সাতাশে ফাল্গুন-অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

                       (১)                                                 

“এই ক্ষীরোদদা, ঘুমোলে নাকি?” অপেক্ষাকৃত রোগা মহাকাশচারীটি, বাঁ হাতের কবজি দিয়ে, অপেক্ষাকৃত মোটা মহাকাশচারীটির ডান বাহুতে, আলতো খোঁচা মারল।

“হুমম?” অপেক্ষাকৃত মোটা মহাকাশচারীটি, অনেকক্ষণ বা কিছুক্ষণ পর, গা ঝাড়া দিল একবার। “ভাবছিলাম।”

“এঃ, পুরো সিগারেটটা নষ্ট করলে!” অপেক্ষাকৃত রোগা মহাকাশচারীটি, যথেষ্ট মন দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে মাংসের টুকরো বের করছে। “সিগারেট ফিগারেট নষ্ট করলে, বেশ গায়ে লাগে মাইরি!”

“মাংসটা কেমন ছিবড়ে ছিবড়ে লাগছেনা?” ক্ষীরোদ ভুরু ভাঁজ করে ছাই ঝাড়ল তালুর উপর থেকে। তারপর হাঁটুর উপর থেকে। তারপর ভুরু সোজা না করেই অপেক্ষাকৃত রোগা মহাকাশচারীটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল।

“সে তো একটু লাগবেই।”

“আমার কি মনে হয় বলো তো নিতাই – ”

“কী?” রুমালি রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিতাই আর ক্ষীরোদের দিকে তাকাল না।

“লিভারে মনে হয়, এখনো হজমের ব্যাকটিরিয়াগুলো গজানো শুরু করেনি।”

“তা’লে এতোগুলো মাংস লিভারে ঢোকালে কী করে?”

“বলছো?” ক্ষীরোদ ঢকঢক করে রামের লালরঙা বোতল খালি করে। সশব্দে ঢেঁকুড় তোলে একটা। তারপর জ্যোৎস্নার চাঁদের দিকে তাকায়। তারপর কালো সমুদ্রের দিকে তাকায়। তারপর বোতলটা সর্বশক্তি দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুঁড়ে মারে।

“স্বাদ পাচ্ছি না যে!”

“টিউব ফুড ট্রাই করবে নাকি একবার?”

“আছে বুঝি?”

“দেখতে হবে।” নিতাই উঠে দাড়ায়।

“যাচ্ছো যখন, একটা রামের বোতলও এনো। প্লিজ।”

“সালা গবগবিয়ে মাল টানতে পারছো, আর চিকেনের বেলায় যত নখরা!” বিড়বিড় করতে করতে নিতাই সমুদ্রের দিকে হাঁটা মারে। ক্ষীরোদ সেদিকে তাকায়। 

একটা আজবদর্শন ষড়কোণ নৌকো। তাতে ডাঁই করা কিছু জিনিস। এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কি আছে, কি নেই। কিন্তু ক্ষীরোদ জানে। নিতাইও জানে। দুটো তাঁবু, কিছু ওষুধ, কাগজপত্র, খাবার, জল আর রাজ্যের যন্ত্রপাতি! ক্ষীরোদ অনায়াসে, একটা সিগারেট ধরালো। সাদা রঙের সিগারেট। কয়েক টানেই, একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে ফিরে এল নিতাই। দুহাতে রামের বোতল। একটার রঙ লাল, অন্যটা ঘন।

বোতল দুটো বালির উপর রেখে পকেট থেকে একটা বড় টুথপেস্টের মতো টিউব ক্ষীরোদের সামনে রাখলো সে।   

“সমুদ্রটা কেমন অদ্ভুত শান্ত, খেয়াল করেছো?”

“তুমি আবার লাস্ট কবে অশান্ত সমুদ্র দেখলে?”

“কেনো? সেদিনই তো দেখলাম! বেস ক্যাম্প থেকে পৃথিবীর যে ফুটেজটা পাঠালো, সেটার তেরো মিনিট ছাব্বিশ সেকেন্ড থেকে চোদ্দো মিনিট দুই সেকেন্ড পর্যন্ত! দেখোনি?”

ক্ষীরোদ টিউব থেকে পেস্টের মতো মাংস নিজের প্লেটে ঢালে।

“একটাই ছিল?”

নিতাই মাথা নেড়ে তর্জনী আর মধ্যমা বাড়িয়ে দেয়। ক্ষীরোদ আধ খাওয়া সিগারেটটা গুঁজে দেয় তাদের ফাঁকে। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়া চলে দুজনের। নিতাই ঘন ঘন সিগারেট ফোঁকে। ক্ষীরোদ গবগব করে রুটি মাংস খায়।

“আমার কি মনে হয় বলো তো নিতাই -”

“কী?”

প্লেটে লেগে থাকা শেষ কণা মাংসটুকু মুখে তুলে ক্ষীরোদ ঠোঁট চাটে। “মাংসটাতেই প্রবলেম ছিল। কই বিফে তো প্রবলেম হল না!”

“সেটা বোধহয় অভ্যাস।” নিতাই সিগারেটের টুকরোটা টুসকি মেরে ফেলে দেয়।

“হবে হয় তো!”

“সমুদ্রটা কেমন বাজে রকমের শান্ত।” আবার মন্তব্যটা করে, টকাস্‌ করে ছিপি খোলে নিতাই।

ক্ষীরোদ খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে নিতাইয়ের মদ খাওয়া দেখে। নিতাইয়ের মদ খাওয়া বেশ সুন্দর! বেশ লাগে দেখতে!

“এই ভালো। কাল সন্ধে অবধি টিঁকে থাকতে হবে।”

“ওরা জামাকাপড় আনবে, না?”

ক্ষীরোদ মাথা নাড়ল।

“যেগুলো রেখে গেছিলাম সেগুলোই?”

“ওগুলো বেস ক্যাম্প থেকে বেরোবার আগে পাবে।”

“আর বাকি জিনিসগুলো?”

“সব।”

নিতাই নিশ্চিন্তে মদ খাওয়া শুরু করে আবার। ক্ষীরোদ উঠে দাঁড়ায়। শরীরটা একবার ঝাড়া দিয়ে নেয় ।

“কই যাও?”

“হাঁটি একটু। কতদিন এমনি এমনি হাঁটি না।”

“আচ্ছা। আমি তা’লে আরেকবার আগুনটা জ্বালাই।” পোড়া কাঠকয়লা আর ছাইয়ের দিকে দেখিয়ে বলে নিতাই। বোতলটা সন্তর্পণে পাশে রাখে।

“জুতোটা খুলতে পারলে ভালো হত, না?” ক্ষীরোদ হাঁটতে শুরু করে।

ষড়ভুজ নৌকাটা, তাদের বসবার পাথর দুটো থেকে খুব দূরে, আবার খুব কাছেও নয়। মোটামুটি মাঝামাঝি কোথাও একটা নোঙর গেঁথে, রাখা হয়েছে। ক্ষীরোদ হাঁটতে হাঁটতে নৌকোটা পেরিয়ে গেছে, হঠাৎই পায়ের দিকে নজর গেল তার। কি একটা লেগেছে! সে ঝুঁকে তুলে নিল। একটা জেলিফিশ!

চোখের কাছে এনে দেখল, মরে গেছে জেলিফিশটা। ক্ষীরোদ ভাবল ফেলে দেবে। তারপর আবার কি মনে হল, পকেটে ভরে নিল। নিতাই খোঁড়াচ্ছিল কেন? ওর কি পায়ে কোনো অসুবিধে হচ্ছে? তার নিজের পায়ে একটা অস্বস্তি হচ্ছে বটে, মনে হচ্ছে জুতোটা খুলে ফেলি, কিন্তু খোঁড়ানোর মতো কিছু তো হয় নি!

তবে কি মাধ্যাকর্ষণজনিত কোনো ব্যারাম? ক্ষীরোদ কোমরের উপর জড়ানো ফাইবারের বেল্টটা একটু টেনে নিল। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখল নিতাই কাঠকয়লা জড়ো করছে। তারপর সামনে বেশ জোরেই একটা লাফ দিয়ে ফেলল আচমকা। স্পেস স্টেশনে নিয়মিত এক্সারসাইজ করলেও, বহুদিন হল শরীরের ওজনটা শুধু ডিজিটাল নাম্বারেই দেখেছে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির হিসেবটা ক্যালকুলেশনের বাইরে ছিল। ধড়াস্‌ করে পড়ল ক্ষীরোদ। বালির মধ্যে একটু গর্ত করেই।

“পড়েছো?” নিতাইয়ের হাঁক শোনা গেল দূর থেকে। ক্ষীরোদ একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। “লাফালাফি করতে যেও না। আমিও একটু আগে করতে গিয়ে পড়েছি।” নিতাই একই ভাবে হেঁকে বলল।

ক্ষীরোদ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। স্পেস স্যুট থেকে বালিগুলো ঝাড়ল জলদি। গ্লাভস্‌ পরার এই এক সুবিধে। তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তারপর উঠতে গিয়ে বুঝল কোমরে সামান্য টান ধরেছে। সে চট করে ওঠার চেষ্টা করল না।

এরকম কোমরে ক্র্যাম্প অবশ্য আগেও ধরেছে। স্পেস স্টেশনে। কমেও যাবে। শুধু কিছুক্ষণ নড়াচড়া না করে কোমরটাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিতে হবে। ক্ষীরোদ আশপাশ দেখল জায়গাটার। শুধুই বালিতট আর সমুদ্রের ফেনা জমে থাকার দাগ। সেখানে চাঁদের আলো পড়ে রূপোলি লাগছে। ডান দিকে বেশ কিছুটা দূরে ঘন জঙ্গল। তার সবজেটে আভা এখানে, এই এতদূর অব্‌ধি পৌঁছচ্ছে। ক্ষীরোদ ভাবল, উঠবে?

ডান হাতটা বালির উপর রাখল সে। ভর দিতে হবে। বাঁ হাতটা তার পাশে রেখে একটু চাপ দিতেই মনে হল, বালির নিচে কি যেন একটা!। সে আরেকটু হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল।  

একটা কাঠের তক্তা। মোটামুটি মাঝারি মাপের। উপরে স্রোতের দাগ। বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরোনো। ক্ষীরোদের মনে হল, যেন কিছু লেখা আছে তক্তাটায়। সে কাছে এনে, জ্যোৎস্নার আলোয় পড়বার চেষ্টা করল। প্রায় পুরোটাই ধুয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে A D আর 7- এই তিনটে জিনিস বুঝতে পারল সে। অক্ষর দুটো আর সংখ্যাটা পাশাপাশি লেখা নয়। আরো কিছু লেখা আছে এদের চারপাশে। কিন্তু সেগুলো বোঝা অসম্ভব।

“ও ক্ষীরোদদা!” নিতাইয়ের আওয়াজে চোখ ফেরালো ক্ষীরোদ। “গ্যাস লাইটারে ধরছে না। ইলেক্ট্রো-লাইটারটা নিয়ে আসো।”

ক্ষীরোদ তক্তাটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাঃ, কোমরে লাগছে না আর। একটু বেশি তাড়াতাড়ি হেঁটেই নৌকোটায় গেল সে। ইলেক্ট্রো-লাইটারটা কোথায় যে রেখেছে! খুঁজতে হবে। খুঁজতে খুঁজতেই নৌকোটার গায়ে লাগানো তক্তাগুলোর উপর চোখ পড়ল ক্ষীরোদের। তাদের স্পেস স্টেশনের নাম, রওনা হওয়ার দিন, আর আরো কিছু তথ্য খোদাই করা আছে। অন্তত তিন জায়গায় সাত সংখ্যাটা চোখে পড়ল। A আর D?

তখুনি লাইটারটা ঠেকল হাতে। সে তক্তার থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্রের কালো জলে তাকালো। সত্যিই খুব শান্ত সমুদ্রটা! খুব একটা ঢেউ দিচ্ছে না। আওয়াজও বেশ কম। সে “নিতাই”, জোরে ডেকে উঠল। নিতাই তার দিকে তাকালে, “নাও ধরো” বলে ছুঁড়ে দিল লাইটারটা। নিতাই লুফে নিল।

ক্ষীরোদের মনে হল সে যেন আগেও এভাবে লাইটারটা ছুঁড়েছে নিতাইয়ের দিকে। আর নিতাইও এভাবেই লাইটারটা লুফে নিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসেছে তার দিকে তাকিয়ে। তার হঠাৎ মনে হল, এই পরিবেশ যেন তার কতকালের চেনা! সমুদ্রটারও যেন এরকমই শান্ত থাকার কথা আজন্মকাল!

ক্ষীরোদের মনে হল সে যেন তিনবার তিন রকম ভাবে নিতাইয়ের দিকে লাইটারটা ছুঁড়ে দিল।

                                                            (২)

“ওরা জানে তো আমরা এসে পড়েছি?”

ক্ষীরোদ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে দু’টুকরো কাঠ ছুঁড়ে দিল আগুনে।

“যোগাযোগ করেছে?”

ক্ষীরোদ অসম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল, “তোমার এটা প্রথমবার, না?”

“হ্যাঁ।”

“ওই জন্যেই।”

“কি?”

“ওই জন্যেই এতো ভাবছো। ওরা সরাসরি চলে আসে। যোগাযোগ করে না।”

“আচ্ছা।”

“হ্যাঁ। বরং যোগাযোগ করলেই বুঝতে হবে ঝামেলা আছে।”

“কেন?”

“যদি মেজর কোনো গন্ডগোল হয়ে থাকে, তবে ল্যান্ডিং-এর সঙ্গে সঙ্গেই যোগাযোগ করে, কি করতে হবে তার ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয়। আর তারপর বিস্তর জবাবদিহি, অনেক ঝামেলা।”

“তোমার সাথে কোনোদিন হয়েছে বুঝি?”

“নাঃ। আমার এক ব্যাচমেটের সাথে হয়েছিল। শেষমেষ তার চাকরিটাই চলে যায়।”

“কি ঝামেলা হয়েছিল?”

“সেটা তো জানি না ভাই। স্টেট সিক্রেট।”

নিতাই বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে। হাঁটু দুটো মুড়ে, দ’ হয়ে বসে আছে সে। শিশির পড়লে, গুঁড়ি মেরে আরেকটু এগিয়ে যাবে আগুনটার দিকে। ক্ষীরোদ কাত হয়ে শুয়ে, বাঁ কনুইয়ে ভর। নিতাই পা দুটো টানটান করে একাকীত্বে, আড়মোড়া ভাঙে।

“তোমার এটা নিয়ে ক’বার হল ক্ষীরোদদা?”

“তিন বার। এটাই লাস্ট।”

“কেন?”

“তিন বারের বেশী আর কাউকে পাঠাবে না। কোম্পানি থেকে নতুন রুল বের করেছে।”

“ও।” নিতাই একটুক্ষণ চুপ করে। “কিন্তু…”

“সেটা আগে হতো।” ক্ষীরোদ ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয়। নিতাই আর কিছু বলে না। ক্ষীরোদ সিগারেটের প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করতে যেতে, হাতে ভেজা ভেজা কি যেন একটা ঠেকে। সে বের করে আনে। সেই জেলিফিশটা!

“এটা আবার কোত্থেকে জোগাড় করলে?”

ক্ষীরোদ কিছু বলে না।

“জ্যান্ত?”

ক্ষীরোদ নেতিবাচক মাথা নাড়ে। তারপর একটা সিগারেট ধরায়। জোরে জোরে টান দেয় চার-পাঁচবার। সিগারেটের মুখটা ভালো করে জ্বলে উঠলে, সেটাকে ঠেসে ধরে মৃত জেলিফিশটার চামড়ায়। ভিজে ত্বকের সংস্পর্শে, একবার ফুস্‌ আওয়াজ করে নিভে যায় সিগারেটটা। দাগ পড়ে না। ব্যথা লাগে না। ক্ষীরোদ, জেলিফিশটাকে ছুঁড়ে দেয় আগুনের মধ্যে। সিগারেটটা আবার ধরায়।

নিতাই নীরব দর্শকের মতো দেখে দৃশ্যটা। তারপর সিগারেটের কাউন্টার নেওয়ার জন্য ছোপ লাগা আঙুল বাড়িয়ে দেয়। ক্ষীরোদ আরেকটা টান মেরে এগিয়ে দেয় সিগারেটটা, তারপর উঠে বসে।

“কোনোদিন জেলিফিশের মাংস খেয়েছো নিতাই?”

“নাঃ।”

“খাবে নাকি?”

“এটা?” আগুনের দিকে দেখিয়ে নিতাই জিজ্ঞেস করে।

জেলিফিশটা আধপোড়া হয়ে একটা ভাঙা কয়লার পাশে পড়েছিল। ক্ষীরোদ একটা সরু গাছের ডাল দিয়ে সেটাকে গেঁথে আনে। নিতাই একটু ইতঃস্তত করছিল, সে আদ্ধেক ভেঙে এগিয়ে দেয়, “নাও।”

“ঠিক মতো পুড়েছে?”

ক্ষীরোদ বাকি অর্ধেক একবারে মুখে পুরে দিয়েছিল। চিবোতে চিবোতে বলল, “চলে যাবে।”

নিতাই একটু ভেঙে মুখে দিয়েই থু থু করে ফেলে দিল। “এঃ, এ তো পুরো বালি ভর্তি!”

ক্ষীরোদ একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। নিতাই আধ পোড়া আধ কাঁচা মাংসপিন্ডটা দিতেই, মুখে পুড়ে দেয় সটান।

“এখন অসুবিধে হচ্ছে না? ব্যাকটিরিয়াগুলো গজিয়ে গেছে?” একটু শ্লেষ মিশিয়েই জিজ্ঞেস করে নিতাই।

“তা-ই তো মনে হচ্ছে।”

“দেখো, আবার পেট খারাপ না হয়।” একটা হাই তুলে টানটান হয়ে বালিতে শুয়ে পড়ে সে।

“ঘুমিয়ে পড়ো না। ওরা কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে।”

“না না, এই একটু পিঠটা টান করে নিচ্ছি আর কি! কতক্ষণ আর এগুলো পরে, বসে থাকা যায়!”

“হুম্‌ম্‌।” ক্ষীরোদ আর কথা না বাড়িয়ে, সমুদ্রের দিকে তাকায়। তারপর বিপরীত দিকে। তারপর পাথরের পিছন থেকে একটা নাইলনের ব্যাগ টেনে আনে। সবুজ রঙের। যে কোনো সাধারণ ব্যাগের মতোই চেইন লাগানো। সে চেইন টেনে খোলে ব্যাগটা।  

ব্যাগটা, কয়েক তাড়া কাগজপত্র আর কিছু ক্যালকুলেটর জাতীয় জিনিসপত্রে ঠাসা। ক্ষীরোদ কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাটি করে কিছু একটা খোঁজে। পায় না। ব্যাগটা আবার বন্ধ করে, পাশে রেখে, বালিতে শুয়ে পড়ে।

আকাশটা বেশ পরিষ্কার। অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। এতোগুলো মাস, স্পেস স্টেশনে কাটিয়ে আসার পর, এখন, পৃথিবী থেকে রাতের আকাশ দেখতে অদ্ভুত লাগে না? ক্ষীরোদের তো লাগে! একটা শ্বাস পড়ল তার। প্রথমবারও একই অনুভূতি হয়েছিল। দ্বিতীয়বারও। সবারই কি এরকমটা হয়? সে নিতাইয়ের দিকে তাকালো। নিতাইও আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

“নিতাই…”

“হ্যাঁ?”

“তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?”

“সবাই! বাবা, মা, দিদি। দিদির দু’বছর হল বিয়ে হয়েছে। এছাড়া ছোটকা, ছোটকাকিমা, তাদের দুই মেয়ে। আর বাবার এক দূর সম্পর্কের কাকাও আমাদের সঙ্গে থাকেন।” নিতাই একটু থামে। দম নেয়। “তোমার?”

“বাবা-মা তো অনেক দিন হল মারা গেছেন। এখন আমি দিদির ফ্যামিলিতে থাকি। ওই, যে ক’টা দিন পৃথিবীতে থাকতাম, ওই ক’টা দিন আর কি।” ক্ষীরোদ হঠাৎ চুপ করে যায়। চোয়ালের কাছটা একটু চুলকে নিয়ে বলে, “এখন থেকে মনে হয় অন্য ব্যবস্থাও রেডি রাখতে হবে।”

“ও।” নিতাই কথা বাড়ায় না। ক্ষীরোদ আরেকটা শ্বাস ফেলে।

“বড্ড ভুল হয়ে গেল!”

“কি?”

“দিদির ছেলেটাকে কথা দিয়েছিলাম, এইবার ফেরার সময় ওর জন্য কিছু একটা নিয়ে আসবো। আনা হয় নি।”

“কি আনতে?”

ক্ষীরোদ ভাবে একটুক্ষণ। “কি জানি!”

“তা’লে?”

ক্ষীরোদ হেসে ফেলে। “আসলে জামাইবাবু যখনই বাইরে কোথাও যান, কিছু না কিছু নিয়ে ফেরেন। অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। এবার আমাকে বলল, মামু তুমি তো আর যাবে না। আমার জন্য কিছু একটা এনো। আমিও বোকার মতো হ্যাঁ বলে দিয়েছি।”

নিতাইও হাসে। “ছোটোবেলায় ঠাকুমাও বাবাকে বলতো। কোথাও গেলে বাড়ির লোকদের জন্য কিছু নিয়ে আসবি!”

ক্ষীরোদ উত্তর না দিয়ে একটুক্ষণ ভাবে। নিতাই ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, “অত টেনশন কোরো না। কি আনা যায়, যদি কোনো আইডিয়া পাও, বোলো, পরের বার নিয়ে আসবো।”

ক্ষীরোদ একবার কাঁধ ঝাঁকায়। “নাঃ। ঠিক আছে। কিছু একটা খেলনা নিয়ে যাব নাহয়। ও তো আর ধরতে পারবে না।”

“বড়ো হয়ে পারবে।”

ক্ষীরোদ নিতাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। দুটো কাঠের টুকরো ছুঁড়ে দেয় আগুনে। ফের তাকায়। নিতাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কি দেখছো?”

“আকাশটা কি পরিষ্কার, না?”

“হুম্‌ম।”

নিতাইয়ের ভুরুটা একটু কুঁচকে যায়। সে মন দিয়ে কয়েক সেকেন্ড আকাশের একটা কোণ পর্যবেক্ষণ করে। তারপর সেদিকে আঙুল দেখিয়ে, ক্ষীরোদের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, “ওটা কালপুরুষ, না ক্ষীরোদদা?”

ক্ষীরোদ দেখার চেষ্টা করে। “কোনটা?”

“ওই যে।” দেখানোর আগ্রহে অর্ধেক উঠে বসে নিতাই।

ক্ষীরোদও উঠে বসে নিতাইয়ের নির্দেশ করা আকাশের কোণে তাকায়। তারও ভুরু যায় কুঁচকে। “কালপুরুষ যেন কোন স্ট্রাকচারটাকে বলে?”

“শিকারী।”

“ও হ্যাঁ।”

ক্ষীরোদ আবার শুয়ে পড়ে। “ম্যানুয়াল বুকটা এতো বার পড়তে হয়েছে, বাংলা বা ইংলিশ নামটা ভুলেই যাই মাঝে মাঝে।” অজুহাত দেওয়ার স্বরে বলে সে। বোকার মতো হাসে।

                                                            (৩)

এখন আবার সমুদ্র আগের মতো স্বাভাবিক। জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়েও গর্জন শোনা যাচ্ছে। সাথে পাখিদের কিচিরমিচির, কাঠবেড়ালির কাটুরকুটুর। রোদ ওঠে নি। আকাশ মেঘলা। লম্বা লম্বা গাছগুলো থেকে সোঁদা গন্ধের সাথে একটা গরম ভাপও বেরোচ্ছে মধ্যে মধ্যে। নিতাই কপালের ঘাম মুছল।

“উফ্‌ফ, এবার এগুলো খুলে ফেললে বাঁচি।” নিজের স্পেস স্যুটটাকে দেখিয়ে বলল সে।

ক্ষীরোদ পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ ফেরাল না। “একটু পরেই ওরা চলে আসবে। ততক্ষণ…” ওদের সামনে একটা শুকনো ডাল ভেঙে পড়ল। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় উপরে তাকাল দু’জনে। কিচ্ছু নেই। গাছগুলোর ঠাসবুনোটের ফাঁক দিয়ে একটু আধটু আকাশ দেখা যাচ্ছে। গাছটার বাকলে বহু বছরের ক্ষয়ক্ষতির লক্ষণ। আর একটা নাম-না-জানা পাখি উড়ে গেল, ডানা ঝাপটে ঝাপটে।

ব্যস, এটুকুই!

ক্ষীরোদ আবার বাড়িটার দিকে তাকালো। এবার দু’পা এগিয়ে, আরো কাছ থেকে। ভুরু কুঁচকে গেল তার। শ্যাওলা পড়া ইটের দেওয়াল ঘন সবুজ। কিছুটা পরপর হলুদ, কালো আর খয়েরী ছোপ সেই সবুজে মানচিত্র সৃষ্টি করেছে। জায়গায় জায়গায় ইট ফাটিয়েছে অশ্বত্থের শিকড়-বাকল। সেরকমই একটা শিকড়ের স্তুপের পাশে, মরচে পড়া পেরেকটা দেখতে পেল ক্ষীরোদ। পেরেকটার বাঁদিকে, শ্যাওলা আর মাকড়সার ফেলে যাওয়া জাল ঘষে তুলতে শুরু করল সে। গ্লাভ্‌স পরা থাকলে তাড়াতাড়ি হয়।

হাওয়া পশ্চিম দিকে বইছে। সামুদ্রিক জোলো হাওয়া। কপালের ঘামে বালি মিশিয়ে দেয়। পশ্চিম দিকেই বইছে তো? নাকি পশ্চিম দিক থেকে বইছে? আরেকবার এক মুঠো বালি তুলে নিয়ে পরখ করে নিতাই। নিশ্চিত হতে পারে না। পকেট থেকে কম্পাসটা বের করে। হ্যাঁ, কম্পাসও একই কথা বলছে। হাওয়ার উৎস পশ্চিম দিগন্ত।

“কি করছো?” ক্ষীরোদের পাশে গিয়ে দাড়ায় নিতাই।

ক্ষীরোদ শ্যাওলার প্রায় অন্তিম আস্তরণটা তুলে দিয়ে হাঁপাতে থাকে। নিতাই লক্ষ্য করে পেরেক বা ওইজাতীয় তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে শ্যাওলার শেষ আস্তরণে কিছু সংখ্যা লেখা। যা তারিখও হতে পারে, আবার অন্য কিছুও। 7 সংখ্যাটা তিনবার নজরে পড়ে তার। কোনো অক্ষর নেই।

“তুমি খোদাই করেছিলে?” নিতাই ক্ষীরোদের দিকে তাকায়। ক্ষীরোদ এখন মাটির দিকে তাকিয়ে।

“কেন?”

“সেটা আমি কিভাবে বলবো, যাব্বাবা!”

“না, কেন এরকম মনে হল, সেটা জিজ্ঞেস করছি।”

“এতো কষ্ট করে ঘষে ঘষে বের করলে, তাই!”

ক্ষীরোদ হেসে ফ্যালে। “না হে, আমার লেখা না।”

“তা’লে?”

“জানি না।”

“তা’লে?”

“শেষবার যখন এখানে ল্যান্ড করেছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম এটা। তাই কৌতূহল হলো।” ক্ষীরোদ এবার হেঁটে একটু তফাতে যায়। নিতাই আরো অল্পক্ষণ সংখ্যাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

“ও।” সে-ও একটু পিছিয়ে এসে দাড়ায়। পোড়ো বাড়িটাকে আরেকবার খুঁটিয়ে দেখে।

বাড়িটার জায়গায় জায়গায় ইট হাঁ করে বেরিয়ে আছে। বাঁদিকটা ধসে পড়া, সেখানে অশ্বত্থের বংশবিস্তার। ছাদ বলে কিছু নেই। যেটা আছে, সেটা চূড়ো বা গম্বুজ জাতীয় কিছুর কঙ্কাল। নিতাই কিছু বড়ো বড়ো গর্ত দেখতে পেল খসে পড়া ইটের দেওয়ালে। সেগুলো জানলাও হতে পারে, আবার দরজাও। কারণ, বাড়িটার বহির্ভাগ অন্তত দু’ফুট নরম মাটিতে ডুবে আছে। আর বাড়িটাও যেন শ্যাওলা, পচা পাতা আর ধুলোর আস্তরণে, দিব্যি ঘুমিয়ে আছে, গা ডুবিয়ে ।

“মিনিমাম দেড়শো বছর!” নিতাই একটা ইট কুড়িয়ে নিয়েছিল মাটি থেকে। সেটা দেখতে দেখতে বলে। ইটটা বেশ পাতলা। উপরের শ্যাওলা আর কাদার আস্তরণ সরাতে গেলে, নিতাইয়ের হাতেই ভেঙ্গে যায়। নিতাই ক্ষীরোদের দিকে তাকায়।

“এটা কি ছিল গো?”

ক্ষীরোদ একটা গাছের গুঁড়ির উপর মাথা নীচু করে বসে ছিল। মুখ না তুলেই সে কাঁধ ঝাঁকায়।

“মন্দির?” নিতাই তিন টুকরো হয়ে যাওয়া ইঁটটা হাত থেকে ফেলে দেয়।

ক্ষীরোদ এবারও কোনো উত্তর দেয় না। তবে নিতাইয়ের দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকায়।

“ভিতরে যাবে?”

“নাঃ।” অনেকক্ষণ পর একটা উত্তর দিল ক্ষীরোদ।

“কেন?”

“সাপখোপ থাকতে পারে।”

নিতাই হেসে ফেলে নিজের জুতোটা দেখায়। “এটা থাকতে ভয় কি! বরং সাপেরই আমাদের ভয় পাওয়া উচিত।”

“ওইজন্যেই।” ক্ষীরোদ আবার মাথাটা নীচু করে দেয়।

নিতাই একটুক্ষণ ক্ষীরোদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা ছোট্টো ইটের টুকরোকে জুতো দিয়ে টোকা মেরে বলে, “উফফ্‌, জুতোটা খুলে ফেলতে পারলে ভালো হত।”

“এসে যাবে ওরা।” ক্ষীরোদ এসে নিতাইয়ের পিঠের ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা নিয়ে জল খায়। নিতাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলে সে হাত নেড়ে না জানায়। “খেয়ে নাও, এরপর কিন্তু প্রায় চব্বিশ ঘন্টা জল না খেয়ে থাকতে হতে পারে।”

নিতাই একটু অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জল খায় দু’ঢোক। বোতলটা ব্যাগে পোরে। ব্যাগটা ফের পিঠে নেয়।

“বাড়ি ফেরার ক’দিনের মধ্যেই টাকাটা এসে যাবে, না ক্ষীরোদদা?” একটা ছোট ইটের স্তুপের উপর বসে সে। ক্ষীরোদ দাঁড়িয়েই থাকে। একটা সিগারেট ধরায়।

“হ্যাঁ। ওই বড় জোর দু-তিন দিন।”

নিতাই গ্লাভ্‌স পরা হাতের উপরই কর গুনে কি একটা হিসেব করে বিড়বিড় করে। ক্ষীরোদ পাঁচ-ছ’টা টানের পর সিগারেটটা বাড়িয়ে দিলে ছেদ পড়ে তাতে।

“আচ্ছা, একটা ফ্ল্যাট কিনতে কত টাকা লাগে?”

“ওভাবে বলা যায় নাকি! কোথায় কিনছো, কিরকম ফ্ল্যাট, কত তলা, ক’টা ঘর, সব কিছুর উপর ডিপেন্ড করে।”

“ও।” নিতাই সিগারেটটা ফেরত দেয়। “যদি শহরে কিনি? ওই ইকো গার্ডেনটার চত্বরে।”

“সে তো অনেক দাম। এই এক ট্রিপের মাইনেতে হবে না।”

“হবে না, না?” নিতাই একটু কাঁচুমাচু মুখ করে।

“তোমার নিজের বাড়ি আছে না? আবার ফ্ল্যাট কিনতে যাবে কেন?”

“দূর! সে তো ভিলেজ অঞ্চলে। ওখানে থাকা যায় নাকি?” নিতাই প্রশ্নের মতো করে বলে।

ক্ষীরোদ মাথা নাড়ে। “আমি কোনোদিন থাকিনি।”

“ওইজন্যেই বলছো। জল বিষাক্ত, মাটি বিষাক্ত, বাতাসে সবসময় একটা পচা গন্ধ। হাসপাতালগুলো বাজে। আর স্কুলটুল, অফিস বাজার সবই তো শহরে। কিছুই তো ভিলেজ এরিয়াতে নেই। লোকে থাকবে কি করে!”

“কিন্তু শহরে যে তোমাকে আর্টিফিশিয়াল পরিবেশে থাকতে হবে!”

“সে তবুও অনেক ভালো। অন্তত আরামটুকু তো আছে।” নিতাই একটা সিগারেট ধরায় এবার। “বাবা তো তাই বলল যে এই চাকরিটা যখন পেয়েই গেছিস, এবার শহরে চলে যাওয়াই ভালো। কদ্দিন আর কষ্ট করে বাঁচা যায়।”

ক্ষীরোদ নিতাইয়ের পাশে কাদা, মাটি আর পচা পাতার উপর বসে পড়ে। নিতাই সিগারেটটা দিতে চাইলে মাথা নেড়ে না জানায়। “তোমাদের গ্রামে পুকুর আছে নিতাই?”

“গ্রাম আবার কি!” নিতাই হেসে ফেলে। “ভিলেজ এরিয়া! ভিলেজ মানেই সেই আগেকার গ্রাম নাকি!”

ক্ষীরোদের চোখের পাতা পড়ে না। “তোমাদের ভিলেজ এরিয়ায় পুকুর আছে নিতাই?”

“আগে ছিল। এখন আর নেই।” সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ তার কি যেন মনে পড়ে। “ও না, পুব প্রান্তে গেলে একটা দু’টো হয়তো পাওয়া যেতে পারে। আমি বহুদিন ওদিকটায় যাই নি।”

ক্ষীরোদের চোখের পাতা পড়ে। একবার। “আমাকে নিয়ে যাবে?”

“কোথায়? পুব প্রান্তে?” নিতাই অবাক হয়ে বলে।

“তোমাদের ভিলেজ এরিয়ায়। তারপর সেখানে।”

“কেন?” নিতাইয়ের বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

“দরকার আছে।”

‘কি দরকার’ বলতে গিয়েও “ও” বলে চুপ করে যায় নিতাই।

“তোমরা শহরে চলে গেলে, বাড়িটার কি হবে?”

“বাবা কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন নিশ্চই।”

ক্ষীরোদ একবার কাশে, যেন গলাটা সাফ করে নেয়। “তোমাদের বাড়িটা আমাকে বেচবে?”

নিতাই ক্ষীরোদের প্রশ্ন শুনে এতটাই অবাক হয়ে যায় যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারে না। “বেচবে?” ক্ষীরোদ আবার প্রশ্নটা রিপিট করে।

“তুমি… তুমি কিনে কি করবে?” নিতাইয়ের বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটে নি।

“থাকবো।” বলে দিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে ক্ষীরোদ। যেন এই একটা শব্দে সে অনেক কিছুর সমাধান দিয়ে দিয়েছে।

নিতাইয়ের হাত আপনেআপ চলে যায় পকেটে। সে আরেকটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখে প্যাকেটে আর একটাই সিগারেট বেঁচে আছে। বাড়িয়ে দেয় ক্ষীরোদের দিকে। ক্ষীরোদ নেয়। নিতাই প্যাকেটটা বাড়ির একটা দরজা বা জানলার ফোকর দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে। পকেট থেকে লাইটার বের করে প্রথমে ক্ষীরোদেরটা জ্বালায়, তারপর নিজেরটা।

“থাকতে পারবে?”

ক্ষীরোদ খুব জোরে একটা টান মেরে নাক মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে। “পারবনা?”

নিতাই একটা উত্তর দিতে যাবে, হঠাৎ ক্ষীরোদ প্রায় লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীরে একটা সচকিত ভাব। দেখাদেখি নিতাইও উঠে দাঁড়ায়।

“কি হল?”

“ওরা এসে গেছে। প্রায়।”

“কই?” নিতাই এদিক ওদিক তাকায়।

ক্ষীরোদ ওর দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলে, “আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছো না?”

“না তো!” নিতাইয়ের মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব।

“এসো।” ক্ষীরোদ ওর হাত ধরে একরকম প্রায় টানতে টানতে একটা লম্বা গাছের সামনে দাঁড় করায়। “এবার?”

নিতাইয়ের মনে হয় খুব ঢিমেতালে একটা কম্পন টের পাচ্ছে। কিন্তু আওয়াজ তো পাচ্ছে না! সে ক্ষীরোদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

“কানটা গাছের মধ্যে লাগিয়ে শোনো।”

নিতাইয়ের মনে হয় ক্ষীরোদ যেন আদেশ করল। সে কানটা গাছটার সঙ্গে ঠেকাতে যায়। পারে না। গাছটার গুঁড়ি বড়ো ও চওড়া। ভর সামলানো যাচ্ছে না। নিতাই গাছটাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কানটা ঠেকায়। হ্যাঁ, তরঙ্গ অনুভব করছে একটা। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটা কম্পন যা তার কান বেয়ে মস্তিষ্কে, আর সেখান থেকে প্রতিটা কোষে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিতাইয়ের মনে হল, কেমন ভেজা ভেজা ঘুম ঘুম ভাব তাকে আচ্ছন্ন করছে।

“শুনতে পাচ্ছো?” অন্য কানে ক্ষীরোদের আওয়াজ গমগমিয়ে উঠল।

নিতাইয়ের ঠোঁট নড়ে উঠল। “পাচ্ছি।”                                               

প্রচ্ছদ – অন্তরা ভট্টাচার্য