চৌকি থেকে নেমে, জলে ছপছপ করতে করতে ঘরের বাইরে এল দ্বারিক। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশ তাকিয়ে দেখল। আকাশ জুড়ে মেঘের পাতলা প্রলেপ। ধূসর প্রকৃতি গ্রামের মাথার ওপরে থমথম করছে। কে বলবে এটা সকাল আটটার চিত্র! বৃষ্টি থেমেছে। সারারাত ধরে একনাগাড়ে অঝোরে জল ঝরিয়ে, ক্লান্ত আকাশ একটু জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। দিন কয়েক হল অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়েই চলেছে। কলাগাছের পাতাগুলো বৃষ্টি আর হাওয়ার দাপটে ফালাফালা হয়ে ছিঁড়ে গেছে। মাটি আলগা হয়ে একটা কলাগাছ কাৎ হয়ে হেলে গেছে। পেয়ারা গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে উঠোনে। জমে থাকা বৃষ্টির জলে পায়ের পাতা ডুবে যাচ্ছে। এই জমা জলের বড্ড বখাটে স্বভাব। যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে। দ্বারিকের ঘরের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। বিরক্ত দ্বারিক জল থেকে পেয়ারার ডালটা তুলে, গা থেকে কাঠি ডালগুলো ভেঙে, ওটাকে শাবলের মতো বাগিয়ে মাটিতে খাল খুঁড়তে বসল। খাল কেটে জল বের না করলে ঘরে হাঁটাচলা করা দায়। খাল কাটতে বসেও বিপদ। মাটি ভিজে ঢোল হয়ে আছে। খোঁচালেই জলে গুলে গিয়ে খাল বুজিয়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে কসরত করার পর, মোটামুটি একটা নালি মতো তৈরি করতে পারল দ্বারিক। সেই নালি দিয়ে ঢোঁড়া সাপের মতো অলস জলের রেখা, বাড়ি আর উঠোনের মায়া ছেড়ে নিচু নয়ানজুলির দিকে গড়াতে শুরু করল। জল নামা শুরু হল।
উঠোনের চারপাশে, বাড়ির পেছনে, ছোট-বড় অনেক গাছপালা। পেটের তাগিদে নিজেরই লাগানো ফুল ও ফলের গাছ। কলা, কুল, বেল, টগর, জবা, শিউলি, ইত্যাদি। এই সবই পুজোয় লাগে। দ্বারিক, বামুন হলেও পূজারী নয়। সরস্বতীর সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে তার আদায় কাঁচকলায়; তাই কোনদিন একটা মন্ত্রও মুখস্ত করে উঠতে পারেনি। দ্বারিকের বাবা করুণাকিরণ এককালে নামকরা পুরোহিত ছিল। নিজের গ্রামে তো বটেই, আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকেও পুজো করার বায়না আসত। কথায় বলে, বারো মাসে তেরো পাব্বণ। পুজোআচ্চা তো লেগেই আছে বাঙালির ঘরে। তাই উপায় মন্দ হতো না। তাছাড়া, কয়ঘর শাঁসালো যজমান ছিল, যাদের কাছ থেকে সারা বছরের চাল-ডাল-তেল-কলার সংস্থান হয়েই যেত। মানুষ বলতে তো সাকুল্যে তিনটি- করুণাকিরণ, স্ত্রী ইন্দুবালা আর ছোট্ট দ্বারিক। সেই আয় একদিন ঝপ্ করে বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন এককুড়ি দ্বারিকের অকস্মাৎ পিতৃবিয়োগ হল! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওর মা-ও দেহ রাখল। দ্বারিক পড়ল অথৈ জলে, তবে জাতে বামুন তো, তাই মন্ত্রতন্ত্র শেখা না হয়ে উঠলেও, পুজোর রীতি রেওয়াজ দ্বারিকের পেছন ছাড়ল না। সে হয়ে গেল পুজোর ফুল-বেলপাতা, ফলমূলের সাপ্লায়ার; তাই উঠোন জুড়ে এই এত গাছপালা লাগানো। বাড়ির উপার্জন আর আগের মতো রইল না বটে, কিন্তু একজনের জীবন নির্বাহ করার মতো যথেষ্ট আয় করতে শুরু করল দ্বারিক।
পেয়ারার ডালটা উঠোনের এক কোণায় ছুঁড়ে ফেলে বেজার মুখে ঘরের দিকে পা বাড়াল সে। ঠিক তক্ষুনি ঘরের পেছন দিক থেকে আঁ আঁ করে একটা গরুটা ডেকে উঠল।
“থাম, থাম, যাইতাছি…” পাল্টা হেঁকে উঠল দ্বারিক।
বৃষ্টির ঠেলায় সারা উঠোন প্যাচপ্যাচ করছে। মাটি পেছল হয়ে গেছে। সন্তর্পণে পা চেপে চেপে, ঘরের পেছনদিকে এগোলো দ্বারিক। গরুটা ওরই। বেশ কয়েক বছর আগে, মহকুমা সদরের আশ্বিনের হাট থেকে ওটাকে কিনে এনেছিল। নাম রেখেছিল শরতী।
বাড়ির পেছনদিকে গোয়ালঘর। অবশ্য সত্যিই গোয়াল বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। চারটে বাঁশের মাথায় খড়ের ছাউনি। বাঁশের তিনদিক দিয়ে চটের ঘেরা দেওয়া। কাছে গিয়ে দ্যাখে, শরতীর অবস্থা শোচনীয়। একে ভালো করে স্নান করানো হয়নি বেশ কয়েকদিন হল, তার ওপর সারারাত খড় থেকে জল চুঁইয়েছে আর শরতী ভিজেছে- আরও ময়লা দেখাচ্ছে ওকে। চটের ঘেরাটোপও ভিজে সপসপ করছে। জমা জল, পচা মাটি, গোবর আর গরুর পেচ্ছাপ… সব মিলিয়ে গন্ধে জায়গাটায় টেকা দায়!
“সাধে কি তোরে গরু কই! ওপর থেকে জল পড়ছে দেখতাছোস, সরে দাঁড়াতে পারস না!”
শরতীর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলছিল দ্বারিক। গা-টা ঠাণ্ডা! ওই বা কী বুঝলো কে জানে, মাথা দোলালো, লেজ নাড়ালো। গাছগাছালির জন্য এদিকটায় মশার উপদ্রব। এই বৃষ্টিতেও এদের কমতি নেই। শরতী থেকে থেকে লেজ নাড়ে আর পা ঠুকে ঠুকে মশা তাড়ায়। পা ঠোকার ধাক্কায় গুলে যাওয়া গোবর আর মাটি ছিটকে ওঠে।
“থাম! থাম! অত পা ঠুকিস না। গোবর লাগে। এখন সাতসকালে আর লুঙ্গি কাচতে পারুম না।”
গজগজ করে দ্বারিক। গরু জোরে জোরে মাথা নাড়ে। আঁ আঁ করে ডাক ছাড়ে। গলার ঘণ্টা ঠং ঠং করে বাজে। জাবনার নাদার দিকে চোখ যায় দ্বারিকের। নাদা খালি। খেতে দিতে হবে। খিদে পেয়েছে শরতীর।
“রও, রও। তোরে খেতে দিই। খিদা পাইছে?”
গলকম্বলে বিলি কেটে উঠোনের দিকে হাঁটা দেয় দ্বারিক। খড়ের গাদার ওপর থেকে রেক্সিন সরিয়ে, কয়েক আঁটি খড় টেনে নামিয়ে রেক্সিনটা আবার ভালো করে ওপরে পেতে দেয়। তারপর আঁটিগুলো তুলে গরুর নাদায় রাখে। বাতাসে আর্দ্রতার জন্য খড়গুলোও যেন ভিজে নেতিয়ে গেছে। শরতী গলা নামিয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে খড় চিবোতে থাকে। দ্বারিক একদৃষ্টে তাকিয়ে ওর খাওয়া দ্যাখে। শরতীকে দ্যাখে। জলে ভিজে হলদে হয়ে যাওয়া চামড়ার তলা দিয়ে, গরুটার পাঁজরের হাড় গোনা যায়। এই কয় বছরে অনেক রোগা হয়ে গেছে। পাছার ওপরে দুইদিকের হাড় দু’টো উঁচু হয়ে থাকে এখন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্বারিক। এই কয়েকবছরেই বড্ড মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। সাবধানে ধীর পায়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে।
দরজার বাইরে রাখা জলের বালতি থেকে একঘটি জল তুলে, পায়ের কাদা ধুয়ে ঘরের ভেতর ঢোকে দ্বারিক। মেঝেতে এখন আর জল নেই। সব বেরিয়ে গেছে, তবে মেঝেটা ভিজে ঢ্যাবঢ্যাব করছে। কাদা পেরিয়ে আর উঠোনের দিকে যেতে ইচ্ছে করল না দ্বারিকের। যাওয়ার দরকার ছিল, কারণ ওর তখনও দাঁত মাজা হয়নি। পেয়ারাপাতা চিবিয়ে দাঁত মাজা ওর ছেলেবেলার অভ্যেস। মুখের ভেতরটা কেমন পরিষ্কার খরখর করে। পেয়ারাপাতার রস খুব মিষ্টি। দাঁত মাজা হয়ে গেলে ঢকঢক করে জল খায়। তখন মুখের ভেতরটা আরও মিষ্টি লাগে। বহুদিনের পুরোনো আর খুব প্রিয় অভ্যেস। জনতা স্টোভের সলতে’য় আগুন ধরিয়ে চায়ের জল চাপাল দ্বারিক। অন্যদিন হলে মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানে গিয়ে, একভাঁড় চা খেয়ে আসত। আজ আর ভেজা রাস্তা পেরোতে ইচ্ছে করল না। নিজের জন্য চা করতে এমনিতে ওর বড় আলসেমি আসে; কিন্তু আজ না করলেই নয়। আকাশের অবস্থা বিশেষ সুবিধের ঠেকছে না। কখন যে হুড়মুড়িয়ে নামে তার কোন স্থিরতা নেই। স্টিলের ছোট একটা গ্লাসে চা ঢেলে, চৌকির ওপর পা ঝুলিয়ে বসে দ্বারিক। ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় গরম গরম চা খেতে ভালোই লাগে। তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিতে থাকে। শরতী আবার আঁ আঁ করে ডাকে। এই ডাক টা কিছুতেই বুঝতে পারেনা দ্বারিক। গত দুইদিন হল মাঝে মাঝে এমন করে ডাকছে গরু টা। ডাক টা অন্য দিনের থেকে একদম আলাদা, আগে কখনো শোনেনি দ্বারিক। চা খেতে খেতে শরতীর কথাই ভাবছিল সে।
বাড়িতে গরু রাখার বুদ্ধিটা দ্বারিকের নিজের। বাপের কল্যাণে শ্রাদ্ধশান্তির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সেই ছোটবেলা থেকে বৈতরণী পার করে দেওয়ার জন্য, কৃষ্ণবর্ণা সবৎসা গাভীর কথা শুনে এসেছে দ্বারিক। সেরকম গাভী তো আর কোনোদিন পাওয়া যায়নি ; তার বদলে দ্বারিক দেখেছে, অনুষ্ঠানবাড়ির লোক ওর বাবাকে যে যার সাধ্যমতো মোটা মূল্য ধরে দিয়েছে। পুরোহিত পিতা আর নেই বটে, কিন্তু তাই বলে বৈতরণীর গরুর ল্যাজ ধরে উপার্জনের পথ তো আর বন্ধ হয়ে যায়নি! তাছাড়া ফুল-ফল বেচে ক’টা টাকাই বা আয় হয়! অনেকদিন বিষয়টা নিয়ে ভেবে, পুজো-ব্যবসায়ী দ্বারিক আশ্বিনের মেলা থেকে শরতীকে কিনে এনেছিল। একটা বাছুরও ছিল শরতীর, কিন্তু টাকায় কুলোতে পারেনি বলে বাছুরটাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেনি সে। বাড়ির পেছনদিকে ওর থাকার জায়গা বানিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকেই শরতী রয়ে গেছে।
খবরটা রটতে বেশি সময় নেয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই, গ্রামে, সনাতন সংস্কারে আবদ্ধ ধর্মভীরু সকলেই জেনে গেছিল, স্বর্গত করুণাকিরণের ছেলে দ্বারিক, বৈতরণী পার করাবে বলে গরু নিয়ে এসেছে। এমন নয় যে গ্রামে গরুর আকাল, কিন্তু শ্রাদ্ধের কাজের জন্য কেউই নিজের গরু দিতে চায় না। এত বছর ধরে গাভীর অভাবে, তল্লাটের কেউই সুষ্ঠভাবে বৈতরণী পার হতে না পারায়, শরতীর কদর বেড়ে গেল। পাড়ায়, গ্রামে, এমনকী আশেপাশের গ্রামেও কারোর পিতৃবিয়োগ হলে, কাজের দিন শরতীকে নিয়ে দ্বারিক পৌঁছে যায় সেই বাড়িতে। আয়োজনের ত্রুটি নেই। বাড়ির লোক বৈতরণীর গরু বাবদ কিছু মূল্য দ্বারিককে ধরিয়ে, শরতীকে নিয়ে যায় । পঞ্চাশ একশো টাকা পকেটে আসে। কখনও দুশোও ঢোকে। তারপর শরতী দান হয়ে যায় শ্রাদ্ধকারী ব্রাহ্মণের কাছে। সব কাজ মিটে গেলে, দ্বারিক আবার শরতীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। করুণাকিরণের ছেলে হওয়ার দরুণ, পুরোহিতের কাছ থেকেও পাঁচ-দশ টাকা কোন কোনদিন উপরি আয় হয়।
সব থেকে বেশি আয় হয় গঙ্গাসাগরের মেলায়। সেখানে কাতারে কাতারে খদ্দের। খদ্দের অর্থাৎ পুণ্যার্থী। বাঙালি, বিহারী, উড়ে, সবাই চায় গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হতে। সকলের ভেতরই পুণ্যলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যবে থেকে শরতী দ্বারিকের সঙ্গী হয়েছে, তবে থেকে ওরা দু’টিতে মিলে প্রত্যেকবার গঙ্গাসাগর পৌঁছে গেছে মকর সংক্রান্তিতে। শ’-দুশো টাকার বিনিময়ে, দানের গরু হয়ে মানুষের হাতে হাতে ফিরেছে শরতী। যদিও দ্বারিক একা পার করায় না। ওর মতো আরও অনেকে সাগরে যায় গরু বাছুর নিয়ে। কেউ ভাড়া করে নিয়ে আসা গরুর ব্যাপারী, কেউ আবার নিজস্ব গরু নিয়ে আসা পুরোহিত। গঙ্গাসাগর মেলার বিভিন্ন গেটে, খদ্দেরের অপেক্ষায় গরু বাছুর নিয়ে বসে থাকে। গরুর ট্যাক্স, থাকা-খাওয়া, আসা-যাওয়ার ভাড়া বাদ দিলেও, আয় মন্দ হয় না। সাতদিনে টাকার অঙ্কটা কোন বছরই তিন-চার হাজারের নীচে হয়নি। শরতীকে ঘরে আনা ইস্তক লক্ষ্মীলাভই হয়েছে দ্বারিকের। সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ শ্লাঘাও হয়েছে। বাপ বেঁচে থাকতে, গরুর লেজ ধরিয়ে কাউকে বৈতরণী পার করাতে পারেনি, অথচ মন্ত্র না জানা দ্বারিক পেরেছে। সে নিজের গ্রামের মানুষদের তো বটেই, এমনকী ভিনরাজ্যের লোকেদেরও নদী পার করায়। আর ভবিষ্যতেও করাবে। এই মহৎ কাজটি করে মানুষের সাথে সাথে তারও যে পুণ্য অর্জন হয়েছে। মোটমাট এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে, শরতীর লেজ ধরে জীবনের স্রোতে কোনরকমে ভেসে রয়েছে সে।
চা শেষ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল দ্বারিক। পুরোনো কথায় এমন ডুবে গেছিল যে, কখন আবার মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে শুরু হয়ে গেছে খেয়ালই হয়নি। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দ্বারিক। বাইরেটা কালো হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙার পরে যে ধূসর ভাবটা ছিল, সেটা আর নেই। এখন চারপাশ কালচে হয়ে গেছে। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। কালো আকাশের বুকে, পাটের সাদা আঁশের মতো লম্বা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে। জোর চড়বড় চড়বড় আওয়াজ উঠছে মাটি আর গাছের পাতা থেকে। মেঘ ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। আজ শরতীর কপালে দুর্ভোগ লেখা আছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে, সাড়ে দশটা বাজে। এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোর নেই। দেওয়ালের একটা খোঁদল থেকে একটা মরচে পড়া টিনের কৌটো বের করল দ্বারিক। ঢাকনা খুলে বিড়ির বাণ্ডিল আর দেশলাই বাক্স বের করে, একখানা বিড়ি ধরাল। বর্ষার হাওয়ায় বিড়ি মিইয়ে যায় বলে এই ব্যবস্থা। বিড়ি টানতে টানতে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল দ্বারিক। মুখে সামান্য চিন্তার ভাঁজ। বৃষ্টিটা বাড়ছে…
এই ক’দিন যে চিন্তা একেবারেই ছিল না, তা নয়। গত কয়েকদিনের ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টিই চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। এবারের বর্ষা বড্ড বেয়াড়া। খালবিল, মাঠ, খেত জলে ডুবে গেছে। পুকুরের জল পাড় ছাপিয়ে, জেলভাঙ্গা আসামির মতো রাস্তার ওপরে এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দ্বারিকের বাড়িতে টিভি নেই, রেডিও নেই। খবরের কাগজ পড়ার বিলাসিতা তার শোভা পায় না। ওকে বা ওর মতো আরও অনেক গ্রামের মানুষকে পৃথিবীর খবরাখবর দেয়, মোড়ের মাথায় ঝাঁপ খুলে সারাদিন গরম চা বিক্রি করা একটি ঝুপসি দোকান। গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গত পরশু বিকেলেই শুনে এসেছে ড্যাম থেকে জল ছাড়বে। এ’টা দ্বারিক বরাবর দেখে এসেছে, ড্যাম থেকে একটু বেশি জল ছাড়লেই ওদের গ্রামে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কারণ গ্রামের অনতিদূরেই বয়ে চলেছে একটি দীঘল নদী, নাম গঙ্গা। সে নদীর তৃষ্ণা মেটে না কোনদিন। পরশুদিনের থেকে আজ অবস্থার অবনতি হয়েছে। যে হারে বৃষ্টি পড়ছে, ড্যাম আর কতক্ষণ জল ধরে রাখতে পারবে! কপালে ভাঁজ সেই আশঙ্কাতেই। কী করবে ভেবে না পেয়ে, বিছানায় শুয়ে পড়ল দ্বারিক। আকাশে মেঘ ডাকলে শরতীও ডেকে উঠছিল আঁ আঁ করে। ওর থাকার জায়গাটা আরও পাকাপোক্ত করতে হবে, অন্তত চালটা তো ছাইতে হবেই, চিৎ হয়ে শুয়ে ভাবছিল দ্বারিক।
টপ্ করে দ্বারিকের হাতে জলের একটা ফোঁটা পড়ল ওপর থেকে। তাকিয়ে দেখল ক্রমাগত বৃষ্টির ফলে টিনের চালে একটা ফুটো তৈরি হয়েছে। এ’টা আজ সকাল অবধি ছিল না। টিনের চালটারও বয়স হয়েছে। ভেতরে জায়গায় জায়গায় মরচে ধরেছে। চালের বাইরেটার কী অবস্থা জানা নেই। এবার ফুটোটা দিয়ে জল পড়তেই থাকবে আর তোষক ভিজবে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে একটা প্লাস্টিকের বালতি বসিয়ে দিল খাটের ওপর। টপটপ আওয়াজ করে জলের ফোঁটা পড়তে থাকল বালতিতে। অস্থির হয়ে আবার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দ্বারিক। উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখল, টগরগাছটা একদিকে নুয়ে পড়েছে বৃষ্টির চাপে। উঠোনে জল জমে গেছে। ঘরেও জল ঢুকেছে। বাইরে বৃষ্টির জল সমানে পড়ে চলেছে জমা জলে, আর জলগুলো যেন একযোগে টগবগ করে ফুটছে। সামনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে কুলকুল করে নয়ানজুলি উপচে জল বইছে। আশেপাশের ঘরগুলোও একনাগাড়ে ভিজে চলেছে। সকলের উঠোনেই কম-বেশি জমা জল। ধানের মড়াই, দাঁড় করানো খড়ের আঁটি, গরু-ছাগল বাঁধার খোঁটা, ছোট ঝোপঝাড় ডুববো ডুববো করছে। দূরে বাড়িঘর গুলোর পেছনে, দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেতের মাটি দেখা যাচ্ছে না। সব ডুবে গেছে জলের তলায় । যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু জল আর জল। মাটিতে, গাছে, বাতাসে, আকাশে ধূসর সাদাটে বৃষ্টির জমাট চাদর। পেছনের আটচালায় দাঁড়িয়ে, শরতী দাপাদাপি করছে আর মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে…
-খবর কী গো? কিছু শুনলা, বৃষ্টি কবে থামব? ওদেরকে উদ্দেশ্য করে হাঁক পাড়ল দ্বারিক।
-গতিক সুবিধের নয়। বৃষ্টি চলবে শুনছি। এক দাওয়া থেকে উত্তর এল।
-গঙ্গার জল বড় রাস্তা ছুঁয়ে গেছে শুনলাম। ড্যাম থেকে জল ছাড়লে সামনে সব্বোনাশ! আর এক বাড়ি থেকে চিন্তিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সকলেই জলের ঠেলায় দিশেহারা। মাথার ওপরে জল, পায়ের তলায় জল। সকলেই উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় পার করছে…
দুশ্চিন্তা মাথায় করে ভাত নামিয়ে, শরতীকে আবার খানিকটা খড় দিয়ে এল দ্বারিক। উঠোনে জল জমে এতটাই পেছল হয়ে গেছে যে, কয়েক-পা হাঁটতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে গেল। এক মালসা গুড়ও ফেলে দিল নাদায়। শরতী খেতে থাকল। গুড় ছাড়া কি আর ওই শুকনো আধভেজা খড় খাওয়া যায়! এমনি দিনে শরতীকে সকালবেলা ছেড়ে দেয় দ্বারিক। শরতী চরে বেড়ায়। ঘাসপাতা খায়। গ্রামে ঘাসের অভাব নেই; কিন্তু লাগাতার বৃষ্টির জন্য এই ক’দিন ওকে ছাড়েনি দ্বারিক। সেই একভাবে খোঁটায় বাঁধা রয়েছে। কখনও বসে, কখনও উঠে দাঁড়ায়। থেকে থেকে ডাক ছাড়ে। টুং টুং ঘণ্টা বাজে। শরতীর জন্য মায়া হয় দ্বারিকের। একটা শুকনো কাপড়ছেঁড়া দিয়ে যতটা পারে, শরতীর গা ঘষে জল শুকিয়ে দেয় সে। গরুর আরাম হয়। গা গরমও হয় সামান্য; তারপর গলকম্বলে হাত বুলিয়ে আদর করে। দ্বারিকের জীবনে আর কেউ নেই আদর করার মতো, তাই ওর ভেতরে যতটা আদর জমা হয়, সবটাই গরুর গায়ে ঢেলে দেয় দ্বারিক। শরতী ছাড়া এই সংসারে ওর দ্বিতীয় দোসর তো আর কেউ নেই…
-কী রে? জলে শীত করে নাকি? সেই কবে থেকে একঠায় দাঁড়িয়ে আছিস…
আদর করে ওর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে দ্বারিক।
গরু শব্দের ভাষা বোঝে না, কিন্তু আদরের ভাষা বোঝে। জাবনা থেকে মাথা তুলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আদর খায়। দ্বারিক দ্যাখে, শরতীর চোখের কোণে জলের দাগ কালো হয়ে শুকিয়ে আছে…
-রও, রও। একটু রোদ্দুর উঠতে দে বাপ। দড়ি খুলে দেব। এখন ছাড়লে গর্তে ডুবে যাবি। চাদ্দিকে জল!
-শরতীকে খাইয়ে, পায়ের পাতা দিয়ে জল ঠেলে নিজের ঘরে ফিরে এল দ্বারিক। ভাত হয়ে গেছে। ফ্যান আর গালেনি। গরম ভাতের গন্ধে, খিদেটা বেশ ভালো করে চাগাড় দিয়ে উঠল। থকথকে ভাতের সাথে নুন দিয়ে আলুসেদ্ধ মেখে, ভাতের ডেকচিটা কোলে নিয়ে খাটের একধারে পা ঝুলিয়ে খেতে থাকল। খাওয়া শেষ হলে, খাটের ওপর পেতে রাখা বালতির জলেই কুলকুচি করে হাত, মুখ ধুয়ে নিল দ্বারিক; তারপর ডেকচি আর বালতি নিয়ে দাওয়ায় এল। বালতিটা, ছাদের ফুটো থেকে পড়া জলে ভরে এসেছিল। জলটা ফেলে বালতি খালি করে, দাওয়ায় রাখা জলে ডেকচিটা ধুয়ে ভেতরে রাখল। তারপর চাদর টেনে শুয়ে পড়ল।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না দ্বারিক। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তাও বলতে পারবে না। শরতীর পরিত্রাহি আঁ আঁ ডাকে ঘুম ভেঙে গেল দ্বারিকের। সময় ঠাহর করতে পারল না। ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। কেমন অপ্রকৃতিস্থের মতো ডাকছে শরতী। সাপে কাটল নাকি? বলা যায় না! জলে তো মাটির সব গর্ত বুজে গেছে। ডাঙায় সাপ উঠে আসা কিছু বিচিত্র নয়। বিছানা থেকে নামতে নামতেই দ্বারিক টের পেল, ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরেটা অন্ধকার। তার মানে সন্ধে হয়ে এসেছে। দু’দিন থেকে পাড়ায় কারেন্ট নেই, তাই আলো জ্বালাতে পারল না দ্বারিক। চট্ করে হ্যারিকেন ধরালো। গরুটা তারস্বরে ডেকেই চলেছে। হ্যারিকেনটা দরজার কাছে রেখে, পেছনদিকে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এল দ্বারিক। বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে একটা হই হই কোলাহল শুনতে পেল। অনেক মানুষের সম্মিলিত আওয়াজ। বিশৃঙ্খল চিৎকার- আর সব ছাপিয়ে দূ—র অন্ধকার থেকে আসছে একটা সোঁ-সোঁ শব্দ। গর্জন বলাই ভালো। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল দ্বারিকের। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে। কানে এল মানুষের আর্তনাদ-
-গ্রামে জল ঢুকছে… পালাও… পালাও… পালাও!!!
অন্ধকারে একটা ছুটন্ত গলার আওয়াজ বলে উঠল-
-রেললাইনের দিকে পালা দ্বা-রি-ক!
ঠাওর করে বুঝতে পারল, লোকজন রাস্তা ধরে জলের মধ্যেই দৌড়োচ্ছে। পালাচ্ছে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। অবস্থাটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল দ্বারিকের। গঙ্গা ফুঁসে উঠেছে। বন্যার জল ঢুকছে। সোঁ-সোঁ আওয়াজটা কানফাটানো গোঙানির মতো হু হু করে বাড়ছে… অর্থাৎ জল ক্রমশ কাছে আসছে! শরতী বুক ফাটিয়ে আর্তনাদ করছে! প্রাণীরা আগাম বুঝতে পারে। বন্যার গন্ধ পায় ওরা। সেইজন্যই যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল দ্বারিক, ততক্ষণ অবিরাম ডেকে গেছে শরতী। নিজের ঘুমের জন্য অনুতাপ করারও সময় পেল না দ্বারিক।
কী করবে ভেবে পেল না। মাথা কাজ করছিল না। হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। কোনমতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে, আলো-আঁধারির মধ্যে হাতড়ে জমানো টাকাপয়সা যা ছিল একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঢুকিয়ে, প্যান্টের পকেটে গুঁজে নিল দ্বারিক। তার থেকে টান মেরে জামাকাপড় যা পেল, একটা কাপড়ের থলিতে ভরে নিল; আর কোনকিছুর মায়া করা যাবে না। সময় নেই। এখান থেকে পালাতে হবে। বাইরে তুমুল হল্লা! সবাই ঘরদুয়ার ফেলে রেখে পালাচ্ছে। রেললাইনটা অনেকটা উঁচুতে, কিন্তু বেশ দূরে। জল আসার আগেই পালাতে হবে। জলের স্রোতের শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হাড় হিম করা গর্জন! গঙ্গা যেন রাক্ষুসীর মতো ফুঁসছে! ঘরবাড়ি, গাছপালা, সংসার – সব কিছু ছারখার করে দিতে দিতে ছুটে আসছে…
হ্যারিকেনটা নেভানোরও সময় পেল না… ভয়ংকর শব্দে পাহাড়প্রমাণ জলের ঢেউ এসে, ঘরের ভেতরেই চোখের নিমেষে দ্বারিকের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়ে, আছড়ে ফেলে দিল! ডিগবাজি খেয়ে জলের তলায় খড়কুটোর মতো তলিয়ে গেল দ্বারিক। অনেকক্ষণ এলোপাথাড়ি হাবুডুবু খেল। জল গিলল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে, কোনমতে জলের তলা থেকে ভুস করে মাথা তুলল। জোরে নিঃশ্বাস নিল একবার। চারিদিকে চাপচাপ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। কানে এল, শরতী পরিত্রাহি চিৎকার করছে। মনে হচ্ছে যেন গলার শিরা ছিঁড়ে ফেলবে। জলের স্রোত দ্বারিককে কেবলই ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মরিয়া হয়ে সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করল দ্বারিক। দরজা আন্দাজ করে এগোতে থাকল। প্রায় একবুক সমান জল কেটে এগোতে গেলে, হাতে ডেকচির ঠোকা লাগল! টের পেল বাটি, কড়াই, থালা সব জলে ভাসছে। দ্বারিকের কেবল একটা কথাই মনে হতে লাগল, শরতীকে খুলে দিতে হবে, নয়ত ডুবে মরে যাবে ওর আদরের শরতী!
জলের বুকে থাবা দিতে দিতে, কোনরকমে এগিয়ে গেল দ্বারিক। থলি, হাত থেকে খসে ভেসে চলে গেল। দু’দিকে হাত ছড়িয়ে, অন্ধকারে নিজের অবস্থান আন্দাজ করার চেষ্টা করল। হাতে কাঠের ছোঁয়া লাগল। একটা আংটা, অর্থাৎ এটা দরজা। জলের ধাক্কায় জল গিলতে গিলতে মনে মনে হিসেব কষে নিল দ্বারিক। এবার বাঁ-দিকে ঘুরে যেতে হবে। দেওয়াল ধরে ধরে এগোনোর চেষ্টা করতে থাকল। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য গঙ্গা, থেকে-থেকেই ওকে ভিটের স্পর্শ থেকে দূরে ছিটকে দিচ্ছিল; কিন্তু দ্বারিক মরিয়া!
-দাঁড়িয়ে থা–ক! আসতাছি… আমি আসতাছি…
বন্যার জলে খাবি খেতে খেতে, অবলা প্রাণীটিকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দেয় দ্বারিক। এতক্ষণ বাদে, ওর গলার আওয়াজ পেয়ে ডাকতেই থাকে শরতী। সে এক বু-মোচড়ানো আকুতি! জলের ভেতর ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগোতে থাকে দ্বারিক, আর অনর্গল চিৎকার করে বলতে থাকে-
– আ-স-তা-ছি, আ-স-তা-ছি……
ওই অবস্থায় দ্বারিক টের পায় জলের সাথে ভেসে যাচ্ছে টেবিল, চেয়ার, কাপড়ের পুঁটলি, কলসি। ব্যা ব্যা করতে করতে ভেসে যাচ্ছে ছাগল, মহিষ… মাথায় বাচ্চাকে চাপিয়ে জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মানুষ… দ্বারিক ক্রমশ শরতীর কাছে পৌঁছয়। দ্বারিকের গন্ধ পেয়ে শরতী, একগলা জলে মাথা বের করে ডাকে। ওর গলার দড়িটা হাতড়ে ধরে, জলের তলায় ডুব দিয়ে খোঁটা থেকে দড়িটা খুলে দেয় দ্বারিক, তারপর ওই অবস্থাতেই শরতীকে ধাক্কা দেয়…
-যা, যা! পালা, পালা! সাঁতার দে…
শরতী ছাড়া পেয়ে, প্রাণে বাঁচবার জন্য অন্ধকারে গা ভাসায়। ওর গলার দড়িটা ছাড়ে না দ্বারিক। দড়ি ধরে ভাসতে থাকে শরতীর পেছন পেছন… চারপাশে ওকে গিলে খেতে আসে অন্ধকার নদী…
… জলে তলিয়ে যেতে যেতে দ্বারিক শক্ত করে দানের-গরুর রশি ধরে থাকে… যেভাবেই হোক, এই বৈতরণী পেরোতেই হবে তাকে …
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী
*****