বসন্তের প্রথম বিকেলেই বনের মধ্যে খুব একচোট ঝামেলা বেধে গেল! চারিদিকে খালি অভিযোগ আর অভিযোগ! কাকেরা বলছে কোকিল তাদের বাসায় ডিম পেড়ে গেছে। আবার টিয়া বলছে কাকেরা নাকি খুব মিথ্যেবাদী; সারাক্ষণ ছাইপাঁশ খায় আর পেট খারাপ হলেই বাজে বকতে আরম্ভ করে। সাপ বলল- ‘কোকিলকে একবার হাতের কাছে পাই, এক ছোবলে সাবাড় করে দেবো।’ তা সে শুনে কোকিল বলছে- ‘এতদিন পর দেশে এলাম আর তোমরা আমাকে গাল দিচ্ছ!’ ওদিকে বনমোরগ প্যাংলা প্যাংলা পা নিয়ে পাগলের মতো ছুটে চলল সারা বন, আর চিৎকার করে বলতে লাগল- ‘পালাও, পালাও! ভূত এসে ডিম পেড়েছে কাকের বাসায়!’
কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে তা আল্লাই জানেন! পায়রার জানার কোনো ইচ্ছেও নেই। সে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আচ্ছা বলো তো, বিরক্ত হবারই কি কথা নয়? সবাই মিলে ঝগড়া করে করে বনটাকে রীতিমতো নরক বানিয়ে ফেলেছে! তাই আর থাকতে না পেরে পায়রা তার বাসা থেকে উড়ে চলল বহুদূরে। একবার ভাবল কোকিলের মতো সেও যদি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়? ভাবতেই বুকের ভেতরটা তার দুরুদুরু করতে লাগল। না না, সে বড় বেশি দুঃসাহসের কাজ হয়ে যাবে! কি হবে, যদি সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে হঠাৎ তার শরীর খারাপ লাগে? যদি মরুভূমির মধ্যে উড়তে উড়তে মাথা ঘোরে, ডানা ব্যথা হয়ে যায়? একটা গাছ পাবে না যার ডালে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। থাক বাবা, অত অ্যাডভেঞ্চারে কাজ নেই। আবার বনের মধ্যে ওই ঝগড়ুটে পাখিদের মধ্যে ফিরে যেতেও তার ইচ্ছে করে না। ফলে কি করবে ভাবতে ভাবতে আর এলোমেলো উড়তে উড়তে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে আসে। অন্ধকারে পায়রা আবার বেশি দূর দেখতেও পায় না। ফলে সূর্য অর্ধেক ডুবতে না ডুবতেই সে একটা বুড়ো নিমগাছের ডালে এসে বসল।
জায়গাটা বনের একেবারে শেষের দিকে। এরপর চওড়া একটা নদী। তার ওপারে মানুষের গ্রাম। গ্রামের পেছনে ঘন সবুজ পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাথার ওপর সূর্য একটু একটু করে ডুবছে। পায়রা সবকিছু ভুলে মুগ্ধ হয়ে কমলালেবুর মতো সূর্যটাকে দেখে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ আলো থাকে। সেই আলো ফুরিয়ে যাবার আগে পায়রা রাতটুকু কাটানোর জন্য ভালো একটা ডাল খুঁজতে লাগল। এমন সময় তার চোখে পড়ল উঁচু একটা ডালের সাথে সুতো দিয়ে বাঁধা একটা মোটাসোটা বই। সে চোখদুটো মলাটের খুব কাছে এনে বইয়ের নামটা পড়ার চেষ্টা করল। জ্যো-তি-র্বি-জ্ঞা-ন! উফ্ কি কঠিন নাম! বইয়ের ভেতরের লেখাপত্র তো আরও জটিল! এমন সব শক্ত শক্ত অঙ্ক কষা যে দেখলেই পিলে চমকে ওঠে! পায়রা ঝটপট বই বন্ধ দিল। এমনসময়, হঠাৎ তার কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু করল। মনে হতে লাগল তার ঠিক পেছনেই যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে! সে ধীরে ধীরে পেছনে ফিরতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল! পায়রার সামনে এখন চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা প্যাঁচা! তার বিশাল বিশাল হলুদ রঙের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে!
জোড়া ভুরুওলা লোকেদের এমনিতেই পায়রার বড় ভয় করে। অনেকদিন আগে শালিক একবার বলেছিল- যাদের দুটো ভুরু জোড়া হয় তাদের নাকি স্বভাব বেজায় প্যাঁচালো! এই প্যাঁচাকে দেখেই শালিকের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আরও একটা কথা- প্যাঁচা নাকি কথায় কথায় রাগ করে আর দুমদাম অভিশাপ দেয়। একবার যাকে অভিশাপ দিয়েছে তার আর নিস্তার নেই।
পায়রাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে প্যাঁচা বলল- ‘কি চাই? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’
ও’রকম গম্ভীর গলা শুনে পায়রা তো আরও ঘাবড়ে গেছে। সে তখন ত-ত করে বলল- ‘ন্না না, আমি তো বুঝতে পারিনি যে বইটা আপনার। জানলে কি আমি ধরতাম নাকি? তা হলেও না জানিয়ে অন্যের বই ধরা আমার উচিৎ হয়নি। সরি।’
প্যাঁচা উত্তর দিল না। যেমন গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন ভাবেই চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইশারা বুঝে পায়রা চটপট সরে অন্য একটা ডালে এসে বসল, আর পাতার ফাঁক দিয়ে দূর থেকে প্যাঁচাকে দেখতে লাগল গভীর আগ্রহে। প্যাঁচা তো সেই বইটা খুলে বসেছে আর কি সব অঙ্ক করে চলেছে নিজের মনে। কিছুক্ষণ দেখে পায়রা ভাবল- বাব্বাঃ, কি বোরিং লাইফ প্যাঁচাটার! সারাদিন ঘুমাও আর সারারাত জেগে জেগে অঙ্ক কর। এই কি একটা জীবন হল? না বাবা, এর চাইতে কোকিলই ভালো। একটু ভয় ভয় লাগে বটে, কিন্তু জীবনে অ্যাডভেঞ্চারের অভাব নেই। একই জিনিস বারবার দেখতে হয় না। ডানার নীচে দেখতে দেখতে কত দেশ, জলবায়ু বদলে বদলে যায়! আর উল্টোদিকে প্যাঁচাকে দেখো! এক জায়গায় গেঁড়ে বসে দিনের পর দিন অঙ্ক করে যাচ্ছে। শালিক একবার এসব কথা তুলতে বুড়ো কাকাতুয়া বলেছিল- ‘সব রোমাঞ্চকর জিনিস কি আর চোখ দিয়ে দেখা যায় রে? মনেরও যে একটা চোখ আছে- আমরা সেটা ভুলে যাই কেনো বল তো? জানি জানি, মনের চোখে ঘুম খুব বেশি, আর তাছাড়া ভীষণ দুবলাও বটে। থেকে থেকেই অসুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই মনের চোখদুটোকে জাগিয়ে রাখতে গেলে তোমাদের অঙ্ক শিখতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে’। বুড়ো কাকাতুয়া বড্ড জ্ঞানের কথা বলত। শালিক তার গলা নকল করে মাঝে মাঝেই ভ্যাঙায়- ‘অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, অঙ্ক শিখতে হবে…’ সবাই সেই ভ্যাঙানি দেখে দুলে দুলে হাসে। বুড়ো তখন দূর থেকে খেঁকিয়ে ওঠে – ‘হাসছ কেনো খোকা? আমি কি রসের কথা বলেছি?’
এখন পায়রা দেখল শালিক মোটেই ভুল বলেনি। প্যাঁচার জীবনটা এক্কেবারে বোরিং! গায়ের রঙের মতোই ফ্যাটফ্যাটে সাদা! নাঃ, এমন জীবন তার পোষাবে না। পায়রা আকাশের দিকে তাকালো। আলো কমে গেছে একেবারে। বেশি দূর অব্দি দেখা যায় না। সবকিছুই যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। নাঃ, আজ রাতটা মনে হচ্ছে তাকে প্যাঁচার সাথেই থাকতে হবে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে প্যাঁচাকে গিয়ে বলল- ‘স্যর, রাগ না করলে একটা কথা বলি?’
প্যাঁচা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সাহস পেয়ে পায়রা বলল- ‘আমি অনেক দূর থেকে আসছি। এখন তো আর ফিরে যেতে পারব না, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমরা আবার আপনার মতো রাতের বেলা দেখতে পাইনে, তাই বলছিলাম কি…’
পায়রার কথা শেষ হবার আগেই প্যাঁচা হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে খাতায় কি যেন লিখতে শুরু করল। কিছুক্ষণ টানা লেখার পর খাতার দিকে তাকিয়ে বড় খুশি হল। তারপর পায়রার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘মিলে গেছে।’
‘কি মিলে গেছে?’
‘অঙ্ক।’
‘ও’
‘হ্যাঁ, তুমি কি যেন বলছিলে? আমি তখন অঙ্কের কথা ভাবছিলাম, কিচ্ছু শুনতে পাইনি। তোমার অঙ্কটা কি? আরেকবার বলো প্রথম থেকে।’
‘আজ্ঞে আমি কোনো অঙ্ক নিয়ে আসিনি।’
‘তাহলে বিদেয় হও এখান থেকে।’ প্যাঁচা বিরক্ত হয়ে বলে, তারপরই আবার খাতার মধ্যে লিখতে শুরু করে।
পায়রা এক পা তুলে বেশ করে মাথা চুলকে বলে- ‘স্যর, আরেকবার দয়া করে শুনবেন স্যর?’
‘ওয়েট! গোল কোরো না!’
পায়রা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অপেক্ষা করতে লাগল। এক মিনিট যায়, দুমিনিট যায়, প্যাঁচার অঙ্ক আর শেষ হয় না। ইতিমধ্যে পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। পায়রার দুচোখেও ঘুম জড়িয়ে আসছে ক্রমশ। ঠান্ডাও বাড়ছে। বনের এইদিকটাতে কি ঠাণ্ডা বেশি? এত ঠাণ্ডা তো লাগে না কখনও! ঠাণ্ডা লেগেই বোধহয় মস্ত এক হাঁচি পেল পায়রার। হাঁচি কি আর চেপে রাখা যায়? দুঠোঁট খুলে সে হঠাৎ এমন জোরে হাঁচল যে ডালপালাসমেত গোটা গাছটাই থরথরিয়ে কেঁপে উঠল যেন! তার সাথেই হল আরেক কাণ্ড! এমন বিকট শব্দে প্যাঁচার হাত থেকে কলমখানা ছিটকে পড়ল মাটিতে! কলম খসে পড়তেই প্যাঁচার একেবারে মাথার হাত! কলম তো আর শুধু মাটিতেই পড়েনি! পড়েছে গাছের তলায় ঘন আগাছার মধ্যে। টেনশনে প্যাঁচার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় আর কি! শুরু হল আগাছার মধ্যে থেকে প্যাঁচার কলম খোঁজা।
পায়রা যখন হন্তদন্ত হয়ে কলমখানা খুঁজছে, ঠিক সেই সময় পায়রার নজর পড়ল গাছের কোটরের দিকে। প্যাঁচার বাসা। সে ভাবল- আচ্ছা, প্যাঁচা তো ঘুমায় দিনের বেলা। ফলে রাতে প্যাঁচা নিশ্চয়ই আর ঘুমাবে টুমাবে না! আর সারারাত যেরকম মন দিয়ে অঙ্ক করে তাতে নিশ্চয়ই সে বাসার দিকে খেয়ালও করবে না। তাহলে এই সুযোগে সেই বা কেন প্যাঁচার বাসায় ঢুকে একটুখানি ঘুমিয়ে নেয় না?
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। পায়রা দিব্যি প্যাঁচার বাসায় ঢুকে চাদর টেনে শুয়ে পড়ল। সাথে সাথে রাজ্যের ঘুম এসে জুড়ল চোখের পাতায়। আহা, এমন আরামে সে যেন অনেকদিন ঘুমায়নি। অন্যের বাসায় শুতেই যদি এত ভালো লাগে, তাহলে ডিম পাড়তেও না জানি কত ভালো লাগবে! ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে সে কোকিলকেও বোধহয় ক্ষমাই করে দিল!
পায়রার ঘুম ভাঙল যখন তখন ভোর হব হব! সে একবার আড়ামোড়া ছেড়ে উঠে বসতেই দেখল কোটরের মুখে প্যাঁচা দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবল হায়রে! পালানোর পথটাও যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল! ভগবান জানে প্যাঁচা এবার কি শাস্তি দেবে!
প্যাঁচা আগের মতোই গম্ভীর মুখে বলল – ‘তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার বাসায় এসে ঘুমিয়েছো? দাঁড়াও, তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করছি।’
পায়রার গলা শুকিয়ে কাঠ, সে কিছু উত্তর দিতে পারল না। প্যাঁচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল- ‘খাতায় একটা অঙ্ক লেখা আছে। সেটা যতক্ষণ না সল্ভ করতে পারছ, ততক্ষণ তোমার ছুটি নেই।’
পায়রা মনে মনে হাসল। থোড়াই সে অঙ্ক করবে! একবার প্যাঁচার বাসা থেকে বেরোতে পারলেই উড়তে উড়তে চলে যাবে অন্যদিকে। সকাল এই হল বলে! প্যাঁচা সকালে কিছুই দেখতে পায় না। ফলে তাড়া করে পিছু নিতেও পারবে না! এই প্ল্যান করে সে গুটিগুটি পায়ে এগোতেই প্যাঁচা বলল- ‘শোনো হে, চালাকি করে পালাতে চেয়ো না। ওতে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না!’
পায়রা মনে মনে বলল- ‘তোমার মাথা, আর আমার মুণ্ডু!’ মুখে অবশ্য কিছুই বলল না। বাইরে বেরিয়ে খাতার সামনে কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন প্যাঁচা ঘুমায়! বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হল না। বাসার ভেতর থেকে প্যাঁচার নাক ডাকার শব্দ ভেসে এল। আর তখন তাকে পায় কে? সে নিজের পাড়ার দিকে তড়িঘড়ি করে উড়ে যেতে লাগল। এতক্ষণে কাক কোকিলের ওপর রাগটাও পড়ে গেছে। এমনকি এতটা সময় তাদের না দেখতে পেয়ে পায়রার কিছুটা মন খারাপও লাগে।
কিন্তু, উড়তে গিয়ে সে দেখল বেশ খানিকটা কুয়াশা জমেছে। অদ্ভুত ব্যাপার! শীত পেরিয়ে বসন্ত এসে গেছে, এতটা কুয়াশা তো থাকার কথা নয়! সে যত উড়তে লাগল ততই কুয়াশা ঘন হইয়ে এল। মিনিট পাঁচেক পর সে সামনের কিছুই আর দেখতে পায় না! তখন তার প্যাঁচার কথাগুলো মনে পড়ল- ‘চালাকি করে পালাতে চেয়ো না। সময় নষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না!’
কি আর করবে? পায়রা ফিরে এল। একবার খাতায় লেখা অঙ্কটাকে দেখল। দেখেই তার ভিরমি খাবার যোগাড়! এমন কঠিন অঙ্ক সে চোখেও দেখেনি। তাহলে উপায়? সে ঠিক করল আরেকবার পালানোর চেষ্টা করে দেখবে। হতে পারে আগেরবার সে রাস্তা ভুল করে ফেলেছিল। এমন একটা দিকে চলে গিয়েছিল যেখানে খুব কুয়াশা পড়ে!
এই ভেবে বুকে সাহস নিয়ে পায়রা আবার উড়তে শুরু করল। এবার আর কুয়াশা নেই, সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেখা গেলেও, কোনো কিছুই তার চেনা লাগছে না। এ সে কোথায় এসে পড়ল? চারিদিকে গাছগুলোও যে বড় অদ্ভুত! পাতার রঙ লাল আর নীল। বাকলের রঙ হলুদ কি সবুজ। আর ডালপালাগুলো মোটেই সোজা নয়। তারা গোল হয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে আছে! এসব দেখে পায়রার বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করতে লাগল। প্যাঁচা কি ম্যাজিক জানে? এসব তো ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না! পায়রা কাঁদতে কাঁদতে এবারও ফিরে এল।
একটা ডালে বসে অনেকক্ষণ ধরে সে কেঁদেই চলল! এমনসময় হঠাৎ কি একটা ফল ধপ করে পড়ল তার মাথার ওপর। কিছুক্ষণ পর আরেকটা। পায়রা বুঝল যতক্ষণ না সে অঙ্ক করা শুরু করছে ততক্ষণ এসব চলতেই থাকবে! ফলে সে চোখ মুছে এবার কলম তুলে নিল। তারপর মিনিটের পর মিনিট যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায়, পায়রাও খাতার পাতায় লেখে আর কাটে, লেখে আর কাটে! নাওয়া হল না, খাওয়া হল না, এক মনে কষতে কষতে আর ভাবতে ভাবতে যখন বিকেল প্রায় শেষ হতে চলল- তখন হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে তার মাথার মধ্যে উত্তরটা দেখা দিল। ঝটপট করে খাতায় গোটা উত্তরটা লিখে ফেলতেই আনন্দে দুচোখ তার জলে ভরে উঠল! এত কঠিন অঙ্কটা সে কষে ফেলল! নিজেরই যেন বিশ্বাস হয় না।
প্যাঁচা ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যেবেলা। পায়রার অঙ্ক দেখে খুব খুশি হয়ে বলল- ‘ব্রেভো! চমৎকার করেছো। যাও এবার তোমার ছুটি।’
পায়রা আমতা আমতা করে বলল – ‘আপনি আমাকে অঙ্ক শেখাবেন স্যর?’
পায়রার কথা শুনে এই প্রথম প্যাঁচা হাসল। বলল- ‘শেখাবো। তবে তুমি কিন্তু আমাকে স্যর বলে ডাকতে পারবে না। নাম ধরেই ডাকো। আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।’
সন্ধ্যে আর ভোরের যে সময়টুকুতে আলো থাকে কম সেই সময়ে দুই বন্ধু বসে প্রাণ ভরে কথা বলে। সেই যে বুড়ো কাকাতুয়া বলতো মনেরও চোখ আছে- সেই চোখই যেন খুলে গেছে পায়রার। কত প্রশ্নই যে ভিড় করে মাথার ভেতর! গাছ থেকে খসে ফল-পাতা কেন মাটিতে পড়ে, আকাশের রঙ কেন নীল হয়, কেন গাছের পাতার রঙ সবুজ- এসব প্রশ্ন কি সে আগে কখনও ভেবেছিল? এখন প্যাঁচা তাকে একটু একটু করে সমস্ত বুঝিয়ে বলে। শুনে পায়রার মাথার মধ্যে পুরনো সব ধ্যানধারণা একেবারে জট পাকিয়ে যায়। তখন প্যাঁচা হেসে বলে- ‘জট তো পড়বেই। ওই জট খুলতে খুলতেই দেখবে পৃথিবীর পেট থেকে একটা নতুন পৃথিবী ভেসে উঠছে।’
সত্যিই হল তাই। মুখের চোখ যা দেখে মনের চোখ তা দেখে না। মুখের চোখ দেখে নদীর জলে সুর নেড়ে খেলে বেড়াচ্ছে একটা হাতি, মনের চোখ দেখে হাতির বুকে দলছুট হবার দুঃখ! মনের চোখ দিয়ে দেখলে কত দূরের জিনিসও এক্কেবারে কাছে চলে আসে। চোখ তো নয় যেন আতস কাঁচ! আগে যা দেখতে পেত না, এখন তা পরিষ্কার দেখতে পায়; আগে যা বুঝতে পারতো না, এখন তা বুঝতে পারে! প্রথম প্রথম ভারি মজা পেত সে। একদিন প্যাঁচা ডেকে বলল- ‘শোনো, ব্যাপারটা যত আনন্দের ভাবছ তেমন কিন্তু নয়। সবকিছু জানতে গেলে মাঝে মাঝে খুব দুঃখও পেতে হয়!’
‘সে কিরকম?’ পায়রা জিজ্ঞেস করে।
‘শোনো তাহলে বলি। আমি যখন একেবারে পুঁচকি, মানে সবে উড়তে শুরু করেছি, তখন হঠাৎ একদিন আমার বাবা হারিয়ে গেল।’
‘হারিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ। সেই যে হ্যাটটুপি পরে সন্ধ্যেবেলা বেরোলো, তারপর আর ফিরল না। আমি আর মা কত করে খোঁজাখুঁজি করলাম। কোথাও চিহ্নমাত্র নেই। কিছুদিন পর এক মাছরাঙা এসে খবর দিল। বাবা নাকি পাগল হয়ে গেছে। কি করে পাগল হল জানো? শোনো তাহলে বলি। বাবা অঙ্ক কষে কষে যখন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল তখন সবাইকে বলে বেড়াতে লাগল “আমি সবজান্তা হয়ে গেছি। যা জানতে চাও বলো আমি সবকিছুর উত্তর বলে দেব।” শুনে একদিন এক ফাজিল কাঠঠোকরা বলল- “যদি সব কিছুই জানো, তবে বলো দিকিনি প্যাঁচাবাবু, তুমি কবে কিভাবে মরবে?” ব্যস সাথে সাথে বাবা অঙ্ক করতে শুরু করল। সবাই তাকে দেখে হাসে, টিপ্পনি কাটে, কিন্তু বাবার যেন হুঁশই নেই। একমনে অঙ্ক করে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার মুখ একেবারে কাঁঠালের মতো থমথম করতে লাগল। কাঠঠোকরাকে উত্তর না দিয়ে সে ফিরে এল বাড়ি। ব্যস, তারপর থেকে আরও তিনদিন বাবা বাসায় ছিল। কারো সাথে বিশেষ কথা বলেনি। তিনদিন পর সন্ধ্যেবেলা ঘুম থেকে উঠে বাদামি হ্যাটখানা পরে দুম করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মাছরাঙা কিন্তু ঠিকই বলেছিল। বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন মাঝদুপুরে সূর্যের দিকে উড়তে উড়তে একটু একটু করে মোমের মতো গলে পড়েছিল নদীর জলে। বুঝতে পারলে ব্যাপারটা?’
পায়রা বোকার মতো মাথা নাড়ে- ‘ঠিক বুঝলাম না তো!’
‘মরার আগেই নিজের মরণ দেখে ফেলেছিল বাবা। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরেই তো পাগল হয়ে গেল। পাগল না হলে অমন অদ্ভুতভাবে কেই বা মরে বলো তো! সেই জন্যই তোমাকে বলছি- কিছু জিনিস না জানাই ভালো।’
‘কিন্তু আমিও তো সবজান্তা হতে চাই।’ পায়রা হাত জোড় করে বলে।
‘না, সবকিছু তোমাকে আমি শেখাবো না। তাহলে তোমার সর্বনাশ হবে। তুমি আজ সন্ধ্যের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাও।’ এটুকু বলে প্যাঁচা ঘুমাতে চলে গেল।
শুনে খুব কান্না পেল পায়রার। এতদিনে মনের মতো একটা বন্ধু পেয়েছিল সে। বনের মধ্যের যত হিংসুটে পাখিদের ঝগড়ার মাঝে সে আর থাকতে চায়নি। প্যাঁচার সাথে সারাটা জীবন গল্প করে আর অঙ্ক কষে সে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই প্যাঁচাই যদি তাকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে সে এখন যাবে কোথায়?
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এসে গেল। সে ভাবল- প্যাঁচা নয় নাই শেখালো সবকিছু, সে নিজেই কি শিখে নিতে পারবে না? তার শুধু দরকার প্যাঁচার খাতাখানা। এই ভেবে পা টিপে টিপে প্যাঁচার ঘরে ঢুকে এল। তারপর খাতাটা ঠোঁটে চেপে ঝটপট করে উড়ে বসে এসে বসল অনেক দূরের একটা গাছে। মনে মনে বলল- যতক্ষণ না আমি সবজান্তা হচ্ছি ততক্ষণ আর কোত্থাও নড়ব না!
দশদিন পর সত্যি সত্যিই সে সবকটা অঙ্ক শেষ করে ফেলল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বুঝতে পারল তার মধ্যে কিছু একটা বদলে গেছে। মনের ভেতরটা যেন জ্ঞানের ভারে বড় ভারী হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর কোনো প্রশ্নের উত্তরই আর তার অজানা নয়! নিজেকেই নিজে সে এত্ত এত্ত কঠিন কঠিন প্রশ্ন করল। তারপর অবাক হয়ে দেখল সমস্ত উত্তরই তার মনের মধ্যে ছড়ানো আছে!
কিন্তু আনন্দের বদলে পায়রার মন ভরে গেল দুঃখে। এতদিন পর, আজ সে বুঝতে পারল তার মগজে যত জ্ঞান, বুকে তত ভালোবাসা নেই। একটু ভালোবাসার জন্য, বন্ধু পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শোনার জন্য তার দু’কান ব্যাকুল হয়ে উঠল। তখন সে উড়ে চলল পুরোনো বাসার দিকে। উড়তে উড়তে শুনতে পেল একসঙ্গে সমস্ত কাকের তারস্বরে কা কা ডাক, বনমোরগের হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার, কোকিলের মিঠেগলার গান… এতদিন পর এইসব হরেকরকম শব্দ কানে ঢুকতেই আনন্দে তার দুচোখ জলে ভরে উঠল। গলা ফাটিয়ে সে সবাইকে বলতে চাইল- ‘তোমাদের সবাইকে, সব্বাইকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। বিশ্বাস করো, এই বনই আমার ঘর, তোমরাই আমার বন্ধু, তোমাদের ছেড়ে আমি আর কক্ষনো কোথাও যাবো না…’
*****
প্রচ্ছদঃ অন্তরা ভট্টাচার্য