সবুজ অন্ধকার, সাদা টিউবলাইটে জ্বলে আছে, স্বচ্ছ কালো জলে। আসলে সবুজ নেট আর কাঁচপোকা, ভনভনে কাঁচপোকা, উড়ন্ত মাছের মতো ফ্যাটফ্যাটে টিউবলাইটের আলোয় ধাক্কা মারছে। টিউবলাইটের সরলরৈখিক আলোর দাগ, যা তুমি বোজা চোখেও দেখে থাকো, হেলে সাপের মতো কিলবিল করছে; আশ্রয় দিয়েছে স্বচ্ছ ও গভীর আস্তরণ, যেখানে বায়ুও জলকণা রূপে আছে।
এই একটা মাছ ডিম পাড়ল! এই একটা মাছ জন্ম দিল কয়েকশ’ ঘুমিয়ে থাকা ভ্রূণের! ঘুমানো ভ্রূণেরও কি চোখ খোলা থাকে?
-আমরা মাছের স্বপ্ন দ্যাখি না আর। আর কি বলছি! কোনো কালেই দ্যাখি না। চোখ খুললেই যা দ্যাখতে পাবো, তা স্বপ্নে আসে না কি! এমনটা হয় না কি! তুমিই বলো, স্বপ্নে ক’বার তোমার বাড়ি দ্যাখেছো? তোমার বাড়ির মতো করে তোমার বাড়িটাকে দ্যাখেছো? দ্যাখেছো? তা’লে তুমি অন্য কোথাও থাকো। এ হতেই পারে না!
-অন্য কোথাও থাকি।
-তবে? আমার চোখ দ্যাখেছো? আমার চোখ দ্যাখো। ঘুনসির চোখ দ্যাখো। কড়ুয়ারও দ্যাখতে পারো। তবে ও মারতে পারে। তোমাদের চোখ ভালো না। কড়ুয়ার দিকে তাকাতে জানো নি এখনো।
-জানি নি এখনো?
-নাঃ। দ্যাখবে? তাকাও। এই কড়ুয়া, এদিকে দ্যাখ। তাকাও, তাকাও। দ্যাখলে? পারলে না। মেয়েমানুষকে দ্যাখতে শ্যাখো নি। আমি দ্যাখি।
-কোথায়?
-স্বপ্নে! স্বপ্নে মাছ দ্যাখবো কোন দুঃখে! সে তো কলাপাতায় দ্যাখি। আমরা মেয়েমানুষের স্বপ্ন দ্যাখি। মেয়েমানুষেরা চাঁদের স্বপ্ন দ্যাখে, ফলপাকুড়ের স্বপ্ন দ্যাখে। তাই না কড়ুয়া! তাই না, ঘুনসি!
–
-শামলা নাকি অল্প অল্প ভাতও দ্যাখেছিল। ভাতের সাথে লাউপাতা বাটা। এই অ্যাত্তোটা ভাতের সাথে অ্যাত্তোটা লাউপাতা বাটা। খয়েরী রঙের ভাত। কোত্থেকে জুটিয়ে ছিল কে জানে! তবে মিথ্যেও বলতে পারে। বিড়ি-গাঁজা খায়। লাউপাতা ওর ঠাকুদ্দাও কোনো জন্মে দ্যাখে নি।
–
-জন্মান্তর আমি দ্যাখেছি। কই থেকে তেলাপিয়া, তোমরা বলো নাইলনটিকা। ওই জল আর পানি। সবুজ আর হলুদ। কই থেকে তেলাপিয়া, তারপর হলো গিয়ে, চিংড়ি থেকে খলসে। আবার চিংড়ি থেকে বাসক পাতার গাছও হতে দ্যাখেছি। সে অনেক কর্ম লাগে তার জন্য। এখানে না। আগে। এখানে চিংড়ি পাবে না।
–
-কতো আগে মনে নেই। বাবু, তুমি বড্ডো বকাও!
সবুজ অন্ধকারে, জমাট শ্যাওলার মতো সবুজ অন্ধকারে ম্যাচিস জ্বলল। নিভেও গেল। বেবাক হাওয়া দিল উত্তর দিক থেকে। নিভে গেল তাই। সবুজ অন্ধকারে, পানের পাতার মতো, শামুকের মতো গুটিয়ে আনা দু’হাতের পাতায় ম্যাচিস জ্বলল এবার। দপ্ করে জ্বললেই, দপ্ করে নিভতে নেই। দপ্ করে জ্বলে, রইল কিছুক্ষণ। আকাশে কয়েকটা তারা ফুটছে সন্তর্পণে। তাই জ্বলে রইল বেশ কিছু মূহূর্ত।
বিড়ির আগুন জ্বলা মুখ। একটু অন্যমনস্কতা নিভিয়ে না দিলেও আঁচ কমিয়ে দেয়। অনেকটা। কলাবনে জোনাকিরা বলল, টরে টক্কা টরে টক্কা। বিড়ির আগুন বলে, টক্কা টক্কা টরে টরে। মহাজাগতিক মর্স কোডে আরো কিছু শীতল নক্ষত্র ফুটে ওঠে। আমাদের মাথার উপর। মৃত্যুও তালে আলো ছড়ায়! হয়তো পাঠিয়ে দেয় মর্স কোড শুনে। হয়তো আলো পাঠিয়ে দেয়, অন্যত্র। মাছেদের ভ্রূণেরা কি জানে, পড়ন্ত অঘ্রাণে শস্য কাটার মতো মায়ের পেট চিরে তাদেরও বের করা হবে, একদিন?
-তোমাদের কষ্ট কি? কষ্টগুলো কি? কি কি?
-আছে। বলবো ক্যানো? রাগও আছে। মন খারাপও আছে। বলবো ক্যানো?
–
-কড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করো। ঘুনসিকে জিজ্ঞেস করো। ওদের এসবে এখনও শখ আছে।
-শখ?
-হ্যাঁ বাবু। আমারও ছিল। ওদের জিজ্ঞেস করো। বিলালকে জিজ্ঞেস করো। বিলাল ওদের দোস্ত। বিলাল কড়ুয়াকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়।
-নিকা করতে চায়।
-নিকা বললে কেনো কড়ুয়া?
-বিলাল নিকা বলে যে। আমার বেশ লাগে বলতে। নিকা, নিকা, নিকা।
–
–
-তুমি বিলালকে নিকা করবে?
-না তো! বিলাল বলেছে নিকা করবে।
-নিকা কিভাবে হয় জানো?
-বই পড়ে। বিলাল বলে নিকা বই পড়ে হয়। জগন্নাথদা বলে বিয়ে বই পড়ে হয়। আমি বই পড়তে জানি না। বিলাল বলে অন্যের পড়া বই কবুল করতে হয়। জগন্নাথদা বলে অন্যের পড়া বই শুনে শুনে বলতে হয়।
–
-অন্যের পড়া বই ভাল্লাগে না কি!
-বই পড়তে জানো? নিজে?
-না তো। বললাম যে! ঘুনসি, জানিস? -ঘুনসিও জানে না।
-ঘুনসিকে ভালো লাগে?
-হ্যাঁ।
-ঘুনসি?
-হ্যাঁ।
-তোমরা বিয়ে করে নাও না কেনো?
-জগন্নাথদা বিয়ে করতে বলে।
-বেশ। তাহলে নিকা করতে পারো।
-বিলাল নিকা করতে বলে। রোজ রোজ আতর মেখে আসে।
-তাহলে কি করবে?
-থাকবো। বোঙা জানে। বোঙা বলেছে একসাথে থাকলে মাছের পেটে ডিম আসে। তাই না বোঙা?
-বোঙা, বিয়ে করেছিলে?
-নাঃ।
-নিকা?
-নাঃ।
-কেনো?
-বলব ক্যানো?
বাঁশবন তখন মড়মড়িয়ে ওঠে। বাঁশবনে তখন মড়্মড়্ মড়্মড়্ শব্দ হয়। বাঁশবনে বাঁশগাছ আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শোয়। উঠে বসে। কেউ কেউ উঠে বসে। আজ চাঁদ ওঠবার রাত নয়। কুকুরেরা ডাকে। হু হু করে শেয়ালেরা ডাকে। কুকুরেরা ডাকে মুখ তুলে। আজ চাঁদ ওঠবার রাত নয়। তাদের বলে দিতে ভুলে গেছে কেউ। কুকুরেরা প্রেমিকা হয়। কুকুরেরা প্রেমিক হয়। তাই তারা মুখ তুলে জানান দেয়। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় নিজেদের কাছে। কারণ এমন রাতে ছায়া পড়ে না। আজ রাতে চাঁদ ওঠে নি। ঘাস আর বাঁজা মাটিতে ছায়া পড়ে না তাই। বাকিটুকু আতপ চালের গন্ধে ভরে গেছে। বোঙা বলে ওটা ভামবিড়ালের গন্ধ। ভামবিড়াল আর খটাস কি এক? বলব ক্যানো?
কড়ুয়া বলে কোনো এক সময়, যখন হামা দিতে শিখেছে সে সদ্য, ভামবিড়াল বা খটাস তার এক কান খুবলে নিয়ে চলে গেছিল। সে মাথাটাকে বাঁয়ে ঘোরায়। ছুঁয়ে দেখে লতিতে পেতলের মাকড়ি। সে মাথাটাকে ডাঁয়ে ঘোরায়। ছুঁয়ে দেখে লতিতে রঙ জ্বলা মাকড়ি। তবে বোধহয় কড়ুয়ার ভাইটাকে নিয়ে গেছিল খটাস বা ভামবিড়াল। পুরোটা নিয়ে গেছিল। কিচ্ছু রেখে যায় নি। তাই কি মা রোজ নাকের নীচে গোঁফ এঁকে দিত? চুল কেটে দিত গুঁড়ি গুঁড়ি করে? মা’কে তো পাগলি বলতো সবাই। মা নাকি বাবাকে রমণসুখ দিতে পারে নি। বাবা নাকি মা’কে সংসারসুখ দিতে পারে নি। হয়তো তাই ভামবিড়াল বা খটাস ভাইয়ের কানের লতি ধরে টেনে নিয়ে গেছিল আকন্দের ঝোপে। আর বোঙা তার বিশাল কাঁধে, যা এখন অনেক অনেক অনেক শীর্ণ, বসিয়ে নিয়েছিল কড়ুয়ার পাছা মায় গোটা শরীর। হয়তো তারা অসুখের সন্তান।
এই মূহূর্তে হাই তুলল ঘুনসি। তার ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পেলে তার খিদে থাকে না। ঘুম পেলে সে যৌনতা ভুলে যায়। ঘুম তাকে অবশ করে তোলে, কারণ নড়াচড়া করলে বিলালের ঘাড় ও বগল থেকে আতরের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে মাচার আনাচে কানাচে। বুক চিতিয়ে শোয়া বিলালের অভ্যাসে নেই। সে কুঁকড়ে শুতে চায়। তাই মাচা তার প্রিয়। ছোটো মাচা। যেখানে বুক চিতোলে, পা বেরিয়ে থাকবে তোমার। সেই পা বেয়ে উঠে আসতে পারে চিতি সাপ, বা কেঁচো, বা মাছেদের প্রেত। কেঁচো এসে ঢুকে যায় নখে, লেগে থাকা মাটি খুঁড়ে, নখে ঢুকে যায়। বিলালের এই কুঁকড়ে শোয়া, তাকে রক্ষা করে। তার নিঃশ্বাস এসে পড়ে আমার নাকে। অথচ আমিও আতরের গন্ধ পাই। অথচ আমিও বুঝতে পারি, বিলাল আমাদের বন্ধু। কিন্তু তাকে নিকা করতে মন চায় না। এইসময় কড়ুয়ার দিকে তাকানো যেত। মারত না সে। এখন অন্ধকার। বিলাল তার নিজেরই আতরের গন্ধে উস্খুস্ করে।
-আপনার কথা বলুন ভাই! কি বুঝছেন?
-ধরতে পারছি না।
-সে আপনার মাচায় ওঠা দেখেই বুঝেছি।
-কড়ুয়া তোমাকে নিকা করতে চায় না।
-জানি। আপনার কথা বলুন ভাই।
-ধরতে পারছি না।
-দেখতে পারছেন না আসলে।
-দেখছি তো!
-সে তো যা দেখতে চাইছেন, সেটা।
-তাই হবে।
-ল্যাখাপড়া না করে আসলে দ্যাখতে পাওয়া যায় না।
-বোঙা, তুমি ঘুমোও নি!
-তুমি বোঙা বলছো ক্যানো বাবু? ও তো তোমার দ্যাওয়া নাম নয়।
-তাহলে?
-তা’লে কি? ল্যাখাপড়া করে আসা উচিত ছিল তোমার।
-রাগ করেছো?
-না তো! রাগ করি নি তো। অভিমানও করি নি। কষ্টও পাই নি। তোমাকে দ্যাখতে পারছি।
-তোমার গলাটা অন্যরকম লাগছে।
-সত্যি বলছি যে! সত্যি বললে অমন শোনায়। খোঁজখবর না নিয়ে, ল্যাখাপড়া না করে আসলে, ধরতে পারা যায় না। বিলালকে জিজ্ঞেস করো। বিলাল আমাদের দোস্ত।
–
-বোঙা ঠিক বলছে ভাই। ও আপনি এখনই পারবেন না।
-তাহলে?
-পেঁচা ডাকছে শুনতে পারছেন? একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছে গিয়ে বসল। ফ্যাট্ ফ্যাট্ করে উড়তে উড়তে গিয়ে বসল। আবার ডাকল। এই নিয়ে তিন বার।
-হ্যাঁ। পাচ্ছি।
-পাচ্ছেন না। ও আমার মনের পেঁচা। বানিয়ে বললাম। এখানে কোনো পেঁচা নেই। আগে, থেকে থাকতে পারে। এখন নেই। তিতিরও নেই, বটেরও নেই, মাছরাঙাও নেই। হাঁস আছে। সকালে দেখেছেন। পায়রা আছে। ভোরে দেখবেন।
–
-চুপ মেরে গেলেন যে ভাই!
-কি বলবো?
-যা প্রাণে চায় বলুন। ভুল বলুন। বলতে থাকুন। মাছেরা তো ডিম মুখে নিয়েই ঘোরে। ঘোলা জলে দেখবেন কি করে?
-কড়ুয়া আপনাকে নিকা করতে চায় না কেনো বিলালভাই?
-কড়ুয়া যে আমাকে দেখে ফেলেছে। কিন্তু তারও আগে, সে যে ঘুনসিকেও দেখে ফেলেছে। ঘুনসিকে দেখে ফেললে, আমাকে নিকা করতে চাওয়া যায় না ভাই।
–
-চিন্তা করবেন না ভাই। এরকম সবারই হয়। কান পাতুন। শুনতে পাবেন। দেখতেও পাবেন।
-কি শুনতে পাবো?
-সেটা তো আমি বলতে পারবো না। সে খোঁজ কি আমি রেখেছি!
-বিলালভাই, তুমি দার্শনিক?
-হ্যাঁ ভাই। ওইজন্যেই তো বুক চিতিয়ে শুতে পারি না।
মহাজাগতিক মর্স কোডে আরো কিছু শীতল নক্ষত্র ফুটে ওঠে। আমাদের মাথার উপর। মৃত্যুও তালে আলো ছড়ায়! হয়তো পাঠিয়ে দেয় মর্স কোড শুনে। হয়তো আলো পাঠিয়ে দেয়, অন্যত্র। মাছেদের ভ্রূণেরা কি জানে, পড়ন্ত অঘ্রাণে শস্য কাটার মতো মায়ের পেট চিরে তাদেরও বের করা হবে, একদিন?..
এখানে, ঝোপে ঝাড়ে, আড়ে আড়ে, শীত জমেছে। এখানে ঝোপে ঝাড়ে, বিকেল থেকেই শীত জমে। সন্ধে হলে জমাট বাঁধে। লোকে মুড়ি খায়, লবণাক্ত জল পান করে। উঁচু উঁচু নারকোল গাছের মাথা থেকে, বাতাস নেমে আসে। উঁচু উঁচু নারকোল গাছের শরীর বেয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়। বাহিত হয় বোঙা বা একটা অত্যন্ত শীর্ণ লোকের পাঁজরার মধ্যে দিয়ে। লোকটা কেঁপে ওঠে। কখনো ওঠে না। বাতাস বাসরাস্তার দিকে চলে যায়।
তখন লোকেরা এখানে মুড়ি খায়। কচ্কচ্ করে শশা চিবোয়। মচ্মচ্ করে এক ফালি নারকোল। আবার এক থাবা মুড়ি। তখন লোকেরা ভাবে, আসছে পরবের দিন মুড়ি আর আলুর তরকারি জম্পেশ করে মেখে, কাঁচালঙ্কা সহযোগে খাওয়া যাবে। কি বলেন দাদা? কাঁচালঙ্কা চলে তো আপনার? তারপর দুই গ্লাস জল? এই সব সময়, দিবাস্বপ্নের বেলায়, বাতাসও থমকে দাঁড়িয়ে যায় কখনো। কান পাতে ফিসফিস স্বরে। তারপর বাসরাস্তার দিকে চলে যায়।
লোক বলতে এই ক’জনই। কখনো বিলাল আসে। কখনো জগন্নাথ আসে। জগন্নাথের পানের বরজ আছে। অথবা তার বন্ধুর আছে। সেখানে সে টাকা খাটায়। জগন্নাথ তার পানের বরজের হদিস কাউকেই বলে না। জিজ্ঞেস করলে ঠোঁট দুটো ছুঁচোলো হয়ে যায় তার। কেনো স্যার? কিনবেন? টাকা লাগাবেন নাকি? ভালো রেট চলছে। আপনার ছপ্পর ফুঁড়ে ধাঁ হয়ে যাবে। ছপ্পর ফুঁড়ে ধাঁ বলার সময়, ছোপ লাগা দাঁতগুলো লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে জগন্নাথ। কড়ুয়া একবার বিয়ে করে নিলে, ওরও ছপ্পর ফুঁড়ে ধাঁ হয়ে যাবে। গোটা বরজটাই ওর নামে লিখে দেবো। বা আরেকটা বরজ কিনবো নিজের জন্য। এইসময় তার গুলিয়ে যায় বরজটা তার, না বন্ধুর!
কড়ুয়া হাসতে শুরু করে। কড়ুয়া হাসতে থাকে, হাসতে থাকে, হাসতে থাকে। জগন্নাথও হাসতে শুরু করে। এখন আর সে ছোপ লাগা দাঁতগুলো লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে না। এখন সে ঠাকুরপুকুরের জগু হয়ে যায়। যাকে ল্যাংটো করে পাড়ার মধ্যে হাঁটিয়েছিল, ছোটবেলায়, গোটা পাড়ায় হাঁটিয়েছিল ক্লাবের দাদারা। কারণ সে তিনটে ক্যারমের গুটি, যার মধ্যে একটার রং লাল, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল হাইড্রেনে।
-ঘুনসি, তোমার নাম ঘুনসি কেনো?
-সবাই ডাকে।
-কে রেখেছিলো?
-বাবা বোধহয়।
–
–
-ঘুনসি মানে জানো?
-হ্যাঁ।
-কি?
-আমি।
-বাচ্চাদের কোমরে তাবিজ বেঁধে দেয় মানুষ। নজর লাগার ভয়ে। তাকে ঘুনসি বলে। জানতে না?
-আমাদের কোমরে বাঁধত না কিছু। পুকুরে চান করে গামছা বেঁধে মাঠে যেতাম।
-তারপর?
-বাবা বলতো, কাস্তেটা দে ঘুনসি। দিতাম। বাবা বলত, পঙ্গপাল আসবে।
-তারপর?
-পঙ্গপাল আসত। আমরা গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাড়াতাম। তখন কোমরে কিছু থাকত না।
-তারপর?
-বোঙা ঠিক বলে। তুমি বড্ড বকাও।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। এটা কি করছো?
-কড়ুয়া পলো দিয়েছিলো রাতে। দেখো, কেমন খলবল করছে। পুঁটি খাবে আজ? কয়েকটা লটে পড়লে হত।
পলোটা কি হাতে বোনা? মাছেদের অশরীরী পাক খাচ্ছে পাশে। ঘুনসির হাত জুড়ে থিকথিকে কাদা। লেগে আছে আঁশ। ভোরের নিবু নিবু অন্ধকার কুয়াশা ছড়াচ্ছে। কুয়াশার রঙ কুয়াশার মতো সাদা। খাদহীন। ভোরের নিবু নিবু অন্ধকার তির্যক হয়ে পড়ছে আবাসভূমিতে। অর্থহীন ভাবে জলের উপর এলিয়ে দিয়েছে গা। তলিয়ে যাচ্ছে কি? কলাবন থেকে দুটো পায়রা উড়ে এসে, আবার গিয়ে বসল কলাবনে। এরই নাম উড়ে যাওয়া।
-জানি। মৎস্যকন্যা।
-মারমেড কি জানো?
-পায়ের বদলে লেজ। কনুই দুটো পাড়ে ভর দিয়ে রাখে। জানি। মৎস্যকন্যা। তবে ওসব আমি দ্যাখি নি।
-আচ্ছা।
-ওসব সত্যি হয় না। ওগুলো তোমরা বানাতে ভালোবাসো।
–
-তবে লাবুকে দ্যাখাতে পারি। লাবুকে তিনটে লোক মেরে টাঙিয়ে দিয়েছিল বাঁশবনে। লাবুকে তিনটে লোক, তাদের নাম বলে যাবো কোনোদিন, খুন করেছিল। তারও আগে ভোগ করেছিল। তারও আগে তুলে নিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে। বোস্ কড়ুয়া। লাবুকে দ্যাখাবো একে। এও দ্যাখুক।
-কেনো দেখাবে?
-দ্যাখুক দ্যাখুক। দ্যাখা দরকার। বাবু সাঁতার জানো?
-অল্প সল্প।
-ওতেই হবে। আমি নিয়ে নামবো। চিন্তা নেই।
-এখানে?
-ওদিকে। ওদিকের জলে আমরা চাষ করি না। লাবুকে ওখানে পাবে। বাবু তুমি ভয় পাবে না তো?
–
-অবশ্য ভয় পেলে লাবু দ্যাখা দেয় না। লাবুরও তো ভয় আছে। কবে যাবে, কে জানে!
পায়রা দুটো উড়তে উড়তে আবার কলাবনে গিয়ে বসল। একেই উড়ে যাওয়া বলে। ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হল। ঠং ঠং বৃষ্টি, পট্ পট্ বৃষ্টি। বৃষ্টির রং, বৃষ্টির শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, বৃষ্টির রং, এতটাই স্বচ্ছ, আর সব কিছু অস্বচ্ছ করে দেয়, দেখতে দেয় না; বৃষ্টির রং, বৃষ্টির শব্দ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে কড়ুয়া। পালং শাক কাটতে কাটতে কড়ুয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। বঁটি আলগোছে ছুঁয়ে রাখা পালং শাক, বঁটিরও অভিমান হয়, ভোঁতা ধার নিয়ে তারও কি ইচ্ছে করে না কড়ুয়ার আঙুল কেটে টপটপিয়ে রক্ত ঝরুক? কড়ুয়া ঘুমিয়ে পড়েছে গো! এখন পালং শাক কে কাটবে গো? অ্যাই কড়ুয়া, উঠে পড়্! বাদলার দিনে কার স্বপ্ন দেখিস? কার স্বপ্ন দেখিস রে!
ঘুনসি মাছ কোটে। পুঁটি মাছ। পলোতে পাওয়া। ঘুনসি ছুরি নিয়ে বসা। ছুরি নয়। ছোটো কাটারি। ঘুনসি এক পায়ে ভর দিয়ে দ’ হয়ে বসা। থুতনি হাঁটুতে ঠেকানো, চোখ কাটারিতে। নাকি মাছে? নাকি আঙুলের ডগায়? ঘুনসি ধড় আর মাথা আলাদা করছে। মাথা দিয়ে আলাদা চচ্চড়ি হবে। ধড় দিয়ে আলাদা চচ্চড়ি হবে। ঘুনসি খট্ খট্ খট্ খট্ আওয়াজ তুলে মাথাগুলো আলাদা করছে ধড় থেকে। ধড়গুলো জমাচ্ছে ডাঁয়ের কলাপাতায়। মাথাগুলো ডান পায়ের বুড়ো আর কনে আঙুলের সামনে, থেকে থেকে জড়ো হচ্ছে। ঘুনসি, তোমার মায়ের দিকে, কেউ তাঁত চালাতো? তোমার কপালে রক্তের ছিটে লেগে আছে। তুমি একটু আগে দু’বার, পরপর দু’বার ঘাম মুছেছিলে।
অ্যাই কড়ুয়া, উঠে পড় রে! তোর পালং শাক হেদিয়ে গেল যে! চান করবি না? চুল বাঁধবি না? আজ পরবের দিন। আজ পুঁটি মাছের চচ্চড়ি হবে। আজ বাসরাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে জগন্নাথ আসবে। আজ বিলাল আতরের সাথে চোখে লাগাবে সুর্মা। আজ জগন্নাথ কালো জাম আনবে বড়ো বড়ো। কি মিষ্টি! কি মিষ্টি! উঠে পড়। ঘুনসির মাছ কোটা তো হয়ে এলো রে! পালং শাক কেটে ফ্যাল। ঘুনসিকে বল্ কলাপাতা আনতে। কালো জাম রাখা যাবে তাতে। কচি কলাপাতা, কচি কলাপাতার মতো সবুজ কলাপাতা, সেখানে কুচকুচে কালো জাম, তার নীল রস, তোরা পাড়ে বসে খাবি, কড়ুয়া আর ঘুনসি পাড়ে বসে খাবে, ঘুনসি পা দোলাবে, কড়ুয়া হি হি করে হেসে ফেলবে, পিছনে কলাবিবি হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে, তার মাথায় ঘোমটা, তার হাতির শুঁড়ের মতো হাত, প্রত্যাশায়, মেলে দাঁড়িয়ে থাকবে।
-ডাকিস নি কেনো রে?
-অ্যাত্তো ঘুম তুইই ঘুমাতে পারিস। জিজ্ঞেস কর্। ডেকে ডেকে সারা।
-আলসেমি লাগছে। আলসেতে বসে আলসেমি লাগছে।
-আলসে মানে?
-এই যে, যেখানে বসে আছি।
–
-জগন্নাথদা বলেছে। তাই না? আলসেতে বসে আছি। তাই না? আলসে আলসে আলসে।
-তুমি চৌকাঠে বসে আছো কড়ুয়া। আলসে জানলায় থাকে। কার্নিস ছাদে হয়।
-আমি চৌকাঠে বসে আছি। চৌকাঠ চৌকাঠ চৌকাঠ। নাঃ। আমার আলসেই ভালো। আলসে আলসে আলসে।
-স্টোভ জ্বালছি।
-জ্বাল্। চান করে আসি। শাকটা কাটছি এসে। তুমি চান করেছো? বাবু, তুমি চান করেছো?
-আমাকে বাবু বোলো না কড়ুয়া। ওটা শুধু বোঙা বলে।
-তুমি চান করেছো? মগ, তারপর হল গিয়ে বালতি, তারপর হল গিয়ে গামছা, কেউ দিয়েছে তোমাকে?
-আছে। আছে সেসব আমার। কিন্তু সাঁতার শিখতে হবে। সাঁতার না শিখলে মান যাবে। বোঙা বলেছে। সাঁতার ঝালাতে হবে। প্র্যাকটিস করে নেবো বাটারফ্লাই স্ট্রোক। নইলে দেখার চোখ, কিভাবে তৈরী হবে! বোঙা বলেছে।
-সকালে করতে হয় সেসব। আর তুমি এত বেলা করে নিলে? তখন তো গুলতানি দিলে। তখন তো বসেছিলে চুপ করে। সকালে করবে’খন এসব। এখন ঝপাঝপ চান করে এসো। কলাপাতা নিয়ে এসো গোটা চার-পাঁচ।
-আমার তো কাটারি নেই!
-লাগবে না। টান দিলে ভেঙে যাবে। একটু খাটাও গতর। বসে বসে খেলে, চলে নাকি!
তবে বোধহয় কড়ুয়ার ভাইটাকে নিয়ে গেছিল খটাস বা ভামবিড়াল। পুরোটা নিয়ে গেছিল। কিচ্ছু রেখে যায় নি। তাই কি মা রোজ নাকের নীচে গোঁফ এঁকে দিত? চুল কেটে দিত গুঁড়ি গুঁড়ি করে? মা’কে তো পাগলি বলতো সবাই। মা নাকি বাবাকে রমণসুখ দিতে পারে নি।..
বুদ্বুদ, জলে বুদ্বুদ ফাটছে, ফাটছে, ফাটছে, মগের জলে, পুকুরের জলে। বাঁশে তেলের ছাপ অবিন্যস্ত। বাঁশের ধাপে, তিনটি ধাপের মধ্যে সর্বশেষ যেটি, আবার ধাপ না বলে সিঁড়িও বলা চলে, স্নান করার চিহ্নস্বরুপ, বাঁশের সিঁড়ির শেষ ধাপটিতে তেলের ছাপ সুস্পষ্ট। নারকোল তেলের ছাপ। অনেকের হাতে লেগে লেগে, অনেকের হাতে লাগা নারকোল তেল; অসংখ্য হাতের ছাপ ধারণ করেছে বাঁশটি। তার সামনে বুড়বুড়ি উঠছে। পুকুরের জলে। মগের জলে বুদ্বুদ ভাসছে। পুকুরের জলে বুড়বুড়ি উঠছে।
মা মাছ, ছানা মাছ, মুখ খুলেই বন্ধ করছে। বাবা মাছ এঁকেবেঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে উদাসীন। মা মাছ গুঁজে দিচ্ছে কেঁচো, কেন্নো, শ্যাওলা; গুগলির রস। মা মাছ গুঁজে দিচ্ছে ছানা মাছেদের মুখে। ছানা মাছেদের পেট মোটা। তারা আরো দাও আরো দাও বলে। পুকুরের নীচে শৈবাল, সবুজ শৈবাল থমথম করছে। এ পুকুর রুই কাতলের নয়। এ পুকুর আড় বোয়ালের নয়। তারা ওই দিকে থাকে। ওই পুকুরে থাকে। বাসরাস্তা থেকে আরো গভীরে। সেখানে ছায়া ঘনতর। সেখানে বেলা পড়লেই অন্ধকার নামে, ঝুপো ঝুপো অন্ধকার নামে। এ পুকুর সরল অনেক।
জল মগে তুলে নিলে থম কেটে যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি পোকা, অথবা ক্ষুদ্রতর মাছ, ঘাই মারে জলে, লাল মগে তুলে নেওয়া জলে। ঘুনসি বলে তার ওঠে সাপের বাচ্চা। এই অ্যাত্তোটুকুন। কেন্নোর বাচ্চার সঙ্গে গুলিয়ো না যেনো! কেন্নোর বাচ্চা অনেক ধীরে কিলবিল করে। সাপের বাচ্চাগুলোর খালি তাড়া। তখন তাদের ফেলে দিতে হয় মাটিতে। ওগুলো হেলে সাপের বাচ্চা। হল গিয়ে, একটা দুটো জলঢোঁড়াও থাকতে পারে। কাটলে দোষ নেই। বিষের সাপ এখানে নেই গো! বিষের সাপ মাছচাষীদের দু’চক্ষের বিষ।
কড়ুয়া বলে সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। কড়ুয়া এভাবে বলতে শুরু করে। তখনও ভাইকে ভামবিড়াল বা খটাস টানতে টানতে নিয়ে যায় নি আকন্দের ঝোপে। তখনও আসলে ভাইয়ের জন্মই হয় নি। কড়ুয়ারও জন্ম হয় নি। কড়ুয়া আর কড়ুয়ার ভাইয়ের মা আর কড়ুয়া আর কড়ুয়ার ভাইয়ের বাবা সবে থাকতে শুরু করেছে একসাথে। উঠোন দিয়ে চিতি সাপ বয়ে গেছিল। তিনটে। দুটো নয়। জোড়া সাপ গেলে হয়তো অন্যরকম হয়তো। কিন্তু তিনটে গেছিল। তাই কড়ুয়ার মা পাগল হয়ে যায়। তাই কড়ুয়ার বাবা আত্মহত্যা করে, অথবা কিষাণ পার্টির বিরোধী দল গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে বাবলা গাছে ঝুলিয়ে দেয়। অথচ জোড়া সাপ গেলে এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না। কড়ুয়ার সঙ্গে বিলাল বা জগন্নাথের অথবা জগন্নাথ বা বিলালের নিকা বা বিয়ে অথবা বিয়ে বা নিকা হয়ে যেত। কড়ুয়ার ভাই অ্যাদ্দিনে কেউকেটা হয়ে বসত গঞ্জের বাজারে। ঘুনসির হাতে হাতে মাছেদের প্রেত, মাছেদের ভ্রূণ, আর ঘুমন্ত ভ্রূণ ছেঁকে ধরত না। কিন্তু এমনটা হয় নি। সেদিন অমাবস্যা ছিল। আর উঠোন দিয়ে চিতি সাপ বয়ে গেছিল তিনটে।
-বাবু, তোমার খাওয়া বড়ো সুন্দর!
-কেনো?
-গুছিয়ে খাও বেশ। নুন লেবু পাশে রাখো। পালং শাক মেখে ছোটো ছোটো গ্রাস তুললে। পুঁটি মাছ খুঁটে খুঁটে খেলে। জলও খেলে চুমুক দিয়ে, চুমুক দিয়ে। শ্বাস নিলে মাঝে দুইবার। বড়ো সুন্দর তোমার খাওয়া।
–
-আমরা কেমন ধারা খাই যেনো! না রে ঘুনসি? সব মেখে চটকে ঘুপুস ঘাপুস করে। মুড়ি খাই তাই তিনবেলা। ভাল্লাগে। তোমার জন্য এসব হল। নইলে তো ওরাই খায়। বল্ কড়ুয়া! বল্ ঘুনসি! বিলাল এলো? জগন্নাথ দেখলাম টাপুর দোকানে বিড়ি কিনছে।
-বিলালভাইয়ের দেরী আছে। আজ নাকের নীচেও আতর লাগাবে। হি হি। পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ পাবে না। জগন্নাথদার ধোঁয়ার গন্ধ পাবে না। হি হি। বিলালভাই ঘড়ি পরবে না। দেখো।
-তুমি খাবে না? বোঙা? খাবে না?
-এই বসি। আমার আবার পিঁড়ি ছাড়া চলে না। ওটুকু আসনে আসক্তি আছে।
-আমার সাথেই বসতে!
-পিঁড়ি তো একটাই। নজর করো নি?
–
–
-খেয়ে নিতে আগে। দেখতাম।
-তা তো হয় না বাবু। তুমি খেলে। আমি দ্যাখলাম। জানলাম। ভালো লাগল। এবার আমার খাওয়া তুমি দ্যাখবে। দ্যাখার দক্ষিণা লাগে। দ্যাখতে হলে দ্যাখাতেও হয়।
-জল খেলে?
-জল খেতে শান্তি লাগে বড়ো। আর শাক দিস্ না কড়ুয়া। হাগা কষে যাবে।
-বোঙা
–
-কি মাছ ভালোবাসো?
-যা এখানে দ্যাখছেন, যা দ্যাখবেন।
-কি মাছ খেতে ভালো পাও?
-একটাও না।
-কোনোদিন না?
-সে যে অনেক অনেক দিনরাত আগের কথা বাবু। কড়ুয়া যেভাবে বলে। না, কড়ুয়া? বলিস না?
-কি কথা বোঙা?
-খেয়ে নি? খেতে খেতে কথা বললে আয়ু কমে যায়।
ভাত ছড়ালে কাক আসে। ভাত ছড়ালে মাছ আসে। মুড়ি ছড়ালেও মাছ আসে। আর আসে হাঁস। থপ থপ করে। আসে হাঁসেদের মা। প্যাঁক প্যাঁক করে আসে ছানা হাঁস। খুঁটে খুঁটে খায়। ঠোঁট দিয়ে তুলে নিয়ে গলা দিয়ে খায়। গায়ে বসা পোকা খায়। কুটি কুটি পোকা, সাফ করে, চান করে। ভাত খেয়ে মাছ হয় পেটমোটা। ভাত খায় মাছেদের ডিম। বড়ো হয় পেটে। আরো বড়ো হলে মুখে আসে। মুখে নিয়ে ঘোরে মাছেদের মা। আরো বড়ো হলে ছেড়ে দেয়। সাফ জল ঘোলা করে ভেসে ওঠে ভ্রূণ। তারাও তো ভাত খাবে। মুড়ি খাবে। বড়ো হলে পোকা খাবে। বড়ো হলে মাছ খাবে। ছোটো ছোটো মাছ। খাবে। কলাপাতা মুড়ে যাবে মাছেদের লাশে।
এখন ঝিমুনি আসে। হাঁটু মুড়ে বোঙা ঝিমোয়। ঘুনসি ঝিমোয়। পিঠে আঁশ লেগে আছে। কড়ুয়া টোকা মারে। পড়ে যায়। ঘুনসি শিহরিত হয়। ঘুনসির পিঠ আর ভুরু, শিহরিত হয়। ঘুনসি ঝিমুতে থাকে। কড়ুয়া ঝিমোয় না। কড়ুয়ার ঝিম নেই। ঝিমুবে না কড়ুয়া? নাঃ। ঘুমোবে না একটুও? নাঃ। বিলালও ঝিমোয় না। সুরমায় চোখ তার জ্বালা করে? করে ভাই। খুব করে। তবে পরা কেনো শুনি? বাঃ, আজ পরবের দিন। সুরমা না পড়লে চলে! কি বলো জগন্নাথ? সুরমা না পড়লে চলে?
জগন্নাথ ছুঁচোলো হাসে। দাঁত লুকায়। নাঃ। সত্যিই ঝিমুনো যায় না। রেডিওতে কলকাতা ক’ চ্যানেল বাজে। জগন্নাথ কড়ুয়াকে দেখে। আশ মিটিয়ে দেখে। কড়ুয়া পা ছড়িয়ে বসে থাকে। জগন্নাথকে দেখে। বিলালের আতরের ঝাঁঝে নাক চুলকে নেয়। বিলালকে দেখে। বিলালের সুরমা পরা চোখ দেখে। জগন্নাথের ছোপ লাগা দাঁত দেখে। কড়ুয়া বাঁশের খুঁটিতে হেলান দেয়। তারপর শ্বাস ছাড়ে। সশব্দে। আগেও ছেড়েছিল। নিয়েও ছিল। এবার সশব্দে ছাড়ে। কষ্ট হয়। জগন্নাথের পানের বরজের জন্য কষ্ট হয়। বিলালের দ’ হয়ে ঘুমোনোর জন্য কষ্ট হয়। কলকাতা ক’ হিন্দি গান বাজায়। জগন্নাথ নব্ ঘোরায়। কলকাতা খ’ হিন্দি গান বাজায়। জগন্নাথ নব্ ঘোরায়। কলকাতা ক’ হিন্দি গান বাজায়। জগন্নাথ মাঝামাঝি নব্ এনে থামিয়ে দেয়। রেডিও ঝিঁঝির ডাক বাজায়। রেডিও মহাজাগতিক সংকেত পাঠায়। বাঁশবনে টর্টর্টর্ আওয়াজ হয়। বাঁশবনে টর্টর্টর্ আওয়াজ হয়।
অ্যাই ঘুনসি। ওঠ্ রে ভাই! লুঙ্গি পড়। মালকোঁচা মেরে। মালকোঁচা মেরে লুঙ্গি পড়িস। গায়ে একটা জামা দে। ভালো জামা। ছেঁড়াটা না। ওটা ফেঁসে গেছে। কোমরের কাছে। মুন্ডু পিছনে হলে দেখতে পেতিস। বোঙাকেও দে। সবুজ লুঙ্গিটা। ওটা কাচা আছে। বোঙা। তুমি ফতুয়া পড়বে? ফতুয়ায় পকেট আছে। হৃদয়ের উপর। বিড়ি রাখতে পারবে। পান রাখতে পারবে। খুচরো পয়সা। রাখতে পারবে। ও, তুমি তো পান খাও না। জগন্নাথ হাসে। হ্যাল হ্যাল করে হাসে। হঠাৎই হ্যাল হ্যাল করে হাসে। বোঙা পান খায় না। বোঙা তুমি ফতুয়া পড়ো। পান খেতে হবে না তোমায়। ঘুনসি! ওঠ্ রে ভাই! আর কতো স্বপ্ন দেখবি? তোর ঠোঁট নড়ছে। পাতা নড়ছে। চোখের পাতা। কি স্বপ্ন দেখিস? কাকে স্বপ্নে দেখিস? কোন মেয়েমানুষের স্বপ্ন দেখিস? তুই কি আমার স্বপ্ন দেখিস? তুই কি কড়ুয়ার স্বপ্ন দেখিস, ঘুনসি? যা চোখ খুলেই দেখতে পাওয়া যায়, তা আবার স্বপ্নে দেখা কেনো বাপু? বোঙা বলে। বোঙা বাবুকে বলেছে। তুই কি কড়ুয়ার স্বপ্ন দেখিস ঘুনসি? বোঙা সব জানে না। বোঙা সব জানে না। তাই না, জগন্নাথদা? তাই না, বিলালভাই?
-কি স্বপ্ন দেখলে কড়ুয়া?
-কই?
-ওই যে ঘুমুলে। অবেলায় ঘুমুলে বঁটিতে হাত রেখে।
-ও। হ্যাঁ।
-কি দেখলে?
-কিচ্ছু না।
-কিচ্ছু না?
-নাঃ।
-তবে যে বোঙা বলে।
-বোঙা কত কি যে বলে। হি হি।
–
-বোঙা ভালো মানুষ ভাই। তাই অনেক কিছু বলে। মনে নিন। মনে রাখুন। সব কথা কি সব সময় মাথায় পৌঁছায়!
-উলটো বললে না বিলালভাই?
-না ভাই। এটাই তো সোজা কথা। না, জগন্নাথ?
-হক কথা। বোঙা বড়ো ভালো। তবে কিনা, অতো মনের কথা নিয়ে সাইকেল চালানো যায় না।
–
-বোঙাকে এই রেডিওটা দিয়ে যাবো একদিন।
-এটা নিলে কবে?
-আজই। বন্ধুর জিনিস। তবে সরেস। চাকদা গেছে দিনতিনেক হল। যাওয়ার আগে দিয়ে গেল। কেয়ারটেকার।
-তারপর?
-ভাবলাম তোমাদের গান শোনাবো। ভাবলাম নিয়ে যাই। সাইকেলে ক্যারিয়ার আছে। ক্যারিয়ারে বউ নাই, মেয়ে নাই, ছেলে নাই। পরবের দিন। নিয়ে যাই। ভাবলাম ঘুম থেকে উঠে।
-তারপর?
-তা এ শালার খালি হিন্দি গান! ভাল্লাগে? দেবো না বোঙাকে। ও গাল দেবে।
-জগন্নাথদা, তোমার কথা বলো?
-কি কথা স্যার?
-কি ভাবলে ঘুম থেকে উঠে?
-তেমন কিছু না। অনেক টাকা কামাবো। তারপর পানের বরজটা কিনে নেবো। পাশের ভাতের হোটেলটাও। তারপর কড়ুয়াকে বিয়ে করবো। ভাতের হোটেলটা কিনে নিলে কড়ুয়ার আর কষ্ট থাকবে না। ও ওটা চালিয়ে নেবে।
-তা’লে ঘুনসির কি হবে জগন্নাথদা?
-হক্ কথা। তা’লে ঘুনসির কি হবে? তুমি কি বলো বিলাল?
-আমিও ভাবছি তাই। এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। এ আপাতত প্রশ্নই থাক না হয়।
–
-তা’লে ঘুনসির কি হবে কড়ুয়া?
-হি হি। কিচ্ছু হবে না। পরবের দিন ঝিমুলে কিচ্ছু হয় না তাদের।
-তুমিও তো ঝিমুচ্ছিলে অবেলায়। নাকি ঘুমুচ্ছিলে?
-ঘুমুচ্ছিলাম।
-তা’লে?
-আমার আরোই কিচ্ছু হবে না।
-ঘুনসিকে ভালোবাসো?
-বাসি তো! ভীষণ।
মাছেরা ভারি বিরক্ত হয়। পরবের দিনে। হাঁসেরা বিরক্ত হয়। বাঁশেরাও। পায়রা দুটো লুকিয়ে পড়েছে। কলাবনে ঝিঁ ঝিঁ বলছে কি কি! কি কি চাই? কত দিন চাই? আর কতো চাই? নারকোল গাছ ঘেঁষে এক টুকরো চাঁদ উঠেছে বহু কসরতের পর। এবার প্রদীপ জ্বালো। বিলাল ঘি এনেছে। এক শিশি ঘি। পরে ভাতে মেখে খাওয়া যাবে। বিলালের ভারী বুদ্ধি। সে বোঙার দোস্ত।
জগন্নাথ ছটাক তেল এনেছে। রেড়ির তেল? জগন্নাথ ফের হ্যাল হ্যাল করে হাসল। এই নিয়ে দুইবার। রেড়ির তেল নয় গো, রেড়ির তেল নয়! এ সরষের তেল। যে তেলে ভূত থাকে। যে তেল মেখে চোরেরা কখনো বেরোতো। যে তেলে ঝম্ঝম্ করে ইলিশ মাছ ভাজা হয়। ইলিশ মাছের ডিম ভাজা হয়। ও, তোমরা তো আবার মাছের ডিম খাও না। মাছ ভাজা খাও না। তবে এ তেলে ভারী সুন্দর আলুসেদ্ধ মাখা হয়। এট্টুন কাঁচালঙ্কা আর দিশি পেঁয়াজ দিয়ে। পানের বরজে আমরা তাই খাই। বাদলার দিনে বন্ধু আমার ভাতে ভাত আর আলু সেদ্ধ দেয়। আমি চুনো মাছ নিয়ে গেলে, গব্গব্ করে সব ভাত সারা।
আঃ জগন্নাথদা, থামো তো বাপু। কান ঝাঁঝিয়ে দিলে। শেয়ালেরা, কুকুরেরা ডাকে শোনো। শেয়ালেরা, কুকুরেরা রেগে গেছে খুব। বিলালভাই তুমি কিছু বলো। বিলালভাই? বলবে না কিছু?
তোমার আর আক্কেল হল না জগন্নাথ! পরবের দিনে মাছ ভাজার কথা, মাছের ডিম ভাজার কথা, বলতে আছে? জানো না কড়ুয়া কষ্ট পায়। জানো না ঘুনসি মান করে। জানো না বোঙার রাগ হয় খুব? এবারের মতো মাফ করো ভাই। বিলকুল ভুলে গেছিলাম। সারা দিন বরজে কোমর ঘষ্টে চলি। সব কথা সর্বদা মনে থাকে না। মাফ করো ভাই কড়ুয়া। আর হবে না। এই জিভ কাটলাম। জিভ কাটলাম। জিভ কাটলাম।
কড়ুয়া হাঁটু গেড়ে বসে। উঠোনের মাঝে। প্রদীপ রাখে। টাপুর দোকানের প্রদীপ। দশ টাকা দাম। মাটির প্রদীপের দাম দশ টাকা। হওয়াই উচিত। টাপু দোকানে সলতেও রাখে। পাকানো সলতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া। চেনা হলে একটা খুলে দেয়। একটার দাম নেওয়া চলে না। টাপু সলতের দাম নেয় নি। আজ পরবের দিন। এখন পরবের সন্ধে।
-কি চাইলে বোঙা?
-বলতে নেই।
-মন্ত্র পড়লে?
-হ্যাঁ।
-কিসের মন্ত্র?
-বলতে নেই।
-শুনতেও নেই?
-পড়তে হয়।
-কিভাবে?
-সে পুঁথিতে আছে। সে পুঁথি হারিয়ে গেছে বাবু।
-তবে?
-মনে আছে। যেটুকু যা আছে, তা মনে।
-আর কারো মনে নেই? কড়ুয়ার? ঘুনসির?
-ওরা দ্যাখে নি। ওদের জন্মের আগে, অনেক আগে জলে ভিজে ছিঁড়ে গেছে। শুকোতে দিলে উড়ে গেছে।
-ওরা তবে কি বলে? ওরা তো চাইতে জানে না।
-ওদের আলাদা মন্ত্র। সে আমি জানি না। সে ওরা জানে।
-তোমার কি মন্ত্র ঘুনসি?
-কড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করুন।
-তোমার আর কড়ুয়ার এক মন্ত্র?
-না তো!
-তবে?
-কড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করুন।
-তুমি বলো কড়ুয়া।
-বললাম যে!
-কখন?
-ওই যে, গড় হয়ে প্রণাম করলাম। তোমার বউ গড় হয়ে প্রণাম করে?
-জানি না। দেখি নি কোনোদিন।
-তা’লে আর মন্ত্র জেনে কি করবে বাবু? দ্যাখো আগে। তবে না মন্ত্র!
-তুমি কি মন্ত্র বললে?
-যেটা ঘুনসি বলল।
-তোমাদের মন্ত্র আলাদা না?
-আলাদাই তো। ঘুনসির বলা আর আমার বলা এক নাকি!
-কিছু ধরতে পারছি না যে বিলালভাই! লেখাপড়ায় বিস্তর ফাঁকি আছে।
-পারবেন ভাই। দ্যাখা শুরু করুন। সব পারবেন।
-আমাদের বরজে আসবেন। সব দেখিয়ে দেবো স্যার। বাদলার দিনে আসবেন। ছাতা নিয়ে। বন্ধুর আবার ছাতা নেই। আমার একটাই ছাতা। আপনি একটা ছাতা নিয়ে আসবেন।
-কি দেখাবেন জগন্নাথদা?
-কিভাবে গড় করে প্রণাম করে। আমরা তো বরজে কোমর ঘষ্টে চলি। ওসব আমাদের হয়েই যায়। একটু চা খাবে নাকি বিলাল?
-নেই তো! চা পাতা নেই তো! আছে চা পাতা? ঘুনসি?
-নিয়ে আসছি। বোঙাও খাও আজ। পরবের দিনে দোষ হবে না। পত্তনের দোকানে কাটুম বিস্কুটও আছে। ভাঁড়গুলোও বেশ বড়ো। সাইকেল কি এমনি এনেছি!
মাছেরা ভারী বিরক্ত হয়। সন্ধেয় আলো জ্বললে। দিনের বেলা আলো জ্বলে না। এবার দুশো টাকা বেশী গেছে। গচ্চা গেছে। কার থেকে শিখলে কথাটা? কার থেকে, বোঙা? ওই জগন্নাথ বলে তো। গচ্চা গেছে। এবার বাদলা হয়েছে খুব। বরজে খুব জল জমেছে গো! পান গাছে জল জমতে নেই। গোড়ায় জল জমতে দিতে নেই। এ বছর বাদলা হয়েছে বেশ খানিক। গেল বার বলেছিল। গেল বারের আগের বারও। তারও আগের বার জগন্নাথ এসে পৌঁছয় নি। তারও আগের বার জগন্নাথ জগু ছিল। পয়সা দিলে ডিম সেদ্ধ কিনে আনত শেট্টির দোকান থেকে। নুন চেয়ে আনত ছটাক। ক্লাবের দাদারা তারিয়ে তারিয়ে খেত ডিমের সাদা। নুন মাখিয়ে খেত ডিমের কুসুম। জগু চেয়ে চেয়ে দেখত। নোলা সকসকিয়ে উঠলে, হাত দিয়ে জোরসে চুলকাত হাত। অবশ্য দাদারা ব্যায়াম করে। জগু ব্যায়াম করত না। বাসরাস্তায়, সেবার বাস না বিগড়োলে, জগুর জগন্নাথদা হওয়া হত না।
ক’টা দিন যেতে দাও। এবারও বলবে। বাদলা হয়েছে খুব। হাজার টাকা গচ্চা গেল। কত হাজার গো জগন্নাথ? আমাদের দুশো টাকা গচ্চা গেছে। টিউবলাইটের মাশুল আর কি! ঘুনসিটাই তো আনল কিনে। অবশ্য চোরও যা বাড়ছে। না লাগিয়ে উপায় কি! দুশো টাকার জন্য রাত জাগা যায় না বাপু! সে ওই বিলাল জাগে। পাশ ফিরে শোয়। হাঁটু দুটো বুকের কাছে আনে। ও জাগে। কেনো জাগো বিলাল? বিলালভাই, তোমার জাগতে কষ্ট হয় না? বিলালভাই তখন আর বিলালভাই থাকে না। বিলালভাই তখন আর বিলাল থাকে না। তার চোখটা হঠাৎ ছোটো হয়ে যায়। হঠাৎ বড়ো হয়ে যায়!
আমি যে খুন করেছি ভাই। না করলে লোকটাই আমাকে করে দিত। পাঁচ সেলের টর্চটা তুলেও এনেছিল মাথার উপর। কিন্তু আমিও তো তৈরী ছিলাম ভাই। ছুরি তো আমার হাতেই ছিল। আমি তো তাকে বিশ্বাস করি নি। আমি তো তাকে খুন করেছি ভাই! আমার সাজা হয় নি। আমার জেল হয় নি। লোকটাই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। চার জন সাক্ষীও ছিল সামনে। ছুরি না চালালে, আমিই হয়তো মরে যেতাম। কিন্তু আমি তো একটা মানুষ খুন করেছি ভাই! তার মুখ আমি ভুলে গেছি। তাই রাতে ঘুম আসে না। তার মুখ আমি চেষ্টা করেছি, মনে আনতে। সবাই বলেছে আমার কোনো দোষ নেই। সত্যিই তো! টর্চটা না উঠালে, ছুরি হয়তো চালাতাম না। কিন্তু হয়তোটা থেকে যাবে ভাই! আমি যে তার মুখ মনে আনতে পারি না। এভাবে ঘুমোনো যায়? এর তো কোনো দাওয়াই নেই। আছে ভাই?
কড়ুয়ার প্রদীপ ভাসতে থাকে। বিলাল কাঁদে না। হাসে না। কড়ুয়ার প্রদীপ ভাসতে থাকলে, আবার বিলালভাই হয়ে যায়। এ সময় মাছেদের খুব কষ্ট। ভারী রাগ। প্রদীপের আলো তাদের চোখে ধরে যায়। পাতাহীন চোখ। মাছেদের পাতাহীন চোখে প্রদীপের আলো স্থির হয়ে থাকে। তারা নড়তে পারে না। চড়তে পারে না। হয়তো তলিয়ে যায়। হয়তো পুকুরের মাটি, শেষ মাটি পুকুরের, যেখানে কেঁচোর দল গুটি মেরে শোয়, সেখানে তলিয়ে যায়। এ সময় মাছেদের অস্বস্তি খুব। তাদের গুটানো নেই। স্বভাবে নেই, অভাবে নেই। মাছেদের শিরদাঁড়া থাকে। গুটানোর পথ তাই বন্ধ। প্রদীপের আলো নিয়ে তলানিতে গিয়ে তারা ঠেকে। হয়তো ঠেকে না। দেখে নি তো কেউ। হয়তোটা থেকে যায়। হয়তো যায় কি ভাই? কখনো কি যায়? বাঁশবনে কট্ কট্ সুর বাজে। কট্ কট্ কট্ কট্! বাঁশবনে সুর বাজে। ঘুনসি কাটছে বাঁশ। সন্ধে বেলায়? ঘুনসি কাঁটছে বাঁশ। কড়ুয়ার ছোটো মাচা বড়ো হবে। অথবা শক্ত হবে আরো। ছোটো মাচা বড়ো হবে অথবা শক্ত হবে।
কড়ুয়া তোমার কি চাই? বড়ো মাচা? নাকি মজবুত চাও? যেখানে দু’জন শোবে। বড়ো মাচা হলে, সরে গিয়ে শোয়া যায়। টানটান হয় পা। জড়িয়ে শুলে, করে নেবে এপাশ ওপাশ। মজবুত হলেও তো সুখ! নিতে পারে দুজনের ভার। কোল ঘেঁষে শুয়ে নেবে একে অপরের। পড়ে যাবে না। কড়ুয়া তোমার কি চাই? সে কি বলা যাবে না? বাঁশবনে বাঁশ কাটে। কট্ কট্ কট্ কট্। ঘুনসি কাটছে বাঁশ। দা দিয়ে। এক ফালি দা। এক ফালি কুমড়োর মতো দা। কট্ কট্ কট্ কট্। ঘুনসি, তোমার মায়ের দিকে, তাঁত কি বুনত কেউ?
-নারকোলের জল পান করো বাবু। অনেক উপকার। কাল তোমায় লাবুর কাছে নিয়ে যাবো।
-আমার তো সাঁতার মনে নেই।
-আমি আছি তো! নারকোলের জল পান করো।
-তোমরা পান করবে না?
-করবো তো। আচ্ছা। বুঝেছি। প্রথমে আমাদের পান করা দ্যাখো। তারপর তোমার পান করা দ্যাখিও।
-কড়ুয়া? ঘুনসি?
-ওরা পান করে না। ওদের পান করতে নেই।
-কেনো?
-ওদের ঘোর লাগে। ওরা সামলাতে পারে না। আজ পরবের রাত। আজ বেসামাল হলে সব মাছ মরে যাবে।
–
-বিলাল পান করো। জগন্নাথ পান করো।
-দাও বোঙা। কতকাল করি না। কতকাল নারকোলের জল পান করি না।
-ঘটিটা মাজা তো রে ঘুনসি? কি একটা যেনো লেগে আছে বোধ হয়। কি লেগে আছে? লেগে আছে কিছু?
-তোমার চোখে লেগে আছে বোঙা। তোমারই ছায়া। সরে বোসো। সরে যাবে।
-টিউবলাইটটার দোষ। গেল বার এমন হয় নি। বিলাল, পান করো ভাই।
–
-বিলালভাই, তুমি কাল চলে যাবে?
-হ্যাঁ ভাই। চলে যাবো। আপনি যাবেন আমার সাথে।
-কোথায়?
-যেখানে যাবো।
-কোথায় যাবে?
-মুস্কিল করে দিলেন ভাই। আপনি তা’লে যাবেন না। কোথায় যাবো জানতে চাইলে যাওয়া যায় না।
-মানে?
-কোথায় যাবো জেনে গেলে, আপনি গিয়ে করবেনটা কি?
-বেশ। যাবো না।
-রেগে গেলেন ভাই। রাগবেন না। গল্প শুনুন।
-হ্যাঁ বিলাল। সেই গল্পটা শোনাও।
-সেবার আমি গাজনমেলায় ঝাঁপ খুলেছি। এ হল গিয়ে সেই হাইওয়ের ধারে, বুঝলেন ভাই, মেদিনীপুর যাওয়ার যে হাইওয়ে, টুন্ডা বলে মিদ্নাপোর, এ হল গিয়ে সেই হাইওয়ে আর তার ধারে একটা মাঠ, অবশ্য জলাও আছে, তবে মূলতঃ মাঠ, মাঠের উপর গাজন বসেছে, তারই মেলা, আমি আর টুন্ডা, টুন্ডা আমার বেরাদর, টুন্ডা বলে ব্রাদার, টুন্ডা আমার জিগরি দোস্ত, আমি আর টুন্ডা ঝাঁপ খুলেছি পসরা নিয়ে। হরেক কিসিমের পসরা। লাল রঙা মগ থেকে কালো রঙা ফল পেষাইয়ের কল। ইয়াব্বড়ো তুলোর ভালুক আর অ্যাত্তোটুকুন টিপের পাতা। তোমার জন্য আর বার নিয়ে আসবো কড়ুয়া। কাঁচপোকা টিপ।
-পসরা মানে কি?
-পসরা মানে বস্তু। যে বস্তু বেচলে টাকা আসে। যে টাকায় ভাত কিনে খাওয়া যায়, গোশ্ত কিনে খাওয়া যায়। আমি খাই না। টুণ্ডা খায়। সে গোশ্ত খেতে বেজায় ভালোবাসে। সে চশমা পরতেও ভালোবাসে। কালো চশমা, তার সোনালী ফ্রেম। আমার একটু কাঁচকি মাছের ঝোল হলেই সাপটে ভাত সারা।
-পসরা, পসরা, পসরা। তারপর?
-তো আমরা দোকান দিয়েছি হরেক কিসিমের। হরেক কিসিমের বস্তুর। মাঠের উপর, গোল করে খড়ির দাগ কাটা। মাঝে জিনিসপত্তর। সামনে তিনটে বোতল। সামনে তিনটে প্লাস্টিকের রিং। যদি সাত পা দূর থেকে রিং ছুঁড়ে মালা পরাতে পারো বোতলের গলায়, পসরা তোমার। একেক বার, একেক বাজি। একেক টিপে একেক পসরা। রিং তোমার হাতে, বোতল দাগের বাইরে, দাগের ভিতর চিনেম্যানদের ঝিনচ্যাক ঘড়ি থেকে কালার টিভি, খড়ির দাগ, গোল করে কাটা, কিস্মত যাচাই করুন জনাব!
-তোমার জুয়ার ব্যবসা বিলালভাই?
-হ্যাঁ ভাই। জুয়ার ব্যবসা।
-তারপর?
-সেবার রাত হয়েছে বেশ। গরমটাও পড়েছে। মাঠে হাওয়া নেই। তবে কামাই হয়েছে ভালো। টাকাগুলো উড়তে না পেরে, টিনের বাক্সে নেতিয়ে আছে ঘামে। সেদিন বেশ রাত নেমেছে। আমি আর টুন্ডা ভাবছি আর কামানোর দরকার নেই। এবার ঝাঁপ ফেলি। আর কামালে ঘুম হবে না। এবার ঝাঁপ ফেলি। একটা মেয়ে এলো। বাচ্চা মেয়ে। দশ-এগারো বয়স। কি আরেকটু কম হবে। হাতে কুড়ি টাকা।
-কুড়ি টাকা?
-হ্যাঁ বোঙা। একেক বার ছুঁড়তে পাঁচ টাকা লাগে। মেয়েটা একটা কিসমত্ বেশী এনেছিল। বোতলগুলো সাজানো আছে। বোতলগুলো হেলানো থাকে। অল্প হেলানো থাকে। খালি চোখে ধরা যায় না। এক বারে রিং পরানো খোদারও অসাধ্য। মেয়েটা পাঁচ টাকার কিসমত্ বেশী এনেছিল। মেয়েটা টুন্ডার কাছ থেকে রিংগুলো নিলো। একবার মেলার মধ্যে কাকে যেনো খুঁজল। বোধহয় বাবাকে।
-কিভাবে বুঝলে?
-বলতে দে ঘুনসি। ওভাবে বার বার কাটতে নেই। বলো বিলাল।
-মেয়েটা টুন্ডার কাছ থেকে রিং তিনটে নিয়ে মেলার মধ্যে বাবাকে, বোধহয় বাবাকে একবার খুঁজল। টুন্ডা মেয়েটার কাছ থেকে পনেরো টাকা নিয়ে টিনের বাক্সে রাখল। ঝনাত করে রাখল। মেয়েটা পনেরোটা এক টাকার কয়েন দিয়েছিল। পাঁচ টাকার একটা নোট ধরে রেখেছিল বাম হাতের তেলোতে। অন্য পনেরোটা কয়েন রুমালে বাঁধা ছিল। ও রুমাল সমেত দিয়েছিল। টুন্ডা রুমাল সমেত নিয়েছিল। তারপর কয়েনগুলো ঝনাত করে ফেলে, রুমালটা ফেরত দেবার কথা ভাবছিল। মেয়েটা রুমাল চেয়ে নিল। অনায়াসে চেয়ে নিল। তারপর একটা দুটো তিনটে করে, একটা দুটো তিনটে করে, একটা দুটো তিনটে করে ফেলে দিল রিংগুলো বোতলের গলায়।
–
-আজ পর্যন্ত কাউকে এমন করতে দেখি নি ভাই। অনেক ঘুরেছি, অনেক ঘুরবো। কিন্তু এমনটা কেউ করে নি আজও। আমি আর টুন্ডা যা কিছু পসরা ছিল, গোল খড়ির দাগের ভিতর যা কিছু পসরা ছিল, জড়ো করে, গুছিয়ে জড়ো করে, মেয়েটার সামনে রাখলাম। মেয়েটা বোবা হয়ে গেছিল। বুঝতে পারছিল না, এ সব ওর। মেয়েটার কানে তালা লেগে গেছিল ভাই।
-তারপর?
-মেয়েটা ওর বাবাকে ডেকে আনল। আমরা কি দুটো কি তিনটে পসরা লুকোতে পারতাম না? তাতে বেইমানি হত। মেয়েটা আর ওর বাবা, ওদের ঘুগনির দোকান তুলে নিয়ে যাবার সময় পসরাগুলো নিয়ে গেল। ওদের ঘুগনির দোকান কাঠের বাক্সে। ওদের ঘুগনির দোকানের পাশে হাভাতে, হাভাতে কুকুরেরা ছোঁক ছোঁক করে। আমাদের দু’বাটি ঘুগনি, শালপাতার ঠোঙায় দু’বাটি ঘুগনি আর মেয়েটা দুটো চিপ্সের প্যাকেট দিয়ে গেল হাতে। সেবার তিন দিন আগেই আমরা ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেলাম।
-তারপর?
-তার আর পর নেই কড়ুয়া। আমি আর টুন্ডা, টুন্ডার মাসির বাড়ি দিনহাটায় চলে গেলাম সেবার গরমে। দিনহাটায় গরম কম। তবে সে অন্য গল্প।
-মেয়েটাকে আর দেখেছিলে বিলালভাই? পরের দিন?
-চেষ্টা করি নি ভাই।
-দিনহাটা, দিনহাটা, দিনহাটা। জগন্নাথদা সরে বোসো।
জগন্নাথ সরে শোয়। পা মাচার বাইরে, ঝুলছে, ঝুলন্ত পায়ের পাতা খাড়া উঠে গেছে রাতের আকাশে, অথবা বুড়ো আঙুলের নখ, জগন্নাথ বুড়ো আঙুলের নখ কাটতে ভুলে গেছিল, বুড়ো আঙুলের নখ উঁচিয়ে দেখছে তারা। পাশে বহু কসরতের চাঁদ। টিমটিম করে জ্বলে আছে। প্রেমিকা কুকুর তাই শান্ত। প্রেমিক কুকুর তাই চুপ। মিটমিটে তারা টিমটিম চাঁদ, তাদের ঘুমোতে দিচ্ছে। সুখী কুকুর-কুকুরীরা চাঁদ মেপে গড়িয়ে নিচ্ছে খানিক। জগন্নাথের পায়ে শুকোনো কাদা চিড়বিড় করছে। ঝুলন্ত পা বেয়ে যে কোনো মূহূর্তে উঠে আসতে পারে ডোরাকাটা চিতি সাপ, কেন্নো অথবা বান মাছের অতৃপ্ত আত্মা। জগন্নাথের পায়ে সন্ধের কাদা, এখন শুকিয়ে আছে।
বিলাল ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরে বেরোতে হবে। প্রথম বাস ধরতে হবে বাসরাস্তায়। নির্মলের গুমটির পাশে, ঠিক ভোরবেলা, মোরগের কোঁকর-কোঁ আর বাসের ভ্যাপ্পর-ভোঁ একসাথে দাঁড়াবে। নির্মলের গুমটি খোলা পেলে, কয়েক প্যাকেট বিড়ি আর কয়েক প্যাকেট বাপুজি কেক, কয়েক প্যাকেট, যে ক’টা পাওয়া যায়, কিনে নিতে হবে। নির্মল ভালো ছেলে। শ’টাকার নোট ভাঙিয়ে দেয়। পকেটে না থাকলে, পান পাতার ডাঁইয়ের তলায় দেখে। পান পাতার ডাঁইয়ের তলায় সবুজ কাপড়। সবুজ কাপড়ের তলায় দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকার নোট। এক-দুই-পাঁচ টাকার কয়েন। না পেলে বাড়িতে যায়। বউকে বলে। বউ তার সেলাই বাক্স খুলে দিয়ে দেয়। না পেলে বাবাকে বলে। বাবা ডেকে দেয় বউকে। বউ সেলাই বাক্স খুলে দিয়ে দেয়। দুপুরে বউ বসবে। বউ সেলাই বাক্সে টাকা রাখে। নির্মল সবুজ কাপড় জলকাচা করে মেলে দেয়। দোকানের পিছনে রৌদ্রের দিনে, নারকোল দড়ির উপর সবুজ কাপড়, আর যা কেচে দেওয়া হয়েছে, শুকায়। নির্মল ভালো ছেলে। শ’টাকা ভাঙিয়ে নেবে বিলাল।
জগন্নাথের নাক দিয়ে আওয়াজ আসে। ফুড়ুৎ ফুৎ। ফুড়ুৎ ফুৎ। জগন্নাথ ঘুমোয় নি। চিত হয়ে শুলে নাক ডাকে, ডেকে ওঠে। ঘুমোতে হয় না। লোকে ভাবে জগু ঘুমোচ্ছে। লোকে ভাবে জগন্নাথ ঘুমোচ্ছে। কড়ুয়া ভাবে জগন্নাথদা ঘুমোচ্ছে। কিন্তু জগন্নাথ ঘুমোয় না। অথবা ঘুমোয়। চোখ খুলে ঘুম দেয় মাছেদের মতো। মণি দুটো বাতায় আটকে থাকে। মণি দুটো ছই দেওয়া চালে, আটকে থাকে। জগন্নাথের খোলা চোখ, নিদ্রাবিহীন চোখ, মাছের চোখের মতো স্বচ্ছ দুটো চোখ, আটকে থাকে, চালের বাতায় গোঁজা শন্শনে দা’য়ে। পাশেই বাঁশ পেকেছে, ফালি ফালি বাঁশ, বোঙার চুলের তেলে, পেকে উঠেছে, ক্রমাগত। বোঙাও ঘুমায়। বোঙাই ঘুমায়, নিরবধিকাল।
পাঁজরের হাড় বেয়ে বয়ে যায় শন্শনে হাওয়া। পাঁজরার হাড়, ক্ষয়ে যায় একটু একটু করে। খক্ খক্ করে কাশে বোঙা। ঘঙ ঘঙ কাশে। ক্ষয়ে যায় পাঁজরের জোর। জোলো হাওয়া রেখে যায় বিন্দু বিন্দু দাগ, মরচে ধরায়। এ আমার চলে যাওয়া বাবু! জোলো হাওয়া চলে যায় গুমটির দিকে। কাল ভোরে বাস এসে দাঁড়াবে সেখানে। নীল বাস। হলুদ আঁচড়ে লেখা তিনটে সংখ্যা, গন্তব্যস্থল। কাল ভোরে টুন্ডা, বসবে সে বাসে। জানলার ধারে, বিলালের জায়গা তো পাকা! টুন্ডা কাটবে ভাড়া, জানলার ধারে। এ বাড়ির প্যাঁকালো হাসের দল, চই চই কালে, বলবে আসবে কবে? আবার আসবে কবে বিলাল? বিলালভাই। আবার আসবে কবে? জানলার সিট, সে তো টুন্ডার দখলে। উঠলেই ছেড়ে দেবে। ব্যাগ নিয়ে রেখে দেবে মাথার উপর। শীত এলে টেনে দেবে কাঁচ। ঘষা কাঁচ, পুরো সরবে না। যেটুকু সরুক, বাকি র্যাপারে থাকবে ঢেকে, কান আর মাথা। র্যাপারের বুকে শুধু দুই জোড়া চোখ, টুন্ডা-বিলালের দুই জোড়া চোখ, বুজে থাকবে।
টুন্ডাকে নিয়ে এসো আর বার। বিলালভাই। টুন্ডাকে নিয়ে এসো। শন্শনে হাওয়া যায় বোঙার পাঁজর দিয়ে। বোঙা কি উঠল কেঁপে? পাঁজরাতে মরচে পড়েছে। ভেঙে যাবে। যেভাবে ভাঙছে ঘুম কুকুর-কুকুরীর। পায়রারা পাখসাট মারে। কড়ুয়া ঘুমোলো কি? পুরোনো মাচায়? শেষের বারের মতো। ঘুনসি শুয়েই আছে। হাত দুটো মাথার তলায়। ক’দিনের না-কামানো দাড়ি, শন্শনে বাতাসে, উড়ে বেড়াচ্ছে। হাওয়ার বিন্দু কণা জমে আছে বোঙার হৃদয়ে। এ আমার চলে যাওয়া বাবু!
-ডুবে গেলে?
-ভেসে উঠবে।
– না উঠলে?
-জাল ফেলব খ্যাপলা। খলবল না করতে করতে উঠে আসবে।
-কেনো?
-মাছেরা জ্যান্ত থাকে জলে!
–
-তোমার তো সে কপাল নেই। লাশ উঠবে। সে লাশ কোথায় পাঠাবো?
-উঠিয়ো না। পাঠিয়ো না।
-লাবুর পাশে শুয়ে থাকবে। পারবে?
-লাবু তো পেরেছে!
-সে তো অনিচ্ছায়। সে তো সাধ করে শোয় নি। সাধ করে শুতে অনেক কষ্ট লাগে। আমার নেই।
-কোথায় শোবে তুমি? বোঙা?
-যেখানে শোয়াবে। যেখানে শোয়াবে কড়ুয়া। যেখানে শোয়াবে ঘুনসি। আমার আর সাধ নেই।
–
-ভয় পেয়েছো বাবু তুমি। কিসের ভয়?
–
-কিসের ভয় বাবু?
-যদি আর দেখতে না পাই!
-কি, না দ্যাখবার ভয়?
-জানি না। সব। যা কিছু দেখি নি।
-সব কি দ্যাখা যায়? সব দ্যাখতে নেই। যা দ্যাখেছো, যা দ্যাখছো, যা দ্যাখবে, নাড়ীতে রেখে দাও।
-নাড়ীতে?
-হ্যাঁ।
-তুমিও নাড়ীতে রেখে দিয়েছো?
-নিশ্চয়।
-কি রেখেছো?
-সে বলা যাবে না বাবু।
–
-সব কথা সবাইকে বলা যায় না। সব কথা সবাইকে বলতে নেই। নাও, পা ডোবাও। এরা বাইরের লোক যক্ করে না। শুতে দেবে না তোমায়।
-সিঁড়ি নেই?
-ভেঙে গেছে। কি বুঝছো? বুড়ো আঙুলে, পায়ের শিরায়, বুঝতে পারছো?
-শীত করছে। উঠে আসতে চাইছে উপরে।
-নেমে যাও বাবু। আরো নামো। আমি আছি। নেমে যাও। আমার পিছনে কড়ুয়া আছে। ঘুনসি আছে।
গোড়ালি বেয়ে শীত উঠে আসে, হাঁটুতে, সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। নখ বেয়ে উঠতে পারে না। মৃত কোষে ছড়িয়ে পড়ে না শীত। লাবু তাই শুয়ে আছে। অথবা লাবুর স্মৃতি। বোঙার হৃদয়ে শোওয়া, বোঙার মাথায় দাঁড়ানো লাবুর স্মৃতি গোড়ালি বেয়ে সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে দেয়। কত দিন আগে, তা মনে নেই বাবু! লোকগুলোর নাম বলে যাবো। মানুষ নয়, লোক। তিনটে? চারটে? একটাও হতে পারে। বাঁশবনে টাঙিয়েছিল? বাবলা গাছে? তখনও পাঁজরা জুড়ে কন্কনে শীত, দানা বাঁধে নি। বা বীজ পুঁতেছিল শুধু। এখন সে পাঁজরার হাড়, কঙ্কালসার। ধুকপুক করে।
এ জলে মাছের চাষ মানা আছে। তবু তারা আছে, সবখানে। ফসল ছাড়াও তো জন্মায় গাছ! লাবণ্যের দেহ কুড়ে কুড়ে, মাছেরা ঝাঁক হয়েছে। অনাদরে, উপেক্ষার ঝাঁক। লাবণ্য নামের কোনো মেয়ে, যাকে কেউ মনে রাখে নি, যাকে একদিন, বোঙা বুঝি ঘুনসির বয়সী, তখন, কি আরো ছোটো, বড়ো আদরে, নামিয়ে ঘাটের জলে রেখে, ডুবিয়ে দিয়েছিল। যত্নে, কষ্টে, দেখেছিল মুখ, লাবণ্যের মুখ। সেই দেখা, বোঙাকে ভাবিয়েছিল। বোঙাকে ভাবায় আজও, লাবু যদি নাই মরত, অপঘাতে, মাছেদের প্রেত তবে জন্মেই মরে যেত ফের। অপঘাতে মরা লাবু, মাছেদের প্রেতরূপ বাঁচিয়ে রেখেছে।
বোঙা লাবণ্যকে দেখেছিল। বোঙা লাবুকে দেখে। কড়ুয়া দেখতে পায় না। ঘুনসি দেখতে পায় না। কড়ুয়া মুড়ি মেখে দেয় দলা দলা করে, একটু তেল, একটু আলুসেদ্ধ, ছড়িয়ে দেয় জলে। অনাচাষের জলে। বোঙা ভালো পায়। কপ্কপ্ করে খায় হাঁসেদের মা। ঠোঁটে তুলে ছানাদের, মুখে দেয়। বেলা হলে, মাসে এক বার, ঘুনসির দাঁ চলে, উঠে আসে শ্যাওলার গাঁদ। বোঙা ভালো পায়। ওরা বলে লাবু’মা। কখনো নয়নতারা জলে ভাসে, আপসেই। চিত মুখে, কিংবা উপুড় হওয়া, নয়নতারার ঝাঁক লাবডুব খেলে। আপসেই। বোঙা বড়ো খুশি হয়। জানে সবই। কড়ুয়ার কারসাজি! ভোর হলে, নাকি নিশুতি রাতেই, ফুল তোলে, ঘুনসিকে নিয়ে। ঘুনসিও ফুল পাড়ে। লম্বা কি না, ঘুনসি তাই ফুল পাড়ে। কড়ুয়া তোলে ফুল। তুলতে তুলতে পৌঁছয় অনাবাদি জলের কিনারে। ঘুনসি রে, ফুলগুলো সাজাতে পারিস না! ওভাবে ছুঁড়তে আছে? মুড়িমাখা দলাগুলো টিপটাপ রাখ্। বোঙা কি উঠল নাকি?
জগন্নাথ বলে লাবণ্যদেবী! লাবণ্যদেবীর পরব! কড়ুয়া বলে লাবু’মার পরব! ঘুনসি বলে বোঙাবাবার পরব! জগন্নাথ বলে লাবণ্যদেবীর পরব! দেবী কথাটা শিখলে কোথায় জগন্নাথদা? রচনা বইতে স্যার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মায়ের নাম শ্রীমতি ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্রকে ঈশ্বরচন্ন বলে জগন্নাথ। ঈশ্বরচন্ন বিদ্যের সাগর! বলার সময় আকাশে তাকিয়ে নেয়। ভোরের ফ্যাকাসে চাঁদ, দেখে নেয়, ঈশ্বরচন্ন বিদ্যের সাগর বলতে বলতে। ভোরের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ দেখে রেডিওটুকু ব্যাগে ভরে নেয়। আসবেন তো স্যার আমাদের বরজে। মাথা নিচু করে ঢুকতে হবে কিন্তু। ম্যাচিসটা আনবেন না। ছাতাটা আনবেন। আমাদের কিন্তু ক্যাম্বিসের জুতো পরা অভ্যাস। নইলে খালি পা! একটু মনে রাখবেন স্যার। জগন্নাথকে একটু মনে রাখবেন। জগুকে মুছে দিয়েছি, বহু বছর হলো, জগু আর নেই। না থাকাই ভালো এক দিক দিয়ে। যদি ভেবে দেখেন আর কি! জগন্নাথকে মনে রাখবেন। তা’লেই হবে। জগন্নাথ এবার আর ছোপ লাগা দাঁত লুকোয় না। বোধহয় ভুলে যায়।
-সুখে আছো ঘুনসি?
-বেশ আছি। ভালো আছি। আছি না?
-তুমি বলো।
-কড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করো।
-তোমার সুখের খবর কড়ুয়া কি করে দেবে?
–
-তোমার সুখের খবর কড়ুয়া কি করে দেবে?
-বড্ড বকাও বাবু!
-ঘুনসি, সুখে আছে কড়ুয়া?
-হ্যাঁ।
-তুমি? সুখে আছো কড়ুয়া?
-থাকবো না?
-তুমি বলো।
-পরবের সন্ধেগুলো, এই মাটিতে, আমরা সুখে থাকি। তাই না বোঙা?
-পরের বার ল্যাখাপড়া করে এসো বাবু। নইলে আসাই সার হবে!
-লাবুকে দেখতে পাবো?
-সে লাবু জানে।
-লাবুকে কেমন দেখতে কড়ুয়া? শুনেছো?
–
-লাবুকে কেমন দেখতে ঘুনসি?
-দ্যাখতে পাচ্ছো না বাবু? দ্যাখতে?
–
-লাবু দাঁড়িয়ে আছে। দ্যাখলাম। এই সে তাকাল। লাবু হাসে না। লাবু কাঁদে না। তার নীল মুখ আমি দ্যাখেছি। তার ফুলো ফুলো ঠোঁট, দ্যাখেছি। লাবু আমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ভাঙা ঘাটে চলে যায়। বাসরাস্তায় চলে যায় বাবু, আমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে। পাঁজরার ঘুণ দ্যাখেছো? কবে আর দ্যাখবে!
-কড়ুয়ার মাচা হতে আর কত দিন লাগবে ঘুনসি?
–
-কড়ুয়ার মাচা হতে আর কত দিন লাগবে ঘুনসি?
-পাঁজরার ঘুণ দ্যাখেছো?
-না।
-কবে আর দ্যাখবে?
-বোঙা তুমি কেঁপে উঠলে?
-হ্যাঁ।
-বোঙা তুমি কেঁপে উঠলে।
-এ আমার চলে যাওয়া বাবু!
******
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি