Third Lane Magazine

ফাজি সেট তত্ত্ব ও শিবরাম চক্রবর্তী~ মিহির চক্রবর্তী

দু’টো কথা :

শিবরাম চক্রবর্তী আসলে ঠিক কে ছিলেন, কোথায়-কীভাবে থাকতেন, এ বিষয়ে মাঝেমধ্যেই ধাঁধা লেগে যায়। হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনে তাকে খুঁজতে যাই, তখন হয়ত তিনি টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুদূর মস্কো থেকে পণ্ডিচেরি। ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ র ছোট্ট কাঞ্চন নাকি ‘ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসা’-র লেখক, কে আসল শিবরাম? মনে হয় দুজনেই! 

মুক্তারামের তক্তপোশে মুক্ত আরামে শুয়ে অবলীলায় জীবনটা কাটিয়ে দিলেন যিনি, তাঁর হাত থেকেই বেরিয়েছে বাংলা সাহিত্যের আশ্চর্য সব মণিমুক্তো। বহুচর্চিত Pun ছাড়াও আরো আশ্চর্য সব উপাদান রয়েছে তাঁর লেখায়। শিবরামের একটি ছোটোগল্পে গণিততত্ত্বের সেই রকম একটি  বিষয়ের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন অধ্যাপক মিহির চক্রবর্তী। শিবরামের একটি গল্পকে যে গণিতের এরকম একটি দুরূহ শাখার আলোয় দেখা যেতে পারে, পাঠক সেই আবিষ্কারে আশ্চর্য হবেন সন্দেহ নেই। 

অধ্যাপক চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের সুবিখ্যাত অধ্যাপক। গণিত ছাড়াও শিল্প-সাহিত্যের বিবিধ অঙ্গনে তাঁর অনায়াস যাতায়াত। কবিতা হোক বা সমাজবিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্ব এমনকি গণিতের জটিল উপপাদ্য – আশ্চর্য মুনশিয়ানায় তিনি হাজির করেন সাধারণ পাঠকের সামনে। গণিত তথা বিজ্ঞান এবং শিল্প, এদের মধ্যে বানিয়ে তোলা বিভাজনরেখা মুছে যায় তাঁর সরস গদ্যভঙ্গিমায়। 

এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় শিবরাম চক্রবর্তী স্মারক গ্রন্থে (আনু ২০০৪)। পরবর্তীকালে এটি ‘অমীমাংসার আলো-আঁধারি’ (প্রকাশক-নান্দীমুখ সংসদ) বইটিতে সংযোজিত হয়েছে।  

পুনঃপ্রকাশ

 ক্ষুদ্র রচনাটিতে আমি দেখাতে চেয়েছি ঠিক আগের রচনায় আলোচিত গণিততত্ত্ব, ফাজি সেট থিওরির মূল দার্শনিক সারাংশটি শিবরাম চক্রবর্তীর একটি ছোট গল্পের বিষয়বস্তু  হিসেবে ছিল।[১] শিবরামের সঙ্গে এই তত্ত্বের সখ্যানুসন্ধান কষ্টকল্পনা  মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাবে শুধু দার্শনিক সারার্থটিই নয়, সমস্যাটির যে জাতীয় ‘সমাধান’- এর দিকে তিনি গল্পচ্ছলে পা বাড়িয়েছিলেন, বর্তমানের তত্ত্বটিও সেই অভিমুখী। গল্পটি শিবরাম লেখেন গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের কোন সময়ে, সঠিক সময়টি জানা সম্ভব হয়নি। আর আগেই অর্থাৎ আগের রচনাটিতে উল্লেখ করেছি বার্কলের অধ্যাপক লতফি জাদেহ তাঁর এ বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন ১৯৬৫ সালে।[২] আমার তো মনেই হয় ফাজি সেট তত্ত্বের ইতিহাস রচনায় শিবরাম চক্রবর্তীর যথাযোগ্য উল্লেখ একটি সঙ্গত দাবী হিসেবেই উত্থাপিত হতে পারে।

     গল্পটির নাম ‘অঙ্ক সাহিত্যের যোগফল’। মুখ্য চরিত্রাবলীঃ রাজীব, খাসা ছেলে রাজীব এবং শিবরাম স্বয়ং। রাজীব ও তার বাবা দাদারা যেভাবে শিবরামের দৈনন্দিন প্রশ্নগুলির উত্তর দেন তাই নিয়ে গল্পের ভূমিকা- যেমন রাজীব দাদাকে যখন শিবরাম জিজ্ঞেস করছেন “কেমন আছো হে”, দাদার উত্তর “এই কেটে যাচ্ছে একরকম।” অথবা তার বাবাকে অনুরূপ প্রশ্নের উত্তর শিবরাম পাচ্ছেন, “আজ্ঞে যেমন রেখেছেন”, রাজীবকে করা সেই একই প্রশ্নের উত্তরে শুনতে হচ্ছে, “চমৎকার”। খেয়াল করবেন এই উত্তরগুলিও আমাদের দৈনন্দিনতা, অথচ কেমন অস্বচ্ছ, অনির্দিষ্ট। এছাড়া আর কোনভাবে কি মনোভাব প্রকাশ করা যেত না? তাই, শিবরামের “বাড়ি ফিরে ভারী খারাপ লাগে। এ কী? … দুনিয়া-সুদ্ধ সবারই ঘিলুর গোলমাল, না আমাদের ভাষার ভেতরেই গলদ। … আমার যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মন কিন্তু ভীষণ বিচলিত হয়।“ স্বাভাবিক ভাষার এই অপরিহার্য প্রকাশভঙ্গিমাকে ব্রার্ট্রাল্ড নির্বাসিতই করেছিলেন বিজ্ঞানের ডিসকোর্স থেকে।

শিবরাম যে সমাধান সূত্র আবিষ্কার করলেন তা নিম্নরূপ-

 “আচ্ছা, আমাদের ভাষাকে অঙ্কের নিয়মে বেঁধে দিলে কেমন হয়? বিশেষ করে বিশেষণ আর ক্রিয়াপদ …। সংখ্যার মধ্যে বাঁধা পড়লে শংকার কিছু থাকে না; আর ভাসা-ভাসা ভাবটা কেটে যায় ভাষার। অঙ্কের নিরিখটাই সবচেয়ে ঠিক বলে মনে হয়।” (মোটা হরফ আমার এবং অনির্দেশ্যতা বলতে এই ভাসা-ভাসা ভাবটার কথাই বলছি)।

জাদেহ অনির্দেশ্য শব্দাবলীর উপস্থাপনার জন্য অঙ্কেরই দ্বারস্থ হয়েছেন, আমরা পরে দেখবো। কম্পিউটার বিজ্ঞানী হিসেবে তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শব্দগুলিকে যন্ত্রের ‘বোধ্য’ করে তোলা। তাই সংখ্যার সাহায্য চাওয়া তাঁর কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু, আশ্চর্য, শিবরামও অনুরূপভাবেই ভেবেছিলেন।

  এরপরে শিবরাম তাঁর তত্ত্বটিকে আরো একটু সুনির্দিষ্টতা দিলেন।

“১০০-কেই পুরো সংখ্যা ধরা যাক তাহলে। আমাদের দেহের, মনের, বিদ্যার, রূপের, গুণের- এক কথায় সবকিছুর সম্পূর্ণতাজ্ঞাপক সংখ্যা হলো গিয়ে ১০০; এবং ওই সংখ্যার অনুপাতের দ্বারাই অবস্থাভেদের তারতম্য বুঝতে হবে আমাদের।”

ফাজি সেট তত্ত্ব ১০০-র স্থানে নেয় ১, তা-ই সম্পূর্ণতাজ্ঞাপক, আর অবস্থাভেদ জ্ঞাপিত হয় বিভিন্ন ভগ্নাংশ দিয়ে।

 তত্ব তৈরী করে শিবরাম চললেন রাজীবদের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি মোটামুটি দ্রুততায় রাজীবদের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখেন রাজীব সদর রাস্তায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন, পিছু হটতে হটতে রাজীব এসে পড়লেন শিবরামের উপর। শিবরাম রাজীবকে ধমকালেন- “আমার ধারণা ছিল তুমি ৪২ বুদ্ধিমান, কিন্তু দেখছি তুমি তা নও। বয়সে ১৩ হলে কি হবে, এই তেরতেই তিন তেরং উনচল্লিশ পেকে গেছ তুমি।” এবং একটু পরেই “এখন দেখছি তুমি উননব্বই ইঁচর-পাকা।” এর পরে বচসা। সমবেত জনমণ্ডলীর কাছে রাজীবের অভিযোগ – লোকটা অঙ্ক কষে কষে কি সব গালাগাল দিচ্ছে। অতঃপর জনতার হাতে শিবরামের লাঞ্ছিত হবার বর্ণনা। বিবরণী সমস্তটাই ঐ গাণিতিক সূত্রানুযায়ী। পাঠ না করলে রসগ্রহণ অসম্ভব- এ কাহিনীর সারাংশ হয় না।

শিবরামের টেক্সট থেকে আর একটু –

“রাজীবের বাবাকে গিয়ে যদি আমি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন মশাই ভালো তো? এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থার সংখ্যা যদি হয় ১০০ – তাহলে ভেবেচিন্তে অনেক হিসেব কষে তাঁকে উত্তর দিতে হবে; এই ভালো আছি এখন! পরশু পেটের অসুখে ১০ দাঁড়িয়েছিল, কাল দাঁতের ব্যথায় ৭-এ ছিলাম, আজ যখন দাঁত তোলাই তখন তো কাত, প্রায় নাই বললেই হয়। এই যাই আর কি! তারপর অনেকক্ষণ ০-বার পর সামলে উঠলাম, সেই থেকে একটু দুর্বল বোধ করছি নিজেকে- এখন এই ৫৩।”

   সাম্প্রতিক গাণিতিক তত্ত্বটির মূল দর্শন মূলত এটাই। যে শব্দগুলি অনির্দেশ্য, তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ (১ সংখ্যা দিয়ে সূচিত) অথবা ‘না’ (০ সংখ্যা দিয়ে সূচিত) সবসময়ে বলা সম্ভব হয় না। তখন, ১ এবং ০-র মধ্যবর্তী  সংখ্যা, ভগ্নাংশগুলি দিয়ে তার প্রযুক্তির মাত্রা স্থির করার কথা বলা হয়। শিবরামের উদাহরণ এর আধুনিক ভাষ্যে বলা হবে-

                                 ‘রাজীববাবু এখন .৫৩ সুস্থ।’

                   অথবা        ‘রাজীববাবুর সুস্থতার মাত্রা .৫৩।’

 এটা মনে রাখা দরকার, যে শব্দগুলি অনির্দেশ্য নয়, যেমন ধরা যাক ‘পরীক্ষায় উত্তীর্ণ’ সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্যতা-মাত্রা হয় ১ না হয় ০- যে উত্তীর্ণ তার জন্য ১ এবং যে নয়, তার জন্য ০ বসবে।

  আরো একটি কথা এ প্রসঙ্গে। অনির্দেশ্য শব্দের প্রয়োগমাত্রা নির্ধারণে সামান্য তারতম্যে খুব একটা যায় আসে না। তত্ত্বটির গঠনের মধ্যেই এই ‘সহনশীলতা’র অন্তর্ভুক্তি থাকে। এ বিষয়টিও শিবরামের ভাবনাতে এসেছে। উক্ত রাজীবের বাবার সুস্থতার প্রসঙ্গে আবার –

     “আমার বিস্ময়-প্রকাশে বরং আরো একটু তিনি যোগ করতে পারেন; হ্যাঁ, ৫২-ই ছিলাম মশাই। কিন্তু আপনার সহানুভূতি প্রকাশের পর এখন একটু ভালো বোধ করছি আরো। তা, এই যাহা বাহান্ন, তাহা তিপান্ন।”

  আরো কয়েকটি বাক্যের উদাহরণ- এই যে আমি লিখেছি মোটামুটি দ্রুততায় শিবরাম কথা বলতে চললেন, তা তাঁর ভাষায়, “আমি তক্ষুনি বেড়িয়ে পড়ি ৬২ বেগে।”

       রাজীবের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখলেন, “শ্রীমান রাজীবলোচন সদর রাস্তায় দাঁড়িয়েই ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন, ৯৮ মনোযোগে।”

  তাঁকে রাজীব “পাঁচশো উজবুক” বলায় শিবরাম লিখছেন – “আমি ৯৭ অগ্নিশর্মা হই”, এবং শুধরে দেন, ১০০-র উপরে সংখ্যাই নেই এই তত্ত্বে, আধুনিক ফাজি তত্ত্বে সেই সংখ্যা যেমন ১।

  অথবা সমবেত জনতা শিবরামের ক্রোধে-লাল চক্ষু আর কম্পমান শরীর দেখে তাঁকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মনে করায় তিনি লিখছেন- “ওদের ৭২ বোকামি আমাকে ৯২ অবাক করে দেয়।”

    আগ্রহী পাঠককে আমি গল্পটি অবশ্যই পড়ে ফেলতে অনুরোধ করব।

    শিবরামের অপরিমেয় রসবোধ, শব্দের যাদুর প্রতি টান এবং কৌতুকপ্রিয়তা থেকেই হয়তো তিনি এই অনবদ্য গল্পটি সৃজন করেছিলেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে ভাষা-দর্শনের যে দিকটির প্রতি তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করে ফেললেন, তা আজকের গণিত-কম্পিউটার বিজ্ঞান-ভাষাদর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। শিবরাম তা করলেন অনেকটাই আগে আর ব্যঙ্গচ্ছলে, জ্ঞানকেন্দ্রের বাইরে থেকে।

*****

তথ্যসূত্র:

[১] উল্লিখিত রচনাটির নাম ‘ভাষার অন্ত্যজ শব্দেরা'(পৃঃ ৪১, অমীমাংসার আলো-আঁধারি; প্রকাশক-নান্দীমুখ সংসদ) 

[২] লতফি জাদেহর প্রবন্ধঃ  

https://www-liphy.univ-grenoble-alpes.fr/pagesperso/bahram/biblio/Zadeh_FuzzySetTheory_1965.pdf

Related Posts