Third Lane Magazine

বনানীর মায়ের প্রেমিক ~ পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

    আমি বনানীর মা’কে ভালবাসি। বনানী একজন উঠতি লেখিকা, ও ইংরেজিতে কবিতা আর গদ্য লেখে। সেইসব এদিক-ওদিক ছাপা হয়, শিগগিরই বই হয়ে বেরোবে। বনানী আমাকে বলেছে, বুকার, পুলিৎজার, নোবেল পুরস্কার পেতে গেলে ইংরেজিতে লেখা খুব জরুরি। আমি সাহিত্যের বেশি খবর রাখি না, ইংরেজিতে না লিখলে এইসব পুরস্কার পাওয়া যায় কি না আমি তা জানি না। আমি শুধু বনানীর লেখা পড়ি, কারণ আমি বনানীর মা’কে ভালবাসি।

    পড়ি না বলে, শুনি বললেই ঠিক বলা হয়। বনানী পড়ে, আমি শুনি। বনানী বাংলাতেও লেখে, তবে ছাপে না, সেসব শুধু আমাকে শোনায়। নোবেল পেয়ে গেলে বাংলা লেখাও ছাপাবে। বনানী আমার স্কুলের বন্ধু, এখন কলেজেও একসঙ্গে পড়ি। অনেকে ভাবে আমি বনানীর প্রেমিক, ভুল ভাবে। বনানী বেশ সুন্দরী, বনানীদের গাড়ি আছে, তবে বনানী গাড়িতে কলেজে আসে না। গাড়িতে আসলে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। যে ভবিষ্যতে সাহিত্যে নোবেল পাবে, তাকে একটু বাসে ট্রামে চড়ার কষ্ট করতেই হয়, পরে নোবেল পেয়ে গেলে আর কষ্ট করতে হবে না, তখন বনানী গাড়ি করে কলেজে আসতে পারবে। অবশ্য ততদিনে বনানী কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে, তবে নোবেল পেলে সংবর্ধনা নিতে তো কলেজে আসতেই হবে।

  আমার ওইসব ঝামেলা নেই, আমি বাড়ির গাড়িতেই কলেজে আসি আর ফেরার সময় মাঝে মাঝে বনানীকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাই, আমার গাড়িতে ফিরতে অবশ্য বনানীর অসুবিধা নেই, কারণ সেই সময় ও আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। বনানীকে নামিয়ে দিয়েই আমি চলে আসি না, খানিক ক্ষণ গল্পগুজব করে তবেই ফিরি। বনানী কি জানে আমি আসলে ওর মা’কে দেখতে যাই?

     যা বলছিলাম, আমি বনানীর মা’কে ভালবাসি, বন্ধুর মা হিসেবে নয়, আমি বনানীর মায়ের প্রেমিক। যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন বনানীর মা বনানীকে স্কুল থেকে নিতে আসত। একবার বোধহয় আপার নার্সারি ক্লাসে বনানীদের গাড়িতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম, কেন মনে নেই, বোধহয় আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছিল। গাড়িতে বনানীর মা আমাকে কিউট বেবি বলে চুমু খেয়েছিল, ঠোঁটগুলো কেমন ভিজে ভিজে আর নিঃশ্বাসে চন্দনের গন্ধ।

     তারপর একদিন বনানী আমাদের স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল। আমি রোজ অপেক্ষা করতাম, ভাবতাম আজ আসবে, কিন্তু বনানী আর এল না। এখন মনে হয়, বনানী নয়, আমি বনানীর মায়ের পথ চেয়ে থাকতাম। সেই ভিজে ঠোঁট আর চন্দনের গন্ধ আমি ভুলে গেছিলাম, নাকি তখন অত কিছু ভাবিইনি, সবটাই আমার কল্পনা। কলেজে ভর্তি হয়ে দেখলাম, বনানীও আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আমি নই, বনানীই আমাকে চিনেছিল। আমাকে চেনা সহজ, আমার কপালের মাঝখানে লম্বা একটা কাটা দাগ আছে।

    ডেকে বলল, “কি রে গাবলু বনানীকে চিনতে পারছিস না?” স্কুলে মোটাসোটা ছিলাম বলে সবাই আমাকে গাবলু বলে ডাকত, আমি চারিদিক চেয়ে বললাম, “এখানে গাবলু গাবলু করিস না, সুপ্রতীক বলে ডাকবি।” তাতে বনানী বলল, “একশোবার গাবলু বলব।” আমি আর বেশি ঘাঁটালাম না, নার্সারিতে দু’-একবার প্যান্টে ছোট বাইরে করে ফেলেছিলাম; যদি মনে করে রাখে, তবে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলে মুশকিল। প্রথমদিনই বনানী ওর বাড়িতে ধরে নিয়ে গেল, আর ওর মা’কে দেখে সব মনে পড়ে গেল, সেই ভিজে ঠোঁট, নিঃশ্বাসে চন্দন গন্ধ।

    বনানীর মা’র বয়স বাড়েনি, আমার এখন আঠারো বছর বয়স, বনানীরও তাই হবে। তার মানে কম করেও বনানীর মায়ের চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হওয়া উচিত, অথচ দেখে চব্বিশ-পঁচিশের বেশি বলে মনে হয় না, বনানীর মা আমাকে যখন চন্দনের গন্ধ উপহার দিয়েছিল, তখনও ওই বয়সী ছিল, সেদিনের বছর চার-পাঁচের আমি আজ আঠারো, বনানীর মা’কে এখন আর আমার চেয়ে বেশি বড় বলে মনে হয় না, সেই নরম চোখ, সেই ভিজে ঠোঁট, সেই শান্ত হাসির সৌরভ, শিউলি হয়ে ঝরে পড়ছে।

ও’টুকু বয়সের তফাৎ আজকাল কোনও ব্যাপার নয়, আমার তাই বনানীর মায়ের প্রেমিক হতে বাধা নেই।

     বনানীদের বাড়িতে গেলেই আমি পায়ে পায়ে বনানীর মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াই। কিন্তু বনানী আমাকে হাইজ্যাক করে ওর ঘরে নিয়ে যায় ওর কবিতা শোনাতে, আমার সেসব মাথায় ঢোকে না। আমাকে ঘিরে থাকে ভিজে ঠোঁট, চন্দনের গন্ধ, শিউলি ঝরা হাসি, আমাকে হাতছানি দেয় একজোড়া নরম চোখ। আমার মনে হয়, চিৎকার করে বলে দিই, বনানী, আমি তোর মা’কে ভালবাসি। শেষ পর্যন্ত আমার কিছুই বলা হয় না। বনানী কি কিছুই বোঝে না?

কে আমাকে দরজা খুলে দিল? বনানী না বনানীর মা! আমি কাকে লাল গোলাপ দিলাম? বনানী না বনানীর মা! কে আমাকে হাসি উপহার দিল? বনানী না বনানীর মা!

     আমি বনানীদের বাড়িতে বেল বাজালাম, আমার হাতে একগোছা লাল গোলাপ আর দু’টো বই। সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের, ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ এবং অমিতাভ বসুর, ‘দা হাংরি টাইড’। বই না পড়লেও এইটুকু জানি। বই দু’টো বনানীর জন্য আর লাল গোলাপ বনানীর মায়ের জন্য। অন্যান্য দিন বনানী আমার সঙ্গে থাকে, ওর কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খোলে। আজ ওর জন্মদিন, তাই কলেজে আসেনি। বনানীর মা দরজা খুলল, আমি ওর হাতে গোলাপ তুলে দিলাম। বনানীর মা বুক ভরে গোলাপের ঘ্রাণ নিল, তারপর আমার দিকে চোখ তুলে হাসল, সেই হাসিতে টুপটাপ শিউলি ঝরে পড়ল।

     আমি কখনও বনানীর মা’কে কিছু সম্বোধন করি না। কী সম্বোধন করব? কাকিমা বলা একজন প্রেমিকের পক্ষে সম্ভব নয়, নাম ধরে ডাকতেও সঙ্কোচ হয়। আজ সেই রাশি রাশি ঝরা শিউলির ঝরনা ধারায় স্নান করতে করতে আমি প্রগলভ হলাম। আমাকে দিয়ে কেউ উচ্চারণ করিয়ে নিল, “‘অসামান্যা, গোলাপ গুচ্ছ অতি তুচ্ছ তোমার রূপের কাছে।’” আর কী কী বলেছিলাম কে জানে! বনানীর ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলাম। ও বলল, “গাবলু এ বার থেকে আমাকে, ‘অসামান্যা’ বলেই ডাকবি।” আমি বনানীকে আগে কখনও শাড়ি পরতে দেখিনি, কলেজে তো সবসময় জিন্স পরেই যায়।

     আমার সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কে আমাকে দরজা খুলে দিল? বনানী না বনানীর মা! আমি কাকে লাল গোলাপ দিলাম? বনানী না বনানীর মা! কে আমাকে হাসি উপহার দিল? বনানী না বনানীর মা!

     বনানী আর বনানীর মা একাকার হয়ে গিয়ে আমাকে, বনানী আর বনানীর মায়ের ঘরে নিয়ে গেল। বনানীই কেক কাটল, কারণ আজ বনানীর জন্মদিন, ওর মায়ের নয়। বনানী আমাকে কেক খাইয়ে দিল, তারপর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল, সেই ভিজে ঠোঁট, চন্দনের গন্ধ। বনানী বলল, “গাবলু, মা মারা যাওয়ার তেরো বছর বাদে আবার জন্মদিনের কেক কাটলাম, তোকে ফিরে পেয়ে আমি আসলে আমার শৈশবে ফিরে গেছি, সেই যখন আমার মা বেঁচে ছিল। দেখ কী সুন্দর আমার মা!”

     দেওয়ালে বনানীর মায়ের পোট্রেট, আমার প্রাক্তন প্রেমিকা, আমি বনানীর দিকে ফিরলাম।

********

প্রচ্ছদঃ অন্তরা ভট্টাচার্য

Related Posts