা-ও সেটা আবার ডিএনএ টেস্ট সাপেক্ষ? জানি না। আর যা আমার জানার বিষয় নয়, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামিয়ে কী করব! শুভমিত্রাকে আমি যতদূর চিনেছি তাতে মনে হয় যতদিন টাকা-পয়সার জোগান ঠিকঠাক থাকবে ততদিন তার কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়ে গিয়েছে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। হয় ভালবাসার অভিনয়, না হয় বোঝাপড়া। ঘৃণা করার মতো বুকের পাটা দেখানোর কাজে তার কোনও আগ্রহ-ই নেই।
প্রত্যয় আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমরা দু’জনে প্রায় একই সময়ে লেখালিখি শুরু করি। ও শিক্ষকতার বাইরে লেখালিখি নিয়েই আছে। অনেক পত্র-পত্রিকায় আমরা দু’জনে একসাথে লেখা জমা দিয়ে আসতাম। ওর অনেক লেখাই প্রকাশিত হত, কিন্তু আমার কোনও লেখার ক্ষেত্রে কখনও শিকে ছেঁড়েনি। প্রত্যয় আমার লেখার প্রশংসা করত এবং আন্তরিক ভাবে চাইত আমার লেখা প্রকাশিত হোক। কেন যে আমার লেখা কখনও কোনও জায়গায় প্রকাশিত হল না, এটা ওর কাছে আজও বড় ধাঁধা। ওর লেখা প্রকাশিত হল অথচ আমার লেখা প্রকাশিত হল না— এ জন্য ও আমার সামনে অকারণে কেমন অদ্ভুত এক অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। সে জন্য কিনা কে জানে, ওর কাছে দেখি আমার সাত খুন মাফ। আমার জন্য ওর মনে গভীর মায়া, আমাকে ঘৃণার কথা ওর মনোজগতে কখনও স্থানই পাবে না।
আমার আর এক বন্ধু প্রতীক দেশের নামি প্রতিষ্ঠানে ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করে গ্ৰামের মুখ উজ্জ্বল করা ব্রিলিয়ান্ট চ্যাপ। তার ইচ্ছা ছিল গ্ৰামের পুকুর নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবে। সেই তথ্যচিত্র বানানোর জন্য সে পুকুরে এমন মনোনিবেশ করে যে রায়পাড়ার মহিলারা তো আর একটু হলে আড়ং ধোলাইয়ের পর ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছিল। আমরা গিয়ে শেষ পর্যন্ত ওকে থানায় চালান হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করি। ওর আর পুকুর কেন্দ্রিক তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হবে না ভেবে ও যারপরনাই ভেঙে পড়ে। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে ফিল্ম বানানোর নাম করে পুকুরে মহিলাদের স্নান-মহিমা দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েই নাকি ও এমন ভিতর থেকে ছটফট করছিল।
প্রতীকের সঙ্গে পারমিতার দীর্ঘদিন সম্পর্ক ছিল। আমরা জানতাম ওদের বিয়ে হবে। সাইকোলজি নিয়ে পারমিতা এমএসসি পাশ করার পাঁচ-ছ’মাস পর জানা যায় ওদের ব্রেক আপ হয়ে গেছে। ব্রেক আপের কারণ আমাদেরই গ্রামের মেয়ে চন্দ্রিমা। যার সঙ্গে পাশের গ্রামের ডাক্তার বরুণ মুখার্জির দু’মাস পরে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বরুণের সাথে পাঁচ বছর স্টেডি রিলেশনে থাকার পরও চন্দ্রিমা চুটিয়ে প্রেম করতে শুরু করে প্রতীকের সঙ্গে। কারণ দু’য়ে দু’য়ে চার। চন্দ্রিমার কোটিপতি প্রোমোটার বাবা প্রতীককে ফিল্ম বানানোর জন্য টাকা দিতে রাজি, অন্য দিকে প্রতীক কথা দেয় তার ফিল্মে চন্দ্রিমাকে নায়িকা হিসাবে সুযোগ করে দেবে। চন্দ্রিমার রেপুটেশন গ্রামে খুব ভাল ছিল না। পাঁচ বছরে কতবার যে বরুণের সঙ্গে দিঘা-রায়চক-ডায়মন্ডহারবার ঘুরে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতীকের সঙ্গেও সেটাই শুরু করে। নায়িকা হওয়ার প্রলোভনে তার বরুণকে ল্যাং মেরে বেরিয়ে আসাটা মানা যায় কিন্তু প্রতীক যে কী করে এত সহজে পারমিতাকে ভুলতে পারল ভাবা যায় না।
আঘাতটা পারমিতার ভালই লেগেছিল। প্রায় বছর পাঁচ-ছয়েক সে বাড়ি থেকে প্রায় বেরতই না। তারপর বাবা মারা যাওয়ার পর একবার এসে আমার সঙ্গে দেখা করে একটা কাজ দেখে দেওয়ার কথা বলেছিল। আমি শাসক পার্টির এক কর্তার সঙ্গে দহরম-মহরমের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওর জন্য কলেজের লেকচারারশিপ জোগাড় করে দিই। পারমিতা অবশ্য প্রতীকের মতো অকৃতজ্ঞ ছিল না। জীবনে চরম ঘা খেয়ে বুঝেছিল ভালবাসার মতো মহৎ আবেগে ভেসে গিয়ে জীবন নষ্ট করার থেকে উপকারীর উপকার স্মরণ করে তার প্রাপ্য মিটিয়ে তার কাছ থেকে পরবর্তী সুবিধা আদায় করে নেওয়াটাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পারমিতার সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমার বন্ধু হলেও প্রতীক একটা ঢেঁড়স, না হলে কেউ এমন মেয়েকে ছেড়ে চন্দ্রিমাকে জীবন সঙ্গিনী নির্বাচন করে। পারমিতা এখন ছেলে নিয়ে সুখে সংসার করছে এবং চাকরিও সামলাচ্ছে। পার্টির দাদার সঙ্গে যে কথা হয়েছে তাতে আমি আশা করছি কয়েক বছরের মধ্যে পারমিতা কলেজের প্রিন্সিপালও হয়ে যাবে।
প্রতীকের সেই প্রথম ফিচার ফিল্ম বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। একে নতুন পরিচালক, তার ওপর নায়িকাও নিউ কামার, কোনও প্রথম সারির নায়ক তো দূরের কথা, দ্বিতীয় সারির নায়কও ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়নি। ফলে নতুন জুটিকে নিয়ে তৈরি ফিল্ম সিনেমা হলে এক সপ্তাহও চলেনি। তারপর থেকে প্রতীকের আর কোনও ছবি দিনের আলো দেখেনি। চন্দ্রিমাও দ্বিতীয় কোন ফিল্মে সুযোগ পায়নি। কিন্তু ফিল্মে সুযোগ না-পেলে কী হবে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এর-ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে তার কোনও অসুবিধা হয়নি। প্রতীক আমাকে ধরেছে তার একটা ছবি প্রোডিউস করার জন্য। গন্ধ পেয়ে চন্দ্রিমাও আমাকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু চন্দ্রিমার প্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে পত্রপাঠ নাকচ করেছি। তবে প্রতীকের ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারিনি। প্রতীক ঘন ঘন ফোন করছে। আমার পারমিতার পাশে দাঁড়ানোটাও ও ভাল রকম জানে। তার জন্য আমার প্রতি ওর কোনও ক্ষোভ নেই। পারমিতাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনায় ও বরঞ্চ আমার কাছে কৃতজ্ঞ। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে পারমিতার খবরও নেয়। কৃতজ্ঞতা এবং প্রত্যাশায় ও যেখানে অবনত হয়ে রয়েছে, সেখানে উন্নত শির হয়ে ওর আমাকে ঘৃণা করতে বয়েই গেছে।
জনগণ…? দেশ…? যে যার নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। জনগণের হাতে আর অপরের জন্য বিন্দুমাত্র সময় নেই। তারা কী ব্যস্ত, কী ব্যস্ত! অথচ তারা অধিকাংশ সময়-ই অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছুই প্রসব করে না। জনগণের সার্বিক স্বার্থ জড়িত থাকলে অথবা নেতাদের দ্বারা চালিত হলে তারা রুষ্ট হয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো আচরণ করতে পারে। খেলা ভেবে পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে শৃঙ্খলিত একক প্রাণকে। উল্লাসে গণপিটুনিতে মেতে উঠতে পারে, দেশপ্রেমের মোড়কে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রচেতনা সঞ্চারিত হলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার চাপ তৈরি করতে পারে, ধর্মীয় উৎসবে ধর্মকে দূরে সরিয়ে রেখে হুজুগে পাবলিক হয়ে উদ্দেশ্যহীনতায় ভেসে যেতে পারে, কিন্তু ঘৃণার মতো আগুনকে সামলানোর দক্ষতা বা যোগ্যতা কিছুই তাদের নেই।
আর দেশ? আমার দেশ তো দেশমাতৃকা! হ্যাঁ, আমার দেশ যদি আমার মতো রাষ্ট্র হত, তাহলে আমার উদ্দেশ্য সাধিত হলেও হতে পারত। হ্যাঁ, আমি নিজেকে রাষ্ট্র ভাবি— যেখানে রাষ্ট্র মানে অধিকার— স্বৈরাচারের অধিকার, স্বেচ্ছাচারের অধিকার, খেয়াল-খুশির অধিকার। রাষ্ট্র মানুষকে অধিকার দেয় হিংসার, অধিকার দেয় সন্ত্রাসের। অধিকার কেড়ে নেয় স্বাধীন প্রাণের, অধিকার কেড়ে নেয় মুক্তচিন্তার। শক্তিশালী রাষ্ট্র মানে স্পর্শকাতর রাষ্ট্র, যার নিজের সীমার চৌহদ্দির বাইরে শেষ হয়ে যায় সমস্ত সংবেদনশীলতা; যে নিজের গায়ে একটা টুসকি পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না, যে বিশ্বাস করে জিরো টলারেন্সে।
অবশ্য শুধু আমি নয় প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষই এক একটা রাষ্ট্র, প্রত্যেক রাষ্ট্রই মনুষ্য সমান। রাষ্ট্র মূষিককে লালন-পালন করে, আবার প্রয়োজনে চরম ক্ষিপ্রতায় মূষিক শিকার করে। রাষ্ট্র মার্জার পোষে; কখনও কখনও সেই মার্জারকে যথেচ্ছ মূষিক ভক্ষণের অধিকারও দেয়! ক্ষমতা কিন্তু সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূত থাকে রাষ্ট্রের হাতে। তাই মার্জার মূষিক শিকার করলেও তার নিয়ন্ত্রণ কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের হাতেই রাখে। চক্ষুলজ্জার কারণে অনেক সময় তাকে মার্জার-তাড়নেও প্রবৃত্ত হতে দেখা যায়। নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার ভাণ বজায় রেখে অপরের কাঁধে বন্দুক রেখে উদ্দেশ্যসাধন করতে হয়।
রাষ্ট্র আসলে কল বিশেষ। খাঁচাকলের মধ্যে আটক মূষিককে নিয়ে ছেলেখেলা করে। ইচ্ছা হলে প্রাণে মেরে দেয়, শখ চাপলে বেকসুর খালাস করে দেয়। কিন্তু পুরোটাই তার স্বেচ্ছাধীন। মূষিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় দৃকপাত অথবা কর্ণপাতের কোনও প্রয়োজনই সে বোধ করে না। মূষিকেরও কণ্ঠস্বর থাকতে পারে— এটা তার কল্পনার অতীত। আর কখনও কোনও মূষিক যদি তাকে বিব্রত করে তো কথাই নেই! মূষিককে শেষ করার আগে সে দু’বার ভাবে না। এমন হাড়-হিম করা আতঙ্কের মধ্যে রেখে তার মৃত্যুকে সুনিশ্চিত করে যে, বেড়ালের উদ্যত থাবায় তার অকস্মাৎ মৃত্যুকে পর্যন্ত সে আশীর্বাদ মনে করে।
রাষ্ট্র ঠিক করে দেয় শুধু সংখ্যার জোরে কোন মূষিকেরা কোন মূষিকদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করবে, আর সংখ্যালঘু মূষিকেরা সবসময় চাপে থাকবে। সেই চাপ কমানোর জন্য তারা যদি গোষ্ঠীচেতনাঋদ্ধ কৌম জীবনযাপন করতে চায় তা নিয়েও তারা সমালোচনার সম্মুখীন হয়। সংখ্যায় লঘু হওয়াটা তাদের অপরাধ এবং এই অপরাধ যেন তারা দগদগে ঘায়ের মতো সহ্য করে— যন্ত্রণায় কাতর হলেও তাদের যেন বাক্যস্ফূর্তি না হয়। প্রেম-ভালবাসার মতো অকারণ ভাবাবেগে তারা কাউকে মহীয়ান করে তুললেও সংখ্যাগুরুর সেই প্রতিনিধি যেন প্রয়োজনে তার ছল-চাতুরি কাজে লাগাতে পারে এবং সময়-সময় হিংস্র দাঁত-নখ সহ নিজের আসল রূপ প্রকাশ করতে পারে।
রাষ্ট্র একটা ধারণা। রাষ্ট্র একটা বিমূর্ত সত্তা। পুরোটাই অনুভববেদ্য। কেউ অনুভব করতে চাইলে অনুভব করতে পারে। আবার অনুভব করতে না-চাইলে অনুভব করতে না-ও পারে। রাষ্ট্রে যখন যে বা যারা ক্ষমতায় থাকে, রাষ্ট্র তাদের অঙ্গুলিহেলনেই চলে। সে পুরুষ হতে পারে, নারী হতে পারে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হতে পারে, মৌলবাদী দল হতে পারে, স্বৈরাচারী শাসক হতে পারে, এমনকি মূষিককূলও হতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে গেলে তাকে রজ্জুতে সর্পভ্রমের আতঙ্কে ভুগতে হয়, ঘৃণা করতে জানতে হয়, সঙ্কীর্ণ স্বার্থান্বেষী হতে হয়। মননে বুনে নিতে হয় সন্দেহ, মজ্জায় বহন করতে হয় আধিপত্যবাদ; আর বাইরে সুমহান হওয়ার ভন্ডামি প্রদর্শন করতে হয়।
সেখানে দেশ তো স্নেহবৃত্ত বই আর কিছু নয়। সে আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়, ভালবাসতে শেখায়, শাসন জানে না, শাসন করলেও সেটা ভালবাসার শাসন—তাতে নিজের কষ্টবৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হয় না। দেশ তো সাধারণ মানুষ ছাড়া কিছু নয়। সেই সাধারণ মানুষ পাপকে পাপ বলে স্বীকার করে ঘৃণা করতে ভুলে যায়— তাদের ভয় পাছে তাদের পাপকেও অন্য কেউ ঘৃণা করে— তাদের প্রতিভূ দেশও আর শুধু শুধু এসব গুরুত্বহীন ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না। তার চেয়ে রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য ধর্মীয় ব্যাপারে সক্রিয়তা, শাসক-বিরোধীদের প্রতি অতি সক্রিয়তা এবং যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় অতিরিক্ত সক্রিয়তা দেখানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আর দেশ সেই কবি, সেই রাষ্ট্রনেতাকে খুঁজে বেড়ায় যাঁদের কাব্যে, যাঁদের বাক্যে সে আবার সকল দেশের সেরা হয়ে উঠতে পারে।
আমি আশা প্রায় ছেড়েই দিই। এমন সময় আমার জীবনে আসে প্রেম। এই প্রথম আমার জীবনে এমন কেউ আসে যে আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসতে আরম্ভ করে। চিত্রা আমাকে ভালবাসত তাতে সন্দেহ নেই। ও যে-বয়সে আমাকে ভালবাসতে শুরু করে সেটা প্রথম-ভালবাসায় পড়ারই বয়স। ওই বয়সে মানুষ কোনও কিছু ভালবাসার জন্য ছটফটিয়ে মরতে থাকে। খালি মনে হয় ভালবাসি ভালবাসি। নিজের ভালবাসতে ভাল লাগে বলেই এই ভালবাসা। এ এক অমলিন স্বচ্ছতোয়া সরল ভালবাসা। এটা ভালবাসা-ই, এটা ঠিক প্রেম নয়। কিন্তু প্রেম এমন জিনিস, বিশেষ ঔকরে নারীর প্রেম, যে, পুরুষের আমৃত্যু অপেক্ষা বুঝি সেই নারীপ্রেম প্রাপ্তিই। ভালবাসতে চায় বলেই নারীর সেই ভালবাসা। ভালবাসাই তার ধর্ম, ভালবাসাই তার সাধনা, ভালবাসাই তার সর্বস্ব।
অমৃতার সঙ্গে আমার পরিচয় আকস্মিকই বটে। প্রত্যেক বছর বইমেলায় ‘সত্য সংবাদ’-এর যে সাংবাদিক আসতেন এবং বইমেলাকে যথেষ্ট মাইলেজ দিয়ে রিপোর্টিং করতেন, এক-বৎসর বইমেলা শুরু হওয়ার দু’দিন আগে তিনি জানালেন শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর পক্ষে বইমেলা কভার করা সম্ভব হবে না। তবে তাঁর পরিবর্তে যিনি আসছেন, তাঁকে তিনি সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন। সুতরাং, চিন্তার কোনও কারণ নেই। রিপোর্টার অমৃতা রায়ের বইমেলায় পদার্পণ এবং সাথে সাথে আমার জীবনে আগমন একই সঙ্গে ঘটে। প্রথম দিনই অমৃতাকে দেখে আমার মনে হয়, আমি যেন এর অপেক্ষাতেই এতদিন ছিলাম। আমার এই বেঁচে থাকা যেন অমৃতার আবাহনেই সার্থক হয়ে উঠবে। এই প্রথম আমি নারীর ভালবাসা পাওয়ার জন্য অন্তরে অদ্ভুত এক আকুলতা অনুভব করি। ভালবাসা, শুধু ভালবাসা— এটাই আমার আন্তরিক চাহিদা হয়ে উঠতে থাকে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। চাইও না। সব লজ্জার মাথা খেয়ে জীবনে এই প্রথমবার আমি পাণিপ্রার্থী হই। আমৃতা হেসে, ভালবেসে আমার সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাত গ্রহণ করে। বলে, তোমার এত সঙ্কোচের তো কিছু নেই। কই আমি তো এতটুকু সঙ্কোচ করছি না। আমার মনে হয় এর থেকে সাধারণ, সহজ-সরল সম্পর্ক আর হয় না। কোনও নারীর পক্ষে যে এ ভাবে সম্পূর্ণ প্রত্যাশা-শূন্য হয়ে এমন গভীর ভালবাসা সম্ভব, তা সত্যই অনেক সময় আমার বোধে পৌঁছায় না।আমার কাছে ঘটনাটা অবিশ্বাস্য মনে হওয়ায় আমি বারে বারে তার ভালবাসার পরীক্ষা নিই। উপলব্ধি করি সত্যিই সে প্রেমময়ী, তার কাছে পিরিতি পরমনিধি। ভালবাসা ছাড়া তার কাছে আর কোনও কিছুর-ই কোনও মূল্য নেই। আমার নতুন আবতারে এই প্রথম প্রকৃত ভালবাসার মতো কাউকে পেয়ে আমিও সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে উঠি। ভালবেসে একবার হলেও নিজেকে ভিতর থেকে উজাড় করে দিই। একবার নিজের তৈরি নিয়মকে নিজে লঙ্ঘন করি। চিত্রার সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর এই প্রথম আমি ভালবেসে শরীরের কাঠামোর বাইরে এনে নিজেকে দাঁড় করানোর কথা ভাবতে থাকি। কিন্তু মোহের টানে ছুটে যাওয়ার কু-অভ্যাস এমন আমার প্রকৃতি হয়ে উঠেছিল যে, সুন্দরী নারী গমনের হাত থেকে আমি নিজেকে চেয়েও আটকাতে সক্ষম হই না। তবুও আমি স্বপ্নে দেখি ভালবাসা আমাকে সাহসী করে তুলেছে। আমি ভালবাসার সাহসে ভর করে এই প্রথম নিজেকে পাপী ভেবে আমার সমস্ত পাপের কথা স্বমুখে আদ্যোপান্ত শোনাই আমার প্রেমস্বরূপিনীকে। শুনে সে হাস্যমদির হয়। বলে, আমার তোমার জীবনে আসার আগে, তোমার জীবনে কে বা কারা এসেছে, কী ঘটেছে বা তুমি কী ঘটিয়েছ, তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আর তা নিয়ে আমি ভাবতে যাবই বা কেন! আমার অবর্তমানে বা আমার পরে তোমার জীবনে কে আসবে— একজন আসবে, না একাধিক জন আসবে, তা নিয়েও আমি এতটুকু ভাবিত নই। কিন্তু আমার সাথে রিলেশনে থেকেও তোমার এই স্খলনকে আমার পক্ষে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমার অন্তরাত্মা আমাকে বলতে বাধ্য করছে যে, তুমি পাপী, তোমার পাপের সীমা-পরিসীমা নেই। আমার এমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, তোমাকে এত গভীর ভালবাসা, এই অনিঃশেষ প্রেমও যখন তোমার মোহ কাটাতে পারেনি— এ জন্মে তোমার আর মোহমুক্তি ঘটবে বলে মনে হয় না। আমি আর তাহলে তোমার জীবনে থেকে কী করব? এই বলে সে আমার মুখের দিকে তাকায়। তারপর রোদের মধ্যে মিলিয়ে যায়। আমি অনুভব করি সুশীতল এক স্নিগ্ধ তরুছায়া দিকচক্রবালে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্তরের গভীরতম প্রদেশে বৃশ্চিক-দংশন-জ্বালা আমার চোখে জীবনে এই প্রথমবার জল নিয়ে আসে। আমি সব কিছু হারানোর মর্মযন্ত্রণায় বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষ সময় আমি তার চোখের দিকে তাকাতে ভুলে যাই। জানি না রোদে মিলিয়ে যাওয়ার সময় তার চোখে কী ছিল— ঘৃণার অগ্নিবাণ না ভালবাসার স্নিগ্ধবারি? এরপর থেকে গায়ে রোদ পড়লেই আমি খুব— খুব চেষ্টা করি সেটাকে গা থেকে তুলে ফেলতে।
(ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি