একটি মৃতদেহের জবানবন্দী – রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

       তারপর অনেকক্ষণ পড়েছিলাম হাইড্রেনের ধারে। বুনো ঝোপে ঝাড়ে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ মেখে। না, ঠিক তা নয়; কয়েকবছর আগে তাজপুরে সমুদ্র সংলগ্ন কেয়া ঝোপে যে তীব্র গন্ধ টান দিয়েছিল; অথবা নবারুণের লেখায় অটোওয়ালার বউ হাসনুহানার মাদকতায় যেমন আবেশ তৈরি করতো! হ্যাঁ, এসব মনে পড়ছিল আমার তখন! বাবা-মা, আর কারো কথা মনে পড়ছিল না।

 পাশে একটু দূরেই পড়েছিল তমোঘ্ন; নগ্ন; ওর বুক তখন নিভু নিভু; আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ও; পারল না; অসহায়ের মতো শুধু দেখতে হল বিকৃত বাসনার উলঙ্গ আস্ফালনে একটি স্বপ্নের অবসান; কোনোরকমে আধবোজা চোখে ও আমাকে দেখছিল। গড়িয়ে আসার ক্ষমতাও ওর নেই।

 আমার চোখের ঝিলে তখন ভাসছিল আমারই ছবি হয়ে যাওয়া একটি মুখ; গায়ের ওপর বিড়বিড় করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পোকা আর মাছি; দু-একটা ধেড়ে ইঁদুর। ওরা বোধহয় বুকের চলাচল বোঝে! তাই নাক-ঠোটঁ ফেটে বেরিয়ে আসা ঈষদুষ্ণ তরল ওরা চাটছিল। ওদের ঠান্ডা জিভ বরফের মতো জ্বালা ধরাচ্ছিল আমার শরীরে। আর ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম গন্ধটা আসলে আঁশটে রক্তের; মাসিকের ন্যাকড়া কলের তলায় ফেললে যেমন ভাপ ওঠে, তেমন। ওরা সাহস করে এবার একটু একটু করে খুবলে খাচ্ছিল মাংস; নরম, তখনও গরম মাংস। সেই যে টেরিকাটা লোকগুলো যেমন করে খেয়েছিল সারারাত চিতার ভয়ে লুকিয়ে বেরানো, ভোরের আলোয় অবগাহিত হরিণটিকে! এখানেও আলো ছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ভেসে উঠছিল একটি নগ্ন শরীর। আলো পেয়ে থেমে যাচ্ছিল রাত-শরীরের ইঁদুরেরা; ঝিলিক মিলিয়ে যেতেই আবারও ছলকে উঠছিল স্বাদু মাংস। সারা শরীর জুড়ে চটচটে রক্তে পিছলে যেতে যেতে ওরা ক্রমশ গভীর ওম পেতে চাইছিল। কিন্তু গভীরে যাওয়া সহজ ছিল না। সে পথে ঢোকানো ছিল মরচে ধরে যাওয়া ব্লেড, ডাস্টবিনের প্লাস্টিক, ভাঙা মদের বোতল; যা যা  তাদের হীনমন্য, অনিশ্চিত, পৈশাচিক মনকে তৃপ্ত করতে পেরেছিল সে সব; এবড়োখেবড়ো কাঁচে তাই কেটে গেল ইঁদুরের ঠোঁট।

ওটা তখন হয়ে উঠল পিঁপড়েদের বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু ও পথে ঢুকেই যে থইথই বন্যা; লাল তরলে ভাসতে থাকা সরু সরু নলী। খাবারের খোঁজ পেয়েও না পাওয়ার জ্বালায় ওরা তখন হুল ফোটাচ্ছিল ত্রিভুজে। আমি বের করে দিতে পারতাম আমার এখনো যা কিছু অন্তরাল; কিছু দূরে তো ছিটকে পড়েই ছিল আমার মাতৃত্ব; না জন্মানো কন্যা সন্তানের জন্য সেখানে উৎসবরত কিছু গন্ধজীব। কিন্তু হাতদুটো নড়ল না। বহুক্ষণ বাধা দিতে দিতে ওরা বাঁধা পড়ে গেছিল আমার নির্ভার চৈতন্যের তলে অহল্যার মতো। গন্ধজীবরা আঁশটানি সম্বল করে ছুটে ছুটে আসছিল আমার কাছে। ধেড়ে ইঁদুরের দল তখন পলায়নপর। গন্ধজীবরা শুঁকছিল; কামড়ে ছিঁড়ে দেওয়া আমার বৃন্ত তখন আলগা হয়ে দুলছিল; ওরা আদর করে চেঁটে দিচ্ছিল; মেয়েরা ছেলেদের কানে কানে বলাবলি করছিল। ছেলেরা অবিশ্বাসের ডাক ডাকছিল; বিস্ময়েরও হতে পারে! জটলা তৈরি হচ্ছিল ক্রমশ। কারো কারো গলায় বিমূঢ় ধ্বনি; কান্না লুকোচ্ছিল ওরা। দূর থেকে জোরালো আলো চোখে পড়লেই নিজস্ব ভাষায় থামাবার চেষ্টা করছিল। মনে আছে, ছোটোবেলা দূরদর্শনে ‘মশাল’ সিনেমায় দিলীপ কুমার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য সাহায্যের প্রত্যাশায় হাইওয়ের গাড়িগুলো দাঁড় করাবার চেষ্টা করছিল; গন্ধজীবরা বোঝেনি মৃত মানুষের জন্য আর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। 

তবু একটু দূরে ইঁদুরের মুখে ঝুলতে থাকা একটি খুবলানো চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। হ্যাঁ, সত্যি বিস্মিত হলাম। কারণ টিমটিমে আলোর বেল বাজানো লোকটা গন্ধজীবদের ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না; দাঁড়িয়ে পড়ল; নেমে এলো সাইকেল ছেড়ে! এগিয়ে এসেই ওকে আবার পিছিয়ে যেতে হলো; খানিকটা ভয়ে পড়ে যেতে যেতে ওর মুখ দিয়ে ভয়ার্ত আওয়াজ উঠল। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে ও সাইকেল নিয়ে ছুটলো। গন্ধজীবরা ওকে আটকানোর চেষ্টায় ওর সাইকেলের টায়ার দাঁতে টেনে ধরতে চাইল; পারল না। টিমটিমে আলো নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেল। কিন্তু ওরা গেল না। ঘিরে রইলো; ওরা কি মৃত মানুষের গন্ধ চেনে না! তাহলে মৃতদেহ আগলে রইলো কেন!

কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে বেশ কিছু কথাবার্তা ভেসে আসতে লাগলো। এবার আর একটা নয়; টিমটিমে অনেকগুলো আলো! হেটো-মুটো কিছু মানুষ জড়ো হলো; তারাও ভয়ার্ত হলো; সাইরেন বাজলো; পুলিশ এলো; ছবি উঠলো; গন্ধজীবদের সরিয়ে দুজন ডোম দুটো বডি তুলে দিল অ্যাম্বুলেন্সে ‘আর এক আরম্ভের জন্য’। হাসপাতালের গেটে প্রেসের লোকেদের ভিড়। কোনোরকমে সাদা চাদরে ঢেকে বডি ঢোকানো হলো পোর্স্টমর্টমের ঘরে। তমোঘ্ন কে হয়তো নিয়ে যাওয়া হলো আই.সি.ইউতে! কয়েকজন ডাক্তার ঢুকলো পোর্স্টমর্টমের ঘরে। চাদর সরিয়ে দিতেই একটি অল্পবয়স্ক ডাক্তার ছোকরা ঢপ করে পড়ে গেল। অমানবিক ভ্রষ্টতা আজও কাউকে কাউকে নাড়া দেয়! সে তখন পাথর হয়ে যায়।

শুরু হলো শরীরে ছুরি-কাঁচির বিভাজন। অজানা কঠিন শব্দ ব্যবহার; পোড় খাওয়া ডাক্তারদের নির্লিপ্ততা ছাপিয়ে উঠে আসছিল বিদেশি গালাগাল মেশানো ক্রোধ! আমার বীভৎস দেহ নিপুণ হাতে বিভাজিত হচ্ছিল। না, মৃত্যুর কারণ জানার জন্য নয়; সে তো স্পষ্টই; আসলে অত্যাচারের মাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছিল; ঠিক কতদূর বিরল হলে ফাঁসির দাবি তোলা যায় তাই পরখ করা হচ্ছিল।

 আমার আমি তখন দূরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য দর্শক। তবে যে শুনেছিলাম মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মা অন্য দেহ প্রাপ্ত হয়! আবার কোনো পিটুলি গোলায় মাখামাখি হয়ে গলে যায় মাতৃত্ব-জঠরে! আবারও খুবলানো বডি হওয়ার সম্ভাবনায়! ও আসলে যেতে চাইছিল না এই সাম্প্রতিক অতীত ছেড়ে। আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত ওর অশরীরী সত্তা শেষ দেখতে চাইছিল। ভিতরে ভিতরে এখনো ও বিশ্বাসী। তাই ও বাবা-মার কান্না বুক ভরে এনে দিয়েছিল আমার কাছে। এনে দিয়েছিল তমোঘ্নর জীবন- বার্তা; পুলিশী সহৃদয়তা, দিকে দিকে ধিক্কার প্রতিবাদ, বুদ্ধিজীবী-মোমবাতি মিছিল,  সোশ্যাল সাইটে ফাঁসির দাবি– সব ও পৌঁছে দিচ্ছিল আমার কাছে। ওর মুখ-চোখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল! যে সাংসদ মেয়েদের পোশাকের সভ্যতার দোহাই দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে কতখানি বিষোদগার উঠেছিল তার বর্ণনা দিচ্ছিল। যে প্রতিবেশী আমার বেশ কিছু ছেলে বন্ধুর প্রসঙ্গ তুলেছিল তার অসংস্কৃত সংকীর্ণতা নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছিল। তমোঘ্নকে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। ওর প্রতিবাদ যা একেবারেই স্বাভাবিক নয়, মর্যাদা পাচ্ছিল। প্রশাসনের তরফ থেকে আমার বাবাকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ; একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সাময়িক বিকৃতির দাম! কলমে কলমে বিশ্লেষিত হচ্ছিল কারণ; চরম শাস্তির পরেও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কেন বর্ধিত হচ্ছে এই প্রবণতা যা আসলে চূড়ান্ত বিদ্বেষের নামান্তর সেসব কথা বলছিল। স্বাক্ষরিত দেশ আজও শিক্ষিত হতে পারল না! 

তাই মোমবাতি মিছিল থেকে দাবি উঠেছিল যতদিন না অপরাধীরা গ্রেপ্তার হবে ততদিন আমার দেহ পোড়ানো হবে না। যেদিন ওই চারজনকে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে সংশোধনাগারে ঢোকানো হলো ও আনন্দে কাঁদল। আমাকে বারবার বলতে লাগল, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। আমি তখনও মর্গের ড্রয়ারে বন্দী। মনে হলো ওরা তবু সংশোধিত হওয়ার সুযোগ পেতে পারত যদি আমার হৃৎপিণ্ড সচল থাকত! সাত বছর বা দশ বছরে ওরা সংশোধিত হয়ে যেত! মৃত্যুদণ্ড তো মৃত্যুর বদলা! অসম্মানের কি! তাই তো এক মাসেরও কম সময়ের জন্য যে ছেলেটি নাবালক বিচার্য হবে সে আবার ফিরতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে! আমাদের দেশের সংবিধান মহান! মানবাধিকার কমিশনও সে নিয়ে ন্যায্য লড়াই চালাবে। বেঁচে থাকলেও সমাজ কি আমায় সে সুযোগ দিত! নষ্ট মেয়ের আবার স্বাভাবিক জীবন! যাক, আগামীকাল পুড়ে ছাই হয়ে যাব। সীতার মতো পবিত্র হবো অগ্নিদেবের স্পর্শে। পৌরুষই নষ্ট করে; পৌরুষই পবিত্র করে! তারপর আর কোনো অসম্মান-যন্ত্রণা লেগে থাকবে না কোথাও। অবশ্য সেই নিশ্চিন্ততা এখনই উপভোগ করা যায়; মৃত শরীরে আর গরম খুঁজবে কে!

 সেদিন অনেক রাতে মর্গের দরজা খোলার আওয়াজ এলো। আবার কেউ বডি হয়ে নম্বর পেলো এমনটাই ভাবছি; কিন্তু আর কোনো আওয়াজ নেই; ডাক্তারের নিস্পৃহ পদধ্বনি নেই; শুধু একের পর এক ড্রয়ার খোলার আওয়াজ। তারপর সব চুপচাপ; শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে! তারপর এক সময় আমার ড্রয়ারটিও খুলল। এক চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া আমি দেখতে পেলাম সেদিনের সেই ডোম লোকটিকে। এই মুহূর্তে এক আসুরিক হিংস্রতা তার শরীরে জেগে উঠেছে। লালারসে টইটুম্বুর তার চোখদুটো আমাকে দিন কয়েক আগের সেই ত্রাসের সন্ধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আমি বিমূঢ় হয়ে দেখলাম ডোমের শক্ত দুটো হাত আমার ঠান্ডা, পাঁশুটে স্তনযুগলকে ক্রমাগত মর্দন করে চলেছে! লালচে আঙুলে দুলতে থাকা বৃন্ত টানছে! তারপর একসময় আমার অগভীর যোনিপথে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার দন্ড! আমার আমি দূরে দাঁড়িয়ে ক্রমশ কুঁকড়ে উঠছিল! ‘বিপন্ন বিস্ময়’ এ সে চেয়ে চেয়ে দেখছিল একটি তিন দিনের বাসি রমণীর মৃতদেহ কেমন করে তৃপ্ত করে তুলতে পারে পুরুষের লালসা! গোটা মর্গ জুড়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিল তার চুঁইয়ে যাওয়া বিশ্বাস! তীব্র শ্লেষে উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। ছোটো হয়ে যেতে যেতে ও সমুদ্র খুঁজছিল। তরলে বিশ্লিষ্ট হয়ে যেতে চাইছিল ওর অশরীরী সত্তা। মিশে যেতে চাইছিল মানুষের অগম্য অযথার্থে। 

কিছু দূরে প্রসূতি বিভাগে সেদিন একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন মা। রক্ত আর জঠরের স্রাবে মাখামাখি সে দেহ পরিস্কার করলেন নার্স। মা অচেতন; শিশুটিকে রাখা হয়েছে বেবি কেয়ার ইউনিটে। নিঝুম দুপুরে ওয়ার্ড বয় আড্ডা মারছে আয়ার সঙ্গে। চোখ টিপে ইশারা করছে;  আয়া এদিক ওদিক চেয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সংকেত পাঠাচ্ছে। ওয়ার্ড বয় হাতে তুলে নিচ্ছে সদ্যোজাতকে। তারপর তার আঙুলের আরাম ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর জুড়ে। কচি গলার কান্না তার শিশ্নে পড়িয়ে দিচ্ছে উষ্ণীষ! 

আয়া বাচ্চাটার কান্না থামাতে থামাতে কোঁচড়ে গুজে নিচ্ছে দশটাকার কয়েকটা নোট।

প্রচ্ছদঃ রেশমী পাল

*****