গাধার ভারী দুঃখ। বনের সমস্ত পশুপাখিরা তাকে নিয়ে কেবল তামাশা করে। তারা বলে সে নাকি ভীষণ বোকা! যখন সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তখন সবাই তাকে নানা ভাবে অপদস্থ করে। এদের ভয়ে আজকাল গাধার কোথাও বেরোতেই ইচ্ছে করে না। একা একা ঘরের মধ্যে শুয়ে সে চোখের জল ফেলে। ভাবে- আজকে যদি তার মা-বাবা বেঁচে থাকত তাহলে কি তারা এ’ভাবে তামাশা করতে পারত? ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় গাধাটার। শীতের দুপুরগুলোতে মায়ের কোলের কাছে শুয়ে সে খালি এটা ওটা প্রশ্ন করত।
‘মা মা, সিংহরাজার সারা গালে ওরকম দাড়ি কেন? উনি কি দাড়ি কাটেন না?’
মা বলতো- ‘দাড়ি না রে পাগল, ওটা হল কেশর!’
ছোট্ট গাধা কিছুক্ষণ ভেবে আবার প্রশ্ন করত- ‘আচ্ছা মা, হাতি যেমন চামচ করে জল খায় আমাকেও ওরকম একটা চামচ কিনে দেবে?’
– ওঃ! ওটা হাতির চামচ নয় বাবু, ওটা হল হাতির শুঁড়।
– আমার শুঁড় হবে না মা?
এসব প্রশ্ন শুনে কখনও কখনও মা মাথায় হাত দিতো। সারাদিন কুলিগিরি করে বাবা বাড়ি ফিরলে মা বলত – ‘ছেলেটা যে আমার বড় সরল গো, আমরা না থাকলে কি যে করবে! সেই চিন্তায় আমার ঘুম আসে না!’
বাবা অত চিন্তা করত না, ‘আমরা যা করেছি তাই করবে। আমরা বাপু একটু সরলসিধে পশুই বটে, বেশি প্যাঁচঘোঁচ আমাদের পছন্দ নয়।’
‘কিন্তু জগৎটা যে অত সোজাসরল নয় গো, কি করবে ও আমরা না থাকলে…’
মা-ই ঠিক বলতো। সে সরল, সে সোজাসাপটা পশু। তাই বলেই কি সে বোকা? মোটেই না। বোকামো সে কখনই বা করল? আচ্ছা বলো তো, পশুপাখিদের বিশ্বাস করাটা কি ভুল? অন্যায়? সে তো আর মানুষদের বিশ্বাস করেনি! তাহলে তাও কেন সবাই ওর সুযোগ নেয়? ওকে বোকা বানিয়ে, টিটকিরি দিয়ে অন্যান্য জন্তুদের কি এমন আনন্দ হয় কে জানে! গাধা এসব কিছুই ভেবে পায় না। সে একা একা এসব কথা ভাবে আর নিজের ঘরে বসে চোখের জল ফেলে।
এদিকে সেইসময়ে বনের মধ্যে বেধেছে ভারী গোল! সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেছে, সবার মনেই অশান্তি! হবে না? সবার প্রিয় সিংহরাজা যে চোখেই দেখতে পাচ্ছেন না! অবশ্য পুরোপুরি যে দেখতে পাচ্ছেন না তা নয়। সবকিছু কেমন ঝাপসা দেখছেন। অনেক ডাক্তার বদ্যি এসেছে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারে নি। কবে থেকে এই ব্যামো যে শুরু হল তাও ঠিক করে কেউ বলতে পারে না! কেউ কেউ বলে একদিন সিংহরাজার খুব জ্বর এসেছিল। সে জ্বর কিছুতেই কমে না। জ্বর কমানোর জন্য তখন ডাকা হল খরগোশকে। সাদা অ্যাপ্রন পরে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে খরগোশ এসে হাজির। অনেক দেখে শুনে সে বলল- ‘ও কিছু ভাববেন না রাজামশাই, নেহাত ভাইরাল ফিভার ছাড়া কিছু নয়। এই ওষুধ দিলুম, সাত দিনেই কমে যাবে।’ খরগোশ চলে গেলে সিংহ বলল ‘হুঁ! সাত দিন! সাতদিন বুঝি আমার শুয়ে থাকার সময় আছে!’ তারপর বিছানায় দুবার এপাশ ওপাশ করে বললেন, ‘ডাক তো ওই শেয়ালটাকে। ও ঠিক নতুন কিছু ওষুধ বলে দেবে।’
শেয়ালপণ্ডিত তখন জটিল কিসব এক্সপেরিমেন্ট করে একটা ইনজেকশন বানিয়ে আনল। বলল, ‘একদিনেই জ্বর কমে যাবে রাজামশাই! কোন চিন্তা করবেন না।’ কি আশ্চর্য! সত্যি সত্যি এক দিনের মাথায় সিংহর জ্বর কমে গেল। কিন্তু গোল বাধল তার কয়েক দিন পরেই। একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে তিনি আর চোখে ভালো দেখতে পান না। বারবার চোখে জলের ঝাপটা দিলেন, কিচ্ছুতে কিছু হল না। তখন আবার শেয়ালের ডাক পড়ল। শেয়াল বলল, ‘চোখের দৃষ্টি দিয়ে কি হবে রাজামশাই? আপনি বরং মনের চোখ দিয়ে দেখুন।’ সিংহরাজা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন- ‘সে কিরকম?’ ‘কেন? আমি আপনাকে সব কিছু বর্ণনা করব। আর আপনি মনে মনে সেগুলোকে ভেবে নেবেন!’ সিংহ ভাবল এ তো এক মজার খেলা! তাকে আর হাজার ঝামেলা পোহাতে হবে না! শেয়ালই সব সমাধান করে দেবে!
সেই থেকে বনের সমস্ত সমস্যা সামলাচ্ছে শেয়াল। আর বনের একেবারে শেষের দিকে, যেখানে কেউ থাকে না, সেখানে একটা প্রাচীন গুহা সিংহর জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করে দিয়েছে শেয়াল। সিংহ সেখানে থাকে আর খায় আর ঘুমায়। এত আরামে থেকেও সিংহর মনে সুখ নেই। কি যেন তাঁকে কুরে কুরে খায়; দিনে দিনে তিনি আরও বদমেজাজী হয়ে উঠছেন। সেই কারণে আজকাল কেউ আর তাঁর গুহার কাছাকাছি যেতে সাহস করে না। কে জানে, যদি তিনি আবার চড়-থাপ্পড় মেরে বসেন!
কথা মতো শেয়ালরা গোটা বনের সবকিছু সামলাচ্ছে। যার যত ঝগড়া মারামারি সবাই নিয়ে আসছে তাদের কাছে। শেয়ালরা কাউকে বকশিস দিচ্ছে আবার কাউকে শাস্তি দিচ্ছে। এই সেদিনই, একটা চ্যাঙড়া ফড়িং-কে শাস্তি দিতে গেলে সে ফড়ফড় করে মুখের ওপর বলে দিল- তোমার শাস্তি মানি না। সিংহরাজা বললে তবেই আমি মানব। শেয়াল তখন বুক ফুলিয়ে বলল- ‘সিংহরাজা তো আমার ওপরই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি যা বলব তাই হবে।’ ফড়িং বলল- ‘যাও যাও, সিংহরাজা যদি তাঁর লাল কালির পেন দিয়ে লিখে দেন তবেই আমি বিশ্বাস করব।’
সেই থেকে শেয়াল পণ্ডিত ভাবছে কি করে লাল কালির পেনটা নিয়ে আসা যায়! কত ভাবে, কিছুতেই কিছু কিনারা হয় না। পেনটা যে সিংহরাজার খুব প্রিয়, কিছুতেই ওটি হাতছাড়া করবেন না! এসব ভাবতে ভাবতে শেয়ালপণ্ডিতের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে তখন একদিন চলে এল গাধার বাড়ি। গাধার জন্য নিয়ে এল অনেকগুলো কচুরিপানা। কচমচ করে কচুরিপানা চিবিয়ে খেতে গাধার খুব ভালো লাগে, আনন্দে গদগদ হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, বলুন শেয়ালপন্ডিত, আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি। শেয়ালপন্ডিত চুপিচুপি প্ল্যানটা খুলে বলল, সিংহ যখন ঘুমিয়ে থাকবেন তখন সিংহের গুহায় গিয়ে ওই লাল কালির পেনটা চুরি করে আনতে হবে। শুনে তো গাধার পা-দুখানা ঠকঠকিয়ে কাঁপতে লেগেছে! কিন্তু মুশকিল হল সে কাউকেই ‘মুখের ওপর’ না বলতে পারে না, তাই শেষমেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেল।
রাজি হলে কি হবে, চিন্তায় যে রাতে তার আর ঘুম আসে না। সে সারাক্ষণ মাঠের মধ্যে পায়চারি করে বেড়ায়। ভাবে আর হাঁটে, হাঁটে আর ভাবে। এভাবে কখন যে গোটা রাতটা কেটে গেল সে খেয়ালই করল না। আকাশে সূর্যের লাল আলো দেখা দিয়েছে, কোথায় দুয়েকটা মোরগ ডেকে উঠল, একটা দুটো করে পশুপাখির ঘুম ভাঙছে। তখন তাকে মাঠের মধ্যে পায়চারি করতে দেখে একটা ইঁদুর চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই গাধা, বোকা গাধা, হদ্দ বোকা গাধা!’ বলেই সে খিলখিল করে হেসে গর্তের লুকিয়ে পড়ল। ইঁদুরের কথা শুনে গাধার চোখদুটো আবার ছলছল করে উঠেছে। সে ভাবছে- কেউ যখন আমাকে ভালোই বাসে না তখন আমার সিংহরাজার হাতে মরাই ভালো। এই ভেবে সে সিংহরাজার গুহার দিকে হাঁটতে লাগল। রাস্তায় যারাই তাকে দেখছে তারাই ‘বোকা গাধা’, ‘হদ্দ বোকা’ বলে টিটকিরি দিচ্ছে। গাধা কিন্তু কাউকে কিচ্ছুটি বলছে না। মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে সোজা হেঁটে যাচ্ছে বনের শেষের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এমন জায়গায় এসে পড়ল যেখানে আর তেমন জন্তু জানোয়ার নেই। মাঝে মাঝে কিছু সাপ-খোপ চোখে পড়ছে বটে তবে তারও সংখ্যা তেমন বেশি নয়।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে গাধার একটু খিদে পেয়ে গেল। সে একটা পাছের পাতা সবে মুখে দিয়েছে এমনসময় কেউ কড়া গলায় বলে উঠল- ‘ফেলে দাও, মুখ থেকে শিগগির ফেলে দাও!’
কিছুদূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা বক পাখি। কথাগুলো সেই নিশ্চয় বলেছে। বকপাখির কথা শুনে গাধা মুখ থেকে পাতাগুলো থু থু করে ফেলে দিল। তার ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখখানা দেখে বকপাখি হেসে বলল, ‘জানো না এই তল্লাটের ঘাসে, পাতায় পোকা লেগেছে! একটা পাতাও যদি খেয়েছো তবে তোমার গলা ফুলে ঢোল হয়ে যাবে।’
গাধা বলে- ‘এই রে! তাহলে আমি কি খাব এখন!’
‘তোমার বুঝি খুব খিদে পেয়েছে?’
‘পাবে না? সেই কখন থেকে হাঁটছি তো হাঁটছিই!’
‘আচ্ছা এসো তবে আমার সঙ্গে।’
বকপাখি গাধাকে নিয়ে এল একটা নদীর ধারে। কুলকুল করে নীল জল বয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া। কি পরিষ্কার আকাশ! গাধা অবাক হয়ে বলল- ‘এটা কি নদী গো? এত সুন্দর নদী তো কখনও দেখিনি।’
বক হেসে বলল, ‘এই নদী হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছে। এর নাম অশ্রু নদী। ভগবানের চোখ থেকে জল ঝরে ঝরে এই নদী তৈরি হয়েছে।’
গাধা তখন ভুরু কুঁচকে বলল- ‘ধ্যাৎ, এটা কি করে অশ্রু নদী হবে? আমরা যেখানে থাকি অশ্রু নদী তো তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে! শেয়ালদের একটা কোয়ার্টার আছে, ঠিক তার পিছন দিয়ে। সেখানে আমরা কেউ স্নান করি না। করব কি করে? তার জল কি ঘোলা আর নোংরা তুমি ভাবতেও পারবে না! আর যদি একবার ভুল করে সেই জল খেয়েছো! সে রাতে তোমার পেট খারাপ হচ্ছেই হচ্ছে।’
বক বলল- ‘এটাই সেই অশ্রুনদী। এখান দিয়ে বয়ে বয়ে তোমাদের পাড়ায় গিয়েছে। নাও, প্রাণ ভরে জল খেয়ে নাও।’
গাধা চুকচুক করে অনেকটা জল খেল। আহ, কি অপূর্ব স্বাদ! জলেরও যে স্বাদ এত ভালো হতে পারে সেকথা সে ভাবেই নি কখনও। তাদের পাড়ার জল তো এর কাছে নেহাতই পানসে! কিন্তু জল খেয়ে তার তো পেট ভরল না! বরং খিদেটা গেল আরও বেড়ে! তখন বকপাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে নদীর জল থেকে ছোঁ মেরে একটা মাছ নিয়ে ফিরে এল! বলল- নাও, এই মাছটা খাও।
গাধা তখন সামনের পা-দুখানা জোরে জোরে নাড়িয়ে বলল- ‘না না, আমি মাছ খাইনে, আমি মাছ খাইনে…’
বকপাখি তখন আবার ডানা ঝাপটে উড়ে গেল তারপর দূরের একটা গাছ থেকে ঠোঁটে করে আপেল নিয়ে এল। আপেল খেয়ে গাধার পেটটাও ভরল, আর শরীরেও যেন কিছুটা বল এল। বকপাখিকে টাটা করে গাধা আবার হেঁটে চলল সিংহের গুহার দিকে।
এদিকে সিংহর গুহা যত কাছে এগিয়ে আসে গাধার ভয় ততই বাড়তে থাকে। শেষে যখন সে সিংহের গুহা থেকে মিনিট দশেক দূরে- তার চারটে পা ভয়ের চোটে এমন ঠকাঠক কাঁপতে লাগল যে সে আর হাঁটতেই পারে না! এমন সময়ে বুঝি সিংহ তার পিঠে প্রকান্ড থাবা দিয়ে সপাটে এক চড় বসালো! ‘ওরে মারে গেলুম রে’ বলে গাধা তো তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছে, তখনই কেউ একটা মিহি গলায় বলে ওঠে- ‘এই দাঁড়াও দাঁড়াও, ভীতুর ডিম কোথাকার! আমি সিংহরাজা নই, আমি হলুম লালহাতি।’ গাধা তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভারী লজ্জা পেল। একহাত জিভ কেটে পাশে তাকিয়ে দেখল সত্যিই তো! তার পাশে একটা লাল রঙের হাতি এসে দাঁড়িয়েছে!
লালহাতি বলল- ‘এত ভয় পাওয়ার কি আছে শুনি!’
গাধা তখন সবিস্তারে তার আসার কারণ খুলে বলে। এও বলল যে সিংহরাজা ধরতে পারলে তাকে ঘাড় মটকে খাবে। হাতি তখন শুঁড় দিয়ে খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল- তাহলে তো একটা উপায় করতে হয়! ‘কি আর উপায় হবে? আমাকে বোধহয় আজই মরতে হবে। আজই আমার শেষ দিন গো…’- গাধা মাথা নীচু করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে। তার কথা বলার ধরনটা দেখে লালহাতির হাসিও পেল আবার খানিকটা মায়াও হল। সে শুঁড় দিয়ে গাধার চিবুক ধরে তুলল, তারপর যত্ন করে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল- ‘আহা রে, আচ্ছা এসো তো আমার সাথে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’
তারা হাঁটছে তো হাঁটছেই, লালহাতির মাথায় যে কি বুদ্ধি এসেছে সেটা জানার জন্য গাধার মনটা ছটফট করছে। কিছুক্ষণ পরে আর থাকতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করে- ‘তোমার মাথায় কি বুদ্ধি এসেছে লালহাতি?’
লালহাতি উত্তর দেবার বদলে উলটে তাকে প্রশ্ন করে বসল- ‘আচ্ছা বলো দেখি, সিংহ একমাত্র কাকে সমীহ করে?’
গাধা বলল- ‘কাকে আবার, হাতিকে?’
‘উঁহু, হাতিকে সিংহ ভয় করে ঠিকই, কিন্তু একজনকে সে ভয়ও করে না আবার তাচ্ছিল্যও করে না।’
‘সে কে গো?’
‘রয়াল বেঙ্গল টাইগার।’
‘রয়াল বেঙ্গল টাইগার? তাদের তো শুনেছি মানুষরাও ভয় করে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তবে জানো কি, সেই বাঘ আর তোমাদের সিংহরাজা একসাথেই খেলেধুলে বড় হয়েছে। একসাথে ব্যায়াম করেছে, শিকার করেছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, তখন দুজনেরই অল্প বয়স। দুজনেরই দারুণ চেহারা, গায়ে ভীষণ জোর। কেউ তাদের সাথে একটুও ইয়ার্কি মারতে সাহস করে না। দুই বন্ধুতে হেসে খেলে ভালোই ছিল। হঠাৎ একদিন রাজা- মানে আগে যিনি রাজা ছিলেন- তিনি পট করে মরে গেলেন। সবার মাথায় হাত পড়ল। এবার রাজা হবে কে? কে আবার? সিংহ আর বাঘের মধ্যে কেউ হবে নিশ্চয়ই। সারা পৃথিবীতে তাদের জুড়ি মেলা ভার! কিন্তু সিংহ হবে, নাকি রয়াল বেঙ্গল টাইগার? সারা বনের পশুপাখিরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে। একদল বাঘের পক্ষে। একদল সিংহের পক্ষে। তাহলে মীমাংসা হবে কি করে? সবাই যখন উত্তর খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন এক রাতে বাঘ সিংহের কাছে এসে বলল- “দোস্ত, তুমি রাজা হও, আমি অন্য বনে চললুম।” কথা শুনে সিংহ হাঁ হাঁ করে উঠেছে- “অন্য বনে যাবে কি? কোত্থাও যেতে পারবে না। আমরা বেস্টফ্রেন্ড না? সারা জীবন একসাথে থাকব।” বাঘ তখন হেসে বলল- “না দোস্ত, আমাদের একজন রাজা হলে অন্যজন হবে প্রজা। রাজা আর প্রজার মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না কখনও। তাই আমাদের একজনকে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। তুমি রাজা হও, আমি চললুম।” “এই বন ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি?” “হয়ত আরও সুন্দর কোন বনে!” এই বলে বাঘ যেই পা বাড়াতে যাবে এমনসময় সিংহ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বলল- “আমারও রাজা হবার দরকার নেই। আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো।” বাঘ সিংহকে বুকে জড়িয়ে বলল- “ধুর বোকা, তোমার না হয় রাজা হবার দরকার নেই, কিন্তু এত এত পশুপাখি যে আছে, তাদের তো একজন রাজা চাই। নইলে তাদের সঠিক পথটা দেখিয়ে দেবে কে?” সিংহ বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে- “তাহলে ভাই, তোমার ব্যবহার করা কিছু একটা আমার কাছে রেখে যাও। আমাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসেবে কিছু অন্তত থাক।” বাঘ তখন তার লাল কালির পেনটা সিংহকে দিল। আর বলল- “সাবধানে রেখো কিন্তু ভাই। আমার খুব প্রিয় পেন এটা।” সেই থেকে সিংহরাজা পেনটা কক্ষনও হাতছাড়া করেন না।’
গাধা বলল- ‘এই রে! তাহলে তো এটা চুরি করতে আসা খুব ভুল হয়েছে।’
লালহাতি বলল- ‘তা কি আর করবে। শেয়ালদের কথা না শুনলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।’
‘তাহলে এখন উপায়?’
‘একটা উপায় আছে। সিংহরাজা তো ভালো চোখে দেখতে পান না, শুধু রঙটা দেখে ঠাওর করেন। তোমার গায়ে বাঘের মত হলুদ-কালো ডোরা কাটা দাগ এঁকে দিই। তাহলে তোমাকে সিংহ বাঘের বাচ্চা বলে ভুল করবে। আদর-যত্ন নিশ্চয়ই খুব করবেন। আর সেই ফাঁকে তুমি তার লাল কালির পেনটাকে পকেটে পুরে ফেলবে, কেমন? পারবে না?’
গাধা কিছু বলার আগেই লালহাতি কোত্থেকে দুটো তুলি নিয়ে এল। একটা হলুদ রঙ, আর অন্যটায় কালো রঙ। গাধার সারা গায়ে লম্বা লম্বা দাগ টেনে লালহাতি র্যয়াল বেঙ্গল টাইগারের মতো ডোরা কাটা ডিসাইন আঁকতে থাকে। গাধা জিজ্ঞেস করে ‘এমন রঙ আর তুলি তুমি কোথা থেকে পেলে গো? আমাদের দেশে তো এ জিনিস কখনও দেখিনি।’ লালহাতি বলে- ‘এদেশে কারও কাছে থাকলে তো জানবে। এ জিনিস আমি নিয়ে এসেছি বহুদূরের এক দেশ থেকে। তার নাম জীব্রাগড়। সেই দেশের লোকেরা নানারকম রঙ দিয়ে ছবি আঁকতে ওস্তাদ!’
খুব যত্ন নিয়ে আঁকা শেষ করল লালহাতি। তারপর কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে গাধাকে আপাদমস্তক দেখে তার হাসি আর থামে না! গাধা তখন রেগে গিয়ে বলে- ‘এত হাসির কি হল বলো তো! আমি কি জোকার নাকি?’ লালহাতি বলে- ‘কিছু মনে কোরো না ভায়া, তোমাকে ঠিক জোকারের মতোই লাগছে। হাঃ হাঃ হাঃ।’
অনেক কষ্টে যখন তার হাসি থামল তখন বলল, ‘এবারে যাও, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর শোনো, দেখো নদীর জলে কিন্তু স্নান করতে নেমো না। কাঁচা রঙে জল পড়লে অনেক সময়ে এসব রঙ বদলে যেতে পারে।’
গাধা ঠোঁট উলটে বলল, ‘আমার যেন এখন স্নান করার সময় আছে!’
এই বলে গাধা তো আবার সিংহের গুহার দিকে হাঁটতে লাগল। সারা গায়ে কাঁচা রঙ চ্যাটচ্যাট করছে। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করছে। এমন সময় কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। গাধা মনে মনে ভাবল, এই বুঝি তার জীবনের শেষ বৃষ্টি! কি সুন্দর, কি ঠান্ডা বড় বড় ফোঁটা গায়ে এসে পড়েছে। গাধা একটা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মনের সুখে ভিজল। একসময় বৃষ্টি কমে এল। তখন আবার হাঁটা শুরু।
কিছুক্ষণ পরেই সিংহর গুহাটা দেখা গেল। শেয়ালদের তারিফ করতেই হয়! এত পুরনো গুহাটাকেও কিন্তু তারা খুব যত্ন নিয়ে সাজিয়েছে। গুহার মুখে কি সুন্দর একটা পর্দা! ওপর থেকে ফেন সুইয়ের ক্ষুদে মূর্তি ঝুলছে। ভেতর থেকে রেডিওয় কি একটা গান চলছে! আর মাঝে মাঝে সিংহ তার হেঁড়ে গলায় সুর মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তার মানে সিংহ এখনও ঘুমায়নি। তাহলে কি সিংহের ঘুমের জন্য অপেক্ষা করবে সে?
কিছুক্ষণ দোনামনা করে গাধা মনে কিছুটা সাহস আনল। তারপর গটগট করে গুহার মধ্যে ঢুকে এল। গাধার পায়ের শব্দ পেয়েই সিংহরাজা উঠে বসেছে। ‘কে রে ব্যাটা না বলে আমার ঘরে ঢুকলি!’
গাধা দেখল সিংহ ভুরু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে তাকে দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ঠিকমত বুঝতে পারছে না। কনফিডেন্স পেয়ে গাধা তখন বলল- ‘আমি বাঘের বাচ্চা। বাবা আমাকে পাঠিয়েছে তার সাধের লাল কলমটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।’
‘আই সি…’ সিংহ এবার গাধার একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে দেখার চেষ্টা করছে। তারপর এক গাল হেসে বলল, ‘তাই তো! আমার প্রিয় বন্ধুর ব্যাটাই তো বটে!’
গাধা আরও কনফিডেন্স পেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, রাজামশাই। আপনার প্রিয় বন্ধুর ছেলে। বাবার শরীরটা একটু খারাপ তাই নিজে আসতে পারল না… আপনাকে অনেক সেলাম পাঠিয়েছেন।’
গাধার কথা শেষ হতে না হতেই গাধার লম্বা গালে সিংহ এক থাপ্পড় মেরে বসল। যে সে থাপ্পড় নয়, সিংহের প্রকান্ড থাবার চড় যে খেয়েছে সে সারাজীবনে ভুলতে পারবে না। পলকা গাধা তো একেবারে ছিটকে গিয়ে পড়েছে গুহার কোণে। তারপরই হাত জড়ো করে কেঁদে উঠেছে- ‘আমার কোন দোষ নেই রাজামশাই, আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন।’
সিংহ কাছে এসে বলে- ‘শোন বোকা, রয়াল বেঙ্গল টাইগার কখনও সিংহকে সেলাম দেয় না, বুঝলি? আর তারা কখনও ক্ষুরজুতোও পরে না। ক্ষুরজুতোর শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়। আমি না হয় চোখে কম দেখি। তাই বলে কি ভেবেছিস কানেও কম শুনি? ছি ছি, এটুকু হোম ওয়ার্ক করে আসা উচিৎ ছিল। তার থেকেও বড় ভুল- বাঘের গায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ! নেশা করে এসছিস নাকি?’
তখন গাধার মনে পড়ল লালহাতির কথা। জল লাগলে এসব রঙ যে অনেকটা বদলে যেতে পারে! গাধার পিঠের হলুদ রঙ বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে গেছে সাদা! কিন্তু লালহাতি তো নদীতে স্নান করতে বারণ করেছিল, বৃষ্টিতে ভিজতে তো বারণ করেনি! হায় রে! বেচারি গাধা এখন কি করবে! সিংহরাজা তো তাকে নিশ্চয়ই ঘাড় মটকে খাবার প্ল্যান করছে! নাঃ, প্রাণে বাঁচতে গেলে এখন সিংহরাজাকে খুশি করতেই হবে কোনওভাবে।
তাই আরেকটা চড় খাওয়ার আগেই গাধা পড়িমড়ি করে বলে উঠল- ‘রাজামশাই আপনার চোখের ব্যামো সারানোর উপায় আমি জানি!’
সিংহ চোখ পাকিয়ে বলল ‘বটে?’
‘হ্যাঁ মহারাজ, অশ্রু নদীর তীরে তালগাছের মাথায় যে বকপাখি থাকে সেই আপনার চোখের ছানি তুলে দিতে পারে।’
সিংহ বলল- ‘তাহলে আমাকে নিয়ে চল।’
সিংহকে নিয়ে গাধা হাঁটতে হাঁটতে অশ্রু নদীর তীরে পৌছে গেল। বক পাখি তখন এক পা তুলে ধ্যান করছে! তাকে বিরক্ত না করে গাধা আর সিংহ দুজনে অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর বকপাখির ধ্যান ভাঙলে গাধা বলল- ‘বকপাখি বকপাখি তুমি যেভাবে নদী থেকে মাছ তুলে এনেছিলে সেভাবে রাজামশায়ের চোখ থেকে ছানিখানি তুলে দাও না!’
বকপাখি হেসে বলল, ‘এ আবার কঠিন কাজ কি?’ বলে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে মুহূর্তেই সিংহ’র চোখ থেকে ছানি তুলে আনল। সাথে সাথে সিংহ আবার সব আগের মতো পরিষ্কার দেখতে পেল! নীল জলের অশ্রুনদী, সবুজ বড় বড় গাছ, আকাশ, মেঘ- এতদিন পরে এসব আবার দেখে সিংহ খুশিতে নাচতে লাগল।
কিন্তু লাল কালির পেনটা যে গাধার নেওয়া হল না! সে আর নেওয়ার দরকারই বা কি? সিংহরাজার যখন চোখ ভালো হয়ে গেছে তখন তিনিই আবার সব কাজ করতে পারবেন। শেয়ালদের আর রাজা সেজে হুকুম দিতে হবে না! কিন্তু এসব ভেবেও গাধার মনে আনন্দ হল না। কি করে হবে? এখন তো তাকে আবার সেই বনে ফিরে যেতে হবে, আবার সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করবে! সেইসব কথা ভেবে গাধার চোখে জল এসে গেল।
গাধার চোখে জল দেখে সিংহরাজা জিজ্ঞেস করলেন ‘কিরে তোর মন খারাপ নাকি রে? কি হয়েছে খুলে বল তো আমাকে।’
গাধা বলল- ‘রাজামশাই, আমি সোজা সরল গাধা বলে সবাই আমাকে নিয়ে তামাশা করে। বোকা গাধা, হদ্দবোকা বলে ডাকে। আমার যে কি কষ্ট হয়…’
এটুকু শুনে সিংহ অবাক হয়ে বললেন, ‘ও তুই কি গাধা নাকি রে? গায়ে এমন রঙ করেছিস যে তোকে চেনাই যাচ্ছে না! আমি তো ভাবলুম তুই বোধহয় অন্য বনের পশু।’
সিংহ’র কথা শুনে গাধা ভাবল আরে! আমাকে গাধা বলে চিনতে না পারলেই তো আর কোন সমস্যা থাকবে না! কেউ আমাকে বোকা গাধা বলে খ্যাপাবে না! কিন্তু এখন তাহলে তার নাম কি হবে? ভাবতে ভাবতে গাধার মনে পড়ে গেল লালহাতির গল্প। জীব্রাগড় থেকে কিনে আনা আজব রঙ- এই রঙ মেখেই তো তাকে অন্যরকম দেখতে হয়ে গেল! সেসব কথা ভেবে গাধা নিজের নতুন নাম ঠিক করে ফেলল। বনে গিয়ে যেই তাকে দেখে অবাক হয়, যেই তার সাদা-কালো ডোরা কাটা শরীরের দিকে চেয়ে নাম জানতে চায়, সে মুখখানা খুব গম্ভীর করে বলে- ‘আমার নাম জেব্রা’। জেব্রা যে আসলে তাদেরই সেই পরিচিত গাধা সেকথা কেউ বুঝতেই পারল না। শুধু এক শেয়াল পণ্ডিতের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ উঁকি দিতে লাগল। রাগে তার দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল, হাত নিশপিশ করতে লাগল। কিন্তু রাগ হলেই তো হল না! সারা বনের পশুপাখি এখন জেব্রাকে খুব খাতির করে। শেয়ালের চেয়েও তার আদর, সম্মান বেশি। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চারিদিকে পশুপাখি সরে যায়, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকে- ‘কি সুন্দর দেখতে, দ্যাখ, একদম যেন রাজপুত্তুর!’ এমনকি সিংহরাজাও আজকাল জেব্রাকে দুচোখের মণি করে রেখেছে। এসব দেখে হিংসেয় শেয়ালের ঘুম হয় না। সে নতুন একটা ফন্দি বাঁধতে থাকে। সেই দুষ্টু ফন্দির গল্পও ভারি মজার, সে গল্পও তোমাদের শোনাবো। আজ না, আরেক দিন।
প্রচ্ছদঃ রেশমী পাল
*****