১
ধুলো থাকতে চায় না, এমন একটা ঘরে আমি থাকি। চব্বিশ ঘন্টায় তিন-বার ঘর মুছলে ধুলো-রা অপমানিত বোধ করে। খালি পায়ে ধুলোর স্পর্শ অনুভব করলেই আমার চোখের সামনে একটা লাল পর্দা নেমে আসে, যেখানে সাইড-প্রোফাইল দেখিয়ে স্লো-মোশনে হেঁটে যায় জেমস বন্ড। মাথায় খুন চাপে। দেওয়ালের কোণে সাজিয়ে রাখা স্টেনগান, মতান্তরে ঝাঁটা হাতে নিয়ে গুলি চালাতে শুরু করি। তার পর হাতে তুলে নিই জল আর একখন্ড ন্যাকড়া। খাটের প্রত্যন্ত অঞ্চল অবধি সাফ করে ফেলি। তার পর শান্তি মেলে। বিপদের মুখোমুখি হলে নয়, আমার শরীর থেকে আড্রিনালিন ক্ষরণ হয় ধুলো দেখলে।
সবে এক-দফা ঝাঁটা আর ন্যাকড়া ব্যবহার করে খাটে বসে হাঁফ ছাড়ছি, বড়দার ক্ষুণ্ন গলার মাঝারি কম্পাঙ্কের চিৎকার কানে এল।
“এসব কী! এইভাবে কেউ সেদ্ধ ডিম অর্ধেক করে! কোনও সিমেট্রি নেই! অসাম্য অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে জানো!”
কঠিন-কঠিন কথা শুনতে পেলেই আমি ঝটাকসে কান খাড়া করে ফেলি। সম্ভব হলে নাক গলাই। জ্ঞান ছাড়া পৃথিবীতে আর আছে কী? ঝটপট পোশাক বদলে নিয়ে খাওয়ার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। বসে পড়লাম খেতে। খেয়েই আজকে বেরতে হবে।
আন্দাজ মতো দাদা তখনও সিমেট্রির অভাব নিয়ে আক্ষেপ করে চলেছে। দুঃখিত দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মহাবিশ্ব যে কসমিক এগ থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলা কল্পনা করা হয়, সেই রেফারেন্স দিয়ে কি তুই বলছিস এই ডিমের কথা?”
“না!” দাদা সতর্ক চোখে আমাকে দেখে নিয়ে ডিম চেবাতে-চেবাতে বলল, “অসাম্য। ডিসঅর্ডার। দুটো জিনিস অবশ্য পুরোপুরি এক নয়। তবু বুঝতে সুবিধা হওয়ার জন্য উল্লেখ করলাম। অসাম্যে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে দুর্যোগ নেমে আসবে।”
“কী রকম?” আমি জানতে চাইলাম।
“রকম!” বড়দা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ভাবতে গেলেও গায়ে কাঁটা দেয় রে। অসাম্য ডেঞ্জারাস জিনিস। আজকে ডিম কাটায় অসাম্য, কালকে রকেট পাঠানোর অংকে অসাম্য। রকেট মহাকাশে না গিয়ে শেষ রাত্রে ধাপার মাঠে ঘাসের শিশিরের উপর ল্যান্ড করল! সূর্য ওঠার আগেই শিশির বাষ্পীভূত! পুরো পরিবেশের ভারসাম্য টলে যাবে। কী বুঝলি?”
“আহা! বৌদি কি আর রকেটের পেল্লাই অংক করতে যাচ্ছে!”
দাদা তেরছা করে আমার দিকে চেয়ে ফুঁৎকার দিল, “ওরে গবেট, তুই ক্যালকুলাস করছিস আর অন্য একজন মাথার চুল কালো করার কালি কিনতে গিয়ে রঙের দামের হিসেব কষছে, দু’জনের চেতনা কিন্তু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। টের পাওয়া যায় না বটে কিন্তু এ-সত্য চিরন্তন। একজনের ভুলের দায় অন্যজনের উপরে গিয়ে বর্তাবেই।”
আমি বিস্মিত হয়ে অনেকটা বড় হাঁ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু একটা মাছিকে আমার মুখ-গহ্বর তাক করে উড়ে আসতে দেখে ঠোঁটের কপাট আটকে দিলাম। মাছিটা দেখলাম ভগ্ন-হৃদয় নিয়ে আবার দাদার ডিমের দিকে লাফ দিল। সামলে নিয়েছি যা-হোক। শুক্রবার আমি নিরামিষ খাই। মাছি খেয়ে ফেললে…আচ্ছা, মাছির কি মাংস হয়? যদি হয় তবে তাতে কোন ধরণের প্রোটিন থাকে? সেই প্রোটিন হজমের উপযুক্ত উৎসেচক কি রয়েছে আমাদের দেহে? মাছি কারা খায়? খাদ্য হিসেবে কি সহজপাচ্য?
দাদা না মাছি কার দিকে তাকাব সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে অবশিষ্ট ডিমের টুকরোর দিকে চেয়ে বললাম, “যদি দু’জনেই ভুল করে, তা হলে? দুটো ভুলের দায় কোন পদ্ধতিতে যোগ হবে, স্কেলার না ভেক্টর?”
দাদা আমার কথাটা বিবেচনা করে দেখল, “ভাল প্রশ্ন। ভুলের কি মান আর দিক আছে? গবেষণা হওয়া উচিত।”
ভাল প্রশ্ন! আমি খুশি হয়ে খেতে শুরু করলাম। আজকে দেরি করা চলবে না।
যারা পেশাদার আঁকিয়ে তাদের মধ্যে এক-ধরণের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। তারা মানুষ ও মানবভঙ্গিমার ছবি আঁকে, আঁকে নিসর্গের ছবি। মাটির কলসি বা হিরের সিংহাসন ইত্যাদি জড় বস্তুর প্রতিকৃতি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু সচল জড়বস্তুর প্রতি তাদের মনোভাব উপেক্ষাধর্মী। কাউকে কখনও চলন্ত বাসের ছবি আঁকতে দেখা যায় না। এর পিছনে অবশ্য জোরালো যুক্তি আছে। বাস কতক্ষণ আর দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকে যে তার ছবি আঁকা সম্ভব? কাগজে দ্বিতীয় আঁচড় দেওয়ার আগেই বাস উধাও হবে, পড়ে থাকবে সাময়িক আবছা একটা স্মৃতি। স্মৃতি থেকে আঁকা ছবিতে আর যাই থাক প্রাণ থাকে না।
আমার বাসটা চলছে শম্বুকতর গতিবেগ নিয়ে। শম্বুকও এর পারফরমেন্সের পরিচয় পেলে স্যালুট করে ব্রহ্মাণ্ড ত্যাগ করত। এ-রকম ধীরে চললে সেই বাসের ছবি আঁকা যায় অনায়াসে। এমন বাসের জন্ম-ই হয় নিজের ছবি আঁকানোর জন্য।
বাসের জানলার বাইরে বিছিয়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যদের ভীষণ ধৈর্যসহকারে দেখে চলেছি। শীতকাল বলে এখনও পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা রয়েছে। গরমকালে এই রকম পরিস্থিতিতে এই বাস ভাঙচুর করে সের-দরে বেচে সেই টাকায় সদলবলে কাঠি-আইসক্রীম খেতাম।
“এটা বাসের ছদ্মবেশে শতায়ু কচ্ছপ নির্ঘাত! হেঁটে গেলে আগে পৌঁছতাম।”
আমি চমকে গিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করা ভদ্রলোকের দিকে চাইলাম। পর-পর বলা দুটো বাক্যে এতটা কোয়ালিটির ফারাক! প্রথম বাক্যে নিখুঁত ব্যঙ্গের মূর্ছনা, দ্বিতীয়টা চরম লেভেলের বস্তাপচা।
আমি বাসের গতিবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সযত্নে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হেঁটে? হ্যাঁ, যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কেন যাব?”
“শক্তি?”
পিছনদিক থেকে নারী-স্বরের জিজ্ঞাসা কানে এল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “হাঁটবার শক্তি আছে দিদি, কিন্তু কেন হাঁটব?”
ভদ্রলোক আমার প্রশ্নে আচমকা স্লিপ খেয়েও সামলে নিয়েছেন। কটমট করে আমাকে মেপে নিয়ে বললেন, “সকালে খেয়ে বেরিয়েছেন? পেট খালি থাকলে মুখ থেকে আবোল-তাবোল বেরোয়।”
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সময়েও কিছু লোকজন যে এখনও ভ্যাকুয়াম টিউবের যুগে পড়ে-পড়ে আরাম করছে, তা দেখলে আনন্দ হয়। এরা বোঝে কম, বোঝাতে চায় বেশি। মধুর কন্ঠে বললাম, “তা হলে তো পেট খালি রেখে-ই সবাই সুকুমার রায় হয়ে যেত! অত সহজ নয় কাকা! আবোল-তাবোল ওই এক পিস।”
পিছনের ভদ্রমহিলা কন্ঠস্বর বাড়িয়ে বললেন, “ইয়ে, আমি বলতে চাইছিলাম যে, আপনি যেটা বললেন, সেটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনের ইয়ে…অনুকরণে, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কবিতা!” ভদ্রলোক পুকুরের জলে মামদো ভূতের ওড়িশি নৃত্য দেখবার স্টাইলে আমাকে জরিপ করলেন। তারপর খ্যাঁক করে বললেন, “কবিতা কোত্থেকে এল?”
“কবিতা আসে না।” আমি সহৃদয় কণ্ঠে বললাম, “কবিতা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। ছেঁকে নেওয়ার অপেক্ষা কেবল। বুক হালকা করে, বৈষয়িক ভাবনা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, অতীতের ট্র্যাজেডি নিয়ে বিষণ্ণ হওয়ার চেষ্টা করলেই কবিতা ধরা পড়ে।”
“খামোকা বিষণ্ণ হতে যাব কেন?”
আমি মধুর কণ্ঠে বললাম, “কবিতা ধরার জন্য। বিষাদ হল কবিতা ধরার জাল।”
ভদ্রলোক চোয়াল শক্ত করে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি একঝলক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কন্ডাকটরের উদ্দেশ্যে বললাম, “নামব।”
“হ্যাঁ, নামুন। আপনাকে তো নামতেই হবে।” ভদ্রলোক চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, “কবিতার লাইন মুখস্ত করে বেড়ানো বুদ্ধিজীবী কোথাকার! নিচে নামা বাদে কী-ই বা করার আছে আপনাদের?”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, “কেন উপরে ওঠা? না উঠলে নামব কী করে্? সাপ-লুডো খেলেননি বুঝি ছোটবেলায়?”
স্টেশনের বড় ঘড়ির ঠিক নিচে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। গায়ে হালকা রোদ এসে পড়ছে। ঠান্ডা বাতাস এবং রোদ, এই কম্বিনেশন কখনও একঘেয়ে হয়ে উঠবে না। ডিম কিংবা অসাম্য নিয়ে দাদা আরও অনেক কিছুই বলছিল। আমি শুধু লাস্টে একটা কথা বলে বেরিয়ে এসেছি, “তোর স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্টে কিন্তু তেমন সাম্যাবস্থা দেখা যেত না, মনে পড়ে? সেই দায়টা কার উপর পড়ত বল তো!”
ও তার পর মনে করার চেষ্টা করেছে নাকি মনে না করার চেষ্টা করেছে, জানি না।
পার্বতী সামনে এল। গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার কামিজ, তার উপরে সবুজ সোয়েটার। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। পোশাক জরুরি নয়, মুখ দেখা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। মনের খোঁজ-ও পাওয়া যায়, যদিও ঠিকঠাক দেখার মতো স্নেহ থাকা চাই। ওর মুখের একদিকের গাল বেশি চকচকে। মেয়েরা কি কোল্ড ক্রিম মাখা আর প্রলেপ দেওয়ার পার্থক্যটা কখনও বুঝতে পারবে না?
অল্প হেসে পার্বতী বলল, “আজকে আমার পালা।”
“ইয়েস।”
ও গভীরভাবে চিন্তা করার ভান করল। তার পর আচমকা বলল, “এগারো।”
পেয়েছি জ্ঞান দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ। আমি বললাম, “হুঁম, একমাত্র সংখ্যা যেটা নিজে মৌলিক কিন্তু তার দুটো অংক আলাদা-আলাদা ভাবে মৌলিক বা যৌগিক কিছুই নয়।”
“ধুস, তুমি না! এতকিছু ভেবেছি নাকি!”
“চলো তা হলে-” আমি ওর কনুইয়ের পিছন দিকটা ধরে টানলাম, “এগারোয় কী আছে দেখা যাক।”
বোর্ডে লেখা এগারো নম্বর জায়গাটায় যাওয়ার দুটো রিটার্ন টিকিট কেটে নিলাম আমরা।
সপ্তাহে অন্তত এক দিন আমরা ঘুরতে বেরোই। অচেনা জায়গাই উদ্দেশ্য প্রধানত। সারা সপ্তাহ একঘেয়ে কাজে কাটে। একটা দিন-ই আমাদের দু’জনকে বাকি ছ’দিন সুস্থ মস্তিষ্কে থাকার মতো অক্সিজেন সরবরাহ করে।
“আমরা যে এইভাবে সপ্তাহের একটা দিন দেখা করি, এটা নিয়ে তুমি কখনও চিন্তা করেছ?” পার্বতী আচমকা জিজ্ঞেস করল আমার দিকে খোঁপা আর ক্লিপ ঘুরিয়ে রেখে।
“হুম।”
“কী চিন্তা করেছ বলো?” পার্বতী শরীর ঘুরিয়ে আমার মুখোমুখি হতে চাইল। পাশাপাশি বসে থাকা অবস্থায় এ-রকম চেষ্টা সফল করতে গেলে সিটের কম পক্ষে এক জন যাত্রীকে ট্রেনের মেঝেতে ফেলে দিতে হবে। তাই পুরোপুরি নয়, শরীর অর্ধেক ঘুরিয়ে মুখ আমার দিকে করে পার্বতী তাকাল। ও অপেক্ষা করছে আমার জবাবের।
কেউ হাঁ করে চেয়ে আমাকে অ্যাটেনশন দিলে আমার গলা শুকিয়ে যায়। অদ্ভুত একটা ভয়ে তলপেটের প্রত্যঙ্গরা সটান নেমে যায় গোড়ালিতে। পার্বতীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। অভ্যাস।
“দেখা করার সময়টা কখন আসবে তা নিয়েই চিন্তা করেছি।”
“আমি জিজ্ঞেস করছি যে-” পার্বতী ক্লিপ খুলে চুল ছেড়ে দিল। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল, “সপ্তাহের যে-কোনও একটা দিন আমরা বেরোচ্ছি, এটা নিয়ে কখনও ভেবেছ? কোনও নির্দিষ্ট দিন ঠিক করা নেই। এক-এক জন এক-এক সপ্তাহে এক-একটা দিন বেছে নিচ্ছে!”
“ভাবিনি।” আমি হেসে উত্তর দিলাম, “তা ছাড়া এই পরিকল্পনাটা তোমার ছিল। ইউনিক, তাই আমি রাজি হয়েছি।”
“আচ্ছা।” পার্বতী মুখ টিপে হাসল। ওর হাসির মধ্যে জিতে যাওয়া দেখতে পেলাম।
“নির্দিষ্ট জায়গাও তো ঠিক করা থাকে না! সত্যিই কি কোনও কারণ আছে এই পরিকল্পনার পিছনে?” আমি কৌতূহলী হলাম।
“হ্যাঁ।”
“বলো।”
পার্বতী জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। হাওয়ার ঝাপটায় খোঁপায় আটকে না-রাখা চুল এসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মুখে, কপালে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু ক্ষণ পর আমার দিকে না-চেয়েই আলতো করে ও বলল, “তোমার কোন ধরণের লাইফস্টাইল পছন্দ, মিশুল? প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা নাকি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের খুশিমতো?”
কথাটার অর্থ ধরতে আমার একটু সময় লাগল। তবে অবাক হলাম না। পার্বতী যখন-তখন উদাস হয়ে যায় আর কঠিন-কঠিন কথা বলে। আর আমি তো সাধারণত কঠিন কথাবার্তার ফ্যান। ওর রোমান্সও উচ্চমার্গের। ওর জিনের প্রকট বৈশিষ্ট্যের এ-রকম বহিঃপ্রকাশে প্রথমদিকে অল্প হলেও ঘাবড়াতাম, পরে সয়ে গেছে। এখন অপেক্ষায় থাকি। বললাম, “যেটায় সুবিধা।”
“সুবিধা বোঝো কী করে? মাপকাঠি কী?”
“সমস্ত কিছু কি আর মাপার উপায় আছে?” আমি হাসলাম, “যেভাবে থাকলে বেঁচে থাকার স্বাচ্ছন্দ্য বেশি পাওয়া যায়।”
“স্বাচ্ছন্দ্য!” পার্বতী একটু চুপ করে থেকে তার পর ধীর গলায় বলল, “মিশুল, প্রকৃতির মধ্যে যে শৃঙ্খলা রয়েছে তার গোড়ার তত্ত্ব হল ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা। প্রকৃতির দিকে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিতে তাকালে তুমি দেখবে যে সব যেন সুচারুভাবে তৈরি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র পতঙ্গ থেকে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসর, শীর্ণ নদীস্রোত থেকে বিশালকায় এভারেস্ট, সবই আপাতভাবে যেন বিশুদ্ধ শৃঙ্খলার উদাহরণ। আসলে এ-সবই বিশৃঙ্খলার ফল। বিশৃঙ্খলা ছাড়া নতুন কিছুর সৃষ্টি হতেই পারে না।”
“তো?” আমি প্রসঙ্গ বুঝতে পারছিলাম না।
“আমি ক্যাওসে বিশ্বাস করি। তাই দেখা করি কোনও নির্দিষ্ট নিয়মে আটকা না-থেকে। হ্যাঁ, বলতে পারো, সপ্তাহে একটা দিন, এটাও তো নিয়ম! ঠিক, অল্প হলেও নিয়মকে কিন্তু আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। সম্পূর্ন বে-নিয়মে নিজেদের মিশিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের এখনও হয়নি।” পার্বতী অন্যমনস্ক স্বরে বলল, “ব্যস্ততার মধ্যেও একটা ছন্দ থাকে। ছন্দ মানেই প্রাণ কিন্তু সেই ছন্দে গরমিল থাকলে তবেই প্রাণের বিবর্তন ঘটে। ঘটে চেতনার অভিযোজন।”
“ওই দেখো!”
দেখলাম। ছোট্ট একটা জঙ্গল।
‘এগারো’-নম্বর স্টেশনে নেমে সোজা চলে যাওয়া পাকা রাস্তাটা ধরে আমরা হাঁটা আরম্ভ করেছিলাম। এলোমেলোভাবে বাঁক নিচ্ছিলাম মোড় এলে। দেখাই যাক কোথায় গিয়ে পৌঁছোই! এ আমাদের প্রতি সপ্তাহের খেলা। হঠাৎ উপস্থিত হলাম কয়েকটা গাছের দলের কাছে। কষ্ট, খুব কষ্ট করে, চার টান গাঁজা সেবনের পর একে জঙ্গল বলতে অসুবিধা হবে না। তবে কেউ-কেউ তো সিঁদুরে মেঘ দেখে কিনা!
“জানো এই জঙ্গলটা পেরোলে কী আছে?” পার্বতী ধোঁয়াটে স্বরে বলল।
আমি তুড়ি মেরে বললাম, “নিশ্চয়ই লোকালয়। এটা কি আর আফ্রিকার চিরহরিৎ বনভূমি পেয়েছ নাকি? কিছু আগাছা, কয়েকটা বুনো বা অবহেলায় বেড়ে ওঠা অপ্রয়োজনীয় ফলমূলের গাছ।”
“উঁহু!” ও ঘাড় নাড়ল, “আমি বলছি যে এই জঙ্গলটা পেরোলে-”
“পেরোলে?” আমি ওর দিকে তাকালাম, “বাক্যটা শেষ করবে তো! সাসপেন্সে রাখছ কেন?”
পার্বতী আচমকা আমার হাত চেপে ধরল জোরে, জলে ডুবতে চলা মানুষ অবলম্বন হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে যেভাবে সামান্য শ্যাওলা আঁকড়ে ধরে। গভীর ভালবাসা থইথই করছিল ওর মুখে, “চলো বাড়ি যাই।”
আমি ওর ভালবাসা অনুভব করতে পারছিলাম সম্পূর্ণ অস্তিত্ব দিয়ে। অনুভূতিটা চট করে হারাতে চাইছিলাম না। তাই সামান্যও আপত্তি না তুলে ফিরে যেতে সম্মত হলাম।
পার্বতী অন্যমনস্ক স্বরে বলল, “ব্যস্ততার মধ্যেও একটা ছন্দ থাকে। ছন্দ মানেই প্রাণ কিন্তু সেই ছন্দে গরমিল থাকলে তবেই প্রাণের বিবর্তন ঘটে। ঘটে চেতনার অভিযোজন।”
২
ঘুম ভাঙার পর গন্ধটা নাকে ঢুকে এল নাকি গন্ধের কারণে ঘুম জায়গা ছেড়ে দিল ভাললাগার অনুভূতিকে, পার্বতী নিশ্চিত নয়। ও শুয়ে-শুয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। সুগন্ধের স্পর্শ মন থেকে বিষাদকে সযত্নে বের করে দেয়।
বারান্দায় খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। গুড় বানানো হবে।
ওরা গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে শহরে চলে এসেছে বছর-পনেরো আগে। তখন যথেষ্ট মনখারাপ হয়েছিল সাত-বছরের পার্বতীর। ও মনে-মনে বাবা-মা-র উপর ভীষণ রেগে গেছিল। ওই বয়স যুক্তির ধার ধারে না। ও বুঝতে পারেনি বড়রা হয়ত কাঁদে না, কিন্তু মনখারাপ তাদেরও হয়; যে মনখারাপের তীব্রতা নেহাত কম নয়। আর ভীষণ মনখারাপ কখনও-কখনও দারুণ কিছু সিদ্ধান্তের জন্ম দিতে পারে। তাই আজও শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও ওদের বাড়িতে সভ্যতার আবর্জনা অমিল। আজও চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকা-মাত্র এক টুকরো গ্রামে ঢুকে পড়া যায়। শীত পড়লে বাবা চলে যায় পুরোনো গ্রামে। নিয়ে আসে একদম টাটকা অকলুষিত খেজুর রস। কিছুটা সরাসরি পান করার জন্য রেখে বাকিটা কাজে লাগে গুড় তৈরিতে। এই মহার্ঘ্য স্বাদের গুড় কত শীতের সকালে জলখাবারের সঙ্গী হয়ে থাকে! গেঁয়ো খাবার! পার্বতী জানে, স্মার্ট কিংবা মর্ডান হওয়ার সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। মর্ডান দেখানোর জন্য জোর করে যা-ই করা হোক, সেটা শুধুমাত্র একজনকে জোকার অথবা অসচেতন চালিয়াত প্রতিপন্ন করে।
পার্বতী শোয়া অবস্থাতেই আলতো করে হাসল। সুগন্ধের কারণে নয়। ওর মনে পড়ল আজকের দিনটায় পড়ে থাকা আগামী সময়ের কথা। আজ যে তারা ঘুরতে যাবে! যাবে, শুধু এই চিন্তাটাই একটা ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।
আগের দিন কোথায় যেন গেছিল? আগের দিন! পার্বতী ভুরু কুঁচকে উঠে বসল। উঁহু, মনে পড়ছে না। গেছিল তো অবশ্যই। তারা এই ঘুরতে যাওয়া, সর্বোপরি একটা দিনের অধিকাংশ সময় একসঙ্গে পাশাপাশি কাটানো কিছুতেই মিস করে না। গেছিল কোথায় আগের দিন?
ধুস মনে পড়ছে না!
খচখচ করতে থাকা মন নিয়েই পার্বতী বিছানা ছাড়ল।
“আজকে আমার পালা।”
পার্বতী অল্প হাসল। বলল, “জানি। আচ্ছা, আমরা আগের সপ্তাহে কোথায় যেন গেলাম বলো তো। মনেই পড়ছে না।”
“আগের-ওই তো-” বলতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম। আগের দিন কোথায় গেছিলাম? আরে আমারও মনে পড়ছে না!
“কী হল?” পার্বতী চেয়েছিল আমার দিকে।
আমি অস্বস্তির সঙ্গে হেসে বললাম, “ঠিক খেয়াল হচ্ছে না।” তারপরেই গম্ভীর হয়ে বললাম, “কেন? ভ্রমণপঞ্জিকা বানাচ্ছ বুঝি? ট্রাভেলগ লেখার মালমসলা গোছাচ্ছ?”
বললাম, কিন্তু এদিকে প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম মনে করার। কি আশ্চর্য! ওই দিনটার ভ্রমণ যেন স্মৃতি থেকে বেমালুম মুছে গেছে। সকালে বেরোনোর আগে সে-দিন সিমেট্রি নিয়ে বকবক শুনে বেরোলাম। বাসে চেপে স্টেশন অবধি আসার সময় দাদার কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে আসছিলাম তা-ও মনে আছে। স্টেশনের ভেতর সমস্ত গন্তব্যের নাম লেখা থাকে একটা বোর্ডে। তিরিশ-চল্লিশটা। অল্টারনেট করে দু’জন একটা করে নাম্বার বলি ইচ্ছেমতন। তত নম্বরে থাকা জায়গাটায় সেদিন আমরা যাই। এই নিয়ম চলে আসছে গত ছয়-মাস যাবৎ। একই জায়গা রিপিট হলেও সেখানেই যাই, কিন্তু অন্য রাস্তা ধরি পৌঁছনোর পর।
কিন্তু আগের দিন কী নম্বর বলেছিল পার্বতী? হ্যাঁ, ও যে বলেছিল তাও মনে পড়ছে। কী মনে পড়ছে না। উফ! মাঝে-মাঝে মগজ বিদ্রোহ করে বসে কেন বুঝি না? অঙ্ক কষার চেষ্টা কিংবা গোয়েন্দাগিরি কিছুই করি না, তবু মগজের হরতাল? আরে, বিদ্রোহের পেছনে যুক্তি তো থাকবে! যদিও দুনিয়ার ইতিহাসে অযৌক্তিক বিদ্রোহের অভাব নেই।
“আচ্ছা ছাড়ো! আজকে তোমার পালা। বলো।”
আমি বললাম, “এগারো।”
পার্বতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটা আমার খুব পছন্দের সংখ্যা।”
আমি একগাল হেসে বললাম, “আমারও। নামতা মুখস্ত করার ট্র্যাজেডির মাঝখানে এই সংখ্যাটা যেন মুক্তির বাতাস ছিল ছোটবেলায়! আর বড়বেলায় এগারো নম্বর বাসে চেপে হিল্লিদিল্লি ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তো নস্টালজিয়ার গুদাম।”
“আমার এমনিই ভাল লাগে।”
আমি ফট করে বললাম, “সিমেট্রি আছে বলে? রাশিমালার প্রথম সংখ্যা যেটায় সিমেট্রি আছে। অর্ধেক করে ফেললে দু’দিকে পড়ে থাকা অঙ্কের মান সমান। এক এক।”
“না। এমনিই।” পার্বতী কড়া গলায় বলল, “ভাল লাগার পিছনে আবার অতো খটোমটো কারণ থাকলে তা আবার ভাল লাগা নাকি!”
ট্রেনের দিকে এগোতে-এগোতে আমি বললাম, “কিন্তু, জানো তুমি এগারো হল একমাত্র-”
“থামো! ”পার্বতী ঠোঁট উল্টে বলল, “অত জেনে কী করব!”
“নলেজ একটা খাদ্যবস্তু। মাথার খাদ্য। না খেলে মাথা গবেট হয়ে যায়।”
“বেশি খেলে বদহজম হয় জানো তো? খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ব্যায়ামটা-ও জরুরি। শুধু নলেজ মস্তিস্ক উর্বর করতে পারে না। ভাবতে হয়।”
“হ্যাঁ, ভাবলেই বুঝবে পেটের মধ্যের পরিসর সীমাবদ্ধ। মাথা তা নয়। মস্তিষ্ক অসীম পরিমাণ জ্ঞান জমা রাখতে পারে।”
“আমি মহাজন নই। জমা রেখে ভার বাড়াব কেন?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই মেয়েটা একদমই আমার মতো নয়। তবু কোথাও যেন একটা টান কাজ করে। প্রকৃতিতে চার-ধরণের বল আবিষ্কৃত হয়েছে। পঞ্চম বল বোধহয় প্রেম!
ট্রেনের লোকদের ভাগ্য ভাল যে কামরায় উঠেই সিট পেয়ে গেলাম। দাঁড়াতে হলে আমি যে-ফ্রিকোয়েন্সিতে চারদিকে অভিশাপ ছুঁড়ি…
“আচ্ছা, তোমার কি আগে থেকে কিছু মনে হয়? যেখানে যাচ্ছি সেখানকার পরিবেশ, দৃশ্য সম্বন্ধে আগাম কোনও আন্দাজ থাকে?” পার্বতী নিচু গলায় বলল।
আমি সকৌতুকে চেয়ে বললাম, “হয়ত থাকে। কিন্তু থাকে কিনা ভেবে দেখিনি।”
“এটা এড়িয়ে যাওয়া জবাব। কিছু তো একটা…আকাঙ্খা থাকে গন্তব্য নিয়ে!”
“সত্যি। তা ছাড়া আকাঙ্ক্ষা করি না কিছু নিয়ে। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, আকাঙ্খাই দুঃখের কারণ।”
ও ছুটন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে পিছনদিকে আপাতভাবে ট্রেনের সমান গতিবেগে পিছতে থাকা গতিশীল বাহ্যিক দৃশ্যের দিকে চেয়ে রইল। এ-ভাবে কিছু দেখা যায় না। প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। আসলে এমন সময় আমরা নির্দিষ্ট করে কিছু দেখি না। দেখি দৃশ্যান্তর। অনুভব করি, পরিবর্তনের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা।
আলতো করে জিজ্ঞেস করলাম, “আর তুমি?”
উত্তর যেন ওর ঠোঁটের ডগায় লেগে ছিল, “আমি আশা করে থাকি সাদামাটা একটা স্টেশনের। স্টেশন পেরিয়ে যে রাস্তায় গিয়ে পড়ব সেখানে সাজগোজ দিয়ে প্রকৃতিকে ঢেকে রাখা হবে না। আটপৌরে সহজ চেহারার একটা পাড়া।” বলে ও হাসল, “অদ্ভুত একটা কল্পনা, তাই না বলো?”
জবাব দিলাম না। ট্রেন থামতে চলেছে। এখানে আমাদের নেমে যাওয়ার কথা।
স্টেশনটা অন্য যে-কোনো মামুলি স্টেশনের মতোই একঘেয়ে একটা আংরাখা চাপিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করল। একই ছাঁদের কিছু বসার জায়গা, বিড়ি-পান-চা-চিপস-এর গুমটি, কয়েকজন ভবঘুরে, কয়েকজন অতিব্যস্ত সাধারণ মানুষ।
“কোনও কল্পনা অদ্ভুত হয় না।” চলতে-চলতে আমি নিচু গলায় বললাম, “অদ্ভুত ঠেকে। কল্পনা অদ্ভুত মানেই তাতে সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে।”
“যে লুকিয়ে থাকতে চায়, তাকে তেমন থাকতে দিলেই হয়।”
“সে হয়ত লুকিয়ে থাকে বিশেষ কারও জন্য।”
পার্বতী হাসল।
আমি নরম গলায় বললাম, “তুমি যেমন জায়গার কথা চিন্তা করো, সেটা যে খুব অদ্ভুত তা নয়। তুমি তোমার গ্রামকে, গ্রামের পরিবেশকে ভুলতে পারোনি। ভোলা উচিত-ও নয়। তুমি চলে যেতে চাও সেখানে কিন্তু পারছ না। তাই…”
“হয়ত!” পার্বতী ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল, “সত্যিই আমার শহর ভাল লাগে না। সবকিছুই এখানে রুক্ষ! যা সুন্দর সেটাও কোনোভাবে কোনও দক্ষ পেশাদার হাতের ছোঁয়ায় জন্মেছে।
আমি হাসলাম, “ভুল বলছ না।”
”কী আছে শহরে বলো তো? প্ৰযুক্তি, আরোপিত সৌন্দর্য, বিলাস সামগ্রীর প্রাচুর্য এসব একরকমের ক্যামোফ্লেজ বা ধোঁকা যাতে অভিভূত হওয়া মানুষ বৃহত্তর আনন্দের সন্ধানে বেরোতে উদ্যম পায় না। দেখো মিশুল, মানুষ একদিন নিজেদের বাসস্থান গড়ে তুলবে জঙ্গলে।”
আচমকা এই দৃঢ় ঘোষণায় আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “মানুষ কেন শহরের বিলাস-ব্যসন ছাড়বে? এত এন্টারটেইনমেন্টের উপকরণ, চটজলদি পরিষেবা-”
“যেস-দিন বাস্তব বুঝবে সে-দিন। বুঝবে, অরণ্যই মানব-সভ্যতাকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে।”
“বন-সভ্যতা!” আমি শুনে হাসলাম, “বিজ্ঞান তবে কি বেকার বলতে চাও? ফালতু?”
“না।” পার্বতী বলল, “মানবসৃষ্ট বিজ্ঞান তোমার-আমার জন্ম দেয়নি, দিয়েছে প্রকৃতি। তাই সভ্যতার প্রায়োরিটি হওয়া চাই প্রকৃতি। বিজ্ঞান ও টেকনোলজি গড়ে উঠবে প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। প্ৰযুক্তি আকাশ ছুঁক, তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আকাশটা যেন ধ্বংস না হয়।”
“ঠিক বলছ। তবে, প্রকৃতির মধ্যে বেশি ডুবে থাকলে মানুষ হয়ত বোবা হয়ে যাবে।”
“হয়ত তা-ই উচিত। বুদ্ধ তো এ-ও বলে গেছেন, নৈঃশব্দের সৌন্দর্যের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার থাকলে তবেই সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে শব্দ উচ্চারণ করো, নচেৎ নয়।”
“ঠিক বলেছ।” আমি বুঝদার ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লাম, “ওই জন্যই বাচ্চারা কথা না-বলে শুধু স্বরবর্ণ ব্যবহার করে চেঁচায়।”
পার্বতী দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়ের স্বরে বলল, “দ্যাখো, মিশুল!”
আমরা দেখলাম, সামনে ছোট্ট একটা জঙ্গলের মুখ। জঙ্গল ঠিক নয়, কয়েকটা গাছগাছালির সমাবেশ। অগোছালো না দেখালে বাগান বলেই মনে করতাম। গাছ চিনি বলব না কিন্তু সামনে স্থির হয়ে নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে দাঁড়ানো বৃক্ষরা নিঃসন্দেহে ফলদায়ী নয়। বট, অশ্বথ দিয়ে কেউ বাগিচা তৈরি করে না।
৩
“যাবে?”
“জঙ্গলে!” আমি হতভম্ব।
“হ্যাঁ। কী সমস্যা?” পার্বতী ভুরু কোঁচকাল।
সমস্যা নয়, স্বভাব। আমার স্বভাব হল ভিড় এড়িয়ে যাওয়া। মানুষ, ইট পাথর, উদ্ভিদ যা-ই হোক, দলবেঁধে থাকলেই আমি সে-রাস্তা ত্যাগ করি। ভিড় মানেই অপরিচ্ছন্ন, ময়লা আর ঝঞ্ঝাট। আসলে ভিড় তো এক ধরণের ধুলোই। ভিড় মানে, অতিসাধারণ গোত্রের, শিরোনাম-বিহীন কিছু মানুষের দল বেঁধে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। আলাদা-আলাদা ভাবে তারা আমাদের নজরে পড়ে না।
ঘরের ময়লা ঝেঁটিয়ে দূর করি। বাইরের আবর্জনা দূর করার সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ করা চাপ। গোটা পৃথিবী জুড়ে সব জায়গায় বৃহৎ একটা ঝাঁটা নিয়ে মুখচোখ খিঁচিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, কল্পনা করতে গেলেই আতঙ্ক হয়। বিকট অঙ্গভঙ্গি সমেত আচমকা তেড়ে গেলে মানুষের ভিড় ছত্রভঙ্গ হতে পারে, কিন্তু চমক কাটার পরে ভিড়ের সকলে আড়ংধোলাই দিয়ে শরীরে হাড়ের সংখ্যা চারশো বারো করে দিলে কী হবে? রিস্ক নেওয়া যায় না। অবশ্য একটা জম্পেশ ব্র্যান্ড তৈরি করে ফেলতে পারলে ব্যাপারটা আর অতটাও ঝুঁকিপূর্ণ দেখাবে না। নাম নেব, ‘ঝাঁটাবাবা’। বাবা যোগ করে বানানো যে-কোনও শব্দবন্ধ শ্রদ্ধা কাড়তে ওস্তাদ। দিনের বেলা রাস্তা ঝাঁট দেব, রাত্রে সুন্দর-সুন্দর দর্শন আউরে মানুষের মন ঝাঁট দেব। একই সঙ্গে ঝাঁটা হল মেহনতি মানুষের প্রতীক। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে পথে নামলে সমাজ আমায় ‘বুর্জোয়া’ বলে দেগে দেবে।
জঙ্গলে উদ্ভিদের বেজায় ভিড়। তারা অবশ্য ঝামেলা করে না। তবু ভিড় তো! কোথাও আমাকে সমেত তিনজনও জড়ো হলে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, যে-কোনও সমস্যায় ওরা দু’জন একদিকে, আমি অন্যদিকে।
“মানে-” আমি ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললাম, “এই ঠান্ডার মধ্যে? ভিতরে রোদ নেই, আরও ঠান্ডা লাগবে।”
“ঠান্ডা!” পার্বতী মুখ ভেচকে তাকাল। “তুমি যা বলছ সেটা কি কোনও দিক থেকেও উপযুক্ত যুক্তি হিসেবে তুমি নিজে-ও মনে করো?”
“কী দরকার বলো?” আমি মরীয়া হয়ে গিয়ে ভয় দেখালাম, “পোকামাকড়, সাপখোপ… ভেতরে কী কী আছে-”
“তোমার মাথা আজকে নেগেটিভ ফোর্স নিয়ে কাজ করছে। শীতকালে সাপেরা ঘুমায়।”
“আমাদেরও ঘুমানো উচিত।” বললাম আমি, “মানে আলাদা-আলাদা…”
“চলো।” পার্বতী হুঙ্কার দিল। চাপা-গলায় যতটা জোরে হুঙ্কার দেওয়া যায়।
আমরা ঢুকে পড়লাম। গলে গেলাম দুটো গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে। আমাদের মচমচ শব্দে অভ্যর্থনা জানাল শুকনো পাতা। ডা-য়ে তাকালাম। কতটা গভীর এই অগোছালো জঙ্গল? বেশি নয়। ডানদিকে কয়েকটা গাছ পেরিয়েই জনবসতি দেখা যাচ্ছে। বাঁয়ে-ও একই দৃশ্য।
কিন্তু সামনে পাতায় মোড়া লম্বা পথ। শেষ ঠাহর হচ্ছে না।
“সামনের দিকটায় বেশি গাছ লাগানো।” আমি বললাম।
“লাগানো না গজানো তুমি জানো না।”
জানি না ঠিকই। তবে দ্বিতীয় অপশনটা মেনে নিতে মন চাইছে না। মানুষ যা-ই করুক না কেন, তার একটা সীমা আছে। কিন্তু নিজে থেকে তৈরি হওয়া বস্তু পরিস্থিতি, পরিবেশ ও ছাপা-নিয়ম দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। যাতে পথ না হারিয়ে ফেলি তাই হাঁটছি একদম নাক বরাবর। পায়ের নিচে শুকনো পাতার মৃদু আর্তনাদ বাদে কোনও আওয়াজ নেই। শীতের দুপুর। এ-রকম সময়ে হাঁটতে খারাপ লাগছে বললে লাই ডিটেক্টর মেশিনের সার্ভার পর্যন্ত চাপ নিতে না পেরে ক্র্যাশ করবে।
হাঁটলাম বেশ অনেকক্ষণ ধরে। জঙ্গল শেষ হল না। পার্বতীর হাত স্পর্শ করে ডানদিকে তাকিয়ে আমি থামলাম। বনের গাছ ঢেকে ফেলেছে লোকালয়ের চিহ্ন। বাঁদিকটাও দেখে নিলাম চট করে। নিশ্ছিদ্র গাছের আবরণ সেখানেও।
খটকা লাগল তখনই।
সতর্ক, অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখলাম গাছদের। বিশালকায় গাছ সব। মোটা-মোটা গুঁড়ি। তিনজন মানুষ হাতে বেড় দিয়েও একটা গুঁড়ি কভার করতে পারবে না। প্রত্যেকটা গাছই বড়। দু-একটা-র ক্ষেত্রে এমন হতে পারে কিন্তু… চারদিকে তাকাতে-তাকাতে বললাম, “গাছগুলো যেন অনেক বড় হয়ে গেছে দেখো-”
“তা না হওয়ার কী আছে? জঙ্গলের সব জায়গায় কি একই হাইটের গাছ থাকবে? তুমিও না!” পার্বতী মুখ-ঝামটা দিল, “চলো তো! এই নির্জন পরিবেশটা তোমার ভাল লাগছে না?”
“ভাল লাগছে। কিন্তু পথ ফুরোচ্ছে না, জঙ্গলের গাছ বড় হয়ে যাচ্ছে…সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা আনক্যানি-” আমি আবার হাঁটা শুরু করে বললাম। আশ্চর্য ব্যাপার! এত-এত মহীরুহ-ওয়ালা জঙ্গল শহরের মধ্যে অথচ সাড়া পড়ে যায়নি!
“ভূতের সিনেমা বেশি দেখলে এমন মনে হয়। আনক্যানি না ঘোড়ার ডিম! ফুঁ!”
“ঘোড়ার ডিম নিজেও আনক্যানি হতে পারে যদি সেই সিনেমার দর্শকেরা ঘোড়া হয়।” আমি মিনমিন করে বললাম।
আমরা হাঁটতে থাকলাম। পার্বতী এগোচ্ছে কৌতূহলী পায়ে। আমি হাঁটছি শেষ খুঁজতে। বারবার লক্ষ্য করছি গাছেদের। একটা ধারণা ধরা পড়তে-পড়তেও যেন নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কোথাও যেন একটা গন্ডগোল…একটা বৈসাদৃশ্য লুকিয়ে আছে। আর একটু…একটু
প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পর আমি থামলাম। পার্বতী বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল?”
আমি ঢোক গিললাম, “পার্বতী, ভাল করে দেখো।”
পার্বতী দেখল। সঙ্গে-সঙ্গে আমিও দেখলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। মহীরুহরা এখন যে পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে আর তাদের গাছ বলা উচিত কি না আমি জানি না। মগডাল অবধি দৃষ্টি পৌঁছচ্ছে না। পায়ের দিকে তাকালাম। পায়ের নিচে পাতা এখনও ছড়ানো। কিন্তু তাদের আকারে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এক একটা পাতায় আমার মতো দশজন হাত-পা ছড়িয়ে শুতে পারবে।
ঠিক ডান-পাশেই নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটা এবং ঘড়ির সময় দেখে নিয়ে আমি হাঁটা শুরু করলাম আচম্বিতে। হকচকিয়ে যাওয়া পার্বতীও পিছু নিল। ওর হাঁটার ছন্দে সামান্য সময়ের জন্য অসংলগ্নতা চোঁয়াতে থাকল, পদক্ষেপে ইতস্ততভাব। গাছটার দিকে চোখ রেখে আমি হাঁটছি। দ্রুত। গতি বাড়াচ্ছি ক্রমান্বয়ে।
থামলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গাছটা পেরোতে আমাদের পাঁচ-মিনিট সময় লাগল। একটা গাছের মূল কান্ডের সমান্তরাল পথ পেরোতে পাঁচ-মিনিট!
“কী হচ্ছে কী এসব?” পার্বতী জিজ্ঞেস করল ফিসফিস করে।
আমার কাছে উত্তর নেই। নেই বিস্ময় প্রকাশ করার তাগিদও। অথচ আনকোরা, উৎসহীন একটা খুশিতে মন যেন প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সামনে এগোতে-এগোতে যদি ছোট হয়ে যেতে হয়, ক্ষতি কী! গন্তব্য অসীমের দিকে হলে নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে যাওয়াই ছেলেমানুষি।
খেয়াল করলাম, এখানে কোনও ধুলো নেই। পাথর রয়েছে। ধুলো-রা পাথর হয়ে গেছে।
********
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি