অ-সক্ষমতা ও ব্যক্তিপরিচিতি ~ সোমালী

বড় শহরের নামী স্কুলে কাটানো ছোটোবেলার ক্লাসরুমের স্মৃতি ঘাঁটলে এমন কিছু ছেলেমেয়ের কথা আমাদের মনে পড়তে পারে, যারা পেছনের বেঞ্চে বসলে বোর্ড দেখতে পেত না বলে অভিভাবকেরা আসতেন সামনে বসতে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। শিক্ষকের মনোবৃত্তির উপর নির্ভর করত সে পরেরদিন অপমানিত হবে, নাকি সামনে বসতে পাবে। তবে আমাদের মত কিছু সক্ষমতার প্রাধিকারপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীরা চিরকালই এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নাক সিঁটকে থাকতাম। বোর্ডের লেখা পড়তে পারে না, অথচ ক্লাসরুমের মতন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে, বলা ভালো সক্ষমতার দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়েছে, আবার তার ‘না পারা’-র দায় আমাদের উপর চাপিয়ে সুবিধে আদায় করতে চায়। এমন লোকের তো রীতিমত শাস্তি প্রাপ্য! ‘নুলোকাত্তিক’, ‘কানারিয়া’, ‘বোবাহরি’ এইসব ডাকনাম হয়ে ওঠে সেইসবের সামাজিক শাস্তি। সক্ষমতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে না পারার শাস্তি। সংবেদনশীল শিক্ষকদের ঘোষণাও জুটত সাথে, “এই স্কুলে ও পারবেনা, অন্য স্কুলে ভর্তি করুন, যেখানে পড়ার চাপ কম”। চাপটা পড়ার নাকি পড়ানোর পদ্ধতির, সে প্রশ্ন পেরিয়ে ‘ওদের জন্য অন্য স্কুল আছে’-র যে অপরায়ন পদ্ধতি, সেই কোমল হিংস্রতাটুকু দলা পাকিয়ে এই মানুষগুলোর সাথে জড়িয়ে যায়। ‘মজার ডাকনাম’-গুলো যে একসময় শ্রেণীকক্ষের অপরায়ন অতিক্রম করে ব্যক্তিপরিচিতির অঙ্গ হয়ে উঠতে থাকে তা ভুক্তভোগীরা যতদিনে বুঝেছে, ততদিনে অ-সক্ষমতা তাদের ব্যক্তিপরিচয়ের অঙ্গ হয়ে গেছে। অমূল্য সময় কেটে গেছে সক্ষমতার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করাতে গিয়ে এবং এর মধ্যে পড়ে নিজের উপর বেশ খানিক অত্যাচারও হয়ে গেছে। উচ্চবিত্ত অথবা খানিক সচেতন পরিবার বা ব্যক্তির ক্ষেত্রে কখনও সামান্য হেরফের দেখা যায় যেখানে সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে অন্তত গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উঠতে পারা গেছে।

         অ-সক্ষমতার অভিজ্ঞতা গাঢ় হতে হতে প্রতিবন্ধকতায় এসে ঠেকে। ‘কানা’, ‘কালা’, ‘বোবা’, ‘খোঁড়া’ — হয়ে ওঠে সক্ষমতার ধ্বজাধারীদের প্রচলিত ভর্ৎসনার পদ্ধতি। প্রতিবন্ধকতা বা Disability শারীরিক, মানসিক, অথবা সামাজিক হতে পারে, অথচ অপরায়ন ধ্রুবক। প্রতিবন্ধী শব্দটি বাংলায় বেশি ব্যবহৃত হয় শারীরিক পার্থক্য চিহ্নিত করতে গিয়ে। ‘সভ্য’ সমাজে মানুষের প্রকৃতি চিহ্নিতকরণের যে সব দুষ্ট লোকাচার রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান শারীরিক ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে মানুষের শ্রেণীবিভাজন। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যকারিতা সংক্রান্ত ভিন্নতা লাল-নীল-সবুজ হরেক বাতি জ্বালিয়ে জানিয়ে দেয় সমাজে ‘আমাদের’ আর ‘তাদের’ মধ্যে ব্যবধান কতটা, এবং সেই ব্যবধানের গরিমা ধরে রাখতে গেলে ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত। এদিকে শারীরিক ভিন্নতা কেবলমাত্র দৃষ্টিহীনতা, বাকহীনতা, শ্রবণশক্তিহীনতা, অঙ্গহীনতা এইধরনের গোদা কিছু ভাগের পরিবর্তে স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত ভিন্নতা, শরীরের রাসায়নিক প্রকৃতির ভিন্নতা, যথাযথ পুষ্টির অভাব, চিকিৎসাজনিত ত্রুটি অথবা দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া শারীরিক ও মানসিক (ঘটনাচক্রে সামাজিক) অবস্থা হিসেবে জানা যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসাশাস্ত্রে এই অবস্থাগুলির নির্দিষ্ট নাম রয়েছে। বহুক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যারা এই ভিন্নতাকে ধারণ অথবা বহন করে চলেছেন, তারা নিজেদের যাপিত জীবন থেকে উঠে আসা বিভিন্ন বিষয়ের প্রেক্ষিতে নিজেদের কিছু নামে পরিচিত করাতে পছন্দ করেন। যেহেতু সামাজিক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিসর ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়না, ফলে সামাজিক পরিচিতি আর আত্মপরিচয়ের ঐক্য ঘটে ওঠে না।

প্রকৃতিতে টিকে থাকার লড়াইয়ের সূত্রে সক্ষমবাদের যে ইতিহাস আমরা শরীর ও সামাজিক মননে বহন করি, তাতে শারীরিক ও মানসিক ভিন্নতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই মানুষদের আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে। সক্ষমতা মাপকাঠি হয়ে ওঠে। ষাট-সত্তরের দশক থেকেই ‘disabled’ মানুষেরা তাদের পরিস্থিতি ও সমস্যাগুলি চিকিৎসাভিত্তিক ব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে চিন্তা ও দর্শনের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আলোচনা শুরু করেন।

সক্ষমবাদের সংজ্ঞা এখনও পরিবর্তনশীল। Talila A. Lewis[1] (২০২১) এ Ableism বা সক্ষমবাদের সংজ্ঞা হিসেবে বলেছেন:-

একটি ব্যবস্থা যা সামাজিক পরিসরে নির্মিত স্বাভাবিকত্ব, মেধা, উৎকর্ষতা, কাম্যতা, ও উৎপাদনশীলতার মাপকাঠির উপর নির্ভর করে মানুষের শরীরের ও মনের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। এই নির্মাণগুলি Anti-Blackness, সুপ্রজননবিদ্যা (Eugenics), নারীবিদ্বেষ (Misogyny), ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, এবং পুঁজিবাদের ধারণার গভীরে প্রোথিত

এই প্রথাবদ্ধ নিপীড়নের ফলস্বরূপ সমাজকে মানুষের ভাষা, নিজেকে উপস্থাপন করার ধরন, ধর্ম, এবং/অথবা বংশবৃদ্ধির, সামাজিক সাফল্যের, ও ভদ্রতা করতে পারার সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে বেছে যোগ্য ও অযোগ্য বেছে নিতে হয়।

স্বাভাবিকভাবেই, এহেন সক্ষমবাদের লেন্স দিয়ে যদি ভিন্নতাকে দেখা হয়, ধারাবাহিকভাবে তাকে অযোগ্য মনে হতে থাকবে ও অপরায়নের পদ্ধতি জারি থাকবে।

কারা ওরা? কি ওদের পরিচয়?

         সক্ষমবাদের বহুবিধ মাত্রা আছে, শারীরিক গঠন, লিঙ্গ, স্বাভাবিকতা, ভদ্রতা, মেধা, অর্থনৈতিক ও মানসিক স্থিরতা, কাম্যতা, উৎপাদনশীলতার মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে একজন মানুষের প্রয়োজনমত নমুনা নিয়ে নির্ধারণ করে দেয় যোগ্যতা কতটা। যেন গবেষণাগারে রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। সময়কাল অনুযায়ী এই সমস্ত নির্মাণের ধরন বদলে বদলে যায় সামাজিক, ভৌগোলিক, ও বাজার সংক্রান্ত চাহিদার হাত ধরে। তবু কিছু মডেলের প্রভাব গভীরে প্রোথিত, সুদূরপ্রসারী, এবং ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে যায়।

(১) পরম্পরাগত / নৈতিক / ধর্মনিষ্ঠ মডেল (প্রতিবন্ধকতা একটি দৈব ঘটনা/ Disability is an act of God)

জন্মসূত্রে প্রাপ্ত শারীরিক ভিন্নতা, ‘অসামঞ্জস্য’ ইত্যাদি পাপের ধারণার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতাই একে —মানুষটির, তার বংশের অথবা তার জন্মদাতা/দাত্রীর পূর্বজন্মের পাপ, অথবা তাদের কোনরকম বেমানান, অতিকাম, অথবা বিকৃতকাম আচরণের ফলে ঘটিত পাপের প্রকাশ বলে মনে করে। অর্থাৎ এই জীবনকাল তার এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের প্রায়শ্চিত্তের কাল, এবং তার শারীরিক, সামাজিক, ও মানসিক অ-সক্ষমতা সবই এক মহাজাগতিক বিচারালয়ে শাস্তির পদ্ধতিমাত্র। এহেন “অপরাধী”দের সমাজের মূলস্রোতেই না রেখে, কোন কারাগারে অথবা দ্বীপান্তরে, জঙ্গলে, নিদেনপক্ষে জলে নিক্ষেপ করে দেওয়ার কথা ভাবা হত। কারাগারে আসামী আর নির্দোষ ব্যক্তি তো আর একসাথে থাকতে পারেননা! কখনও অ্যারিস্টটলও বলেছেন, সন্তান যদি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হয়, তবে পিতামাতা তার থেকে মুক্তি পেতে পারেন। বিংশ শতকেও ব্রিটেনের রাজপরিবারের যে সদস্যদের বৌদ্ধিক বৈকল্য দেখা যেত, তাদের পরিবার থেকে দূরে কোন অ্যাসাইলামে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হত। ইতিহাসের পট থেকে সমসাময়িক পটে নেমে এলেও এর প্রমাণ পাওয়া যায় উনবিংশ শতকের ইউজেনিক্স আন্দোলনের সময়, যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় হিটলারের গণহত্যার নীতি ও প্রতিবন্ধী মানুষদের হত্যানীতি প্রসঙ্গে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে সবার আগে হত্যা করা হত প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের (শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম মানুষদের)। এখনও যে মানুষেরা প্রতিবন্ধকতাকে সাথে নিয়ে বাঁচেন, তারা পরিবারে এবং ঘনিষ্ঠ পরিসরে প্রতিনিয়ত হিংসার শিকার হন[2]

                  এই মডেলটি প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতাকে অপরাধের সমতুল্য করে তোলে, তার উৎস কেন্দ্রীভূত হয় ব্যক্তির শরীরে (চরিত্রে) অথবা তার গোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে তার জীবনের রশি ফসকে চলে যায় তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, অজানা-অদৃশ্য কিছুর কাছে। ফলে এই অপরাধবোধ ব্যক্তির/গোষ্ঠীর, এবং তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। অস্বস্তিকর হলেও এই ধরনের গল্প বহুল প্রচলিত যে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। আজ এপিজেনেটিক্সের গবেষণা প্রমাণ করছে জিনগত অবস্থানই চূড়ান্ত নয়। পরিবেশের প্রভাব DNA-র মধ্যে পরিবর্তন আনেনা ঠিকই, তবে শরীর কেমন করে জিনের অবস্থানগুলিকে ব্যাখ্যা করছে, তার পরিবর্তন ঘটায়। ফলে অ-সক্ষমতা সমাজে কিভাবে গৃহীত হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে আরও গুরুতর মানসিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে, যা ব্যক্তির অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দেয়।

…এহেন সক্ষমবাদের লেন্স দিয়ে যদি ভিন্নতাকে দেখা হয়, ধারাবাহিকভাবে তাকে অযোগ্য মনে হতে থাকবে ও অপরায়নের পদ্ধতি জারি থাকবে।

(২) মেডিক্যাল মডেল / চিকিৎসাশাস্ত্রমুখী ধারণা ও  (৩) পুনর্বাসন মডেল/রিহ্যাবিলিটেশন মডেল

         নাম থেকেই স্পষ্ট, এই ধারণা অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতা একধরনের শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা, ‘সুস্থ’ ও ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপনের জন্য যার চিকিৎসার মাধ্যমে সংশোধন প্রয়োজন। এই মডেলটি Biological-Inferiority বা Functional-Limitation মডেল নামেও পরিচিত, যা যত্নের তুলনায় চিকিৎসা, সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।

         মেডিক্যাল মডেলের সাথেই পুনর্বাসন মডেলটি ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। মানুষকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারার অঙ্গীকার। শুশ্রূষার পরিসরে একজন বিশেষজ্ঞ থাকবেন, যিনি চিকিৎসা করবেন এবং আরেকজন ‘Client’ থাকবেন, যিনি সুস্থ হতে এসেছেন। পূর্বনির্ধারিত ভূমিকা ধরেই নেয় প্রথমজনের জ্ঞানের পরিধি বেশি, সুতরাং দ্বিতীয় মানুষটির সুস্থতা সংক্রান্ত প্রায় সবরকম সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন।

         আবারও লক্ষণীয়, যে এক্ষেত্রেও মানুষের দক্ষতা/সক্ষমতার থেকেও এই পরিসরে বেশি আলোচিত হয় অ-সক্ষমতাগুলি। যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ-সক্ষমতাগুলিই (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে, তাই অ-সক্ষমতাগুলিকে কেন্দ্র করেই আত্মপরিচয়ের দুই মেরু সৃষ্টি হয়ে যায়। প্রথমত, বিশেষজ্ঞের তরফে প্রাথমিক চেষ্টা থাকে পরিসর নির্বিশেষে মানুষটিকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার, যা সক্ষমবাদের আদর্শ দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে প্রভাবিত। এই আদর্শের প্রভাব প্রতিবন্ধী হিসেবে যিনি নিজেকে চিহ্নিত করেন, তার কাছে ক্ষতিকারক হতে পারে। সক্ষমবাদী চিন্তার পরনির্ভরশীলতা এবং অ-সক্ষম ধারণার পরনির্ভরশীলতার মধ্যে পার্থক্য থাকবে সেরকমই স্বাভাবিক। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিশেষজ্ঞ একজন তথাকথিত সক্ষম মানুষ, ফলে তার নির্ধারিত চিকিৎসাপ্রণালী, দৈনন্দিনের ব্যবহার্য নিয়ম ইত্যাদিও সক্ষমবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, সক্ষমবাদী আদর্শে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলে হীনমন্যতা তৈরি হতে থাকে। নিজেকে পরনির্ভরশীল, অপ্রয়োজনীয় মনে হতে থাকে, এবং সক্ষম শরীর ও পরিসরের সাথে কোন আদানপ্রদান অসম্ভব মনে হয়। এই দূরত্ব চিরকালীন। মানুষ তার সমাজ থেকে যে অপরায়ন ও ঘৃণার শিকার হয়, অন্তরে তার অনুবাদ হয়ে তৈরি হয় আত্মঘৃণা!

(৪) চ্যারিটি মডেল ও (৫) অর্থনৈতিক মডেল

         পূর্বোল্লিখিত মডেলগুলির চিকিৎসা, ও সংশোধনী উদ্দেশ্য পেরিয়ে চ্যারিটি মডেলে সমাজ যত্ন নিয়ে কথা বলে। ভিন্নতা এই মডেলেও সমস্যার। এই সমস্যা এখনও উক্ত মানুষের বা গোষ্ঠীর শরীরের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। তবে এই মডেল অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতা নামক দুর্ভাগ্যজনক (মূলত শরীরকেন্দ্রিক) পরিস্থিতির ‘শিকার’ অসহায় মানুষগুলি সক্ষম মানুষদের দয়ার উপর নির্ভরশীল, এদের ‘আমাদের মত আত্মনির্ভরশীল’ করে তোলা প্রয়োজন, এবং সে দায় সমাজের সক্ষম মানুষদের। ফলে অচিরেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বগুলির অন্যতম হয়ে ওঠে এই অসহায়, বেচারা মানুষগুলির সহায়তা করা। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলির বেশিরভাগ নীতিই (Policy) এই মডেলের ছায়াতে তৈরি।

         চ্যারিটি মডেল ও অর্থনৈতিক মডেল এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। শারীরিক বা মানসিক বিকলতা মানুষের কর্মক্ষমতাকে (অর্থনৈতিক স্তরেও) প্রভাবিত করে। চ্যারিটি মডেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে অর্থনৈতিক পরিবেশের উপরে। প্রতিটি গোষ্ঠীতেই এমন কিছু সদস্য থাকেন, যারা উৎপাদন পদ্ধতিতে বরাবরেরই অংশীদার না হলেও, উৎপাদিত দ্রব্যের ভাগীদার হন। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় এই সদস্যরা ‘free rider’ হিসবে পরিচিত। অ-সক্ষমতার অভিজ্ঞতা বহুক্ষেত্রেই ‘free rider’-এর সমতুল্য হয়ে ওঠে। ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদ যেখানে কম, সেই সমাজে বাতিল ও অপসারণের মাধ্যমে দায় ঝেড়ে ফেললেও, উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকলে, সেই নীতি পরিবর্তিত হয়। অক্ষমের প্রতি সক্ষমের দয়া কারেন্সিতে পরিণত হয়। প্রতিবন্ধকতার প্রতি পরোপকারের দায় যে নৈতিক মূল্য তৈরি করে, তার উপর ভিত্তি করে অনেক সংস্থার বাজারদর নির্ধারিত হয়। Disability Quota-র মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতার ‘শিকার’ মানুষদের কাজে নেওয়া (এমন জেনেও, যে তাদের কাজের পরিমাণ তথাকথিত ‘সক্ষম’ সহকর্মীদের তুলনায় কম হতে পারে), পরোপকারের খাতে পুঁজি বাড়ানো (জামাকাপড়, খাবার ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলিতে দান করা), ইত্যাদি সংস্থার নৈতিক দর বাড়িয়ে দেয় (Corporate Social Responsibility – CSR)। ‘সক্ষমের’ সক্ষমতার দর নির্ধারিত হয় ‘অ-সক্ষমের’ অ-সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এই মানুষেরা তখন আর মানুষ থাকেন না, পরোপকার প্রকাশের নিষ্ক্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। স্ব-ইচ্ছা (Agency), যা খানিকটা Rehabilitation Model এর ক্ষেত্রেও উপেক্ষিত হয়, এক্ষেত্রে দৃশ্য থেকে একেবারেই মুছে যায়।

         এই মডেলের ছায়া প্রতিবন্ধকতা অথবা ভিন্নতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষদের আত্মমর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর। হিংসার না হলেও, এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে মানুষগুলি দয়ার ‘শিকার’ হন। বহু মানুষ যারা প্রতিবন্ধকতাকে জীবন দিয়ে বুঝেছেন, তারা এই দয়ার অন্তর্নিহিত অবমাননা নিয়ে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। দয়া আর সহমর্মিতার মধ্যে যে ক্ষীণ রেখা টানা আছে, সে রেখা রাজনৈতিক, ফলে ব্যক্তির আত্মমর্যাদার আলোচনা সেই রাজনীতির আলোচনা ব্যতিরেকে অসম্পূর্ণ। সক্ষমবাদ যখন কারোর উপর দয়া করে, সেই দয়া দিয়েই তাদের চিহ্নিতও করে ফেলে। এই দয়ার প্রকরণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আত্মমর্যাদাকে হীন করে, তাদের ভালো থাকার সাথে আপস করতে বাধ্য করে।

বিশেষ চাহিদা: এক উচ্চতা থেকে আরেক উচ্চতায় উঠবে বলে মানুষ সিঁড়ি বানিয়েছে। কিন্তু র‍্যাম্প বানাতে হলে সেটা Wheelchair এ থাকা মানুষটির বিশেষ চাহিদা বলে চিহ্নিত হয়। ব্যাঙ্কে পাশের মানুষটিকে নিজের ফর্মটা ভরে দিতে অনুরোধ করলে সেটি সামাজিক সহায়তা কিন্তু একজন দৃষ্টিহীন মানুষ পাশের মানুষটিকে স্টেশনে ট্রেনের তালিকাটি পড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে তা হবে বিশেষ চাহিদা। চশমা হবে সহায়তা কিন্তু ওয়াকিং স্টিক হবে বিশেষ চাহিদা। শারীরিক অথবা মানসিক বিকলতার অনুভব রয়েছে এমন মানুষদের জন্য চ্যারিটি মডেলের ছায়াতেই তৈরি হয় ‘বিশেষ’ বিদ্যালয় (Special Schools), ‘বিশেষ’ প্রতিষ্ঠান (Special Institutions), ‘বিশেষ’ সহায়তা (Special aid), ‘বিশেষ’ শিক্ষক (Special Educator)।

দিব্যাঙ্গ: চ্যারিটি মডেলের সাথে ধর্মনিষ্ঠতার এক অদ্ভুত মিশেল দেখা যায় যেখানে অঙ্গহানি অথবা অঙ্গহীনতাকে দৈব সক্ষমতার আশীর্বাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সক্ষমবাদের প্রবল প্রভাব এই ধারণায় স্পষ্ট। Impairment অথবা বিকলতাকে এই ধারণায় মহানতার আভাস হিসেবে দেখা শুরু হয়। সামাজিক স্তরে দয়ার পাত্র অথবা পূজার পাত্র হিসেবে দেখলে সমাজ যে পরিমাণ মনোযোগ (পড়ুন: সংস্থান) দেয়, তার জন্য এই দুই ধারণার এক্ষেত্রে একত্রে ব্যবহার কৌশলী পরিকল্পনাশক্তির পরিচায়ক এবং অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু অন্তিমে এই ধারণা প্রতিবন্ধকতাকে সক্ষমবাদের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে নিজের জীবনের উপরই মানুষগুলির নিয়ন্ত্রণ থাকে না। Disability Movement এর অন্যতম সক্রিয় কর্মী Stella Young[3] এর কথা অনুসরণে বলা যায় সক্ষমবাদী সমাজ প্রতিবন্ধকতা অনুভবকারী মানুষদের আত্মনির্ভরশীল দেখলে তাদের প্রেরণার বস্তু বলে মনে করে (Objects of inspiration)। একজন Wheelchair এ বসা মানুষকে দেখে আমরা তাকে শিক্ষক, পেশাদার প্রসাধনকর্মী, অভিনেত্রী, বা যৌনকর্মী বলে ভাবতেই পারিনা। আমাদের ভাবতে হয়, যে তিনি তার গোষ্ঠীর নায়ক, প্রেরণার প্রতীক। দুর্ভাগ্যবশত এই প্রতীকিকরণ আদৌ প্রতিবন্ধকতার অনুভবকারী মানুষদের দ্বারা বা তাদের জন্য তৈরি নয়। এটি তৈরি সক্ষমবাদী মানুষদের জন্য। Stella সচেতনভাবেই এই ঘটনাটির বিবরণ দিতে গিয়ে একে Inspiration porn[4] হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কোন এক গল্প বা ছবি, যেখানে মুখ্য চরিত্রের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা বা বিকলতার প্রকাশ স্পষ্ট এবং সে সক্ষমবাদী ভাবাদর্শের সাফল্যকে অর্জন করে ফেলেছে বা পারছে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে আঙুল তুলে দেখানো যে ‘এরা’ যদি পারে, তুমি কেন পারবে না? Leon Festinger এর Social Comparison Theory র অন্যতম মুখ্য দিক ছিল – Downward Social Comparison, যা অনুযায়ী মানুষ নিজের তুলনায় ‘দুর্বল’, ‘অযোগ্য’, ‘অসহায়’ মানুষের সাথে নিজেদের তুলনা করে নিজের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। এই ধরনের সামাজিক অভ্যেস এক মানুষকে অপর মানুষের পরিচয় সাধনের যন্ত্র বানিয়ে ফেলে, তার মানবিকতাকে খর্ব করে, যা অন্তিমে অ-সক্ষম মানুষদের পক্ষে তো বটেই, সক্ষম মানুষদের পক্ষেও ক্ষতিকর।

..সক্ষমবাদী আদর্শে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলে হীনমন্যতা তৈরি হতে থাকে। নিজেকে পরনির্ভরশীল, অপ্রয়োজনীয় মনে হতে থাকে, এবং সক্ষম শরীর ও পরিসরের সাথে কোন আদানপ্রদান অসম্ভব মনে হয়। এই দূরত্ব চিরকালীন। মানুষ তার সমাজ থেকে যে অপরায়ন ও ঘৃণার শিকার হয়, অন্তরে তার অনুবাদ হয়ে তৈরি হয় আত্মঘৃণা!

() পরিচয় মডেল (Identity Model)

       মানুষের পরিচয় সামাজিক পরিসরের নির্মাণ। সামাজিক পরিসরে মানুষের অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়, তার পরিচয় কেমন হবে। এই প্রসঙ্গে পরিচয় মডেলে এসে ব্যক্তির শরীরের পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার দায় প্রতিস্থাপিত হয়। এই মডেলের অন্যতম মুখ্য বিবৃতি ছিল, মানুষের মধ্যে শুধু তার প্রতিবন্ধকতা বা অ-সক্ষমতাকে চিহ্নিত করলেই হবেনা। প্রত্যেকেই সক্ষমতা ও অ-সক্ষমতা পেরিয়েও এক-একজন স্বতন্ত্র মানুষ, এবং সেইটুকু মর্যাদা প্রতিটি মানুষেরই প্রাপ্য। এই মডেল মানুষের মধ্যে তার প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা পেরিয়েও ব্যক্তি হিসেবে তার বিভিন্ন দক্ষতা, তার অদ্বিতীয়তা, তার শক্তি, তার ভালোলাগা ও ভালোবাসাগুলির সন্ধান করে; একজন ‘প্রতিবন্ধী’ অথবা ‘প্রতিবন্ধকতার শিকার’ মানুষকে পেরিয়ে একজন স্বতন্ত্র মানুষকে খোঁজে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ‘Persons with Disability’ (PWD) শব্দবন্ধটির জন্ম, যা আজ দেশকাল ব্যতিরেকে প্রচুর মানুষ যারা প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাঁচেন, তারা নিজেদের পরিচায়ক হিসেবে আপন করে নিয়েছেন।

 

(৭) সামাজিক মডেল (Social Model) (৮) বৈচিত্র্য মডেল (Diversity Model)  

উপরোক্ত মডেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে সক্ষমবাদের প্রভাব স্বীকার করে যখন মানুষ নিজেদের অধিকার দাবী করতে শুরু করে, সেখানে (দৃষ্টিভঙ্গির, চিন্তার, দর্শনের, এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রেক্ষিতে) একটা বড় পরিবর্তন ঘটে এবং আমরা সামাজিক মডেলের ধারণায় এসে পৌঁছই। এই ধারণার কেন্দ্রে রয়েছে এক দৃঢ় সংকল্প যে মানুষের শরীর নয়, বরং সে যে পরিবেশে অবস্থান করে তার প্রকৃতিই মানুষকে সীমাবদ্ধ করে। প্রতিবন্ধকতার উৎস মানব শরীর নয়, বরঞ্চ পরিবেশের সীমিত সংস্থানের সম্ভাবনা, সামগ্রিক সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (বিদ্বেষ, অবমাননা) এবং অপরায়নের মাধ্যমে ভিন্নতার অভিজ্ঞতাকে সমাজের মূলস্রোত থেকে অপসারণ।

         প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতাকে দেখার ক্ষেত্রে এই মডেলে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রতিবন্ধকতা এবং বিকলতার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়। প্রতিবন্ধকতার কেন্দ্র এক্ষেত্রে সরে যায় মানুষের শরীর থেকে সমাজে; সমাজের কাঠামোয়, দর্শনে, এবং নৈতিক স্তরে। বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় Rehabilitation Professional, ডাক্তার, পরিবারের সক্ষম কেয়ারগিভারদের পরিবর্তে এই মডেলে মর্যাদা পান প্রতিবন্ধকতা যারা অনুভব করছেন, তারা নিজেরা। পরিচয় মডেল যেখানে মানুষের দক্ষতা ও শক্তির সন্ধান করে, তার বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করতে চায়, সামাজিক মডেল তা ছাপিয়ে গিয়েও সমাজের ডিজাইন ও স্থাপত্যের ত্রুটির দিকে আঙুল তোলে, এবং প্রতিবন্ধকতাকে আসলে সেই ত্রুটিরই শরীরগত প্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই মডেল দাবী করে, এই ‘design error’-গুলিই কিছু মানুষকে সক্ষম এবং কিছু মানুষকে অ-সক্ষম করে তুলেছে, এবং তুলছে। আলোচনা ও সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে চলে আসে প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত ব্যক্তিনির্ভর অভিজ্ঞতাগুলি, সমাজের তরফ থেকে আসা সেই সংক্রান্ত বিদ্বেষ, ঘৃণা ইত্যাদি সবকিছুই, যা প্রতিবন্ধকতার অনুভবকারী মানুষদের প্রতিদিনের শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও স্থাপত্যবিষয়ক সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। ফলে এই ধারণায় বিশ্বাসী মানুষেরা নিজেদের Person with Disability র বদলে Disabled Person বলতে পছন্দ করেন, যার অন্তর্নিহিত অর্থ ‘সমাজ আমার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, আমাকে অক্ষম করে তুলেছে’। বলাই বাহুল্য এই মডেল Disability Advocacy-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে উঠেছে যা ‘বিশেষ চাহিদা’-র ধারণাকেও প্রশ্ন করতে শেখায়। ফলে দাবী ওঠে প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত যে কোন নীতির কেন্দ্রে থাকুক প্রতিবন্ধকতার সাথে যাপিত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, যা দয়া নয়, নিয়ন্ত্রণ ফেরত দেয় — স্লোগান ওঠে, “nothing about us, without us”।

এই মডেলের সাথে আবার অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে থাকে বৈচিত্র্য মডেলের ধারণা। এই মডেলটি শরীর সংক্রান্ত একক সত্যকে প্রশ্ন করে। প্রতিটা মানব শরীর ভিন্ন, ফলে এক নির্দিষ্ট ধরনের শরীরকে স্বাভাবিক, বা আদর্শ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে না, যাতে তাদেরও শরীরই কেবল স্বীকৃতি পায়, এবং বাকিদের শরীরকে ‘বিশেষ’ শরীর বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যে কোনরকমের ভিন্নতাই শারীরিক না হলেও মানসিক অথবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। ভিন্নতাই সেক্ষেত্রে বিকলতার সমতুল্য হয়ে উঠছে। ফলে প্রতিবন্ধকতা নয় বিভিন্নতা হিসেবে চিহ্নিতও করা যেতে পারে।

 (৯) Legitimacy Model, যা কে প্রকৃত প্রতিবন্ধকতার অনুভব করেছে, কে করেনি এই বাদানুবাদকে তুলে ধরে, তার শ্রেণীবিভাজনকেও প্রশ্ন করে Diversity Model। মানুষের ভিন্নতাকে সক্ষমতার মাপকাঠিতে, স্বাভাবিকতার মাপকাঠিতে বিচার করতে গেলে তবেই যোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে, সক্ষমতা বা অ-সক্ষমতার প্রশ্ন ওঠে নচেৎ নয়। প্রতিটা শরীরের চাহিদা ভিন্ন, ফলে কেউ বেশি স্বাভাবিক নয় অথবা কেউ বিশেষ নয়।

 (১০) রাজনৈতিক ও সামাজিক মডেল বলে সমাজ নিরপেক্ষ না হলেও, কিছু কিছু নিপীড়িত শ্রেণীও রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় তাদের অবস্থানের দরুন disabled হয়ে পড়ছেন। এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে বয়স, লিঙ্গ, যৌনপরিচয়, জাতি, বর্ণ, বর্গ, ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে তথাকথিত একজন সক্ষম মানুষ জীবনের কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে অ-সক্ষম হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। কোন এক বাড়িতে মালিকের ছেলে এবং তার গৃহসহায়িকার ছেলে একই রকমের সাফল্যের স্বপ্ন দেখতে পারেন না, কারণ সমাজের পরিকাঠামো এই দুজনের মধ্যে একজনকে কিছু কিছু সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তার চাহিদাগুলিকে গন্ডি কেটে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। তার জীবনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

প্রতিবন্ধকতাকে দেখার ধরন বদলালেও, প্রতিবন্ধকতার আগে আগে মশাল নিয়ে হাঁটে সক্ষমবাদের ধারণা। সমাজের সামগ্রিক পরিকাঠামো নির্ধারণে এর যে ভূমিকা, তার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রায় কমবেশি প্রতিটি মানুষেরই পরিচয় প্রতিবন্ধকতার নয়, বরং সক্ষমবাদের শিকার হতে থাকে। অসুস্থ পুরুষ, বাচ্চা, বৃদ্ধ, ও ‘দিব্যাঙ্গ’ তরুণের স্থান হয় ট্রেনের মহিলা কামরায়, কারণ সাধারণদের তুলনায় তাদের ‘বিশেষ’ যত্নের (পরিবেশের) প্রয়োজন। শুরুর গল্পের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকা ছাত্র/ছাত্রীটিও সক্ষমবাদের খাঁড়ার নিচে চলে এসেছে। Talila A. Lewis এই বিষয়কেই মাথায় রেখে বলেন, “You do not have to be a disabled person to experience ableism”। কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার না হয়েও সক্ষমবাদের খাঁড়ার কাছাকাছি চলে আসা যায়, হয় খাঁড়ার ধারক হিসেবে অথবা শিকার হিসেবে। তবে, এর উপস্থিতি প্রতিবন্ধকতার কাহনে পৃথক আলোচনার দাবী রাখে, কারণ ওই একই ছাত্র বা ছাত্রীটির যদি দৃষ্টিশক্তি আংশিক ও হারিয়ে যায়, তবে সে সক্ষমবাদের হাতে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারাবে।

 ******

[1] Talila A. Lewis নিজেকে একজন সামাজিক ন্যায়ের কারিগর, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, আইনজীবি এবং শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করেন। শিক্ষা, চিকিৎসা, এবং আইনের পরিসরে সামাজিক ন্যায় সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে USA তে কাজ করেন এবং Disabled মানুষদের সাথে হতে থাকা ধারাবাহিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন (ব্লগ)।

[2] Disability and the culture of violence (https://www.thehindu.com/opinion/columns/Disability-and-the-culture-of-violence/article17205302.ece)

[3] Stella Young (1982-2014) একজন অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক, কৌতুককর্মী। তিনি Disability আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। (YouTube Link)

[4] Inspiration Porn – একটি ছবি যেখানে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এমন এক মানুষ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন শিশুকে দেখা যায়, যে খেলা, কথা বলা, দৌড়নো, ছবি আঁকা, টেনিস বল মারা ইত্যাদি কিছু সাধারণ কাজ করছে, অথচ শিরোনামে দেওয়া রয়েছে এই ধরনের কথা — “তোমার অজুহাত খাটে না”, “হাল ছাড়ার আগে আরও একবার চেষ্টা করো”। (Young, 2012)

Reference

Retief, M. & Letšosa, R., 2018, ‘Models of disability: A brief overview’, HTS Teologiese Studies/ Theological Studies 74(1), a4738. https://doi.org/ 10.4102/hts.v74i1.4738

World, D. (2010, September 10). Models of Disability: Types and Definitions. Retrieved from Disabled World: https://www.disabled-world.com/definitions/disability-models.php

Grue, J. (2016). The problem with inspiration porn: A tentative definition and a provisional critique. Disability & Society, 31(6), 838–849. https://doi.org/10.1080/09687599.2016.1205473

প্রচ্ছদঋণঃ Dadu Shin