গোটা পৃথিবীর চলচ্চিত্রে, আঞ্চলিক বাজার ছেড়ে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়ার প্রবৃত্তি, নব্বই দশকের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য । আবার এই বিশ্বায়িত চলচ্চিত্রেই প্রবলভাবে লক্ষ করা যায় অঞ্চল-সংস্কৃতির অস্মিতার এক নস্টালজিক পাঠ। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে এই প্রবৃত্তি চোখে পড়ার মত। একদিকে আন্তর্জাতিক আর্ট-চলচ্চিত্রের বাজারে ঝ্যাং জিমু, চেন কাইজে (চীন) অথবা কিম কি দুক-বং জুন হো’র (দক্ষিন কোরিয়া) মত এশিয়ান অঁতরদের নজরকাড়া উপস্থিতি, অন্যদিকে আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম ও কানাডার মত দেশে ভারতীয় মূলধারার ছবির প্রতিনিধিত্ব করে হিন্দি সিনেমার ব্র্যান্ড বলিউড হয়ে ওঠা। আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে দেখব বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ছোঁয়ায় নব্বই-এর গোড়াতেই ভারতীয় ছবির কর্পোরেটিকরণ ও বাজারের নিরিখে আমূল পরিবর্তন হয়- হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে আমরা যে পরিবর্তনকে এককথায় বলিউড নামে চিনি। নব্বই-এর মাঝামাঝি ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র (আদিত্য চোপরা, ১৯৯৫) হাত ধরে যখন ব্র্যান্ড বলিউড বিস্তৃত হচ্ছে, তখন পশ্চিমে বাজার বৃদ্ধির পাশাপাশি এক ডায়াস্পোরিক হিরোর কল্পনা হিন্দি ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠছে। বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত এই নায়কদের দেশে ফেরার আকুতিকে মূলধন করে প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের এক নব্য মেলোড্রামা নিয়ে এসে বিপুল মাত্রায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলিউড – অন্যদিকে এগ্জটিক ভারতের কল্পনাকে মূলধন করে আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তার নতুন মাপকাঠি তৈরি করছে ‘মুথু’ (কে এস রবিকুমার, ১৯৯৫)-র মত তামিল ছবি। প্রসঙ্গত জাপানে ‘মুথু’র মুক্তি ও বাণিজ্যিক সাফল্য তামিল চিত্রতারকা রজনীকান্তের জনপ্রিয়তায় নতুন মাইল ফলক নিয়ে আসে। নব্বই দশকের বিশ্বায়ন-প্রবণতা এভাবেই ভারতীয় ছবির বাজারে নতুন গঠন-গড়ন নিয়ে আসতে থাকে।
সমাজতাত্ত্বিকেরা বলবেন নব্বই-এর এমন সাংস্কৃতিক নির্মাণের একটা বৈশিষ্ট্য হল বহির্বিশ্বের প্রতি অদম্য আকর্ষণের পাশাপাশি ঘরে ফেরার পিছুটান – গ্লোবালাইজেশনের হাত ধরে এক নতুন রকমের লোকালাইজেশন। এই গ্লোবাল-লোকাল সমীকরণের আলোয় নব্বই-পরবর্তী বাংলা ছবির মধ্যে যেমন কিছু চেনা ছক লক্ষ্য করা যায়, আবার অনেক অচেনা অভিমুখও নজরে পড়ে । মনে রাখা দরকার, যে উদারীকরণের হাওয়ায় হিন্দি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ছবির কর্পোরেটিকরণে নব্বই-এর গোড়াতে হলেও , বাংলায় তার প্রভাব একটু দেরীতে বুঝতে পারি আমরা। বাজারের নিরিখে বাংলা ছবিতেও কিছু পরিবর্তন হয়, কিন্তু ছকগুলো একটু অন্য রকম আর পরিবর্তনের কুশলীরাও খানিকটা আলাদা। আমরা বম্বের যে পরিবর্তিত মিডিয়া ও কালচার ইন্ডাস্ট্রিকে বলিউড নামে চিনি, টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়াতেও অনুরূপ একটি মিডিয়া নির্মাণ, থুড়ি, টলিউড এসে পড়ে। কিন্তু ব্র্যান্ড টলিউড পরিচিতি পায় নব্বই-এর শেষে, এবং আরো ভালোভাবে ২০০০ পরবর্তী সময়ে । কর্পোরেট হাওয়া ঢুকে পড়ে বাংলা ছবিতেও – আর প্রবাসী চরিত্রের হাত ধরে আসতে থাকে ‘বং কানেকশন’ (২০০৬)-এর মত ছবিদের ডায়াস্পোরা কল্পনা। কিন্তু নব্বই-এর বাংলা ছবির বাজারের অন্যতম বিশেষ দিক কিছু ছোট প্রযোজকদের উত্থান ও তাদের বিনিয়োগের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এক নব্য শহুরে ‘সমান্তরাল’ ছবি। ঋতুপর্ণ ঘোষের পরপর ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৬), ‘দহন’(১৯৯৮), ‘অসুখ’(১৯৯৯), ‘উৎসব’(২০০০) বা অপর্না সেনের ‘পারমিতার একদিন’ (২০০০) বা অঞ্জন দাসের ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’(২০০২) সমান্তরাল ছবির এই ধারণা তৈরি করে।
অনেকেই বলতে পারেন একটা সমান্তরাল ছবির ধারা তো পশ্চিম বাংলায় আগেই ছিল। ঠিকই,তবে সত্তর বা আশির দশকে সমান্তরাল ছবি নির্মাণের রাজনীতি ও নান্দনিক গড়ন একেবারেই অন্যরকম ছিল। মৈনাক বিশ্বাস তাঁর লেখায় মনে করাচ্ছেন কিভাবে এইসময়ে ‘সিনেমা অফ কনসার্ন’ জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের রাজনৈতিক ছবির অবসানের পটভূমিতে। ছবিগুলোর দিকে ফিরে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব কিভাবে এই সমান্তরাল ছবির ভাষা তৈরী হয়েছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি ড্রইয়িং রুমকে ক্লোস-আপ ও মিড ক্লোস-আপের বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে। ন্যারেটিভের ঝোঁকটা ছিল সম্পর্কের গল্প বলায়। ‘কলকাতা ৭১’ (মৃণাল সেন, ১৯৭২), ‘দখল’ (গৌতম ঘোষ, ১৯৮৪) বা ‘গৃহযুদ্ধ’ (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ১৯৮৪)-এর যে সমান্তরাল ছবির ধারণা ছিল, তার পরিবর্তে স্পষ্টতই এক অন্য ছাঁচ আসে ছবির ধারায়। নতুন একদল প্রযোজক-পরিচালক ও সমান্তরাল ছবির বাজার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা নব্বই-পরবর্তী নব্য সমান্তরালের জন্য অনেকটাই দায়ী। সে কথায় খানিক পরে আসছি, তার আগে এই সমান্তরাল ছবির ভাষার ও তাদের বিশেষ কিছু ভঙ্গিমার দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। বাজার বা প্রযোজনার অঙ্কগুলো সরিয়ে রাখলে আর কোন দিক থেকে ‘নতুন’ এই সমান্তরাল ছবির দুনিয়া? নানা ভাবেই এর উত্তর দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ফিরে দেখলে মনে হয় এই ছবির জগত জুড়ে এক অতীতচারিতা ও অতীতচারণার রাজনীতি ছবিগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কীভাবে এই অতীতচারণা আসে? একটু ফিরে দেখা যাক।
ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম যে ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন তার নাম ‘হীরের আংটি’ (১৯৯৪), চিল্ড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার প্রযোজনায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ছবির গল্প এগোলেও ঋতুপর্ণ সচেতন ভাবেই যেন ছবিতে নিয়ে আসেন প্রবাসী নস্টালজিয়ার স্বাদ। ছবিতে আক্ষরিক অর্থে শুধু মেজ ছেলে ও তাঁর পরিবার প্রবাসী হলেও গোটা ছবি জুড়েই প্রবাসী বাঙালির দেশে ফেরার, ঘরে ফেরার রোমান্স। এক গোপন পারিবারিক অতীত, যা জানেন শুধু পরিবারের কর্তা; বাড়ির মালিকানা নিয়ে এক রহস্য ও ধীরে ধীরে তার জট খোলা, অন্যদিকে রূপকথার চরিত্রদের মত শ্বেত-লোহিত ও গন্ধর্ব কুমার – এসব নিয়েই ‘হীরের আংটি’। ছবির গল্প, ও বিশেষত তার ক্লাইম্যাক্স, যেন ছোটবেলায় ফেরার একটা সুযোগ করে দেয় । আর সবটা মিলিয়ে ছবিটা যতটা না প্রথাগত ভাবে ছোটদের ছবি, তার চেয়ে অনেক বেশী বড়দের ছোটবেলায় ফেরবার ছবি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’ যদি ছোটবেলায় ফেরবার ইচ্ছেপূরণ হয়, কাছাকাছি সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’ (১৯৯৭) ছোটবেলায় ফিরতে না পারার যন্ত্রণা ও অসহায়তা নিয়ে বড়দের (এ সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ডেন্টিস্ট নবীন দত্তকে গ্রাস করেছে অশক্ত ও পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ভয় । তাঁর শারীরিক, মানসিক, আত্মিক পঙ্গুত্বের ভয় ও অসহায়তার বিপ্রতীপে আসে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি। এবং ছবির ফ্ল্যাশব্যাকে বালক নবীন দত্ত যেন এক রূপকথার কিশোর নায়ক যাঁর কাছে মন্ত্র রয়েছে বদ্ধ সব দরজা খুলে মুক্তির পথ বেছে নেওয়ার। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘কালপুরুষ’এ (২০০৫) আবারও ছোটবেলার স্মৃতি ফিরে আসে ক্লিন্ন, মলিন বর্তমানের সমান্তরালে। এবং রাহুল বোস অভিনীত চরিত্রটি সেই ফেলে আসা অতীতের ছায়ায় নতুন করে আবিষ্কার করেন তাঁর বাবাকে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিগুলি যদি গল্পের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রদের মায়াময় ছায়াময় অতীতচারণার পাঠ হয়, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’ পরবর্তী ছবিগুলোয় ফিরে ফিরে আসে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রদের স্মৃতির অনুভবী বিশ্ব। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৬)-এ মা ও মেয়ের সম্পর্কের গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে সরোজিনী ও মিঠুর (অভিনয়ে অপর্ণা সেন-দেবশ্রী রায়) এক অতীতচারণা। উনিশে এপ্রিল মিঠুর বাবার মৃত্যুদিন; আবার এই দিনেই ওঁর মা সরোজিনী পুরস্কৃত হয়েছেন এক বিশেষ সম্মানে। গোটা ছবি জুড়ে সরোজিনীর পুরস্কার পাওয়ার সেলিব্রেশনের পাশাপাশি আসে মিঠুর স্মৃতিচারণা আর সেই সূত্র ধরে সরোজিনীর প্রতি অভিযোগ। ছবির শেষ অংশে এই স্মৃতিচারণা ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা থেকে সরে এসে পারস্পরিক হয়েই অবসান ঘটায় অনেক ভুল বোঝাবুঝির । ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’ (১৯৯৮) আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় মা-মেয়ের যৌথ স্মৃতিযাপন। একটি দৃশ্যে অসুস্থ মা (গৌরি ঘোষ) আর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে নানা দ্বিধা, দ্বন্দ বিপর্যস্ত মেয়ে (দেবশ্রী রায়) আশ্রয় ও শুশ্রূষা পায় তাঁদের যৌথ স্মৃতিচারণ ও সঞ্চয়িতার পাঠে। অতীতচারণার এই নান্দনিক দিক ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিগুলোর হাত ধরে তাঁর অঁতরশিপের চিহ্নক হয়ে ওঠে নব্বই ও শূন্য দশকের কাজগুলোয় । তাঁর ছবির অতীতচারণার এই ধারাকে অনেকেই বলতে পারেন ঋতুপর্ণীয় বা ঋতুপর্ণয়েস্ক । কিন্তু এই নস্টালজিয়াময় ছবির জগত শুধু ঋতুপর্ণ ঘোষের একার নয়। অপর্ণা সেন থেকে অঞ্জন দাস এমনকি গৌতম ঘোষও নিয়ে আসেন ছবির চরিত্রদের অতীতচারণায় বিস্তৃত এক জগত।
‘পারমিতার একদিন’ (২০০০)এর কথা ধরা যাক। ছবিটি এক নিবিড় বন্ধুত্বের/সম্পর্কের কথা বলে যা গড়ে উঠেছিল পারমিতা (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) ও ওঁর প্রাক্তন শাশুড়ি সনকার (অপর্না সেন) মধ্যে। ছবি শুরুই হয় উত্তর কলকাতার পুরোনো এক বাড়ির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজনে। সেই বাড়ির উঠোন-জানলা-সিঁড়ি আর তার মধ্যে খেলে যাওয়া দুপুরের আলো-ছায়া আর তার সমান্তরালে ফেলে আসা সময় ও সম্পর্কের স্মৃতিময় হয়ে ওঠা। সদ্য প্রয়াত সনকার শ্রাদ্ধে এসেছেন পারমিতা এবং এরপর গোটা ছবিতেই ফ্ল্যাশব্যাকে ফ্ল্যাশব্যাকে অতীত সময়, ঘটনা ও চরিত্রদের ধরে অপর্না সেনের চিত্রনাট্য ও অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা। অঞ্জন দাসের ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’(২০০২-তে আবার কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্মৃতি, স্বপ্ন ও কল্পনা মিলেমিশে যায় এক সঙ্গে। এই ছবিগুলিতে নস্টালজিয়া অবশ্যই একটা বিশেষ নান্দনিকতা নিয়ে আসে, কিন্তু আমার মতে এই অতীতচারণার আর এক জরুরি দিক হল তার রাজনীতি । একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে কিভাবে এই চরিত্রের স্মৃতিচারণ বা অতীতের ঘটনা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে এক সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অতীতের অনুষঙ্গ । ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’ বা ‘উৎসব’ সচেতন ভাবে নিয়ে আসে সত্যজিৎ রায়ের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’(১৯৭৯) এর স্মৃতি। গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে'(২০০৩) একরকম ভাবে ফিরে দেখে সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০)-কে, যেখানে চরিত্রের অতীত, গল্পের অতীত আর দর্শকের অতীত এক হয়ে যায়। সমসময়ের প্রেক্ষাপটে কিভাবে দেখা যেতে পারে এই অতীতচারণা? কিছুটা উত্তর পাওয়া যাবে সমসময়ের বাংলা ছবি প্রযোজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্মাণগুলো দেখলে।
আশির দশকের শুরুতে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আগমন হয় নতুন একদল প্রযোজক ও পরিচালকদের আর নানা রকম নতুনত্বের আমদানি হয় এঁদের হাত ধরে। বাংলা চলচ্চিত্রে আশির দশক এমন এক সময় যখন বাংলা ছবির নায়কের শ্রেণী অবস্থান থেকে, হিরো–হিরোইনদের শরীরী উপস্থিতি ও অভিনয়, ছবির গানের কথা-সুর-ছন্দ সবই বদলে যেতে থাকে খুব দ্রুত । এই পরিবর্তনের নেপথ্য কারণ হিসেবে সমসাময়িক চলচ্চিত্রকার ও প্রযোজকরা যেটা বলছিলেন তা হল বাণিজ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলা ছবির টিকে থাকা নিশ্চিত করতেই তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন ছবির ‘ফর্মুলায়’ বদল আনতে। চলচ্চিত্রকার স্বপন সাহা বা হরনাথ চক্রবর্তীর মতে আশির দশক এটা বুঝিয়ে দ্যায় টি.ভি./ ভি. সি. আর./ভিডিওতে বিনোদন খুঁজে নেওয়া শহরের ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্তরা আর সিনেমা হলে যাবেন না। গেলেও তাঁদের সংখ্যা খুব কম। মোদ্দা কথা তাঁরা আর পপুলার ছবির ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ নন। তাই বাংলা ছবিকে পৌঁছতে হবে শহরের শ্রমিক শ্রেণীর কাছে। অতএব তাঁদের চেষ্টা ছিল এই বাজার ও রুচির কাছে পৌছোনোর। এরই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হল, কলকাতার কিছু সিনেমা-হল মালিকও জানাচ্ছেন যে আশির দশকে বাংলা ছবির দর্শক শ্রেণীর একটা পরিবর্তন আসে। ঐতিহাসিক পরিমল ঘোষের গবেষণা ধার করে নিয়ে এটাও মনে রাখার যে কলকাতা শহর ও তার সংলগ্ন এলাকা এই সময় শ্রমিক শ্রেণীর এক নতুন বিন্যাস দেখে। রেলওয়ের যোগাযোগের বিস্তার, দেশের নতুন অর্থনীতির মডেল ও আরো নানান কারণে নীল-কলার শ্রমিকেরা (একা বা পরিবার সঙ্গে নিয়ে) অনেক বেশি সংখ্যায় কলকাতা আসতে ও থাকতে শুরু করেন। ফলে কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট থেকে বাজার এলাকা, বাণিজ্য কিংবা বিনোদন ইত্যাদি অনেক কিছুই শ্রেণি বৈচিত্র্যের প্রেক্ষিতে আগের থেকে বেশি ‘ইনক্লুসিভ’ হয়ে ওঠে। আশির দশকের বাংলা চলচ্চিত্র জগতের নতুন বাংলা ছবি, সেই ছবির কারিগর ও তাদের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’রা হয়ে ওঠেন এই পরিবর্তিত সময়েরই প্রতিনিধি-স্বরূপ।
এই নতুনত্বের আমদানিতে আহত হয় বাংলা চলচ্চিত্রে পাঁচ দশক ধরে চলে আসা ভদ্রলোক শ্রেণীর কর্তৃত্ব। ভদ্রলোক-রুচি অভিযোগ আনে বাংলা ছবিতে স্থূলরুচির প্রাচুর্য্যের! ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পুরনো পরিচালক ও কলাকুশলীরা অখুশি হতে থাকেন নতুনদের কাজে। আর পত্র পত্রিকার পাতায় সাংবাদিক ও শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শকের একাংশ আক্রমণ করতে শুরু করেন এই বদলে যাওয়া চলচ্চিত্র জগতকে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা ছবির এই আলোচনায় প্রধান জায়গা নেয় হারানো বাংলা ছবির ‘গৌরব জনক অতীত’। আশি ও নববই দশকের বাংলা চলচ্চিত্র এই ‘নতুন ওরা’ বনাম ‘পুরনো আমরা’ দুটো শ্রেণীরও লড়াই। তাই নতুন চলচ্চিত্রের রুচি ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে ভদ্রলোকদের ভয় ও সঙ্কট এতটাই। একদিকে বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনায় বাড়তে থাকে দীর্ঘশ্বাস – সঙ্কট, অবক্ষয়, অবনতির মত শব্দদের উপস্থিতি! অন্যদিকে এক আদর্শ ছবির ধারণায় দেখা হতে থাকে উত্তম-সুচিত্রার পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কাজগুলি ও সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী অপু ট্রিলজি বা অন্যান্য ছবি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক ব্যাপী বাংলা ছবির যে সুবর্ণ যুগের কল্পনার সঙ্গে আমরা পরিচিত তার অনেকটাই কিন্তু এই আশি-নব্বই দশক ও তার পরবর্তী ভদ্রলোক নস্টালজিয়ার নির্মাণ। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সমসাময়িক আলোচনায় উত্তম-সুচিত্রার অনেক ছবিই নিন্দিত। ছবির প্লট সমালোচিত কারণ তাতে নাকি যথেষ্ট নীতি-নৈতিকতা নেই! সুচিত্রা সেনকে শুনতে হচ্ছে তাঁর অভিনয় অতিরেক দোষে দুষ্ট এবং এটাও ঘটনা যে সিনেমা ঘরের পর্দা জুড়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটি আলো করে থাকলেও হিসেবের খাতা বলছে ১৯৬৭ বা ১৯৬৮ এর বাংলা ছবির বাক্স দপ্তরে ‘হারানো সুর’ বা ‘সাগরিকার’ জুটির ম্যাজিক স্তিমিত।
উনিশশো আশিতে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর আশির দশকের গোড়া থেকে মাঝামাঝি অবধি পরপর বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক নামী পরিচালক অবসর নেন ও প্রয়াত হন, আবার কেউ কেউ বম্বে চলে যান বা হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে যোগ দেন । সুচিত্রা সেনের অবসরও অন্যতম একটি পরিবর্তন। এরপর উনিশশো বিরানব্বই-এ সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ সামগ্রিকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি যুগের অবসান চিহ্নিত করে দেয়। এবং একই সঙ্গে নস্টালজিয়ার ব্র্যাকেটে বন্দী হয় বাংলা ছবির হারানো এক অতীত। ‘স্থূলরুচির’ বাংলা ছবিতে ভদ্রলোক রুচির পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে বাংলা সিনেমার সেকাল ও একালের তুলনামূলক আখ্যান। পত্র-পত্রিকার পাতায় সাংবাদিক ও দর্শকদের আলোচনা ও অতীতচারণা ‘ভালো বাংলা ছবি’র এক ধারণা নিয়ে আসে। নব্বই এর নব্য ‘সমান্তরাল’ ছবি সেই ধারণাকেই আত্মস্থ করে বাংলা ছবিতে ‘ভদ্রলোক’-রুচির পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়। এই যোগসূত্র আরেকটু বিস্তারিত হবে ছবি প্রযোজনার অঙ্কগুলো দেখলে।
যাঁরা এই ছবিগুলোর প্রযোজনা করেছিলেন তাঁরা মনে করেছিলেন ‘স্থূলরুচির ফর্মূলা ছবিতে’ বাজার ছেয়ে গেলেও ‘ভালো গল্পের পরিশীলিত নির্মাণ’ দেখতে চান এরকম একটা ভদ্রলোক দর্শকের বাজারও রয়েছে। কেননা পপুলার বাংলা ছবি নিয়ে বিরক্ত একটি দর্শক শ্রেণী রয়েছে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পত্র-পত্রিকার পাতায়। দ্বিতীয়ত তাঁরা এও ভেবেছিলেন ছোট পুঁজি নিয়ে এগোলে ‘কম রিস্ক’ নিয়ে অল্প মার্জিনে লাভ হতেই পারে। কিন্তু সমান্তরাল এই বাজারের শর্ত হল এই ছবিগুলোকে নিয়ে আসতে হবে হারানো বাংলা ছবির স্বাদ- বাংলা সাহিত্য অবলম্বনে ভালো গল্প, ‘সুস্থ রুচি’ (পপুলার ছবির নাচ-গান/ অন্যান্য মশলা বর্জিত) আর উচ্চকিত মেলোড্রামার বদলে সংলাপে, অভিনয়ে পরিমিত পরিশীলিত নির্মাণ। ছবিগুলোর নান্দনিক দিক এবার যদি আমরা ভেবে দেখি, বুঝতে পারব কিভাবে নব্বই-এর নব্য, শহুরে ‘সমান্তরাল’ ছবিতে এই শর্ত পূরন করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। আসলে প্রযোজক থেকে পরিচালক সকলেই চাইছিলেন হারিয়ে যাওয়া বাংলা ছবির স্বাদ নিয়ে আসুক এই সমান্তরাল ছবির দুনিয়া। প্রসঙ্গত, ‘উনিশে এপ্রিল (১৯৯৬) প্রযোজনার জন্যে তৈরি হয় ‘স্পন্দন ফিল্মস’। ছবির অভিনেত্রী অপর্ণা সেন ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন ক্যালকাটা ক্লাবের প্লেসিডেন্ট রেণু রায়ের। রেণু রায় ছবিটির প্রযোজনা করবেন স্থির করেন কারণ তাঁর মনে হয়, এক ধরনের ‘ভালো বাংলা ছবি’ (যেরকম আগে হত) হওয়া খুব দরকার। রেণু রায় তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন খুব অল্প বাজেটে শেষ করা হয় ছবির কাজ। আটটি প্রিন্ট নিয়ে কলকাতার মিনার-বিজলি-ছবিঘর চেনে মুক্তি পায় ছবিটি আর রিলিজের প্রথম সপ্তাহেই জানা যায় এ ছবি হিট। আরো একটি উদাহরণ হিসেবে ‘দীপ ফিল্মসে’র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ন্যাশনাল অ্যাডভার্টাইসিং এজেন্সির মালিক সন্দীপ সেন নব্বইএর দশকের শেষ দিকে ছবি প্রযোজনা শুরু করেন দীপ ফিল্মসের ব্যানারে। সন্দীপ সেন তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন যে,তাঁরা স্থির করেছিলেন অল্প কিছু প্রিণ্ট নিয়ে সীমিত কিছু সিনেমাহলে চালাবেন এই ছবিগুলি। তাই তাঁদের কারোরই আফসোস হয়নি বড় চেনে ছবি রিলিজ করতে না পেরে। রেণু রায় বা সন্দীপ সেনের মত প্রযোজকরা জানিয়েছেন যে এই ছবিগুলোর নির্মাণের সময় থেকেই তাঁদের স্পষ্ট ধারনা ছিল এইসব ছবি ‘মাস দর্শকদের নয়, নিশ দর্শকেদের’। ওঁরা জানতেন বড় চেনের বাংলা ছবির ফর্মুলা রোমান্স আর মারপিটের ছবি দেখে দেখে একশ্রেণীর দর্শক বিরক্ত এবং তাঁরা অপেক্ষা করে রয়েছেন অন্য রকম বাংলা ছবির জন্য। এই প্রযোজকদের এও দাবি যে তাঁদের এই অনুমানে ভুল ছিল না। মুক্তির আগেই এই ছবিগুলো নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ছবিগুলোর শহরকেন্দ্রিক সীমিত বাণিজ্য/বাজারের মধ্যেই ‘সুস্থ রুচি’র সমান্তরাল বাংলা ছবির একটি মডেল নিয়ে আসে ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৬) বা ‘সাঁঝবাতির রূপকথা’রা (২০০২)।
এভাবে ছবি প্রযোজনার অঙ্কেও ‘ভালো বাংলা ছবি’ ও তার ‘রুচিশীল বাঙালী দর্শক’ দুই-এরই পুনরুদ্ধার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঋতুপর্ণ ঘোষ বা অঞ্জন দাসের মত চলচ্চিত্র নির্মাতারাও স্বীকার করেছেন তাঁদের জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল এই হারানো বাংলা ছবির জগত ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারার বিশেষত্ব। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ছবিটি যে গড়পড়তা মূলধারার চেয়ে আলাদা, তার প্রচার, বিপণন ও বিজ্ঞাপন কৌশল। ভালো রিভিউ-এর পাশাপাশি এ প্রচারের অন্যতম দিক ছিল এই ছবিগুলোকে বাংলা সিনেমার সেকাল ও একালের তুলনামূলক আখ্যানে ভদ্রলোক রুচির পুরনো বাংলা ছবির উত্তরসূরি হিসেবে দেখা ও এই পরিচালকদেরও সেই স্বীকৃতি দেওয়া। ফলে সংবাদপত্র ও পত্রিকার পাতায় এই ছবি গুলোর আলোচনার কেন্দ্রেও নজরে পড়বে বিশেষ কিছু ভঙ্গিমা। ঋতুপর্ণ ঘোষ বা অঞ্জন দাসের ছবির রিভিউ করতে গিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচকেরা প্রায়শই নিয়ে আসছেন অতীত চারণা ও ‘ভালো বাংলা ছবি’র নস্টালজিয়া। নব্বই এর নব্য ‘সমান্তরাল’ ছবি তাঁর নির্মাণ, প্রচার, বিপণন ও বিজ্ঞাপন সবটা নিয়েই যেন ঘোষণা করে দেয় বাংলা ছবিতে ভদ্রলোক রুচির পুনরুদ্ধার। বৃত্ত সম্পূর্ন হয় ছবি আলোচনায় অতীতচারণা থেকে ছবির জগতের নস্টালজিক নির্মাণে।
জিগনা দেশাই-এর মত চলচ্চিত্র গবেষকরা জানাচ্ছেন নব্বই দশকে উদ্ভুত সাউথ এসিয়ান ডায়াস্পোরিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও নস্টালজিয়া ও নতুন বাজারের প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। নব্বই-এর গোড়ায় মীরা নায়ারের ‘মিসিসিপি মসালা’ (১৯৯১) বা পরের দিকে কাইজাদ গুস্তাদের ‘বম্বে বয়েজ’ (১৯৯৮) বা নাগেশ কুকুনুরের ‘হায়দেরাবাদ ব্লুজ’ (১৯৯৮) এক ধরণের প্রবাসী নস্টালজিক ছবির স্বাদ নিয়ে আসে যা আবার একেবারেই বলিউডিও আদিত্য চোপড়া – সুভাষ ঘাইএর আদলে নির্মিত আদর্শ দেশ ও দেশজ সংস্কৃতির পিছুটান নয়। ‘মিসিসিপি মসালা’র মধ্যবয়স্ক জয় বা ‘বম্বে বয়েজ’ এর তিনটি যুবক দেশ বা হারিয়ে যাওয়া এক সময়ে ফিরতে চাইলেও বর্তমান ও বহমান জীবনের জটিলতায় অনুধাবন করে দেশের সঙ্গে তাঁদের অসেতুসম্ভব দূরত্ব। কিন্তু এক অস্থির ও বিষণ্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এই পিছুটানকে উপেক্ষাও করতে পারেন না তাঁরা । সমসময়ের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির এই গ্লোবাল/ লোকাল সমীকরণের আলোয় নব্বই-পরবর্তী বাংলা ছবির অতীতচারণাকে কিভাবে দেখতে পারি আমরা? বলিউড বা সাউথ এসিয়ান ডায়াস্পোরিক চলচ্চিত্রের মত প্রবাসী দর্শকের বাজার অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ২০০০ পরবর্তী সময়ে বাজারের কিছু নতুন সম্ভাবনা ও সমীকরণ এই নব্য সমান্তরাল বাংলা ছবিতেও এসেছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ এখানে বিশেষভাবে আলোচনার দাবী রাখে।
যাঁরা ‘উৎসব’ দেখেছেন তাঁরা জানবেন কিভাবে শুরুর দৃশ্য থেকে একের পর এক ফ্রেম জুড়ে একধরনের বাঙালী নস্টালজিয়া আর তার ইচ্ছেপূরণের গল্প বলে ছবিটি। ব্যাক্তিগত অতীত থেকে পারিবারিক অতীত আবার পারিবারিক অতীত থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অতীতকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে চান ঋতুপর্ণ । আর তাঁর অবলম্বন এক বনেদী বাঙালি পরিবারের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু সদস্য যাঁরা একত্রিত হয়েছেন দুর্গাপূজোর ছুটিতে। ছবি যত এগোয়, দেখা যায় কিভাবে একদিকে যেমন চরিত্ররা নিজেদের সম্পর্কগুলো আবিষ্কার করতে করতে ফিরে আসতে থাকেন নিজেদের শেকড়ে, অন্যদিকে একচালা প্রতিমার সাবেকী সাজ থেকে সত্যজিৎ রায়- সুকুমার সেনের অনুষঙ্গে পরিচালক দর্শকদেরও নিয়ে যান এক নস্টালজিয়া ট্যুরে। ‘উৎসব’-এর প্রযোজক তপন বিশ্বাস বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে ১৯৮১ সাল থেকে যুক্ত । ১৯৯৯ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে তাঁর আলাপের পরেই উনি পরিকল্পনা করেন উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির একটি রেট্রোস্পেক্টিভের। বঙ্গ সম্মেলনে ‘উনিশে এপ্রিল’ ও ‘দহন’-এর সাফল্য দেখে পরিকল্পনা হয় আমেরিকাতেই একটি ছবি প্রিমিয়ার করার। সেই মতই ‘উৎসব’এর প্রযোজনার কাজ চলে। পরিকল্পনা মতই লস এঞ্জেলসের জেনেরাল সিনেমায় প্রিমিয়ার সহ আমেরিকার আরো নানা জায়গায় ছবিটি দেখিয়ে ভালো আয়ও হয়। সেই সাফল্যে বিশ্বাসবাবু ভাবতে থাকেন কেমন হয় যদি উত্তর আমেরিকায় প্রতি বছর দুটো করে বাংলা ছবি মুক্তির পরিকল্পনা করা যায়। সেই মত কথাও এগোয়, কিন্তু নানা অসুবিধের কারণে এই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়না। এই ক্ষেত্রে ‘ডায়াস্পোরা’ বাজার সেভাবে সাড়া না দিলেও ‘উৎসব’ এর পথ ধরে এগিয়ে এর পরেই উত্তর আমেরিকায় এই ধরনের বাংলা ছবি দেখানোর জন্য বেশ কিছু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এগিয়ে আসতে থাকে।‘ ডেটা বাজার মিডিয়া ভেঞ্চার ‘বা ‘ভিন্ন মত নিউজ নেটওয়ার্ক’-এর মত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলা ছবির অনলাইন বাণিজ্যও বিস্তৃত হয় একে একে। আর এই প্রবাসী বাজারের কথা ভেবেই যেন ‘পিয়ালীর পাসওয়ার্ড’ বা ‘বং কানেকশন’এর মত বাংলা ছবিগুলো সচেতন ভাবে ডায়াস্পোরিক চরিত্র ও তাঁদের অতীতচারণার গল্প নিয়ে আসতে থাকে।
কিন্তু এটাও ঠিক যে বাংলা ছবিতে অতীতচারণা ও ছবির জগতের নস্টালজিক নির্মাণের এই এক বগ্গা ধরন খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০০০ সালের পর কর্পোরেট প্রযোজনার নানা অঙ্ক ঢুকে পড়ে বাংলা ছবিতে। বাজারের বিন্যাস ঘটে নতুন নিয়মে, বদলে যায় ছবি প্রযোজনা-পরিচালনা, ডিস্ট্রিবিউশন-এক্সিবিশন ও বিপণন- বিজ্ঞাপনের আন্তঃসম্পর্ক। মহেন্দ্র সোনি ও শ্রীকান্ত মোহতা নব্বই-এর দশকে পূর্ব ভারতে মূল ধারার হিন্দি ছবির ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে পথ চলা শুরু করে ক্রমে ক্রমে বাংলা ছবির বাজারে নিজেদের আসন পাকা করতে থাকেন। ওঁদের মালিকানায় শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস (এস. ভি. এফ) হয়ে ওঠে মূলধারার বাংলা ছবির ‘সফলতম’ প্রযোজনা সংস্থা এবং বাংলা ছবির বাজারের নিয়ন্ত্রকও। বেশ কিছু গড়পরতা মূলধারার ছবির প্রযোজনার পর ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ (২০০৩) এস. ভি. এফ.এর কর্পোরেট পুঁজির বাণিজ্যে এক বড় মাপের সাফল্য। অন্যান্য নানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেট হাওয়ায় মূলধারা ও সমান্তরাল ছবির এই বিভাজনের রেখাগুলোই অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ।
নতুন পরিচালকদের হাত ধরে অতীত চারণার রাজনীতিও নতুন রূপ নিতে থাকে। সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘হারবার্ট’ (২০০৫) নস্টালজিক ‘ভদ্রলোক’ ছবির ধারণাকেই ভেঙেচুরে নিয়ে আসে অতীতের এক অন্য পাঠ – যেই অতীত বিপ্লবের, হিংসার, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আর তার থেকে মুক্তির লড়াই-এর। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত সেই অতীত যেকোনো মুহুর্তে ফেটে পড়তে পারে! একদিকে প্রতিষ্ঠিত পরিচালকেরা অতীতচারণার চেনা কাঠামোয় প্রায়-আত্মজীবনীধর্মী ছবি বানাতে থাকেন- যেমন ‘ইতি মৃণালিনী’ (অপর্ণা সেন, ২০১১), ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ (অঞ্জন দত্ত, ২০১২) বা ‘চিত্রাঙ্গদা’ (ঋতুপর্ন ঘোষ, ২০১২); অন্যদিকে নতুন পরিচালক সৃজিত মুখার্জি বা অভীক মুখোপাধ্যায় তাঁদের ছবির অতীতচারণার মধ্যে খুঁজে পান বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের অন্য একটি দিক- অপরাধ! সৃজিত মুখার্জির ‘বাইশে শ্রাবণ’ (২০১২) বা অভীক মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি তারার খোঁজে’ (২০১০) বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস থেকে খুঁজে নেয় স্টোনম্যান রহস্য বা ঠগিদের বিবরণ আর ছবিতে নিয়ে আসেন এই অপরাধের জগতের অতীত। এভাবেই অতীতচারণার গল্পগুলো বদলায় আর বাংলা ছবিতে নতুন নতুন নজির নিয়ে আসে। কিন্তু সে কথা না হয় আরেকদিন হবে।
সূত্রঃ
মৈনাক বিশ্বাস, “রে অ্যান্ড দ্য শ্যাডো অফ পলিটিকাল সিনেমা” মার্গ, ১লা মার্চ, ২০১০।
সোমেশ্বর ভৌমিক, ভারতীয় চলচ্চিত্রঃ একটি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন, প্যাপিরাস, ১৯৯৬।
অনিল আচার্য, সত্তর দশক, অনুষ্টুপ, ১৯৮১।
পরিমল ঘোষ, “হ্যোয়ার হ্যাভ অল দ্য ‘ভদ্রলোকস গন”, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলী, ২৭শে জানুয়ারি, ২০০৪।
জিগনা দেশাই, বিয়ন্ড বলিউডঃ দ্য কালচারাল পলিটিক্স অফ সাউথ এসিয়ান ডায়াস্পোরিক ফিল্ম, রুটলেজ, ২০০৪।
অনুজ্ঞান নাগ, “ফ্রম টলিগঞ্জ টু টলিউডঃ দ্য ট্রানসফরমেশন অফ বেঙ্গলি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিটুইন নাইনটিন এইট্টী অ্যান্ড দ্য প্রেসেন্ট”, জার্নাল অফ বেঙ্গলি স্টাডিস, ২০১১, বর্ষ ১, সংখ্যা ২।
প্রচ্ছদঃ সৈকত পালিত
*****