সুমিত জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো। কারণ তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে সে। ফলত মুখটাকে খুলে রাখতে হচ্ছে সবসময়। সে যদি পারত তবে গুঙিয়ে উঠত, চিৎকার করে উঠত, যদি পারত ছুটে বেড়াতো গোটা ফ্লোর, কিন্তু সে এখন চেয়ারের মধ্যে পাথরের মতো বসে আছে, অপেক্ষা করছে। আর চারপাশ থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে আনতে চাইছে লুকিয়ে রাখা অশনি সংকেত।
‘সুমিত, প্লিজ আসুন।’
বস ডেকেছিলেন ১২টার সময়। সে মিনিট পনেরো আগেই এসে পড়েছিল। ঘড়ির কাঁটা যত ১২টার দিকে এগোচ্ছিলো, মনের মধ্যে উদ্বেগ জোয়ারের জলের মতো দানব হয়ে উঠছিল তার। আর এখন, বসের ঘরে ঢোকার আগে, সুমিতের বুকে যে ঢঙ ঢঙ করে ঘণ্টা বাজছে, তাও কোন ছুটির ঘণ্টা নয়। এমনকি জেলের ঘণ্টার মতোও নয়। জেলে তো ঘণ্টা বাজে নির্দিষ্ট সময়ে। ভোরে কয়েদিদের ঘুম থেকে তোলার জন্য, ব্রেকফাস্টের জন্য… কিন্তু সুমিতের বুকে এই ঘণ্টাটা বাজে যখন তখন। রাতে স্বপ্ন দেখতে দেখতে, দুপুরে টিফিন খেতে খেতে, ছ’টার পর বাড়ি ফিরতে ফিরতে… কুমিরের মতো সেই ঘণ্টাধ্বনি তার মনের মধ্যে ডুবে থাকে। তারপর কখন জল খেতে আসা পশুটিকে হিড়হিড় করে টানতে শুরু করে তা কেউ আগে থেকে বলতে পারে না।
‘বসুন, বসুন।’
সুমিত বসল। তার দুচোখ ফাঁদে আটকে পড়া বেড়ালের মত। ভাগ্যিস বেড়ালের মতো তার গায়ে লোম নেই, থাকলে তাও নির্ঘাৎ খাড়া হয়ে উঠত।
‘আপনি ফাইলটা খুব ভালো তৈরি করেছেন। আমি দেখে নিয়েছি। খুব ভ্যালুয়েবল অ্যাডিশন। কিপ ইট আপ।’
‘থ্যাংক ইউ স্যর।’ সুমিতের বুকের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি মৃদু হতে লাগল।
‘প্রদীপের কাজটা নিয়ে আমি এখনও স্যাটিস্ফায়েড নই। মনে হচ্ছে ওর একটু হেল্প লাগবে। আপনি কি কাইন্ডলি ওকে একটু সাহায্য করতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘ঠিকাছে। আমি ওকে একটা মেল করে দিচ্ছি, আপনাকে সিসিতে রেখে।’
সুমিত বেরিয়ে এল বসের ঘর থেকে। মনের জল এখন শান্ত। কুমিরের দেখা নেই। খোলা টাইমকল থেকে জলের মতো ঝরে অ্যাড্রিনালিন এখন সবে থেমেছে। চোখের পাতা আরও কিছুক্ষণ দপদপ করে যাবে, কানের কাছে ভোঁ ভোঁ শব্দটাও। বরাবর এই সময় কফি খেতে ইচ্ছে হয় সুমিতের। অথবা অনেকটা আদা দিয়ে ঝাঁঝালো চা। অফিসে না ঢুকে সুমিত গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এলো।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে কফিশপ। সুমিত ঢুকে দেখল তরুণ সান্যালও আছে। কফি খাচ্ছে না, বরং সামনে রাখা কফির কাপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশি চিনি আর দুধ দিয়ে কফি বানিয়ে মুখোমুখি বসতেই তরুণ ঘাবড়ে গিয়ে মুখ তুলে বলল ‘ওঃ তুই! আমি ভাবলাম…’
‘কি ভাবলি?’
‘কিছু না। ভয় পেয়ে গেলাম খানিকটা।’
তরুণ হাসছে। সুমিতের হাসির সাথে এই হাসির মিল আছে। শুধু হাসিই বা বলা হবে কেন? সুমিতের সাথে তরুণের আরেকটা বড় মিল হল ভয়। ছোটখাটো সবকিছুতেই তারা ভয় পেয়ে কুঁকড়ে থাকে। ভয় কাটার পর দুজনেরই কফির প্রয়োজন হয়। কফির প্রয়োজনীয়তাটুকু না থাকলে হয়ত তাদের বন্ধুত্বই হত না। আলাদা ফ্লোর, আলাদা অফিস। জীবনযাপনেও দুজনের মিল নেই বেশি। সুমিত স্ত্রীর সাথে দুই কামরার ছোট ফ্ল্যাটে থাকে। মধ্যবিত্ত জীবন পৌনপৌনিকতায় বিলম্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে তরুণের পৈতৃক বাড়ি, সম্ভ্রান্ত পরিবার, এলাকার সবাই এক নামে চেনে। তিনতলা প্রকাণ্ড বাড়িতে তার বাবা আর জ্যাঠার যৌথ পরিবার। ঠাকুরদার দাঁড় করানো ব্যবসা এখনও রমরমিয়ে চলছে। পয়সাকড়ির অভাব নেই। তরুণ বিয়ে করেছিল বছর ছয় আগে। পাঁচ বছর সংসার করেছিল। বউ মারা গিয়েছে এক বছর হল। সুভাষপল্লীর একটা পরিত্যক্ত জমিতে মৃতদেহ পাওয়া যায়। শ্বাসরোধ করে খুন। খুনের আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
‘কি ঘটছে এখন?’ তরুণ জিজ্ঞেস করে সুমিতকে। এই বাক্য দিয়েই বরাবর তাদের কথা শুরু হয়। যেন এই সংকেত আসলে কোনো গোপন আদানপ্রদানের চাবিকাঠি। অবশ্য একে গুপ্ত-সংকেত বললে এমনিতেও খুব একটা ভুল হবে না। দুজনেই বিশ্বাস করে তাদের জীবনে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কবে ঘটবে তা জানা নেই। তবে ঘটবে, কপালের লেখা খণ্ডাবে কে? দুজনেই কফি খেতে খেতে চতুর্দিকে সেই বিপর্যয়ের আগমনীবার্তা খুঁজে চলে, অযথা থেকে থেকে বুকের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে, অ্যাড্রিনালিন ঝরে সজাগ করে দেয়, বলে ঘুমিয়ো না, দেখো, জেগে থাকো…
সুমিতের বউ ঊর্মিলা অনেকবার বলেছে তাকে, কোনো মনস্তাত্ত্বিককে দেখনোর কথা। ঊর্মিলার কোন বন্ধু নাকি সল্টলেকের দিকে প্র্যাকটিস করে। তিনি বলেছেন এটা আসলে একধরনের ট্রমা। সম্ভবত ছোটবেলার কোনো স্ট্রেসফুল ঘটনার পর থেকে ডেভেলপ করেছে। বা হতে পারে রেয়ার টাইপের স্কিৎজোফ্রেনিয়া। যাই হোক না কেনো, ডায়াগনোসিস হওয়া দরকার। প্রবলেমটা আইডেন্টিফাই করতে পারলে উপশম নিশ্চয়ই আছে।
ডায়াগনোসিসের কথা শুনে সুমিত আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিল; বলেছিল- যা আসার তা আসবে। আমি শুধু অপেক্ষা করি ঊর্মিলা। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।
ঊর্মিলা এখন আর কিছু বলে না। সংসারে থেকেও বিচ্ছিন্ন দুটি মানুষ তারা এখন। তাহলেও, সারাদিন একটাও কথা না বলেও, শুধুমাত্র ঊর্মিলার হাঁটাচলা, পায়ের শব্দ থেকেই অনেক কিছু ধারণা করে নেয় সুমিত। ডিনারের পর লিখে রাখে ডায়েরিতে। শেষ শনিবার লিখেছিল- ‘আমি জানি অন্য একটি পুরুষের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে ঊর্মিলা। ভীষণ ভালো খবর। অথচ আমি ওকে কনগ্র্যাচুলেট করতে পারছি না।’ বউয়ের পরকীয়ার সম্ভাবনায় খুশি হয়েছে সুমিত। মানুষ তার কাছে যত কম প্রত্যাশা করে ততই মঙ্গল। প্রত্যাশার কথা টের পেলেই তার টেনশন শুরু হয়। বুকের মধ্যে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। নদীর জলে চোরাস্রোত হঠাৎ পাড়ের দিকে এগোতে থাকে। তখন জল খেতে আসা হরিণটির মতো সুমিতও পালাতে থাকে, সম্পর্ক থেকে, প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব থেকে।
পলায়নপরতা কিন্তু দুর্বলতা নয়, বরং তার ক্ষেত্রে প্রয়োজন। নইলে ব্যাপারটা যখন ঘটবে তখন সে সামলাবে কি করে? পিছুটান খুব গোলমেলে জিনিস, চট করে স্থিতিশীল হয় না। হয় বাড়ে, নয় কমে। ফালাফালা করে দেয়।
আজকে অফিস থেকে ফিরে সেই ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখল ড্রয়িং রুমে। ঊর্মিলার বয়ফ্রেন্ড। নামটাও বেশ সুন্দর, তুফান। দিব্যি বসে ছিল লোকটা। কোনো জড়তা নেই, ভয় নেই। কি ঝকঝকে চেহারা! চোখেমুখে স্মার্টনেস, ঊর্মিলারই কলিগ। প্রচুর মাইনে। প্রচুর কনফিডেন্স। পায়ের ওপর পা তুলে বসে ছিল, সুমিতকে দেখেও পা নামালো না। ঊর্মিলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর আবার মুখ তুলে বলল, ‘আমার কলিগ। অফিসের একটা পার্টি আছে। আমরা বেরিয়ে যাবো। তোমার খাবার রাখা আছে। গরম করে নিও’।
ঊর্মিলা বেরিয়ে গেলে সাধারণত খুশি হয় সুমিত। সে একটু নিজের মতো থাকতে পারে। ঘরময় পায়চারি আর নিজের মনে বকবক করে, কফি খায়, তারপর হাঁপিয়ে গেলে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক দেখে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আজকে ঊর্মিলার বয়ফ্রেন্ডকে দেখে সে খুশি হল না। কিছুক্ষণ খাটের ওপর বসে থাকল। বুকের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে কিনা শোনার চেষ্টা করল। তারপর রোজকার মতো সে কফি বানালো, নিয়মমাফিক বেশি দুধ আর চিনি দিয়ে। অথচ একবার চুমুক দিয়েই কফিটা ফেলে দিতে হল। মনের মধ্যে কেউ একজন যেন বলল- ছি, এটা কি কফি না শরবৎ?
আবার কফি বানালো সে। এবার কম দুধ, কম চিনি দিয়ে। সাথে আগের চেয়ে তুলনায় একটু বেশি কফি। ফ্যাটফ্যাটে সাদা কফির বদলে এবার বেশ হালকা বাদামী রঙ ফুটে উঠল। কিন্তু তাও খাওয়া গেল না। একবার মুখে নিয়েই থুঃ থুঃ করে ছুঁড়ে ফেলল সুমিত।
তারপর, কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর, জীবনে এই প্রথম সে ব্ল্যাক কফি খেলো। তেতো লাগল না, বরং ভালো লাগল খেতে। সুমিত বুঝল তার অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। কিছু একটা ব্যাপার তার জীবনে ঘটতে চলেছে। শরীরের মধ্যে অ্যাড্রিনালিন ঝরছে না, বরং অন্য কিছু হয়ে চলেছে। কি হচ্ছে সেও পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। ইংরেজি ছবিতে দেখেছে ইভিল স্পিরিট আক্রমণ করার পর আক্রান্তের শরীরের দখল নেয়, সেভাবে তার শরীরেও কি কেউ ভর করছে?
ব্যস, সেদিনের ঘটনা বলতে ওটুকুই। সে অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও আর কিছু ঘটল না। টিভিতে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চলতে লাগল ভলিউম বন্ধ করে। একটা বেড়াল জানলা দিয়ে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে এগোতে গিয়ে সুমিতকে দেখে আবার পালিয়ে গেল। সিলিং থেকে পটাং করে টিকটিকি পড়ল মাটিতে, ব্যস এটুকুই। আর কিছু ঘটল না। বা শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটে চলল সুমিত তেমন ভালো করে বুঝল না। জমজমাট খিদে পেল বহুদিন বাদে। ঘড়িতে যখন বারোটা বাজল সুমিত বুঝল ঊর্মিলা আজকে ফিরছে না। দরজায় ছিটিকিনি দিয়ে সে খেয়ে নিল, সামান্যই খাবার- ভাত, কলমির শাক আর মাংসের ঝোল। তারপর বিছানায় শরীর ছোঁয়াতেই একরাশ ঘুম চোখে ভিড় করে এল।
সকালবেলা ঘুম ভেঙে দেখল জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে মুখের ওপর। যেন গালে গাল ঘষে ডাকছে। সেও যেন সত্যিই রোদের ডাকে সাড়া দেবার জন্য একটু হাসল। অন্য দিন ঘুম ভাঙার পরও সে অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে। আজ এক ঝটকায় উঠে পড়ল। অন্যদিন দুরুদুরু বুকে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়, রাস্তাঘাট দেখে, বাজারের থলিটিকে দেখে, পাশের ঘরে গিয়ে ঊর্মিলাকে দেখে, আজকে সোজা কফি বানাতে লেগে গেল। বড় মগের এক মগ ব্ল্যাক কফি খেয়েই তোয়ালে তুলে বাথরুম। অন্যান্য দিন বাথরুমে ধ্যান করতে হয়। তার কোষ্টকাঠিন্য আছে। ব্ল্যাক কফির গুণেই কিনা কে জানে, আজকে বসতেই পেট পরিষ্কার হয়ে গেছে। স্নান করল অনেকক্ষণ ধরে। ঘষে ঘষে সাবান শ্যাম্পু মেখে স্নান শেষ করে যখন বেরোলো তখন ঊর্মিলা ফিরে এসেছে। সারারাত বোধহয় ঘুম হয়নি, বিছানায় উলটে শুয়ে আছে। হয়ত সুমিতের সাথে চোখাচোখি করতে চায় না। না করাই ভালো। চোখের ভাষা তো গভীর হয়, সুমিত অমন চট করে পড়তে পারে না। শুয়ে থাক ঊর্মিলা, ঘুমোক, সারারাত ঘুম হয়নি। শুক্রবার ক্যাজুয়াল ডে বলে কোনমতে একটা টি শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পড়ে সুমিত বেরিয়ে পড়ল।
অফিসে লিফটের মুখে তরুণের সঙ্গে দেখা। তরুণ জিজ্ঞেস করল- ‘কি ঘটছে?’ সুমিত হাসল একটু। তরুণ জিজ্ঞেস করল- ‘চুল আঁচড়াসনি কেন?’ সুমিত বলল- ‘যা, ভুলেই গেছি।’ বলে আবার একগাল হাসল। হাসিটা তরুণের ভালো লাগল না। সে যথারীতি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগল।
এগারোটার সময় বসের ঘরে ডাক পড়ল। বস বললেন, ‘আচ্ছা সুমিতবাবু, আজকে সকালে যে আপনার একটা ফাইল দেওয়ার কথা ছিল প্রদীপবাবুকে। সেটা হয়নি?’
সুমিত এক হাত জিভ কেটে বলল, ‘এঃ, একদম ভুলে গেছি!’
বস হেসে ফেললেন, ‘বাপরে, আপনারও ভুল হয়? এতদিন চাকরি করছেন কোনদিন তো কিছুতে ভুল হতে দেখিনি। মাঝে মাঝে ভুল হওয়া ভালো বুঝলেন তো? আমিও করি। যাক গে, সন্ধ্যের মধ্যে ফাইলটা প্রদীপবাবুকে পাঠিয়ে দিলেই চলবে।’
বসের অফিস থেকে বেরিয়ে সুমিত খুব অবাক হয়ে গেল। অন্যদিনের মতো তার মনে ঘণ্টা বাজল না তো? বসের ঘরে ঢোকার আগে তেমন টেনশন হয়নি। কি একটা ভাবছিল তখন এক মনে। এরকম হয় না অন্যদিন, টেনশনের তোড়ে সমস্ত ভাবনা ভেসে ভেসে চলে যায়। তারপর অনেক পরে মৃতদেহের মতো আবার ভাসতে ভাসতে পাড়ে ফিরে আসে। মৃতদেহের মতই তাদের গায়ে পচন শুরু হয়। তখন ভাবনাদের হয় কবর, নয় পুড়িয়ে ফেলতে হয় চিরদিনের মতো।
আজকে ভাবনাগুলো স্টিক করে আছে। সাঁতারুর মতো ঠিক ভেসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর বালিতে ফিরে এসে চুল থেকে জল ঝরিয়ে, ডাবের জল খেয়ে, আরও কিছু কমবয়সী ভাবনাদের সঙ্গে করে ঝাঁপ দিচ্ছে।
তাহলে কি তার ঘুম কাটেনি ভালো করে? সুমিত টয়লেট করে ভালো করে মুখে চোখে জল দিল। তারপর রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বেরোনোর সময় হঠাৎ মনে পড়ল তরুণের কথাটা। সে নাকি চুল আঁচড়াতে ভুলে গেছে? চিরুনি তার পকেটেই থাকে। সেটাকে বার করে চুলটা ঠিক করে নেওয়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সুমিত শিউড়ে উঠল।
আয়নায় তার কোনো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে না।
আর সমস্ত কিছু কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাথরুমের দেওয়াল, ইউরিনাল, বেসিন, হলুদ টাইলের ফ্লোর- সমস্তকিছুই দেখা যাচ্ছে, শুধু তাকে ছাড়া।
দরজা ঠেলে শুভম ঢুকে এল বাথরুমে।
‘কি সুমিতভাই, চমকে উঠলেন কেন আমাকে দেখে? ভূত দেখলেন নাকি?’
‘না, হঠাৎ করে ঢুকলেন তো!’
শুভম বেসিনে হাত ধুতে ধুতে কিছুক্ষণ আবড়ি-জাবড়ি গল্প করল সুমিতের সাথে। কথাগুলো সে বলছে আয়নার দিকে তাকিয়ে। অর্থাৎ আয়নার মধ্যে দিয়ে শুভম দেখতে পাচ্ছে তাকে। শুধু সেই…
কফি খেতে নেমে দেখা গেল তরুণও আছে, যথারীতি কফির কাপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সে ব্ল্যাক কফি নিয়ে মুখোমুখি বসতে তরুণ ভুরু কুঁচকে সন্দেহের চোখে তাকালো। সুমিতই জিজ্ঞেস করল- ‘কি ঘটছে এখন?’
‘ঘটছে তো তোর।’ তরুণ জিজ্ঞেস করল।
‘কি ঘটছে? কিছু ঘটছে না তো!’ সুমিত হেসে বলার চেষ্টা করল। হাসিটা ঠিকমত ফর্ম করল না। তরুণ বলল- ‘আমাদের কিন্তু শর্ত ছিল সব কিছু শেয়ার করার।’
‘আরে কিছু হচ্ছে না তো! শেয়ার কি করব? এই দ্যাখ, ব্ল্যাক কফি খাচ্ছি। নতুন কিছু টেস্ট করে দেখছি আর কি!’
সুমিত মুখ ভেটকে তেতো স্বাদ বোঝানোর চেষ্টা করে। তারপর এক ঢোকে পুরোটা কফি শেষ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে ক্যাফে থেকে।
সুমিত অফিসের কাজ আর করল না। এই অবস্থায় করা সম্ভব নয়। সারাটা দিন সে পায়চারি করল আর অফিসের প্রতিটা ফ্লোরের আয়নায় গিয়ে দেখল বারবার। পার্কিং-এ রাখা গাড়ির কাঁচে, বন্ধ কম্পিউটারের স্ক্রিনে, লিফটের চকচকে দেওয়ালের মধ্যে- কোত্থাও সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে তা’হলে?
সুমিত অফিস থেকে বাড়ি এল অন্যদিনের চেয়ে অনেকটা আগে। ঊর্মিলা রান্না করছে। গন্ধ শুঁকে মনে হচ্ছে চিকেন তেহারি। এটা প্রত্যাশিতই ছিল। যেদিনই রাত্রিবেলা ফিরতে দেরি হয় তার পরদিন ঊর্মিলা ভালো কিছু রান্না করে। অপরাধবোধ না তার প্রতি করুণা সেটা সুমিত ভালো জানে না। সে যথারীতি উদাসীনভাবে খেয়ে উঠে যেত। রান্না কেমন হয়েছে, ঊর্মিলার যথেষ্ট আছে কিনা এসব নিয়ে কখনও কথা বলেনি। বুকের মধ্যে যে পাথরটাকে সন্তানের মতো বয়ে বেড়াতে হয় তাকে ঘুম পাড়াতেই তার সবটুকু এনার্জি খরচ হয়ে যায়। সাংসারিক কথাবার্তা বলতে গেলেই ভয় হয়, বুকের পাথরটা জেগে যাবে। পাথর জাগার ভয়ে সে চুপ করে যতটা সম্ভব শরীর স্থির করে বসে থাকত। পাশের ঘরের আলো বন্ধ হয়ে গেলে সেও ধীরে ধীরে উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ত।
কিন্তু সেই পাথর আজকে যেন বুক থেকে গড়িয়ে পড়েছে। বা পাখির বাচ্চা যেমন পাখা শক্ত হলে হঠাৎ একদিন উড়ে যায় তেমন হুট করে বুক থেকে উড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে সে জানে না, শুধু অনেকদিন বাদে আজকে তার খুব এনার্জিটিক লাগে। তারই মধ্যে নাকে এসে পড়ে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা গন্ধ। সুমিত রান্নাঘরে ঢুকে হাতা গুটিয়ে বলে- দাও, আমিও তোমার সাথে হাত লাগাই! সরাসরি না তাকিয়েও সে বুঝতে পারে যে ঊর্মিলা অবাক হয়ে তাকে দেখছে। সন্দিগ্ধ হয়ে দেখছে। তাই তো স্বাভাবিক। বহু বহুদিন পর আজ আবার সুমিত তার সাথে রান্নায় হাত লাগাতে চাইছে। গত তিনবছর যে ঊর্মিলার সাথে ভালো করে কথা বলতেই পারেনি সে হঠাৎ এত সপ্রতিভ হয়ে উঠলে সন্দেহ তো হবেই। কিন্তু কেন সুমিত পারেনি, কি যে তার ওপর ভর করে ছিল, তা সে ঊর্মিলাকে এখনও বলতে পারবে না। বললেই ঊর্মিলা বলবে- ‘সাইকোলজিস্টের কাছে চলো। এগুলো একরকম মানসিক অসুস্থতা’। দুজনের বিছানা আলাদা হয়ে যাবার আগে অনেকরাতে সুমিত ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে, বলতে চেয়েছে ঊর্মিলাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি।
থাক, না বলাই ভালো, বরং সে অতি উৎসাহে রান্না করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আদর্শ তেহারির গন্ধে গোটা ঘর ম ম করতে লাগল। সে ঊর্মিলাকে চোখ মেরে বলল- ‘দেখেছো? ঈশ্বরের হাত। এক ছিল মারাদোনার আর দুই হল আমার। আমি যা রাঁধব তাই অমৃত।’ সত্যিই তাই, তেহারি ছাড়াও সুমিত বানালো পায়েস, সেটিকেও অমৃত বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু খেতে বসে ঊর্মিলা একটা দলাও মুখে দিতে পারল না, তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।
‘কি হল ঊর্মি? কাঁদছ কেন?’
ঊর্মিলা উত্তর দিল না। হাপুস চোখে কাঁদতে লাগল।
‘ঊর্মিলা?’ কাছে যেতেই ঊর্মিলা কষিয়ে থাপ্পর মারল সুমিতের গালে। তারপর আবার কান্না। কান্নার কারণ সুমিতের বুঝতে অসুবিধে হয় না। যে উষ্ণতার উপবাস অনন্তকাল ঊর্মিলার সঙ্গী হয়ে উঠেছে, তাকে এত সহজে, এত অনুষ্ঠানহীন, বিচারহীন, অভিমানহীন ভেঙে দেওয়া যায় না। অভিমানের হক ঊর্মিলার আছে। যতটা বরফ মনের মধ্যে জমেছে তাকে আর ভালোবাসা দিয়ে গলানো যায় না। বরং ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে ফেলতে হয়। সেই ডিনামাইটের ব্যর্থ খোঁজ ঊর্মিলা করেছে বহুদিন। তারপর হেরে গেছে, আত্মসমর্পণ করেছে, দাম্পত্যের শাখা ভেঙে হাত কেটে সে রক্ত দিয়ে লিখতে চেয়েছে অন্য নাম, অন্য পথ। আজকে হঠাৎ এই সবকিছুকে প্রহসন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? দাম্পত্যের রঙ যে কোনোদিন দেখেনি, বালির ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যে পায়ের তালু পুড়িয়ে ফেলেছে তাকে হঠাৎ মরুদ্যানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছে সুমিত। চড় তো তার প্রাপ্যই।
আর একটা এক্সপ্ল্যানেশন দেওয়াটাও বোধহয় সুমিতের কর্তব্য। কিন্তু সেই কি এর ব্যাখ্যা জানে? বরাবর কুঁকড়ে, সন্ত্রস্ত হয়ে, মোমবাতির শিখার মতো কম্পমান হয়ে যাকে থাকতে দেখেছে সে হঠাৎ কী করে সে খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো? কি ব্যাখ্যা দেবে সুমিত? কেন কোনো আয়নাতেই সে আর নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হতে পারে?
ব্যাখ্যা দেওয়ার বদলে সে ঊর্মিলাকে কোলে তুলে নিয়ে যায় তার বিছানায়। ঊর্মিলা গোঙাতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে, সুমিতকে ঠেলে দূরে সরাতে চায়, আঁচড়ে দিতে থাকে, কামড়ে দিতে থাকে। কিন্তু সুমিত এসব গ্রাহ্য করে না। নিজের গায়ে সে এক দানবিক শক্তি অনুভব করছে। টান মেরে খুলে ফেলে ঊর্মিলার শাড়ি, ছিঁড়ে ফেলে অন্তর্বাস। যখন ঊর্মিলা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যায় তখন সুমিত তাকে আদর করতে চায়। একসময়ে ঊর্মিলার প্রতিরোধ বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়ে। তার যোনির ভেতর সুমিতের পুরুষাঙ্গ রাবারের মতো ঘষে তাদের এতদিনের অতীতকে মুছে ফেলতে চায়।
কিন্তু অতীত তো মোছা যায় না অত সহজে। ফলে, যখন দুজনে উঠে মুখোমুখি বসে, ঊর্মিলার চোখে তখনও জল। আর প্রশ্ন। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সুমিত অস্ফুটে বলে – জানতে চাও?
ঊর্মিলা মাথা নাড়ালে সুমিত তাকে টেনে আনে আয়নার সামনে।
‘কি দেখতে পাচ্ছো?’
ঊর্মিলা লজ্জা পেয়ে নিজের যৌনাঙ্গ দুহাত দিয়ে ঢেকে বলল- ‘ধ্যাৎ, এ আবার কি?’
সুমিত ঊর্মিলার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরল, ‘বলো, কি দেখতে পাচ্ছো?’
‘দুজনে নির্লজ্জের মতো ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তাই দেখতে পাচ্ছি।’
‘আমি শুধু তোমাকে দেখছি। আমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘কি?’
‘আজ সকাল থেকে আমি কোনো আয়নায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।’
ঊর্মিলা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি ভাবছ, আমি পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু তা নয় ঊর্মি। আমি পাগল হইনি।’
‘এর মানে কি?’
‘আমিও সারাদিন তাই ভাবছি। এর মানে কি? এর মানে হল আমি আর এক্সিস্ট করি না। আমি অ্যাকচুয়ালি মরে গেছি ঊর্মি।’
‘ও মাই গড!’ ঊর্মিলা মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়েছে।
‘তুমি বিশ্বাস করবে না জানি…’
‘ও মাই গড!’
‘কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি ঊর্মি। আমি এক্সিস্ট করি না। আমি বুঝিয়ে বলছি তোমাকে…’
‘ও মাই গড! ইউ আর কমপ্লিটলি ফাকড আপ।’
‘আমার কথাটা শোনো ঊর্মি।’
‘ইউ আর ম্যাড। ও মাই গড, দিস ইজ…’
‘ঊর্মি, তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না জানি কিন্তু তাও শোনো তোমাকে বলা দরকার। আর কেউ না জানুক তোমাকে আমি বলতে চাই।’
‘না আমি শুনতে চাই না। প্লিজ, আমাকে কিছু বোলো না তুমি।’
ঊর্মিলা শাড়ি পরে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। খাচ্ছে না। থালার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে। বা ভাবনা কিছুই জমছে না, খালি হিল স্টেশনের মেঘের মতো শরীর ছুঁয়ে উড়ছে। সুমিত এসে থালাটা তুলে নিল, ‘দাঁড়াও, গরম করে আনি। একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’
গরম তেহারির গন্ধ উঠছে। সুমিত একবার মুখে তুলে বলল, ‘আঃ, কি ভালো রেঁধেছি! নিজের রান্নার প্রশংসা করা যায় না, কিন্তু না বলেও পারছি কই?’
‘আমার একটা লাস্ট রিকোয়েস্ট রাখবে সুমিত?’
‘আমি সাইকোলজিস্টের কাছে যাব না ঊর্মি। আমাকে তুমি জোর কোরো না।’
দুজনের আর কথা হল না সেদিন। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সুমিত দেখল ঊর্মিলা আগেই বেরিয়ে গেছে। তা এক দিক থেকে ভালো। সকাল বেলা উঠেই কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। স্নান করে উঠে সে ঠিক করল ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাবে। বাড়ির কাছেই একটা ক্যাফে আছে, সন্ধ্যে থেকে নেহাত বড়লোক বা আঁতেল মধ্যবিত্তের আনাগোনা শুরু হয়। কিন্তু সকালের দিকটা ফাঁকা থাকে। সেখান থেকে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোতে বেরোতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। অফিসে সে আজ দেড় ঘণ্টা লেট।
পিয়ন সুবোধ এসে বলল, ‘স্যর আপনাকে ডাকছেন’।
‘ঠিকাছে’। সঙ্গে সঙ্গে গেল না সুমিত। একটা এ-ফোর-শিট নিয়ে এরোপ্লেন বানালো। তারপর উড়িয়ে দিল অফিসের মধ্যে। কিউবিকেলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে সেটা কার কাছে গিয়ে পড়ল কে জানে!
‘আমাকে ডাকছিলেন স্যর?’
‘হ্যাঁ, আপনার না কালকে ফাইলটা প্রদীপবাবুকে দেওয়ার কথা ছিল? সেটা দেননি, আজকে অফিসে দেরি করে এসেছেন- এরকম তো আপনি করেন না, ব্যাপার কি? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?’
‘না শরীর ঠিক আছে। কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না, তাই করিনি।’
‘ইচ্ছে করছিল না মানে? ইচ্ছে করছিল না কেনো?’
‘স্যর, একটা কথা বলবো?’
‘বলুন।’
‘আপনাকে না আমার একদম ভালো লাগে না। আপনি নিজেকে খুব ভালো বলে মনে করেন, কিন্তু আসলে আপনি একটা মিচকে শয়তান।’
বসের দুটো চোখ প্যাঁচার মতো গোল-গোল হয়ে গেছে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না কি বলবেন।
‘তাছাড়া আপনি বেসিকালি একটা অপদার্থ। ইউনিটের হেড হয়ে নিজেকে খুব বড় বলে মনে করেন অথচ ইউনিটের পতনের জন্য আপনিই দায়ী। ইনফ্যাক্ট, আপনি ডিএসএমের ফান্ড নিয়েও নয়ছয় করেছেন। টাকা হাতিয়েছেন। এগুলো আপনার করা উচিৎ হয়নি স্যর। মাইনে তো আপনি ভালোই পান!’
এরপর গোটা অফিসে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। বসের ঘর থেকে সুমিত হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে এবং ভদ্রলোক করিডোরের মধ্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। কিছু কর্মচারী তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও কিন্তু তিনি চিৎকার থামান না। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর তাঁর পায়ের কাছে উড়ে এসে পড়ে একটি কাগজের এরোপ্লেন। তখন চিৎকার থামিয়ে তিনি নিজের কেবিনে চলে যান। পিয়ন সুবোধ মারফৎ জানা যায়- তিনি ডেস্কে বসে বেশ কিছুক্ষণ চশমা খুলে কেঁদেছিলেন।
সুমিত গ্রাউন্ড ফ্লোরের ক্যাফেতে নামে লাঞ্চ করার জন্য। দরজা ঠেলে ঢুকতেই তরুণ হড়বড় করে ছুটে আসে।
‘এই তুই কি করেছিস বলতো? বসের সাথে ঝামেলা করেছিস নাকি?’
‘তুই কি করে জানলি?’
‘আমাদের অফিসেও লোকে বলাবলি করছে।’
‘হ্যাঁ, একেবারে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছি।’
‘তোর ভয় করছে না? তোকে তো এবার তাড়িয়ে দেবে!’
‘সেটা করবে না। রিজিওনাল ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করতে পারত, কিন্তু করবে না। আমি যা বলেছি তার মধ্যে কোম্পানির ফান্ড তছরুপের অভিযোগটাও আছে। হায়ার অথরিটিকে জানাতে গেলে সেটাও জানাতে হয়। সেটা ও জানাবে না। খুব ইমেজ কনশাস আছে মালটা।’
‘অভিযোগটা কি সত্যি?’
সুমিত উত্তর না দিয়ে হাসল, তারপর বলল ‘দাঁড়া, খাবারটা নিয়ে আসি।’
‘ওয়েট। একটা কথা বলবি সুমিত?’
‘কি?’
‘ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করেছে, না?’
‘কোন ব্যাপার?’
‘আমাদের ব্যাপারটা। যেটা একদিন ঘটবে বলে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।’
‘কি ঘটবে বলে তুই নিশ্চিত?’
‘কি ঘটবে তা জানি না, কিন্তু কিছু একটা ঘটবে সেটা তো তুইও মানতি। এখন নাটক করছিস কেন?’
সুমিত কাঁধ ঝাঁকালো। অর্থাৎ তরুণের কথা সে বুঝতে পারছে না। তারপর অ্যাব্রাপ্টলি উঠে খাবারের অর্ডার দিতে গেলে তরুণ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবে। সে নিশ্চিত সুমিতের জীবনে কিছু একটা হয়েছে। ভীতু ভীতু ভাবটা আর নেই, এমনকি মুখের মধ্যে যে হালকা বুড়োটে ভাব প্লাস্টারের মতো লেগেছিল তাও যেন হঠাৎ করে উবে গেছে! ফ্রেস দেখাচ্ছে সুমিতকে। হাঁটাচলায় এখন আর ইতস্তত ভাব নেই, বরং খুব সপ্রতিভ, ডানপিটে ভাব এসেছে। তরুণ মাথা নাড়ল, এতটা পরিবর্তন স্বাভাবিক হতে পারে না। ব্যাপারটা কি তাকে জানতেই হবে।
সুমিত নিয়ে এসেছে গ্রিলড স্যান্ডুইচ আর একটা প্যানকেক। যারা সুমিতকে চেনে তাদের কাছে এও অবাক করা ব্যাপার। সুমিত বরাবর খেতো রুটি আর তরকা। এতদিন তারা একসাথে লাঞ্চ করল অথচ তাকে স্যান্ডুইচ বা প্যানকেক খেতে কখনও দেখেনি তরুণ। সে প্যানকেকের দিকে দেখিয়ে বলল- ‘হঠাৎ প্যানকেক নিলি?’
‘নিলাম’।
‘তাও বলবি ব্যাপারটা তুই বুঝতে পারছিস না?’
সুমিত এবার ঠাণ্ডা চোখে তরুণের দিকে তাকালো, ‘কথাটা যদি আর একবার বলিস তাহলে এই কাঁটাচামচটা তোর গলায় গেঁথে দেব’।
কথাগুলো সুমিত বলেছে বেশ জোরে। তরুণ উত্তর না দিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়, আর বুঝতে পারে অন্যান্য টেবিল থেকে লোকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। টপ করে একফোঁটা জল তার চোখ থেকে নেমে সাদা প্যান্টের ওপর পড়ে। চোখ চুলকোবার ছলে সদ্য ভারী হওয়া আরেকটা ফোঁটা সে মুছে নেয় আঙুল দিয়ে। এখন তার চোখ ঝাপসা কিন্তু মন পরিষ্কার। সে জানে তাকে কি করতে হবে।
সুমিতের অফিসে আর কোনো কাজ নেই। বসের সাথে ঝামেলা করায় বস তাকে আর কোনো কাজ দিচ্ছেন না। তিনি রেগেও গেছেন আবার ভয়ও পেয়েছেন। সরাসরি প্রতিশোধ নেবেন না, মাথা খাটিয়ে কিছু বার করে সুমিতকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবেন। সুমিতের তাতে সুবিধেই হল। সে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঊর্মিলার অফিসের দিকে।
ঊর্মিলার অফিসের রিসেপশন থেকে তুফান করের বাড়ির অ্যাড্রেস জোগার করল কায়দা করে। তারপর আবার ট্যাক্সিতে উঠে বসল। গন্তব্য শুভেন্দুর গলফগ্রিনের বাড়ি। শুভেন্দু তার স্কুলের বন্ধু। অবশ্য বন্ধুত্ব আর কোথায়? স্কুল থেকে কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল শুভেন্দু। শোনা যায় হায়ার সেকেন্ডারিও পাশ করতে পারেনি। বিপথে চলে গেছে বদসঙ্গে পড়ে। নানা ছোটখাটো দুনম্বরি কাজে জড়িয়ে টড়িয়ে শেষে এসকর্ট সার্ভিসের ব্যবসা ফেঁদেছে। সোজা কথায় যাকে বলে পিম্প। পুলিশ-প্রশাসন পকেটে নিয়ে ঘোরে। নইলে এরকম ইল্লিগাল ব্যবসা করেও বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়?
শুভেন্দুর প্রকাণ্ড বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে গেল কাঁকুড়গাছির একটা বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িতে। তখন উল্টোদিকের চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করতে লাগল তরুণ। এতক্ষণ যা মৃদু সন্দেহ ছিল, এখন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। নদী তো বইছে দৃশ্যতই, কিন্তু উৎসটা কোথায়?
আকাশ অন্ধকার হয়েছে। আর তরুণের দুচোখ ছোট হয়ে এসেছে। এই এক মুশকিল, একটানা বসে থাকলেই তার ঘুম পায়। এক ঘণ্টার মধ্যে তিনবার চা খেয়েছে, তাও একই অবস্থা। একবার হেলান দিয়ে বসতেই ছপ্পর ফুঁড়ে ঘুম নেমে এল। সমুদ্রের মতো দ্রুত, সমুদ্রের মতো অন্তহীন। আর সে কি ঢেউ! পাহাড় সমান। তরুণ খালি তলিয়ে গেল। চারিদিকে জল জল জল। কোথাও ডাঙা নেই। কোথাও সমাপ্তি নেই।
ও কাকু, ও কাকু, আপনি ওই গাড়িটাকে ফলো করছিলেন না? ওটা ছেড়ে চলে গেল তো!
প্রথমত সমুদ্র যেমন হুস করে এসেছিল তেমনই হুস করে চলে গেল। যেন পাড়স্থ বালি গোটা সমুদ্রটাকে শুষে নিল সুরুৎ করে। দ্বিতীয়ত, কাকু বলে সম্বোধন করায় চা-ওলার ওপর সে যাহারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছে। সবশেষে উল্টোদিকের পার্কিং লট ফাঁকা দেখে হাঁকুপাকু করে ছুটে গিয়ে বসেছে নিজের স্কুটারে। ভাগ্যিস মোড়ের মাথায় সিগনালটা পড়েছিল, নইলে দু’ঘণ্টার পরিশ্রম স্রেফ পণ্ডশ্রম হয়ে যেত।
বালিগঞ্জে এসে থামল ট্যাক্সি, কিছুদূরে গাছের আড়ালে তরুণ। সুমিতকে দেখা গেল ট্যাক্সি থেকে নেমে একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে। বাড়ির গেটের ওপর লেখা “তরুণ কর। ৮২, বোস পুকুর রোড, কসবা।”
তুফান কর দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন।
‘আপনি?’
‘একটু কথা বলতে এলাম।’
‘কি বিষয়ে কথা বলবেন বলুন তো।’
‘আমার স্ত্রীর বিষয়ে।’
‘দেখুন এবিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে আমি বাধ্য নই।’
‘উর্মিলাকে কি আপনি এই বাড়িতেই নিয়ে আসেন?’
‘আপনি প্লিজ চলে যান। আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।’
‘ওই ঘরে? ওটা কি বেডরুম?’
‘একি আপনি আমার ঘরে ঢুকছেন কেন? পাগল হয়ে গেছেন নাকি?’
‘ইয়েস, ঊর্মিলার গায়ের গন্ধ কিছুটা আছে।’
‘আপনি যদি এক্ষুনি না বেরিয়ে যান তবে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।’
‘বিছানায় ও কেমন বলুন তো? সাহসী না লাজুক?’
‘হ্যালো পুলিশ স্টেশন?’
তুফান কর আর কথা বলতে পারলেন না। সুমিতের ঘুষিতে তাঁর হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে। তুফান কর বুঝতে পারলেন যে তিনি বেকায়দায় পড়ে গেছেন। সুমিতের মুখের ভাষা তাঁর পড়তে অসুবিধা হল না। হাত জোড় করে বললেন ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর কখনও…’
এরপরের ঘটনাগুলি একেবারেই নান্দনিক হল না। সুমিত তাঁর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল বাথরুমে। তুফানের সুদর্শন, ক্লিন শেভড আর কনফিডেন্ট মুখশ্রী চেপে ধরল কমোডের মধ্যে।
‘ঊর্মিলাকে চাস তুই?’
‘না।’
‘আবার বল।’
না।
তুফান করের মুখটা কমোডে চেপে রেখেই সুমিত ফ্লাশ করে দেয়। উতল জলের মধ্যে ভালো করে শ্বাস নিতে না পেরে ভদ্রলোক গোঁ গোঁ শব্দ করেন। তখন তাঁর ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে সুমিত ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে। টিভি চলছে। জি মিউজিক। চ্যানেল পাল্টে কিছুক্ষণ সে মুগ্ধ হয়ে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক দেখে। আজ দেখাচ্ছে তিমি মাছের জীবন। কে যেন বলেছিল মাছেদের মধ্যে তিমি সবচেয়ে একা! এত বড় শরীর, অথচ এত একা! সে বলেছিল একা থেকে থেকে তিমিমাছ জলের ভাষা শিখে ফেলেছে। সারাদিন সে জলের সাথে কথা বলে। সেই কথোপকথন আর কোনো প্রাণী বুঝতে পারে না। বোঝে কেবল সমুদ্রের নীচে গাছেরা। তিমি, গাছ আর জলের ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল জুড়ে ব্যাপ্ত থাকে ভালোবাসা- যা কোনো মানুষ কখনও আরেকটি মানুষকে নিবেদন করেনি। লুকোনো স্বার্থ, দাহ্য অহঙ্কারের তেজ সেই ত্রিভুজের ভূমিকে লম্বভাবে ছেদ করতে পারেনি। এসব ভাবতে ভাবতে সুমিতেরও জলের ভাষা পড়তে ইচ্ছে করে। আলাপ করতে ইচ্ছে করে। ডুবে যেতে ইচ্ছা করে। যে কথাগুলো কোনদিন বলা হবে না সেগুলোকে বুদবুদের মতো ছেড়ে দিতে চায় জলের মধ্যে। জলের আরেক নাম জীবন, সে জীবনের মধ্যে ডুবে মরতে চায়।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সুমিত এবার একটা গাড়ি ভাড়া করে। রাতের জন্য কিনে নেয় ড্রাই ফুড আর দুতিনরকম পেস্ট্রি। তারপর পুরীর উদ্দেশ্যে শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তরুণ আর তাকে ফলো করতে পারে না। ফলো করার বদলে সে তখন চলে আসে সুমিতের বাড়ি। একমাত্র ঊর্মিলাই তাকে সাহায্য করতে পারে, একমাত্র ঊর্মিলার পক্ষেই ব্যাপারটা জানা সম্ভব।
ঊর্মিলার কাছে তরুণ প্রতিটা ঘটনা খুলে বলে, যতটা সে বুঝেছে বা বোঝা সম্ভব। ঊর্মিলা পাথরের মত মুখ করে শুনে যায়। কোনো কথারই উত্তর দেয় না। তরুণের কথা শেষ হলে মুখ তুলে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে- আচ্ছা আপনার কোনো কার্পেন্টার জানা আছে? যে ড্রেসিংটেবিল বানায়…
সুমিত যখন পুরী পৌছালো তখন ভোর। জোয়ার লাগছে। সমুদ্রের মধ্যে লাল কোমরবন্ধনীর মতো সূর্যের ভাঙা প্রতিবিম্ব। সুমিত জলের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। নোনা জল ছুটে এসে তার পা জড়িয়ে ধরতে চাইছে। যেন তারা কিছু বলতে চায়। বা কিছু শুনতে চায়। ভিক্ষা করছে যেন। দক্ষিণেশ্বরে যেতেই যেমন অনেকগুলো বাচ্চা ছেঁকে ধরেছিল পয়সা চেয়ে, তেমন ছেঁকে ধরছে সাদা ফেনাগুলো।
যে ছেলেটা তিমির গল্প বলেছিল তার আরেকটা কথা সুমিতের মনে পড়ে যায়- ‘জলের কথা শুনতে গেলে নিজেকে জলের কাছে বিলিয়ে দিতে হয়।’ বলেছিল ‘সমুদ্র অহঙ্কারহীন মানুষকে নেয় না। ভয়ত্যাগী, স্বার্থত্যাগী মানুষকে নেয় না। ব্রহ্মের সাথে মিলিত চেতনাকে নেয় না।’ ‘নেয় না মানে?’ ‘মানে ডোবায় না’, বলেছিল সে, ‘এইসব মানুষরা কখনও সমুদ্রে ডোবে না। সমুদ্র ঠিক পাড়ে ফিরিয়ে দেয়’। ‘তাহলে ডোবে কারা?’ ‘যেসব মানুষ ভীতু, অহঙ্কারী, স্বার্থান্বেষী, মৃত্যুর চোখের দিকে তাকিয়ে যাদের শরীর কেঁপে ওঠে তারাই ডুবে যায়।’
সুমিত চোখ বন্ধ করে বড় একটি শ্বাস ছাড়ল, শ্বাসের সাথে সমস্ত স্বার্থ, হিংসা, ক্ষুদ্রচিন্তা যেন ছোট্ট একটু বাতাস হয়ে বেরিয়ে চলে গেল হাওয়ায়। চোখে জুড়িয়ে আসছে, শরীর হালকা হয়ে আসছে, শরীরের মধ্যে যেন কত সহস্র স্নায়ু এতকাল জট পাকিয়ে গিট বেঁধে পড়েছিল, হঠাৎ যেন তারা জট খুলে টানটান হয়ে দাঁড়ালো। সুমিত চোখ ভরে প্রকৃতিকে দেখে, প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চায়। সূর্য এখন হাঁসের ডিমের মতো লাল, সেই রঙে ক্রমশ রাঙা হয়ে ওঠে সুমিতের চোখও। সে সূর্যপ্রণাম করে, তর্পন করে; তারপর এগিয়ে যায় সমুদ্রের মধ্যে। জলের কথা শোনার জন্য নিজেকে ভাসিয়ে দেয়।
ভেসে যায় সুমিত। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া মাত্র সে প্রস্তুত হয়ে ওঠে, প্রকৃতির সাথে অন্তর্লীন হওয়ার জন্য শরীর শিথিল করে দেয়; কুঠার দিয়ে গাছ কাটার সময় যেমন গাছ ছটফট করে না, সুমিতও প্যানিক করে না তলিয়ে যেতে যেতে, বরং আশ্চর্য হয়ে দেখে পায়ের তলায় মাটি না থাকার অভিজ্ঞতায় সে বেশ শান্তি পাচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম যেভাবে আসে, প্রতিরোধহীন অথচ অজান্তে, সেভাবেই সুমিতের জ্ঞান জলের অধিকারে চলে যায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়া।
কিন্তু ওই যে লোকটা বলেছিল, সমুদ্র শূন্য মানুষকে নেয় না, পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে দেয়, তার কথাই সত্যি হল। সুমিতের দেহ ফিরে এল তীরে। যারা স্নান করতে নেমেছিল তারা একটা মানুষের শরীরকে ভেসে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। হইহই পড়ে গেল। তারপর তার নাড়ি পরীক্ষা করা হল। বুকের ওপর চাপ দিয়ে ফুসফুসে জড়ো হওয়া জল বের করে দেওয়া হল। একটি রাত সুমিতের জায়গা হল হাসপাতালে।
পরের দিন সুস্থ হয়ে উঠল পুরোপুরি। যদিও তার মুখ দেখে মনে হল যেন শত্রুতা করে কেউ তার শান্তি চুরি করে নিয়েছে। সে সুস্থ হয়েছে, কিন্তু স্বাভাবিক হয়নি। মাটিতে পা ফেলতেও যেন তার কষ্ট হচ্ছে। স্নানের ঘরে বসে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। খাবার মুখে তুলছে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেওয়ালের দিকে। ডাক্তার বলল- ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা হয়েছে তো! নার্স এসে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনার বাড়ির লোক কেউ এসেছে?’ সে মাথা নাড়ালো দুদিকে। ‘বাড়ির কারোর ফোন নম্বর?’ ‘আত্মীয়? বন্ধুবান্ধব? কারোর একটা কনট্যাক্ট নিশ্চয়ই আছে।’ ‘আপনি কি আরও একদিন হাসপাতালে থাকতে চান?’ ‘সাইকিয়াট্রিস্ট তুষার মহাপাত্র আসবেন সন্ধ্যা বেলা, আপনি কি কনসাল্ট করতে চান?’ সমস্ত প্রশ্নের উত্তরেই দুদিকে মাথা নাড়ে সুমিত। তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলে- সে কি জীবিত না মৃত?
হাসপাতাল থেকে বাইরে পা দিতেই সকালের মিঠে রোদ গায়ে এসে পড়ল। আর সুমিতের মুখেও একটুখানি প্রসন্নতা শিউলিফুলের মতো ফুটে উঠল। যে প্রকৃতির সাথে বিলীন হতে চেয়েছিল সেই প্রকৃতিই যেন তার হাত ধরে বলছে- বাঁচো প্রিয়, তোমার সময় এখনও আসেনি। প্রকৃতি কি তাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করছে? সুমিতের বুকে অনেকক্ষণ পর একটু শান্তি আসে। সে নিশ্চিত যে প্রকৃতি তাকে ভালোবেসে আরেকটি জীবন উপহার দিতে চায়।
সে আবার সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। এখন ঢেউগুলোকে শ্রমিক ঢেউ বলা যেতে পারে। শ্রমিকের ঘামের মতো রোদ পড়ে ঢেউয়ের শরীর চিকচিক করে উঠছে। তারা সুমিতের পায়ের কাছে এসে দিনের কাজ শেষ করে, কেউ কেউ কেউ ফিরে যায় সমুদ্রের পেটে। সেইসব ঢেউয়ের সাথেই ঝিনুকের মতো ভেসে আসে কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন – সে বেঁচে গেল কেনো? এর অর্থ কি? এখন তার জীবন কোন দিকে চলবে, কিভাবে চলবে? ঝিনুক নয়, এগুলো আসলে মুক্তো। মুখ খুলতে পারলেই প্রশ্নগুলোর পেটের মধ্যে থেকে দুর্মূল্য পাথর পাওয়া যাবে।
ঝিনুক ও সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলোকে পকেটে নিয়ে দশ-বারো ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরে এল তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। একজন নিরীহ মানুষের মতো ধীর পায়ে সে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। সন্ধ্যে হয়ে এলেও কেন যেন সিঁড়ির আলোগুলো জ্বলছে না। যুধিষ্ঠিরের কুকুরের মতো অনেক দূর থেকে ছুটে আসা স্ট্রীটল্যাম্পের আলো তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। ঊর্মিলা এখনও ফেরেনি। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সুমিত দরজা খুলে ঢোকে, দরজা বন্ধ করে, দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও খুব অপরিচিত একটা গন্ধ পেল সুমিত। কিসের গন্ধ আন্দাজ করা যাচ্ছে না। নতুন কাঠের গন্ধ কি? কিছু দেখা না গেলেও সে সুইচবোর্ডটার পজিশন জানে। একেবারে বাঁদিকের সুইচটাই টিউবের। ফলে দ্রুত লাইটের সুইচটা অন করতে অসুবিধা হয় না।
টিউব জ্বলে। আর সুমিতের পেট থেকে একটা স্বতস্ফূর্ত চিৎকার আহত বাঘের মতো লাফিয়ে ওঠে। চোখের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আহত বাঘের মতো ভয়। মেরুদন্ড আহত বাঘের মতো ঈষৎ ভাঁজ হয়ে থাকে। সে ঘরের চারিদিকে বারবার ঘুরে ঘুরে তাকায়, যেন চারদিকে বল্লম হাতে শিকারিরা তাকে ঘিরে ধরেছে। ঘরের চারদেওয়ালে কে যেন বসিয়ে গেছে আয়না। রান্নাঘরের দরজার সামনে আয়না, বেডরুমের দরজার সামনে আয়না। গোটা ফ্ল্যাটটাকে যেন আয়না দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। চারদিকের আয়নায় প্রতিফলিত অসীম, অসংখ্য প্রতিবিম্বের মধ্যে কোন একটিতেও সুমিত নেই।
সে ছুটে এসে দরজা খুলে বেরোতে চায়। কিন্তু শত চেষ্টাতেও দরজা খোলে না। বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে ঊর্মিলা তখন বসে আছে সিঁড়ির ওপর। তারও চোখে ভাষা নেই, শরীরে শক্তি নেই, শুধু থেকে থেকে কাঁপছে আর ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা চিৎকার, দরজায় ধাক্কা ও আঁচড়ের শব্দ দুহাতে কান চাপা দিয়ে আটকাতে চাইছে। সেইসব আওয়াজ যখন ধীরে ধীরে কমে এল তখনও উঠে দাঁড়ানোর সাহস হল না ঊর্মিলার শরীরে। এভাবে সে বসে থাকে আরও অনেকক্ষণ। অন্যন্য ফ্ল্যাটের লোকেরা মাঝে মাঝে ওঠা নামার পথে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু ঊর্মিলা কারোর সাথেই ভালো করে কথা বলতে পারে না।
ঊর্মিলা কতক্ষণ সিঁড়িতে বসেছিল সে নিজেও জানে না। বহুক্ষণ পর তরুণ এসে ডাকলে সে শুধু আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখিয়ে দিল।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তরুণ। দাঁত দিয়ে শক্ত করে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তার একমাত্র বন্ধু সুমিত ঘরের মাঝে কুঁকড়ে পড়ে আছে। মরা ছাগলের মতো তার চোখ দুটি খোলা, যেন দূরে কিছু একটা দেখতে চাইছে, খুঁজতে চাইছে। স্পন্দন নেই। সুমিতের শব পড়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে। তাকে ঘিরে চারিদিকে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে কতগুলি আয়না। আর সবকটি আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে পড়ে আছে অসীম, অসংখ্য সুমিতের মৃতদেহ।
এতগুলি মৃতদেহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তরুণের মাথা ঘুরতে থাকে। হয়ত সেই কারণেই সে খেয়াল করে না যে ওই অসংখ্য প্রতিবিম্বের মধ্যে একটিতেও তার নিজের কোন উপস্থিতি নেই।
প্রচ্ছদঃ অন্তরা ভট্টাচার্য