ইউনিকর্নের জন্ম – অর্ণব চক্রবর্তী

যাদের মাথায় এতটুকু বুদ্ধি আছে তারা বুঝতে পেরেছিল ঘুম ভাঙার পরই। এক্কেবারে সকাল থেকেই সব কেমন গোলমেলে! যেমন সূর্য উঠে পড়েছে দুই ঘণ্টা আগে- অত সকালে সূর্যকে উঠতে কেউ কখনও দেখেনি। তা উঠেছিস ওঠ, এত তেজ দেখানোর কি আছে? গরমে সবাই ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে। এত গরমে ঘরের বাইরে বেরোতে বাঘের একটুও ভালো লাগে না। অথচ সেই দিনেই সক্কাল সক্কাল এত খিদে পেল! উরিব্বাবা, সে কি খিদে, কি খিদে! বাঘের নাড়িভুড়ি যেন হজম হয়ে যায়! 

এদিকে রোগা হবে বলে সকাল সকাল জগিং করতে গেছে গণ্ডার মশাই। কিন্তু ওই শরীর নিয়ে কতক্ষণ আর দৌড়ানো যায়! তার ওপর চড়া রোদ! গণ্ডার মশায়ের গলা শুকিয়ে কাঠ হল। নদী থেকে পেট ভরে জল খেয়ে তাঁর খুব শান্তি হল। কিন্তু একপেট জল খেয়ে কি আর দৌড়ানো যায়? গণ্ডার মশাই একটা বড় বট গাছের তলায় আরাম করে বসলেন। যেই না বসা অমনি বট গাছের মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়ল তাঁর ঘাড়ের ওপর। গণ্ডার মশাই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না।

তার থেকেও মাইলখানেক উত্তরে, জঙ্গল যেখানে সামান্য পাতলা- সেখানে একদল হরিণের বাস। হরিণগুলো আবার রোদ পোহাতে বড় ভালোবাসে। তাই সক্কাল সক্কাল সবাই মিলে চলে এসেছে ঘাস খেতে। ভবঘুরের মত তারা ঘুরে ঘুরে ঘাস খায়। এক জায়গায় শান্ত হয়ে যে একটু বসবে সে তাদের ধাতে নেই। একমাঠ থেকে অন্য মাঠে তারা ছুটে যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে। গান গাইছে না শুধু একজন। সেই হরিণটার খুব দুঃখ। এত বয়স হয়ে গেল তার এখনও শিং গজালো না। বাকি হরিণরা এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। কেউ কেউ ওর নাম দিয়ে মাকুন্দ।

সবাই যখন গান গাইছে তখন এই হরিণটা মনের দুঃখে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলো নদীর দিকে। নদীর জলে নিজের ছায়া দেখে ভাবছিল ইশ, আমার কবে যে একটা শিং গজাবে! ঠিক সেই সময় খাবারের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে ওখানে হাজির হয়েছে সেই ক্ষুধার্ত বাঘ! হরিণ তখন জলের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে এতই ব্যস্ত যে সে বেচারা টেরই পায়নি কখন পাশে বাঘবাবাজী এসে দাঁড়িয়েছে!

বাঘের তো মহা আনন্দ! খিদের মুখে সে পেয়েছে একখানা আস্ত হরিণ। হরিণের নরম মাংস খেতে তার কি ভালোই না লাগে! হরিণের ঘাড় কামড়ে ধরে টানতে টানতে বাঘটা নিয়ে এসেছে তার গুহায়। তারপর এক মস্ত দড়ি দিয়ে হরিণকে বেঁধে রেখে বাঘ স্নান করে আসতে গেছে নদীর জলে।

বাঘের হাতে বাঁধা পড়ে হরিণ কাঁদতে লাগল। কান্না শুনে একটা ইঁদুর ঢুকে এল গুহার মধ্যে। সে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে হরিণকিশোর? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? হরিণ বলল দেখো না, বাঘ আমাকে খাবে বলে ধরে নিয়ে এসেছে। শুনে ইঁদুরের খুব মায়া হল। সে দাঁত দিয়ে হরিণের দড়ি কেটে দিল। হরিণ ছাড়া পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পালাতে লাগল। সে ভেবেছে সোজা গিয়ে সরু নদী সাঁতরে পেরোলেই আর বাঘের ভয় নেই। কিন্তু সে তো জানে না যে বাঘ নদীতেই স্নান করতে গেছে। যেই হরিণ জলে নামতে যাবে অমনি বাঘ আবার লাফিয়ে ওর ঘাড় কামড়ে ধরেছে। টানতে টানতে আবার নিয়ে এসেছে গুহার মধ্যে। যেই না খেতে যাবে এমন সময় কেউ ডাকল “বাঘবাঘুম বাঘবাঘুম!” ডাকটা আসছে গুহার ছাদ থেকে। বাঘ বলল কে রে ব্যাটা আমার নাম নিয়ে তামাশা করছিস? ছাদের দেওয়াল থেকে ইঁদুর বলল, জানেন না বাঘমামা, বাঁশবনের ধারে যে সবজান্তা পায়রাপাখি এসেছে সেই তো আপনাকে বাঘবাঘুম বলে ডাকে। আপনার ব্যাপারেও নাকি সে সব জানে। জন্ম মৃত্যু সঅঅব…  বাঘ তখন বলল, এত্ত বড় সাহস! কে রে এই পায়রাপাখি? ইঁদুর বলে যে সে পায়রা নয় বাঘমামা, সবজান্তা পায়রাপাখি, বুঝলেন বাঘমামা, সে নাকি সব জানে। যা বলে তাই নাকি সত্যি হয়। বাঘ বলল বটে! চল তো দেখি কেমন সর্বজ্ঞ সে পায়রাপাখি!

বাঘ আর ইঁদুর বাঁশবনের ধারে এসে দেখে বনের সমস্ত জন্তু জানোয়ার সেখানে জড়ো হয়েছে আগেই। পায়রাপাখি ঝটপটিয়ে উড়ছে আর সব্বাইকে অজরং-বজরং জ্ঞান দিচ্ছে। বাঘকে দেখে সবাই তো একেবারে ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালো। বাঘ বলল কি রে পায়রাপাখি? তুই নাকি সবজান্তা?

পায়রাপাখি বলল- হ্যাঁ বাঘবাকুম। আমি সর্বজ্ঞ। আমি সবকিছু জানি।

বাঘ বলল- তবে বল দেখি আমি আজকে কি খাব?

পায়রাপাখি বলল- ওই যে হরিণটাকে তুমি ধরে এনেছ, সেটা আর তোমার খাওয়া হচ্ছে না! খাবার আগেই সে যাবে পালিয়ে।

বাঘ চিন্তিত হয়ে বলল সেকি কথা! এমন তো হয় না কখনও! তখন পায়রাপাখি বলল- যাও যাও গিয়ে দেখে এসো। বাঘবাকুম বাঘবাকুম!

বাঘ লাফিয়ে লাফিয়ে এসে দেখে কই হরিণ তো পালায়নি! একইভাবে বাঁধা পড়ে আছে গুহার মধ্যেই। বাঘ ইঁদুরকে বলল- তোরা সব বোকার হদ্দ! ওই পায়রাপাখির কিস্যু জানে না। ওর কথা তোরা বিশ্বাস করিস! সত্যি তোরা হলি হদ্দবোকা। বলেই বাঘমামা চলল পায়রাপাখিকে শাস্তি দিতে।

গিয়ে দেখে পায়রাপাখি কাঁদছে। বলছে ভুল বুঝো না বাঘবাকুম। আমি মিথ্যে কথা বলিনি। তুমি সত্যিই হরিণটাকে খেতে পারবে না। বাঘ রেগে দিয়ে দিল থাবা! বাঘের থাবায় কি পায়রাপাখি বাঁচে? পায়রা মরে গেলে বাঘ সেটাকে খেয়ে নিল। খেয়ে বলল- ধুর! এইটুকু পায়রা খেয়ে খিদে যেন গেল বেড়ে! যাই গিয়ে হরিণটাকে খাই।

হরিণের মাংসের কথা ভেবে বাঘের জিভ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগে।

এদিকে হয়েছে কি, বাঘ তো ইঁদুরটাকে বোকার হদ্দ বলে গিয়েছিল। ইঁদুরের তাতে হয়েছে বিশাল রাগ। সে রেগে গিয়ে আবার হরিণের দড়ি কেটে দিয়েছে। তখন হরিণ মুক্তি পেয়ে আবার গুহা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বাঘ ফিরে দেখে গুহা একেবারে ফাঁকা! তার মানে সবজান্তা পায়রার কথা ঠিক হল! এসব ভেবে বাঘের মাথায় যেন রোখ চেপে গেল। যে করেই হোক হরিণটাকে খুঁজে বার করতেই হবে। সে তখন খোঁজ লাগালো বাজপাখিকে।

বাজপাখি আর বাঘ একসময় দারুণ বন্ধু ছিল। এক সাথে গল্প করত, একসাথে খেতো। তারপর হঠাৎ একদিন বাজপাখি ভবঘুরে হয়ে গেল। তারপর থেকে আর তাকে দেখাই যায় না। খালি ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে বেড়ায়। বাঘমামা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাজপাখিকে ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দূর আকাশে একটা ছোট্ট বিন্দুর মত বাজপাখিকে দেখা গেল। বাজপাখি মাটিতে নেমে জিজ্ঞেস করল- কিরে, ওরকম পাগলের মত হালুম হালুম করে ডাকছিস কেন? বাঘ তখন যা যা ঘটেছে সব সবিস্তারে বর্ণনা করে হাত জোড় করে বলল- হরিণটা কোথায় আছে তুই একটু বলে দে ভাই। বাজপাখি বলল- আচ্ছা দাঁড়া, দেখছি কি করা যায়। বলেই বাজপাখি ডানা ঝাপটে একেবারে আকাশে উঠে গেল। তখন আকাশ থেকে গোটা বনটাকে ও দেখতে পেল। দেখতে পেল হরিণ লাফাতে লাফাতে চলেছে। বনের পশ্চিমে যে বটগাছ, তার পাশে যে বাঁধানো ঘাট, আর তার পাশে যে নদী একেবারে সরু হয়ে হাঁটুজল- হরিণ চলেছে সেই নদী পার হবার লক্ষে।

বাজপাখি এসে বাঘকে বলায় বাঘ আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ছুটল হরিণকে পাকড়াও করতে।

ততক্ষণে হরিণ সবে বটগাছের কাছে এসেছে, ঠিক সেই সময় কে যেন তাকে ডাকল- এইযে! একটু শুনছ?

হরিণ দাঁড়িয়ে পড়েছে। কে ডাকল তাকে? আর কি গম্ভীর গলা! এমন গম্ভীর গলা শুনেই কেমন ভয় ভয় করে!

আবার শোনা গেল, কেউ বলছে- ভয় পেও না, ভয় পেও না। বট গাছের নিচের দিকে দেখো। বটগাছের নীচের দিকে তাকিয়ে হরিণটা দেখতে পেল একটা মস্ত ভাঙা ডাল, ডালটা মাঝে মাঝে একটু উঠছে, তারপর আবার একটু নামছে, আবার উঠছে। ওমা এ আবার কিরকম ব্যাপার? ডাল কি এমন নড়ে নাকি? ডাল তো নড়ে কেবল হাওয়ায়! এখন হাওয়া-টাওয়া কিছুই তো নেই, তাহলে? আবার কণ্ঠস্বর ভেসে এল  – এই যে আমি, ডালের নীচে চাপা পড়ে গেছি। হরিণ এবার দেখে- আরেহ, তাইতো! এখানে যে গণ্ডারমশাই পড়ে আছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে তার ঘাড়ের ওপর। গণ্ডার বলল- আমাকে একটু সাহায্য করবে হরিণকিশোর?

হরিণের বুকের ভেতরে দুরুদুরু করতে লাগল। সে যদি গণ্ডারমশাইকে সাহায্য করতে গিয়ে দেরি করে ফেলে? যদি সেই ফাঁকে বাঘ চলে এসে তাকে কামড়ে ধরে? তাহলে কি সাহায্য না করে সে চলে যাবে? আগে নিজেকে বাঁচাবে? কিন্তু এইসব কথা সে বেশি ভাবল না। গণ্ডারমশাইকে ওভাবে ব্যথা নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে তার খুব মায়া হল। সে তখন রোগা রোগা পা-গুলো দিয়ে বটগাছের ডালটাকে সরাতে লাগল। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, বট গাছের ডাল বলে কথা! অত সহজে কি নড়ে? কিন্তু হরিণ আবার হাল ছাড়ার পাত্র না। চেষ্টা করতে করতে সূর্য ডুবে গেল, সন্ধ্যে হল, হরিণ হাল ছাড়ল না। চেষ্টা করতে করতে একসময় কিন্তু সে ঠিক ডালটাকে সরিয়ে ফেলল।

গণ্ডারমশাই ছাড়া পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। বললেন- দ্যাখো, আমি তো আর বেশিক্ষণ বাঁচব না, মরার আগে তুমি আমাকে যা শান্তি দিয়েছ তার জন্য আমি তোমাকে একটা পুরস্কার দেব। এই বলে গণ্ডার তার শিংটাকে খুলে হরিণের মাথার ওপর বসিয়ে দিল। আর বলল – আজ থেকে তোমার নতুন নাম ইউনিকর্ন।

মাথার ওপর একটা সিং পেয়ে হরিণ তো মহা খুশি। সেই শিং নিয়ে লাফাতে লাফাতে সে যেই পেছনে ঘুরেছে দেখে অন্ধকারের মধ্যে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। হরিণের রক্ত হিম হয়ে গেল! এতো বাঘ না হয়ে যেতেই পারে না।

বাঘ এতক্ষণে জঙ্গলের মধ্যেই খুঁজছিল। এখন হরিণকে দেখে হালুম বলে লাফিয়ে পড়তে চাইল হরিণের ওপর। প্রাণে বাঁচতে হরিণ তখন তার নতুন শিং দিয়ে দিল বাঘকে গুঁতিয়ে!

এক গুঁতোতেই বাঘ একেবারে কুপোকাত! সে হাতজোড় করে বলছে- ক্ষমা কর হরিণসোনা। তোমাকে আর আমি খাব না।

হরিণ মুখটাকে বড়দের মত গম্ভীর করে বলল- আমার নাম হরিণ নয়। জানো না? আমার নাম হল ইউনিকর্ন!

সেই থেকে বনের যত পশু পাখি- সবাই তাকে ইউনিকর্ন বলেই ডাকে! কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে সাহস পায় না। আর বাঘটা? গুঁতো খেয়ে বাঘটার হয়েছে এক অদ্ভুত ব্যামো। সে রাগ করে যতই চেঁচাতে চায় ‘হালুম হালুম’, পেটের মধ্যে থেকে কে যেন বলে ওঠে- ‘বাকুম, বাকুম!’  

প্রচ্ছদঃ পাল রেশমী

*****