Third Lane Magazine

ছদ্মজীবনী (পর্ব ৩ ) ~ দিলীপ কুমার ঘোষ

 এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।

এবারে তৃতীয় পর্ব 

ক্ষণিক বরিষণ।। মেলোড্রামা

   পর্ব এক: যাপনচিত্র

   যেদিন কলকাতায় ভূমিকম্প হচ্ছিল, আমি এতটুকু ভয় পাইনি। বেশ মজা লাগছিল। এমন অভিজ্ঞতা তো সচরাচর হয় না। অফিসের তিনতলা থেকে সবাই নেমে এসে দাঁড়াল রাস্তায়। শেষে আমিও নেমে এলাম। দেখলাম রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করছে। গাড়িঘোড়া সব স্তব্ধ। সকলের মুখ-চোখ কেমন থমথমে। টেলিফোন বুথে আচমকা জনজোয়ার। সকলে বাড়ির লোক অথবা প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমার বাড়ির লোক আছে; প্রিয়জনও আছে। বাড়ির প্রিয়জন মা সাড়ে সাতটা বাজলেই আর বাড়িতে টিকতে পারে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় এসে পিচরাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার বারণ করায় কোনও কাজ হয়নি। শুধু চাঁদের আলোয় যে রাতগুলোতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে থাকা আমাকে রাস্তায় একটু দূর থেকেই দেখতে পায়, সেদিন আমি বাড়িতে ঢোকার আগেই বাড়ি ঢুকে যায়। আরেক প্রিয়জন চিত্রা প্রত্যেক রাতে দশটা-সাড়ে দশটায় আমার ফোন পেলে তবে খেতে বসে এবং সোম থেকে শুক্র— প্রত্যেক দিন সকাল সাড়ে সাতটায় ঘরের জানালা থেকে প্রতীক্ষাতুর নয়নে তাকিয়ে থাকে রাস্তায়— আমার অফিসযাত্রাকে শুভ করার জন্য। অথচ তাদের খবর নেওয়ার অথবা আমার খবর তাদের কাছে পৌঁছনোর কোনও তাগিদ আমি ভিতর থেকে অনুভব করলাম না। রাস্তা থেকে সরে গঙ্গার পাড়ে এলাম, তাকালাম ঢেউ ছলোছলো গঙ্গার দিকে। কোনও এক অলখ টানে চেনা গঙ্গার কেমন এক উত্তাল অবস্থা! মুগ্ধ চোখে চিত্রার্পিত আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

কোনও মুগ্ধতাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এ নিয়ে আমার অভিযোগও কম নেই। যারা চেনাপথের যাত্রী, যাদের জীবন সাধারণ গন্ডির বাইরে বেরতেই চায় না, তারা নিরুপদ্রব জীবন পছন্দ করে। কিন্তু এই চেনা জীবন, চেনা যাপন, চেনা পথ, চেনা ছক আমাকে বড় ক্লান্ত করে, আমি হাঁপিয়ে উঠি। ভূমিকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত কম্পন তাই আমাকে ভিতর থেকে আলোড়িত করে। আমি মুগ্ধ হই, কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী মুগ্ধতা যেন আমাকে আরও বেশি অতৃপ্ত করে। অদ্ভুত এক ক্লান্তি গ্রাস করে।

একটি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া আমি আমার কোনও অনুভূতি চিত্রার কাছে লুকোই না। চিত্রা জানে কিছু লুকিয়ে-চুরিয়ে করা আমার চরিত্রে নেই। কিন্তু চিত্রা বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়েও— ওর সামনে স্পষ্ট করে মেলে ধরা আমিটাকেই কেমন করে অসন্দিগ্ধচিত্তে সম্পূর্ণ আমি বলে ধরে নেয়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। এই কারণেই বোধ হয় বলে, প্রেম অন্ধ!

আমি যখন ক্ষণিক মুগ্ধতায় কোনও মেয়ের দিকে অপলক নয়নে তাকাই, চিত্রা জানতে চায়, তুমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এত কী দেখো বলো তো?

সৌন্দর্য দেখি, আর… আর… সত্যি কথা শুনতে চাও? শুনলে কিন্তু রাগ করবে!

না, আমার রাগ হবে না। তুমি বলো।

না শুনলে চলছিল না! তবে বলি শোনো। আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে…

কী হল, থেমে গেলে কেন?

না, থামিনি। কথাটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছি। হ্যাঁ, আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে উহাদিগের বক্ষসৌন্দর্য উপভোগ করি এবং উহারা শয্যায় কী পরিমাণ পারঙ্গমা হইয়া উঠিতে পারে তাহা কল্পনা করি।

ধ্যাৎ, তুমি ভীষণ অসভ্য! কী কুক্ষণে যে তোমার কাছে জানতে চাইলাম!

সত্য কথা বললাম, আর অমনি অসভ্য হয়ে গেলাম! তাকাব, ভাবব… অথচ সভ্য-ভদ্র সেজে থাকার জন্য সত্য কথা বলব না! না, এমন হিপোক্রিট আমি হতে পারব না।

এরপর কারও দিকে তাকিয়ে দেখো না! আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেবো।

সে তো তোমার সামনে কারও দিকে তাকালে! আর যখন তুমি সঙ্গে থাকছ না?

শুভ, তুমি না!… সত্যি তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।

মনে মনে ভাবলাম, ঘাই হরিণীই পেরে উঠছে না, আর তুমি তো প্রেমান্ধ আশ্রমকন্যা!

যা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক, তাতেই চিত্রার অগাধ আস্থা, প্রশ্নহীন আনুগত্য। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ না করলে তাই এ মেয়ের কাছ থেকে প্রোমোতে কিছুই মিলবে না। আর এতে আমার বেশ অসুবিধা হতে পারে ভেবে চিত্রা আমার আদিরসাত্মক কথাবার্তায়, ভাবনায় আমাকে একটু প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে। ভাবে, নিরামিষ যৌবনে এই যথেচ্ছ আমিষ কল্পনাই আমার একমাত্র ভরসা। এ ছাড়া বেচারার বিকল্পই বা কোথায়?

বিকল্প যে এক নয়, একাধিক— এ চিত্রার সুদূরতম কল্পনাতেও আসে না। কিন্তু একাধিক বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আমাকে একটু শান্তির খোঁজে সেই চিত্রার-ই শরণ নিতে হয়।

আমি যে ঘাই হরিণীর কেমন অদ্ভুত ফাঁদে জড়িয়ে , সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পেরে তার-ই আত্মজাকে ফাঁদে জড়িয়েছি এবং নিজে ক্রমশ রসাতলে নেমে যাচ্ছি, তা আমার পক্ষে কিছুতেই চিত্রাকে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু চিত্রার সঙ্গে এটা আমি একদমই ঠিক করছি না। তাই চিত্রার কাছে এলে আমার মনে এখন কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। আমি বুঝতে পারি চিত্রাকে নিয়ে আমার মনোজগতে যে একটা পরিবর্তন এসেছে সেটা চিত্রারও দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু ও হয়তো ভাবছে লেখা প্রকাশ না-হওয়া নিয়ে আমার গভীর মনখারাপের কারণেই আমি হয়তো ভিতরে ভিতরে ভীষণ কষ্টে আছি, তাই ওর প্রতি মনোযোগ দিতে পারছি না বলে আমি অপরাধবোধে ভুগছি। চিত্রার এমন ভাবনা খুব স্বাভাবিক। কারণ এর আগে সত্যিই অনেকবার আমার লেখা প্রকাশিত  হয়নি বলে শারীরিক ভাবে ওর কাছে থেকেও মানসিক ভাবে ওর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে থেকেছি। তখন ওর অতলান্ত গভীর ভালবাসাও আমাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি।

পরিণাম জানা উদ্যোগে উদ্যম নিয়ে ঝাঁপাতে আমার মন সায় দেয় না। তাই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তা মনোনীত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকার মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত উন্মাদনা অনুভব করি। কিন্তু ইদানীং লেখা প্রকাশিত না হওয়াটা এমন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে যে আমি আর বিষয়টা নিয়ে উত্তেজনা অনুভব করি না। কিছুদিন পরে হয়তো লেখা ছেড়েই দেব।

আমি অপেক্ষা করে রয়েছি একটা নতুন স্পার্কের— একটা তড়িৎ-চমকের— আমার দিকে ধেয়ে আসা তরঙ্গ-স্রোতের। এমন প্রবাহী স্রোত যা আমাকে অচিনপুরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন আর ঘটে কই! ভূমিকম্প তো আর রোজ রোজ ঘটে না।

একরাতে অফিস কলিগ সুজিতদার বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম ডায়মন্ডহারবারে। জানতাম ফিরতে রাত হবে। বাড়ি না ফিরে কলকাতায় কোনও কলিগের বাড়ি থেকে যাওয়া সেফ। কিন্তু আমার নিজের বাড়ি ছাড়া কোথাও রাত কাটাতে ইচ্ছা করে না। তা ছাড়া, আমার একটা অদ্ভুত বিশ্বাসই রয়েছে যে, এ জীবনে নাটকীয় কিছু ঘটবে না। আর যাই ঘটুক না কেন— আমি যেন কেমন ভিতর থেকে জানি— আগামীকাল সকালে আমি সেই অফিস যাওয়ার জন্য যথারীতি বাড়ি থেকে রওনা দেব।

বিয়ে বাড়ি থেকে বেরতে সাড়ে আটটা বাজল। পিটিএস পৌঁছতেই এক ঘন্টার ওপর লাগার কথা। ম্যারেজ হল থেকে বেরিয়েছি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। আমতলায় এসে বাস আর এগোয় না। কী ব্যাপার? কানাঘুষো শুনে জানতে পারলাম, কী একটা গন্ডগোলের জেরে বাস চলাচল বন্ধ… আমতলা থেকে কোনও বাস আর কলকাতায় যাচ্ছে না।

জানি কোনও একটা উপায় ঠিক হয়ে যাবে।… সেটাই ঘটল। একটা ম্যাটাডোর চেপে আরও কয়েকজনের সঙ্গে থ্রি-এ এলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটা মিনিবাস এল। কিন্তু পিটিএস যাবে না, এক্সাইডে নামতে হবে। তাই সই! উঠে পড়লাম। একে জঘন্য রাস্তা, তার উপরে বর্ষার মরশুম। বাসের পিছনের সিটে বসে নৌকার মতো দুলতে দুলতে ডায়মন্ডহারবার রোড পেরোতে লাগলাম। এক্সাইডে এসে ঠেকলাম রাত সাড়ে দশটায়। বাস ধরব বলে হেঁটে রবীন্দ্র সদনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রথম শকটা খেলাম এখানেই। মহানগর— এমন ল্যান্ডমার্ক— অথচ রাত সাড়ে দশটাতেই শুনশান! কলকাতা কি তাহলে এখনও গন্ডগ্রাম-ই রয়ে গেল! শুধু মানসিকতাতেই নয়, রাতের নগ্ন বাস্তবেও। উঁহু, কলকাতা এমন হলেও হতে পারে, কলকাতাবাসী কিন্তু ভীষণ স্মার্ট। কতটা স্মার্ট ভাবা যায় না! যাদের মাসের আঠাশ তারিখ পর্যন্ত অফিসে একদিনও লেট হয় না, তাদেরও কিন্তু মাসের শেষ দু’-তিনদিন উইক ডে পড়লে, অবশ্যম্ভাবী ভাবে দু’দিন লেট হয়। আমার মতো গেঁয়ো ভূতও এদের সাহচর্যে কম স্মার্ট হয়ে ওঠেনি। এদের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য আমি অর্জন করেছি তা হল মনে এক, মুখে এক। তার সফল প্রয়োগ আমি সুনিপুণ দক্ষতায় আমার ভালবাসার পাত্রী চিত্রার ওপর অবিশ্রান্তভাবে চালিয়ে যাচ্ছি।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমি কলকাতায় চাকরি করতে এসেছিলাম। এই চাকরি পাওয়ার আগে কলকাতা শহরে আমার নিয়মিত যাতায়াতের সুযোগ কখনও ঘটেনি। কলেজ লাইফ কেটেছে মফসসলে। কলকাতায় আমার কোনও আত্মীয়-পরিজন, চেনা-জানা কেউ ছিল না। আমার জীবনে এর আগে কোনও শহুরে ছোঁয়াই লাগেনি। আমার প্রথম লিফ্ট চাপা— চাকরিতে জয়েন করার আগে এই চোদ্দোতলা অফিসের তিনতলায় নিজের ডিরেক্টরেটে কাগজপত্র জমা দিতে এসে।

অফিসে বসে আমি চিঠিপত্র ডেসপ্যাচের কাজ করি। সারা সপ্তাহে সব মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েক কাজ করতে হয় কি না সন্দেহ। বাকি সময় গুলতানি মেরে, ক্যান্টিনে বসে, হাইকোর্ট চত্বরে পুষ্প প্রদর্শনীর বাহারি ফুলের বাগানে ঘুরে, ইডেনে  একটা সেশন ক্রিকেট ম্যাচ দেখে কাটিয়ে দিই। এ সব ব্যাপারে দু’বছরেই আমি যথেষ্ট স্ট্রিট-স্মার্ট হয়ে উঠেছি। আমার বাঁ পাশে বসে চিঠি রিসিভ করে অনুপ— অনুপ মন্ডল। ও আমার থেকে মাস ছয়েকের বড় হবে। আমার এক বছর আগে জয়েন করেছে।

আমার জানা ছিল না চাকরির পরীক্ষা দিয়ে, দু’টো ধাপ পেরিয়ে এসে, রীতিমতো টাফ কম্পিটিশনের মধ্য দিয়ে পাওয়া সরকারি করণিকের চাকরিতে, যোগদানের পর কাজ বলতে করতে হবে শুধু এটুকু! আবার সেই কাজও নাকি যথেষ্ট যোগ্যতা বিচার করে দেওয়া! দপ্তরের বড়বাবুর আমাকে দেখে কী মনে হয়েছিল জানি না। প্রথম যোগ দেওয়া করণিককে এই দপ্তরে যে কাজ দেওয়ার কথা অর্থাৎ চিঠিপত্র রিসিভের কাজ, তা না দিয়ে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন তার পরের ধাপের অর্থাৎ চিঠিপত্র ডেসপ্যাচের কাজ। এ নিয়ে প্রথমদিকে অনুপের আমার উপর একটু গোঁসা হয়েছিল বুঝতে পারি। কিন্তু পরে যখন বুঝেছিল এতে আমার কোনও হাত নেই ওর আমার প্রতি মানসিক বিরূপতা কেটে যায়। তবে আমার বেশ মজা লেগেছিল এটা শুনে— আমি নাকি ডেসপ্যাচের কাজে দারুন কর্মদক্ষতা দেখাচ্ছি, আমার টেবিলে নাকি কোনও চিঠিপত্র কখনও পড়ে থাকে না। এমনটা নাকি সরকারি দপ্তরে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু বছর দুয়েক এভাবে কাটতে থাকায় আমি বিরক্ত হয়ে মাঝেমাঝে ভাবি আমার কর্মদক্ষতা কি শুধু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে!

আমার ডান দিকে বসে দেবাশিসদা—দেবাশিস বসু। ওপার বাংলার মানুষ। প্রত্যেক দিন অফিসে ঢুকেই উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, শুভ, দ্যাশের খবর কী? আমি কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসি। দেবাশিসদা নিজেকে বলেন, বর্ন এলডিসি। কুড়ি বছর ধরে পদোন্নতি হয়নি। ডিরেক্টরেট সার্ভিসে একই পদে রয়ে গেছেন। আর বছর বারো চাকরি রয়েছে। অনেক দেরিতে বিয়ে করেছেন; ছেলের বয়স সবে পাঁচ। জানেন না সামনে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে রয়েছে।

নামেই সরকারি চাকরি! এ দিকে পে-প্যাকেট এতই পলকা যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না। কেটেকুটে, পার্সোনাল লোনের ইএমআই মিটিয়ে প্রত্যেক মাসের শেষে কমবেশি সকলেরই দেখি ল্যাজেগোবরে দশা। দেবাশিসদা প্রায়ই বলেন, শুধু এই চাকরির ভরসায় না-থেকে যদি অন্য কিছু পারো, চেষ্টা করে দেখো। না হলে আমার মতো সারা জীবন এলডিসি থেকে লেংড়ে চলবে আর বুড়ো বয়সে বিয়ে করে ঠ্যালা সামলাবে।  কপাল করে তো অসংরক্ষিত হয়ে জন্মেছ। একা আম্বেদকারে রক্ষা নেই, মন্ডল দোসর!

দেবাশিসদা এক সময় দিন বদলের স্বপ্ন দেখতেন। আরও অনেকের মতো। এখন আর দেখেন না। আমার ভাল লাগা, মন্দ লাগার বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করায় একদিন অনেক কথা ওঁকে বলে ফেলেছিলাম। সব শুনে বলেছিলেন, গরিবের ঘোড়া রোগ ঠিক নয়। তোমার ভালর জন্যই বলছি। যতই তোমার ঋত্বিক-সত্যজিৎ-বার্গম্যান-আইজেনস্টাইন-রেনোয়াঁ-গোদার ভাল লাগুক না কেন, তোমার নিম্নবিত্ত অর্থনৈতিক অবস্থানই কিন্তু দাবি করবে বাণিজ্যিক ছবি ভাল লাগাতে; যতই বিটোভেন-মোৎজার্ট-বাখের সোনাটা-সেভেন্থ সিম্ফনি-অর্কেষ্ট্রা- কম্পোজিশন তোমাকে টানুক না কেন, তোমার কানকে কিন্তু জনপ্রিয়-বাজার চলতি গান শোনাতেই তৃপ্ত রাখতে হবে। গ্রুপ থিয়েটার দেখে যতই তুমি ভাবো না কেন সেটাই তোমার জগৎ, আসলে তোমার জগৎ কিন্তু নিজস্বতা বিকিয়ে দেওয়া, চিন্তাভাবনাশূন্য-বোধহীন-অর্থহীন-নিষ্করুণ-স্বার্থপর দুনিয়া। শুভ, ভুলো না, আমরা সাধারণ, অসাধারণত্বের প্রতিভা আমাদের নেই। পাতি পাবলিকের মতো বাঁচাতেই আমাদের অধিকার। তার মধ্যেই কী ভাবে স্থূল অর্থে আরও কিছুটা ভাল থাকা যায়, তার চেষ্টা করো। নচেৎ শেষে পস্তাতে হবে।

আমি বুঝেছিলাম দেবাশিসদা আমাকে বলছিলেন না, নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন।

আধঘণ্টাটাক কেটে যেতে বিরক্তিটা আরও বাড়ল। ভয় পাচ্ছিলাম না, কিন্তু ফেরা নিয়ে একটা টেনশন শুরু হল। যদিও বিশ্বাস তখনও অটুট—উপায় কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। সেটাই সত্যি করে অবশেষে একটা বেসরকারি বাস হাজির হল। উঠে পড়লাম। বাসে ওঠার মিনিট পাঁচ-সাত পর বুঝলাম কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি। প্রত্যেক দিন সকালে বিদ্যাসাগর সেতু থেকে নেমে আসার সাথে সাথে আরসিটিসি থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ আমাকে জানিয়ে দিয়ে যায় যে, আমি কলকাতার বুকে পা রাখলাম। ফেরার পথে একঘেয়েমির ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ায়, বেশিরভাগ দিনই কলকাতা ছেড়ে-যাওয়া ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের অনুভূতি পর্যন্ত পৌঁছায় না। আজ সজাগ থাকায় রেসকোর্সের দৌড়বাজদের পুরীষ এবং মূত্রের দুর্গন্ধ নাকে এল। কেন জানি না মনে হল, এই দুর্গন্ধ বোধ হয় মহানগরবাসীরও বৈশিষ্ট্য। যে সব খবর কলিগদের কাছ থেকে প্রায়শই কানে আসে তাতে মনে হয় শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতির বাইরে একটা পূতিগন্ধময় যাপন শহরবাসীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে। এরই নাম বোধ হয় শহুরে আধুনিকতা! আমরা যাকে শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে ভোগা মানুষের গ্রাম্যতাদোষ বলে মনে করি, শহর কলকাতা কিন্তু তা থেকে এতটুকু পিছিয়ে নেই, বরঞ্চ বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। আসলে গ্রাম হোক বা শহর, মানুষ তো সেই একই!

একদিন অফিসে অনুপের সঙ্গে একটি মেয়ে দেখা করতে এল। চাপা স্বরে ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল ওরা কোনও সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনা করছে। পরের দিন শ্যামলদা দেবাশিসদার পাশে এসে বসলেন। অনুপ সেদিন আসেনি। ওর অনুপস্থিতিতে শ্যামলদা বললেন, অনুপের দাদা কিন্তু পুরো ফেঁসে গেছে দেবাশিসদা। বেচারার চাকরি না চলে যায়! আমাকে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠতে দেখে দেবাশিসদা কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। শ্যামলদার উৎসাহ দেখে সহজে প্রসঙ্গ ঘোরানো যাবে না বুঝতে পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, চলো শ্যামল, বাথরুমে গিয়ে একটা সিগারেট ফুঁকে আসি।

তার পরের দিন অনুপকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললাম, ব্যাপার কী? দেখে মনে হচ্ছে খুব চাপ যাচ্ছে।

ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম দু’জনে।

অনুপ ওর দাদাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছে। গত পরশু যে মেয়েটি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, সে ওর মাসতুতো বোন সুমিতা। সুমিতার সঙ্গে অনুপের দাদা অতীনের একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা আজকের নয়, অনেক দিনের। সবাই ভেবেছিল অতীনের বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী! এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে অতীনের না ডিভোর্স হয়ে যায়! তা ডিভোর্স হলে কারও কোনও আপত্তি ছিল না। সমস্যা দাঁড়িয়েছে অনুপের বৌদি পুলিশে কেস করায়। অনীত সেক্রেটারিয়েট সার্ভিসে আছে। এখন ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছে। আইনজীবীর পরামর্শ নিতে দু’ভাই এবং সুমিতা এখন ছুটোছুটি করছে।

এ তবু মন্দের ভাল। কিন্তু একদিন সুজিতদা এসে যে কাহিনি শোনাল, তাতে আমার মতোএকাধিক ঘাটে জল খাওয়া বান্দাও থ বনে গিয়েছিল।

সুজিতদার বন্ধু গোবিন্দ রায় কলকাতার এক নামি কলেজের লেকচারার। সে ভদ্রলোক নাকি শ্বশুর বাড়িতে সপরিবারে রাত কাটিয়ে, সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ফ্ল্যাটে ফেরার আগে— নিদ্রিত সন্তানের উপস্থিতিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না-দিয়ে—অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা সহধর্মিণীর সঙ্গে অভ্যাসমাফিক রতিক্রীড়ায় রত হয়। তার পর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে টিউশন নিতে আসা উদ্ভিন্ন-যৌবনা ছাত্রীর সঙ্গে— যার এক মাস পরে বিয়ে—প্রথা ভাঙা খুল্লাম খুল্লা উদ্দাম যৌনতা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। আবার কলেজ শেষে, শেষ বিকেলে তার পান্ডিত্যের প্রেমে পড়া বিদুষী সঙ্গিনীর সঙ্গে অনালোকিত পার্কে বসে ফোর-প্লের কালোয়াতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়।

মধুশ্রীদি এক দিন অফিসে খুব সাজগোজ করে এল। দিদির মেয়ের বিয়ে বলে হাফ সিএল নিয়ে বেরিয়ে গেল। দেবাশিসদা বললেন, জানো শুভ, মধুশ্রীর বর স্টেটস থেকে এসেছে শুধুমাত্র শালির মেয়ের বিয়ে বলে! কিন্তু এসে বাছাধন এক মারাত্মক সমস্যায় পড়ে গেছে। হঠাৎ করে ভদ্রলোকের শাশুড়ি মা স্ট্রোকের কবলে পড়ে কোমাতে চলে গিয়েছেন। এখন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে ভর করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায় তিনি বেসরকারি হাসপাতালে শুয়ে রয়েছেন। এদিকে বরের যে-কারণে দেশে ফেরা অর্থাৎ শালির মেয়ের বিবাহানুষ্ঠান— তার মৌজ-মস্তিতে যাতে বরের এতটুকু খামতি না হয় সে-জন্য মধুশ্রী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বরকেও তার সেই উদ্যোগে শামিল করেছে। তাই কার্যত বাধ্য হয়ে এখন বিদেশ প্রত্যাগত মধুশ্রীর বর ডাক্তারদের অনুরোধ জানাচ্ছে তার মাকে যেন আরও কয়েক দিন ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। বেচারা! আর তোমার নারীবাদী অলোকাদির ব্যাপারটা জানো তো? বিয়ের পরই ওর বরকে তার বৃদ্ধা মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জোড়ায় আলাদা ফ্ল্যাটে থাকছে। এদিকে মহিলাদের প্রতি দরদ একদম উথলে ওঠে! কিছু বলতে যাও না, বলবে, কেন, সর্বক্ষণের লোক রেখে দিয়েছি তো! যাক গে যাক। নিজের ঠ্যালা নিজে সামলা। তোমার-আমার কি যায়-আসে!

দেবাশিসদাকে দেখে এবং কথা বলে চিত্রারও পছন্দ হয়েছে। দেবাশিসদাকে ও একবারই দেখেছে। সেই যেদিন ও অফিসে এসেছিল, সেদিন। চিত্রা আমারই মতো। কলকাতার কোনও বড় সরকারি অফিস দেখেনি। অফিস দেখার খুব ইচ্ছা। আমি বললাম, ঠিক আছে, একদিন আমার অফিসে চলে এসো। ভাবিনি সত্যিই  চলে আসবে। ও যে আসছে, অফিসে একটা ফোন করে তো জানাবে! তা না, সোজা একদম তিন তলার অফিসে হাজির। আমি তো প্রথমে ওকে ঢুকতে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম ঠিক দেখছি তো! ইউনিভার্সিটি থেকে চিত্রা যে সোজা আমার অফিসে চলে আসবে তা আমি অনুমান করতে পারিনি। স্ট্যামিনা আছে বলতে হবে! দেবাশিসদা আমার মুখ দেখে ধরতে পেরেছিলেন আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছি। বললেন, ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে বসো। আমি ধাতস্থ হয়ে বললাম, আপনিও চলুন না। দেবাশিসদা চিত্রার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আমাকে বললেন, তোমরা যাও। আমি আসছি।

ক্যান্টিনে বসে আছি অনেকক্ষণ। পাঁচটা বাজতে চলেছে। পাঁচটা পনেরো বাজলেই সবাই ব্যাগ কাঁধে তুলে বেরিয়ে পড়বে। আমাকেও ব্যাগ নিতে এবং সই করার জন্য যেতে হবে। পাঁচটা দশ থেকেই সইয়ের খাতা কখন ঘরে আসবে, তার জন্য সবাই উশখুশ করতে আরম্ভ করে দেয়। ডিপারচার দিয়ে খালি ভোঁ কাট্টা হওয়ার অপেক্ষা। উঠব উঠব করছি, দেবাশিসদা এসে হাজির। এসেই শূন্য টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কী, তোমরা দেখছি চা-ও নাওনি। আমি বললাম, বড্ড দেরি করে এলেন দেবাশিসদা। এখ্খনি তো উঠতে হবে। আরে আমি তো আসব বলে অনেক আগেই উঠে পড়েছিলাম। নীহার একটা ব্যক্তিগত কথা বলতে শুরু করল বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। আসলে অফিসে দেবাশিসদার সঙ্গে সবারই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সবাই বিশ্বাস করে দেবাশিসদাকে পার্সোনাল কথা বলে। সকলের হাঁড়ির খবর তাই দেবাশিসদার নখদর্পণে। চা আর টোস্টের অর্ডার দিয়ে উনি চিত্রার নাম-পরিচয়, পড়াশোনা— এই ধরণের সাধারণ দু’-চারটে কথাবার্তার পর বললেন, শুভকে কিন্তু খুব শক্ত করে বাঁধা দরকার। কি, সেটা তুমি পারবে তো? চিত্রা বলল, কেউ যদি ধরা না দেয়, তাকে কি বাঁধা যায়! দেবাশিসদা মুচকি হেসে বললেন, ওরে বাবা! এ যে দেখি ভাল কথা জানে।  তিনজনে চা-টোস্ট খেলাম। টাকাটা আমার আপত্তি সত্ত্বেও দেবাশিসদা মেটালেন।

দিনটা ছিল শুক্রবার। শুক্রবার সকালে আমার অফিসে বেরতে সবচেয়ে ভাল লাগে। সোমবার সকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্তি। চিত্রাকে নিয়ে ফেরার সময় সেই কারণে আরও ভাল লাগছিল। মিলেনিয়াম পার্ক থেকে লঞ্চে উঠে যখন হাওড়া ফেরিঘাটে ফিরছি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গঙ্গা-জলের ওপর তিরতির করে এগিয়ে চলা লঞ্চ-বর্ষণ ধারা-প্রাকসন্ধ্যার প্রকৃতি এবং চিত্রা— সব মিলিয়ে কী ভাল যে লাগছিল বলে বোঝানো যাবে না! হাওড়া স্টেশনে এসে বড়গাছিয়া লোকালে উঠে দু’জনে পাশাপাশি বসলাম। ভারী ভাল লাগছিল। এ ভাবে সন্ধ্যারাতে এর আগে ট্রেনে করে এক সঙ্গে কখনও ফিরিনি। মুগ্ধতা ঘিরে রেখেছিল আমাদের। কোথায় এলাম, কতটা সময় কাটল কিছুই খেয়াল ছিল না। কিন্তু ট্রেনকে তিরিশ সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’বার থামতে দেখে বুঝতে পারলাম ঝালুয়ারবেড় স্টেশনে এসে পড়েছি। স্টেশন এত ছোট যে, পুরো ট্রেনটা একবারে প্ল্যাটফর্মে আঁটে না, তাই দু’বারে ট্রেনের সমস্ত কামরাগুলো ধরাতে হয়। ডোমজুড় রোডে পৌঁছে ট্রেন থেকে নামলাম।

স্টেশনের নাম ডোমজুড় রোড। পরবর্তী স্টেশন ডোমজুড়— মাত্র এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পরিকল্পনায় ভারত সরকার চিরকালই যে দড়, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

কলকাতা থেকে মাত্র কুড়ি-বাইশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ডোমজুড় কলকাতার মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। সেই তুলনায় অনেক গুণ দূরে অবস্থিত ডোমকলের নাম তাদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। অবশ্য এইডস রোগের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ডোমজুড় এইডস রোগীর সংখ্যায় প্রথম সারিতে উঠে এলে অনেকের ডোমজুড় নামের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। সুপ্রভাত ডোমজুড় নিয়ে ওর একটা নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা একদিন শুনিয়েছিল। ওর স্কুলের দূরত্ব প্রপার ডোমজুড় থেকে দশ কিলোমিটার। ও একদিন ক্লাস টুয়েলভের একটা ছেলের কাছে ডোমজুড়ের কোনও প্রসঙ্গ ওঠায় জানতে চেয়েছিল, কী রে, কোনও দিন ডোমজুড় গেছিস? ছেলেটা কী উত্তর দিয়েছিল ওর মনে নেই। কিন্তু পুরো ক্লাসের রহস্যময় প্রতিক্রিয়ায় ও এত অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল যে স্টাফরুমে এসে ঘটনাটা বলেছিল। তখন স্থানীয় শিক্ষক বিমলবাবু, ওকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে, ছেলেদের এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আসল কারণটা জানায়। সুপ্রভাত সেটা শুনে অপ্রস্তুত বোধ করেছিল। অন্নপূর্ণার গলিই যে স্কুলপড়ুয়া কমবয়সী ছেলেদের কাছে ডোমজুড়ের ল্যান্ডমার্ক এবং সেই কারণে ডোমজুড়ে যাওয়া যে সোনাগাছিতে যাওয়ার সঙ্গে তুলনীয়, এটা জেনে ডোমজুড়ের ভূমিপুত্র হিসাবে ওর খুবই খারাপ লেগেছিল। হায় রে ডোমজুড়ের কপাল! একেই বোধ হয় বলে নেগেটিভ পাবলিসিটি।

সেদিন চিত্রার সঙ্গে সন্ধ্যারাতে ফেরায় নাটকীয়তা ছিল না, কিন্তু রোমাঞ্চ ছিল। আজ গভীর রাতে নাটকীয়তার উপাদান যথেষ্ট কিন্তু সেই তুলনায় রোমাঞ্চ খুঁজে পাচ্ছি না।

বাসে বসে খুব স্বস্তি বোধ করছিলাম না। এই বাসযাত্রাতেই আজকে আমার যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটবে না। কারণ এ বাস আমার গন্তব্য পর্যন্ত যাবে না। সাঁতরাগাছিতে নেমে পড়তে হবে। তারপর সেখানে আবার যাত্রার কী বন্দোবস্ত আমার অপেক্ষায় আছে কে জানে! সেখানে কি রোমাঞ্চকর কিছু ঘটবে?

সাঁতরাগাছিতে নেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে এগারোটা। বাইক রাখা আছে অঙ্কুরহাটিতে। প্রায় ছ’-সাত কিলোমিটার দূরে। আর বাসের কোনও আশা নেই বুঝতে পারছি। ট্যাক্সিও অপ্রতুল। যা-ও বা দু’-একটা এল, দাঁড়াল না। হেঁটে মৌখালির দিকে এগোতে লাগলাম। একজন পুলিশ এগিয়ে এল সাহায্যের জন্য। কিন্তু তাতে সুরাহা কিছু হল না। সময় কেটে যাচ্ছে… ট্যাক্সি থামছে না… ভাবলাম হাঁটতে শুরু করলে ম্যাক্সিমাম ঘন্টা দেড়েক লাগবে। অবশ্য এত রাতে হেঁটে ফেরা কতটা নিরাপদ বুঝতে পারছিলাম না। পুরোপুরি না ঘাবড়ালেও ফেরার ভাবনাটা কিন্তু বেশ চেপে ধরছিল। হাঁটার ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে বাইক থামানোর চেষ্টা শুরু করলাম। দু’-তিনটে পাশ কাটিয়ে হুশহুশ করে বেড়িয়ে গেল। আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। মনে একই সঙ্গে আশা ও আশঙ্কা। আশঙ্কা প্রত্যাশিত দুর্ভাগ্যের আর আশা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটার।… হঠাৎ দেখি একটা বাইক কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

অঙ্কুরহাটি চেকপোস্ট যাবেন?

কোনা ব্রিজ পর্যন্ত যাব।

কোনা ব্রিজ পর্যন্ত গেলেও অনেকটা এগোনো যাবে। তারপর আর কিলোমিটার দুয়েক হাঁটলেই চেকপোস্ট।… উঠে বসলাম বাইকের পিছনে। প্রথমে আমি ঠিক বোঝার মতো অবস্থায় ছিলাম না। কিন্তু বাইকে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম চালক মদমত্ত। এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। নেশার ঘোরে না-থাকলে কেউ রাত বারোটার সময় অচেনা ব্যক্তিকে লিফ্ট দিতে চাইবে না! নিজে বাইক চালাতে না-জানলে হয়তো এমন বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ে এত অস্বস্তি হত না। বুঝলাম এ যা চালাচ্ছে মিনিট তিন-চারেকের মধ্যেই কোনা ব্রিজে পৌঁছে যাব। তারপর আধঘণ্টার হন্টন!

আমি মাকড়দহ যাব, সামনে থেকে ভেসে এল বাইকচালকের স্বর।

তাহলে তো কোনা ব্রিজ পেরিয়ে… নিবড়া হয়ে, অঙ্কুরহাটি দিয়েও যেতে পারেন।

এর আগে কখনও আমি কোনা ব্রিজ পেরিয়ে যাইনি। শলপ ব্রিজ হয়ে কাটলিয়া দিয়ে গেছি।

কিন্তু নিবড়া দিয়ে গেলে তো রাস্তা অনেক কম হয়… অনেকটা সময়ও বাঁচে।

তবে তাই যাই চলুন।

অঙ্কুরহাটি পৌঁছে বাইক থেকে নেমে ধন্যবাদ জানানোর আগে, বাইকচালকই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে গেল, আপনার জন্যই আজ আমি অনেক তাড়াতাড়ি মাকড়দহ পৌঁছতে পারব।

প্রায় একটায় বাড়ি পৌঁছে পরের দিন সকালে যথারীতি অফিসে হাজিরা দিলাম। সন্ধ্যাবেলায় চিত্রাকে বললাম, দেখেছ, আমার জীবনে কেমন চূড়ান্ত নাটক নেই। ক্ল্যাইম্যাক্সে পৌঁছনোর আগেই কেমন তালভঙ্গ হয় বুঝতে পারলে! অদ্ভুত ব্যাপার… কোনও জায়গায় আমার আটকে থাকা নেই!

আমি মরছিলাম দুশ্চিন্তায়, আর তুমি খুঁজছিলে নাটক! পারো বটে! সেই কোন বিকেলে তুমি অফিসে থাকতে তোমার সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয়েছিল। এদিকে রাত দশটা থেকে তোমার ফোনের অপেক্ষায় থেকেছি। এগারোটা… সাড়ে এগারোটা… ফোনের অপেক্ষায় আর বসে থাকা শোভা পায় না বলে মায়ের ডাকে শুতে গেছি, কিন্তু বিছানায় ছটফট করেছি, ঘুমোতে পারিনি। এদিকে ফিরেও যে একটা কল করবে তা নয়!… বাবু বলে কিনা চরম নাটকীয় কিছু ঘটছিল না বলে আক্ষেপ হচ্ছিল! যেদিন সত্যি নাটকীয় কিছু ঘটবে, সেদিন বুঝবে!

তোমার তো ঈশ্বরের সাথে হট কানেকশন আছে। তা তুমি আমার জন্য তোমার ঈশ্বরের কাছে একটু প্রার্থনা করো না, যাতে আমার জীবনে সত্যি নাটকীয় কিছু ঘটে।

যেদিন ছেড়ে চলে যাব সেদিন বুঝবে পরিস্থিতি কেমন নাটকীয় লাগে!

কিন্তু আমি জানি চিত্রা আমাকে ছেড়ে যাবে না।

আমার সব কিছুই কেমন ঠুনকো, ফালতু, অর্থহীন মনে হয়। অথচ… চিত্রার ব্যাখ্যাহীন প্রেমকে কী গভীর, শাশ্বত এবং জলের মতো স্বচ্ছ মনে হয়। আর তা থেকেই আমার চিত্রার প্রতি এক অটল বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত, যে মানুষটা তাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে—সেই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার মতো বোকামি চিত্রা আর কখনওই করবে না। কিন্তু এই চিত্রাই বছরদুয়েক আগে—আমি চাকরিটা যখন পাইনি— আর একটু হলে কী চরম একটা ভুল করে বসেছিল! ঘটনাটা আমার কাছে এমন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল যে, আজও যেন ঠিক সেটা বোধে গিয়ে পৌঁছয়নি। আমি শুধু হতবাক নয়, মারাত্মক মর্মবেদনা অনুভব করেছিলাম। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যতই কষ্টদায়ক হোক, সমস্ত সম্পর্কই যে কত ভঙ্গুর এবং সম্পর্কে জড়ানো দুটো মানুষের মধ্যে যে কেউ, যে কোনও সময়, অপরের কথা না-ভেবে— ইচ্ছা করে হোক বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও— যে কোনও সিদ্ধান্ত যে নিতে পারে সেই সবক আমাকে ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

আমার মনে যাই থাক না কেন, আমার মনে প্রশ্ন জাগে— চিত্রা কি আমাকে বিশ্বাস করে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আমাকে কি বিশ্বাস করা যায়? একজনকে প্রাণপণ ভালবাসব, আবার অন্য নারীর শয্যাসঙ্গী হব বা অন্য নারীকে শয্যাসঙ্গিনী করব— এটা তো মারাত্মক দ্বিচারিতা। আমার পক্ষে কী করে এটা করা সম্ভব হচ্ছে! পুরোটাই ফাঁকি না হলে কি এটা করা সম্ভব? আচ্ছা, আমি কি এভাবে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ঠকাচ্ছি না! নিজেকে ঠকিয়ে, নিজের কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে এ আমি নিজেকে আজ কোথায় নিয়ে চলেছি! জানি না। শুধু বুঝতে পারি অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে মানুষ যেমন শত চেষ্টা করেও আর প্রশ্বাস বায়ু গ্রহণ করতে পারে না, আমার পক্ষেও আর এই দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাই বোধ হয় অবচেতনে সবসময় খুঁজে চলি নতুন ওপেনিং, জীবন্ত ইনহেলার, সর্বক্লেশহর বিশল্যকরণী।

আমার ভাবতে ভাল লাগে, চিত্রা আমাকে বিশ্বাস করে। আমার এই বিশ্বাস কিন্তু একটুও ঠুনকো নয়।

সুজিতদা বলছিল, ওকে ওর স্ত্রী— যাকে সাত বছর প্রেম করার পর ও  বিয়ে করেছে— খুব বিশ্বাস করে। খেয়াল করে দেখেছি ওর প্রতি স্ত্রীর এই বিশ্বাসকে ফলাও করে প্রচার করতে ভালবাসে সুজিতদা।  ওদের বিয়ের ফার্স্ট অ্যানিভারসারির দিন সুজিতদা অফিসে ডুব মারল। পরের দিন দেখা হতেই জানতে চাইলাম, কী সুজিতদা, কাল সারাদিন কী করলে? দেখে তো মনে হচ্ছে জব্বর সেলিব্রেশন হয়েছে।

মানে!

মানে আবার কী! ভাবছ, ডেটটা ভুলে গেছি নাকি!

কীসের ডেট…?

কেন? কাল তোমাদের ম্যারেজ অ্যানিভারসারি ছিল না?

তো?

নাহ্… তাই জানতে চাইছিলাম।

কালকের কথা আর বলিস না!

কেন কী হল গতকাল? স্পেশাল কিছু নাকি!

তুই তো জানিস-ই আমি একটা কোচিং সেন্টারে কমপিটিটিভ একজ্যামের ম্যাথ দেখিয়ে দিই। মাসখানেক হল সেখানে একটা নতুন মেয়ে কোচিং নিতে আসছে। মেয়েটা… ম্যারেড, আর বুঝলি… যাকে বলে কিনা… ফাটাফাটি ফিগার!… তা বুঝলি, কয়েকদিন আগে মেয়েটা বলল, স্যর, আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা একটু দেবেন?… দিলাম। কিন্তু কি মনে করে বাড়ির নাম্বারটা দিইনি, অফিসেরটা দিলাম।

আমার খেয়াল পড়ল ইদানীং নারায়ণদা মাঝে মাঝেই ডাক দিতেন, সুজিত, তোমার ফোন। এমনিতেই অফিসের ফোন সব সময় বিজি থাকে। হয় কারও ফোন আসছে, না হলে কেউ ফোন করছে। মুফতে মেলা সুযোগ কেউ সহজে ছাড়তে রাজি নয়। অফিসিয়াল ফোন হাতে গোণা হলেও, ইউডিসি নারায়ণদার টেবিলের পাশে ফোনটা রাখা আছে বলে, এই আনঅফিসিয়াল ফোনের ঝক্কি ঝামেলা নিয়ে নারায়ণদাকে সদা সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তাতে ওঁর খুব আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। এই অফিসে ছাই কাজই বা কী আছে! এটা তো ঘটনা, অজয়দা দশ বছর ধরে  আটচল্লিশজনের এই  ডিপার্টমেন্টে সম্বৎসর কে ক’টা সিএল নিয়েছে তার হিসাব রাখতেন আর বিগত পাঁচ বছর ধরে মেডিক্যাল লিভের হিসাব রাখেন। ওয়ার্ক কালচার, ওয়ার্ক কালচার বলে খবরের কাগজের পাতা ভরালে হবে? ওয়ার্ক-ই নেই তো ওয়ার্ক কালচার!

বাড়িরটা না দিয়ে অফিসেরটা দিলে কেন!

আরে মেয়েটার হাবভাব দেখে আমার কেমন ফিশি মনে হচ্ছিল। তাই আর রিস্ক নিইনি।

তারপর?

তারপর আর কী… যা ভেবেছিলাম তাই! ফোন নাম্বার নেওয়ার প্রয়োজনটা ক্রমশ আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগল। আর এদিকে ফোনের মাধ্যমে শুধু অঙ্কের সমস্যা নয়, বুঝলি জৈবিক সমস্যারও বিনিময় হতে লাগল। এমন ব্যক্তিগত বিষয় উঠে আসতে লাগল, বুঝলাম— দুধ জমে ক্ষীর! বেচারার আসলে খুব কষ্ট বুঝলি! আর কষ্ট হবে না কেন বল? বিয়ের একমাস পরেই হাজব্যান্ড আউট অব স্টেশন।… ওর দুঃখে আমারই ভিতরে যেন কেমন হচ্ছিল! তাই যখন আমাকে ডাক দিল, বুঝলি, আমিও আর কালক্ষেপ করিনি। মাথায় থাক অ্যানিভারসারি! ও আবার সামনের বছর হবে’খন।… কাল দুপুরে তাই… মেয়েটির সঙ্গেই…, চোখে অর্থবহ ইঙ্গিত ফুটিয়ে তুলল সুজিতদা,… ওই আর কী… সময় কাটালাম!

সত্যি?

সত্যি না তো কী! সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে পরে পস্তাতে আমি রাজি নই। টাকা-পয়সা এবং নারী শরীর— সুযোগ পেলেই আমি হাতাব। ম্যাদামারা-সৎ-চরিত্রবান পুরুষ হওয়ার কোনও বাসনা আমার নেই।… ইশারা আসবে, অথচ বুঝতে পেরেও না-বোঝার ভান করে সচ্চরিত্র সেজে থাকব— সুজিত দত্ত সে বান্দা নয়।

নাটক ছাড়াই খুব স্বাভাবিক ভাবে এসব ঘটে চলেছে। আজকাল। চিরকাল।

আর আমি শালা এদিকে নাটকের জন্য হেদিয়ে মরছি!

কী মনে করে চিত্রাকে সুজিতদার ঘটনাটা শোনালাম। না শোনালেও চলত। কিন্তু আমার অবচেতনে কোথাও একটা নিজের গোপন সত্য প্রকাশের ইচ্ছা বোধহয় তৈরি হচ্ছিল। অথবা আমার গোপন সত্য জানলে চিত্রার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটা জানার একটা কৌতূহলও মনে জেগে থাকতে পারে। তা সুজিতদার ঘটনাটা শুনে অদ্ভুত হাসি ফুটল চিত্রার মুখে। বলল, তোমারও যদি এমন মনে হয়, জানিয়ো। বাধা দেব না। মর্যাদার সঙ্গে সরে যাওয়ার রাস্তাটা অন্তত রেখো।

মনে হল আমার পক্ষেও আর এই ভন্ডামির মুখোশ পরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চিত্রাকে খুলে বলি সব কথা। মুখ খুললাম। কিন্তু মুখ খুলে যা বলে উঠতে পারলাম তা নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত শোনাল—এর এক শতাংশ ঘটলেও তুমি সবার আগে জানবে। তখন কিন্তু ‘ধ্যাৎ’ বলে কানে আঙুল দিলে চলবে না।

আজ সকালে দেখেছি মেয়েটা বাস ধরার জন্য যথারীতি দাঁড়িয়ে। মেয়েটা বছর খানেক ধরে এসে দাঁড়াচ্ছে অঙ্কুরহাটিতে। সপ্তাহে পাঁচদিনের মধ্যে অন্তত চারদিন কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করি। আমি মাকড়দহের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে অঙ্কুরহাটি আসি। আসার পথে কিবরিয়া গাজি স্কুলের ঠিক পরে মাঝে মাঝে মেয়েটিকে পিছন থেকে দেখতে পাই— সাইকেল চালিয়ে অঙ্কুরহাটি আসছে। পিছন থেকে দেখার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। আবার যখন বাসস্টপে দেখি, সেটা অন্যরকম। একই নারী অথচ কেমন আলাদা রূপ! আশ্চর্যের ব্যাপার, চিত্রাকে কিন্তু কখনও এমন আলাদা লাগে না! চিত্রা আমার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে নির্বিকল্প নারীপ্রতিমা। আর ঘাই হরিণী এবং রমা এত স্পষ্ট যে তাদের নিয়ে কল্পনার কোনও অবকাশই নেই। এই মেয়েটিকে নিয়ে কিন্তু বেশ কল্পনা করা যায়!

মেয়েটির বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে কেমন এক অকারণ অহঙ্কার। আর এটাই মেয়েটির ইউএসপি— অন্ততপক্ষে আমার কাছে। যতদূর মনে হয়, কলকাতার কোনও স্কুলে শিক্ষকতা করে। কাঁধে দুটো ব্যাগ এবং বাসে কয়েকজনের সঙ্গে ওর কথাবার্তা সে রকমই ইঙ্গিত বহন করে।

আমি ওর সঙ্গে কথা বলি না এবং যেচে কখনও কথা বলবও না। তবে মনে হয় আমার সঙ্গে ও কথা বললে খারাপ লাগত না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি। দু’-একবার চোখাচোখিও হয়েছে। কোনও পাত্তা দেয়নি। আমাকে কেউ পাত্তা না দিলে আমার কেমন তার প্রতি বেয়াড়া রাগ তৈরি হয়ে যায়। এটা নতুন কিছু নয়, এ আমার অনেক পুরনো অভ্যেস। আর সেই রাগ থেকেই মেয়েটিকে একদিন অস্বস্তিতে ফেলে দিলাম। সেই যেদিন অঙ্কুরহাটিতে ওর সঙ্গে একজন সুদর্শন পুরুষ এসে দাঁড়াল। কেমিস্ট্রি দেখে মনে হচ্ছিল বয়ফ্রেন্ড। আমি সেদিন একটু বেশিই আড়নয়ন। বয়ফ্রেন্ড বাবাজি সেটা লক্ষ করে দু’একবার কড়া চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ না করে একবার স্ট্রেট তাকালাম মেয়েটির দিকে। এতে ছেলেটি বেশ চুপসে গেল, তারপর চোখে প্রশ্ন ফুটিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝে নিতে চাইল। দেখলাম সামান্য একটু অস্বস্তি বোধ করছে মেয়েটি। বাস আসতে আমি স্মার্টলি বাসে উঠে গেলাম এবং তারপর সিটে বসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চিত্রা এ ব্যাপারটা শোনেনি। আসলে শোনানোর মতো কিছু ছিল না বলেই শোনেনি।

অফিসটাইমে চিত্রাকে নিয়ে সেদিন একটু বেরিয়েছি। অঙ্কুরহাটি থেকে বাস ধরব বলে দু’জন হেঁটে বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছি। একটু দূর থেকে দেখে নিয়েছি মেয়েটিকে— যেখানে দাঁড়ায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই দেখলাম মেয়েটি  ঘুরে— এই প্রথমবার— সোজা আমার দিকে তাকাল এবং গলায় পঞ্চাশ শতাংশ অনুযোগ এবং পঞ্চাশ শতাংশ অভিমান মিশিয়ে বলল, আজ এত দেরি…!

 

  পর্ব দুই: চন্দ্রাহত

সমুদ্রের দিক থেকে বেশ জোরে হাওয়া বইছে। সন্ধ্যা এগিয়ে চলেছে ক্রমশ রাতের দিকে। আকাশে পরিণত চাঁদ। পূর্ণিমা। চারিদিক ইলিশ-চকচকে।

কটেজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্নে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে দেখা হল। অনেক দিন পর। তারপর থেকে অনেকটা হালকা লাগছে। সকালের ঘটনা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এমনটা যে হতে পারে আগেই অনুমান করেছিলাম। তবুও ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। জীবন বড় গতানুগতিক, চড়াই-উতরাই বিহীন; নাটকীয়তার কোনও অবকাশই সেখানে নেই।

সেই জন্য হিটলার আমার প্রিয় চরিত্র। হিটলার! শুনে চমকে উঠেছিল চিত্রা। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সেই ভদ্রলোক।

চাকরির জন্য সেটাই আমার প্রথম ইন্টারভিউ। বেশ কিছু নিরীহ প্রশ্নের পর পাতলা চুলের মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক— আগে যিনি একটিও প্রশ্ন করেননি— জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?

আমি স্পষ্ট উচ্চারণে বললাম, হিটলার।

প্রশ্নকর্তা বিস্ময়-চকিত হয়ে আমার মুখের দিকে সোজা তাকালেন।

তাঁর পাশের ভদ্রলোক মিটিমিটি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু ব্যঙ্গাত্মক গলায় জানতে চাইলেন, রাবণ নয় কেন?

কারণ আমি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নই।

প্রথম ভদ্রলোক এবার বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে স্মার্টলি জানতে চাইলেন, আপনি কি নাৎসি-ইজমে বিশ্বাস করেন?

উনি দ্বিতীয়বার বিস্মিত হলেন যখন ওঁর কানে ঢুকল আমার উত্তর, আমি কেবল একটি ইজমেই বিশ্বাস করি এবং সেটি হল ফ্রয়েড-ইজম।

একটা সময় এমন ছিল যখন আমি সদা-সর্বদা হিটলারেরই স্বপ্ন দেখে এসেছি। আজ আবার দেখলাম। আর তারপর থেকেই দেখছি আমার অস্বস্তিবোধটা ধীরে ধীরে কমছে।

রমা কখন বেরিয়েছে কে জানে! এবার আর আমাদের সঙ্গে মিসেস চৌধুরী আসেনি। তার না আসার গূঢ় কারণ রয়েছে। তা থাক। কিন্তু বেশ কয়েক বৎসরের অভ্যেস! আমার একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেড়াতে এসে একা রমাতে ঠিক আমার পোষায় না। যদিও ঘাই হরিণী আর আগের মতো দৌড়াতে পারে না। কিন্তু তা হলে কী হবে— মরা হাতি লাখ টাকা!

রমা আমাকে বলে যাওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ভালই করেছে। আমাদের দু’জনের বৈবাহিক সম্পর্ক এবং দাম্পত্য জীবন মিসেস চৌধুরীর কারণে প্রথম থেকেই জট পাকিয়ে গিয়েছে। দোষটা আমারই এবং ইচ্ছা করলেই আমি এই গাঁট পাকিয়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতোর গিঁট সহজেই খুলতে পারি। কিন্তু এত সহজে কি মিসেস চৌধুরীকে মুক্তি দেওয়া উচিত? দ্বিতীয়ত, জটিলতা আমার বড় প্রিয়। আর এটা আমার কাছে প্যারাডক্স-ই মনে হয় যে, আমার জীবন বড়ই সরলরৈখিক।

সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছিল। হাতে ছ্যাঁকা লাগতে ফিল্টারটিকে নীচে ছুঁড়ে দিলাম।

রমা ফিরছে। রমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। এখনই ওর ফিরে আসার কী দরকার ছিল!

রমাকে সুন্দরী বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। কিন্তু ওর এই গর্বোদ্ধত সৌন্দর্য আমার ঠিক সহ্য হয় না। ওকে দেখে মনে হয় ওর মধ্যে এতটুকু দুঃখ-কষ্ট নেই। এত সুখ আসে কোথা থেকে! আমার নিজের মায়ের কথা খুব মনে হয়। কখনও মুখ দেখে সুখী মনে হয়নি। অবশ্য খুব যে দুঃখী মনে হয়েছে তাও নয়। সবসময়ই মুখের মধ্যে কেমন একটা ম্লান গাম্ভীর্য।

রমা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। আমার দিকে একবার তাকায়। ঘরে ঢুকে যায়। মিনিট দুয়েক পরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়।

আমি একদৃষ্টে চাঁদ দেখতে থাকি। কলঙ্কস্বরূপ কালো কালো দাগগুলো বড় স্পষ্ট। হালকা সাদা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে পূর্ণ চন্দ্রমা। সেদিকে তাকিয়ে আত্মগত ভাবে জানতে চাই, আজ কী পূর্ণিমা?

রমার মৃদু স্বর ভেসে আসে, তাই তো মনে হয়।

না,না! আজ যে পূর্ণিমা, আমার সেটা জানা আছে। আমি জানতে চাইছি এটা কি কোনও বিশেষ পূর্ণিমা? অধৈর্য ভাব ফুটে ওঠে আমার গলায়।

মাঘী পূর্ণিমা, বলে নিশ্চুপ হয় রমা।

আমার মনে পড়ে। মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্ম মাঘী পূর্ণিমার ভোররাতে। এমন সুন্দর ক্ষণে আমার আবির্ভাব! বিশ্বাস করতে মন চায় না।

কলঙ্কময় বলেই তো চাঁদ এত সুন্দর, আকর্ষক, মনোহর। কলঙ্ক! হ্যাঁ, কলঙ্ক। আমার জীবনও তো ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে কলঙ্কে। তাহলে আমার জীবনও কি হয়ে উঠতে চলেছে উপভোগ্য? অন্তত আমার নিজের কাছে।

রমার ডাকে আমার ভাবনা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বেশ রাত হয়েছে, চলো খেয়ে নেওয়া যাক।

আমি খেতে যাওয়ার কোনও আগ্রহ বোধ করি না।

কী হল?

একা খেতে তোমার কোনও অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। আজকাল তো একা চলাফেরা করতে তোমার কোনও অসুবিধা হয় না।

এটা শুনতে হবে আগেই জানতাম। কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে, দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে না-তুলতে।

না-ডেকে ভালই করেছ, ঘুরে ঘুরে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না। তবুও— হয়তো তোমাকে সঙ্গ দিতে পারতাম।

কয়েক মুহূর্ত সময় নেয় রমা, তারপর অনুরোধের মতো করে বলে, সে-সঙ্গ এখনও তো তুমি দিতে পারো।

খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে নাও। রাতে আমি আজ আর খাব না।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রমা। অপাঙ্গে দেখে আমাকে। কিছু না বলে রুমে চলে যায়। আমি জানি ওর কিছু খেতে ইচ্ছা না-করলেও ও খেয়ে নেবে। নিজের কথা ভেবে নয়, ওর গর্ভস্থ সন্তানের কথা ভেবে। আমি যখনই বুঝেছি রমা আমার কাছ থেকে মুক্তির জন্য গভীর চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে, তখনই বের করেছি রাবণের মৃত্যুবাণ। আমি নিশ্চিত ও এখন বেশ কিছু বছর আমার ইচ্ছা মেনে সংসারে পড়ে থাকতে বাধ্য।

রমা কি আজও আমাকে ঠিকমতো বুঝতে পেরেছে? রমা কেন, আমিও কি আমাকে বুঝতে পারি! কেউ কি নিজেকে সম্পূর্ণ চিনতে-বুঝতে পারে? আমার বর্তমান মানসিক বিকৃতির জন্য আমি মিসেস চৌধুরীকে দোষারোপ করি। আচ্ছা, মিসেস চৌধুরী আমার জীবনে না-এলে আমার জীবনটা কি অন্য রকম হত? চিত্রাকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে ঘর-সংসার করে একটা জীবন কাটিয়ে দিতাম? জানি না, কিন্তু জানতে বড় ইচ্ছা করে। আমি আমার চরিত্রের যেটাকে বিকৃতি ভাবি সেটা কি প্রকৃতই বিকৃতি? একাধিক নারী-সংসর্গ তো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। সর্বদেশে সর্বকালে ক্ষমতাশালী মানুষ বিলাস-ব্যসনের অঙ্গ হিসাবে খুব স্বাভাবিক ভাবে বহু নারী ভোগ করেছে। ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধও হয়েছে। অবশ্যই নারী-সঙ্গর জন্য নয়, অন্য কারণে। কিন্তু তাদের চরিত্রের এই দিক তো অনালোকিতও থাকেনি। তা সত্ত্বেও তারা যদি ঐতিহাসিক চরিত্রের মর্যাদা পায়, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাস কি বিকৃত মানুষের ইতিহাস!

কারও কোন ক্ষতি না করে আমি যদি বহু নারী-গমনে নিজেকে নিয়োজিত রাখি তাতে কার কি যায় আসে? হ্যাঁ, কেউ যদি চিত্রার মতো মন থেকে আমাকে ভালবাসত, তার হয়তো ভিতর থেকে কষ্ট হতে পারত, খারাপ লাগতে পারত। কিন্তু সেই চিত্রাও তো আমাকে এত ভালবাসা সত্ত্বেও কেমন সেজে-গুজে মেয়ে-দেখতে আসা অন্য পাত্রপক্ষের সামনে বসে গিয়েছিল। তাদের পছন্দ হয়নি তা-ই, না হলে আমাকে প্রাণাধিক ভালবেসেও তো চিত্রা সেই অন্য পুরুষের অঙ্কশায়িনী হত! আর এখনই বা কি করছে সে? যতদূর জানি ইতিমধ্যে সে দু’সন্তানের মা। সেগুলো তো আর আকাশ থেকে তারাখসার মতো এমনি-এমনি ঝরে পড়েনি! সে আমাকে ভুলে অন্য পুরুষের ঔরসে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে আর আমি চিত্রাকে মনে রেখেও অন্য নারীতে উপগত হচ্ছি। কে যে ভালবাসাকে মর্যাদান্বিত করছে আর কে-ই বা তার অমর্যাদা করছে, বুঝি না! খুব বোঝার চেষ্টা করি বলে মনেও হয় না। তবে মাঝে মাঝে আমার এই পরিণতির জন্য মিসেস চৌধুরীকে যতটা দায়ী মনে হয়, চিত্রাকে তার তুলনায় কম দায়ী মনে হয় না। ঘাই হরিণীর আমাকে সর্বনাশের খাদে টেনে নিয়ে গিয়ে পেড়ে ফেলা ভুলতে পারি না বলে যেমন সৌন্দর্য-শিকারে নিজেকে ব্যাপৃত রাখি, তেমন নিঃস্বার্থ ভালবেসেও চিত্রার কাছ থেকে পাওয়া গভীর আঘাত ভোলার জন্য জীবনকে সবসময় নাটুকে করে তুলতে চাই। একটা চরম সত্য আমি এতদিনে বুঝে গিয়েছি যে, নাটক করতে পারলে আর যাইহোক নিজেকে আঘাত পেতে হয় না।

মা নাটক শুনতে খুব ভালবাসত। কলকাতা ক, বিবিধ ভারতী, রেডিও খুলনা, রেডিও ঢাকা থেকে সম্প্রচারিত নাটক নিয়মিত শুনত। বাবা অবশ্য বুধবারের যাত্রা বেশি পছন্দ করত। কিন্তু আমি তাদের আমার জীবন থেকে ছেঁটে ফেলে আজ যেখানে যেমন ভাবে রেখে দিয়েছি তাতে তাদের সেই যাত্রা-নাটক শোনার মানসিকতা আর আছে কি না জানি না। আচ্ছা, আমি মা-বাবাকে আমার জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিলাম কেন? প্রাথমিক কারণ অবশ্যই মিসেস চৌধুরী এবং রমা। কিন্তু আমি তো নিজের মতে চলতে পছন্দ করি এবং যা চাই তা-ই করি, তা হলে আমি কি মা-বাবাকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম, তবুও মা-বাবাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমার বর্তমান সফল রংদার জীবনে ওরা ঠিক খাপ খায় না বলে যে শুধু এটা করেছি ঠিক তা নয়, আসলে আমার মধ্যে কোথাও একটা অতীত বিসর্জনের প্রবণতা রয়েছে। মনে হয় শিকড় ছিঁড়ে ফেলতে না পারলে যেন ভেসে যাওয়া যাবে না। আমি নতুনের আকর্ষণ বজায় রাখার জন্য কেমন সব পুরনো ঝেড়ে ফেলে নিজের মতো করে সাফসুতরো হয়ে বাঁচতে পছন্দ করি! মায়া-মমতা-স্নেহ-ভালবাসা কোনও কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারে না। অথচ এদিকে মনে হয় কেউ আমাকে ভালবাসে না, কেউ আমাকে ভালবাসুক।

খুব মনে পড়ছে বিয়ের পর আমার আলাদা থাকার সিদ্ধান্তে হতচকিত বাবা-মা’র মুখগুলো। তার আগে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ছ’মাস ধরে নতুন বাড়ি তৈরী হয়েছে পিচরাস্তার ধারে, মিসেস চৌধুরীর পছন্দের জমিতে। বাড়ির সমস্ত কিছু— প্ল্যান-স্ট্রাকচার-গ্যারেজ-আউটার ওয়াল-কালার-ফিনিশিং-ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন-ফার্নিশিং— সব সব মিসেস চৌধুরীর পছন্দ এবং তত্ত্বাবধানে হয়েছে। জমিদারি রুচি বলে কথা! আভিজাত্য এবং বনেদিয়ানার ছাপ বাড়ির সর্বত্র। তার সঙ্গে অনুপম সৌকর্যে মিশেল ঘটেছে খানদানি আধুনিকতার। বাড়ি একখানা হয়েছে বটে! এ তল্লাটে এমন বাড়ি আর একটাও নেই। এমন একটা বাড়ি তৈরি করাতে পেরে মিসেস চৌধুরীও খুব খুশি হয়েছিল। এতটা খুশি হয়েছিল যে, হোমযজ্ঞ করে গৃহপ্রবেশের দিনে যে দামি গরদের শাড়ি পরে এসেছিল, রাতে যখন আবার আমার সঙ্গে এল, সেই শাড়ি বদলে পরে এসেছিল নিজের বিয়ের বেনারসি শাড়িটা। সোনার জরি লাগানো ময়ূরকণ্ঠী  বেনারসিতে অনিন্দ্যকান্তি মিসেস চৌধুরীকে অসম্ভব সুন্দরী এবং আকর্ষণীয় লাগছিল। আমার শুধু মনে পড়ছিল একটাই উপমা— প্যারাগন অব বিউটি। আর মোহাবিষ্ট হয়ে উপলব্ধি করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম এপিটোম অব সফিস্টেকেশনের  অবয়ব কেমন হতে পারে সেটা।

সেই রাতে পালিশ করা মেহগনি খাটে মিসেস চৌধুরী নিজেকে যেভাবে মেলে ধরেছিল এবং মিলন-রভসে উল্লসিত হয়ে সুখের সপ্তম স্বর্গে যে উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমাকেও আসঙ্গ-লিপ্সার উত্তুঙ্গ চূড়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল তার তুলনা মেলা ভার। দীর্ঘস্থায়ী রমণ-সমাপনে আদ্যন্ত তৃপ্ত মিসেস চৌধুরী সুস্মিত বদনে এবং প্রশান্ত চিত্তে ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। রাত দুটোর সময়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলার সময় আমার মনে হচ্ছিল আসলে রমার জন্য নয়, মিসেস চৌধুরী নিজের জন্যই এ বাড়ি তৈরি করিয়েছে। আমার ডাকে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ মেলে অদ্ভুত এক কান্নাভেজা গলায় ঠিক সে কথাই বলেছিল মিসেস চৌধুরী, এই ঘর, এই খাট তুমি আমার সঙ্গে ছাড়া কখনও ব্যবহার করো না। ওর না বলা উচ্চারণটাও আমার অন্তরে ধ্বনিত হল, নিজেকেও নয়। কিন্তু তা যে হবার নয় এটা জানত বলেই মিসেস চৌধুরীর বেদনা যেন গলার স্বরে ফুটে উঠেছিল। মিসেস চৌধুরীকে রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে— গৃহপ্রবেশের রাতে বাড়িতে কাউকে কাটাতে হয় এই বাধ্য-বাধকতায়— নতুন বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ফিরে আর ওই ঘরে শুতে পারিনি, পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছিলাম।

মা-বাবাকে পুরনো ভিটেতে রেখে তাদের ছাড়াই বিয়ের পরে পরেই সস্ত্রীক নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠব মা-বাবা ভাবতে পারেনি। মা বলেছিল, সে কী রে খোকা, তোকে ছাড়া আমরা আগে কখনও থাকিনি, তুইও আমাদের ছাড়া কখনও কাটাসনি, আর এখন বলছিস কিনা আলাদা থাকবি! পারবি তো?

বাবা বলেছিল, তুই পারলেও তোর মা কী করে পারবে! আমাদের বাইরের দিকে একটা ছোট ঘর দিলেও চলবে।

আমি কোনও কথা না বলে চলে এসেছিলাম। আর একদিনও মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমি চলে এসেছিলাম। সেদিন আমি অবশ্য একা চলে আসিনি, মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। আমার বড় পিসির ছেলের বিয়ে ছিল। আমি আর মা গিয়েছিলাম। বাবা কেন যায়নি ঠিক মনে নেই। বাড়ির অন্যান্য সকলে— জেঠাইমা-কাকিমা, জেঠা-কাকা এবং জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই-বোনেরাও হাজির ছিল সেই বিয়েবাড়িতে। পিসি তার সদ্যবিবাহিত ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার সমস্ত বৌদি এবং ভাজদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু সেজোবৌদি অর্থাৎ আমার মা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও পিসির মধ্যে কোনও আগ্রহ দেখলাম না মাকে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। বুঝতে পারলাম পিসির দৃষ্টিতে আমার মায়ের অপরাধ— আমার বাবার অর্থ রোজগারের অপারগতা। অপমানে মায়ের মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। মাকে সেই অস্বস্তি এবং লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য আমি সোজা মাকে নিয়ে বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। পরবর্তী জীবনে নিজে বড় পিসির বাড়ি মাড়াইনি তো বটেই, মাকেও কোনও দিন সেখানে যেতে দিইনি। কিন্তু সেই আমি আমার বিয়ের পরে নিজে মাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে কেমন ড্যাংডেঙিয়ে চলে আসতে পারলাম! কেন তৈরি হল আমার মধ্যে এমন চরম অসংবেদনশীলতা? এর স্পষ্ট উত্তর সেদিন আমার নিজেরও জানা ছিল না।

মিসেস চৌধুরীর নতুন বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াতের খবর মায়ের কানে গিয়ে থাকবে হয়তো। না হলে প্রায় মাস তিনেক পর যখন কয়েকটা দরকারি জিনিস নিয়ে আসার জন্য একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম, মা কেন-ই বা বলবে, তুই এখন নতুন মা পেয়েছিস বল! নিজের মায়ের আর কী দরকার!

মনে মনে শুধু বলেছিলাম, হ্যাঁ, নতুন মা-ই পেয়েছি বটে!

বাবা বলেছিল, আমাদের কী করে চলছে, কী করে চলবে, কিছু ভেবে দেখেছিস কি?

কোনও কথা না বলে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে মুখ বুজে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি থেকে।

আমার ঘুম আসছে না। একই সঙ্গে মায়ের বেদনাকাতর মলিন মুখমন্ডল এবং মিসেস চৌধুরীর হিল্লোলিত দেহবল্লরী আমার মনশ্চক্ষুতে ভেসে উঠছে। হঠাৎ দুটো ছবি মিলেমিশে এক হয়ে যেতে লাগল। আতঙ্কগ্রস্ত আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে বসলাম। রমার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম চাঁদের আলো ওর ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়ছে। আগামীকাল আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা। বঙ্গোপসাগরের সান্নিধ্য ছেড়ে সরস্বতী খালের তীরে। এটাই দীঘায় শেষ রাত। রমা আরও কয়েকদিন থেকে যেতে চাইছিল। আমি রাজি হইনি। ফিরেও এখন তেমন কোনও কাজ নেই। কয়েক দিন থেকে গেলেও চলে। আসলে রমা থাকতে চাইছে বলেই যেন আমার থাকার সমস্ত ইচ্ছা উবে গিয়েছে। আমি নিজের জন্য এখন একটাই শর্ত রেখেছি— অনলি আই ক্যান ডিক্টেট দ্য টার্ম। অন্য কিছু কোনও ভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। কেন, এর কোনও যুক্তিগ্ৰাহ্য ব্যাখ্যা নেই। আমার ইচ্ছা তাই।

বাইরে একটা রাতচরা পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। রমা চোখ মেলে। তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুম-জড়ানো স্বরে কী যেন বলে। আমি গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে বিছানা থেকে সাবধানে নেমে আসি। জ্যোৎস্নায় ঘড়ির ডায়ালে দেখি রাত বারোটা দশ। নীচে গেট বন্ধ হয়ে যায় এগারোটায়। লোহার গ্রিল দেওয়া গেটটা অবশ্য খুব উঁচু নয়। এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।

বিদেশি ব্যান্ডের দামি রিস্ট ওয়াচটা টেবিলের ওপর অলস ভাবে শুয়ে কেমন জ্যোৎস্না মাখছে! ঘড়িটাকে এই অবস্থায় দেখে যেন চন্দ্রভূক মনে হয়।

গতকাল রাতে ঘড়িটা ওখানে ছিল না। আমি সরিয়ে রেখেছিলাম একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। রমা সেটা জানত না। শোওয়ার সময় দেখতে না-পেয়ে খোঁজ করতে শুরু করে। প্রথমে আমায় কিছু বলেনি। আমিও ইচ্ছা করে উদাসীন থেকেছি। ঘড়িটা খুঁজে না-পেয়ে সামান্য হতাশ হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে রমা। কিন্তু একটা ঘড়ির জন্য কতটুকুই বা হতাশা সম্ভব! মনে করলে ও নিজের টাকা থেকেই যে কোনও সময় এর থেকে আরও দামি ঘড়ি কিনতে পারে। তবুও অবাক হয়ে মাঝে মাঝে শূন্য টেবিলটার দিকে তাকাচ্ছিল। ওর তাকানো দেখে আমার মনে হয় ওর যেন স্পষ্ট মনে পড়ছে নীচে খেতে নামার আগে ও একবার ঘড়িটা দেখেছে। সন্ধ্যার সময় সি বিচ থেকে ফিরে ঘড়িটা ও প্রথম দিন থেকেই টেবিলে খুলে রাখে। ঘড়িটা টেবিল ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারে না, এটা ভেবেই ও যেন অবিশ্বাসের চোখে টেবিলটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না-পেরে আমাকে ঘড়িটা দেখতে না-পাওয়ার কথা জানাতে বাধ্য হয়।

আমি তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। বলি, কই কখনও তো আমার কিছু হারায় না। তোমাদের এত জিনিস কী করে হারায় বলো তো?

এরকম অদ্ভুত জবাব শুনে রমা আর হারানো ঘড়ি নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহ বোধ করেনি।

সকালে ঘুম ভাঙিয়ে রমাকে বললাম, তোমাকে আজ একটা প্লেজান্ট সারপ্রাইজ দেব।

সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে পড়ছিল। বেলাও হয়ে গিয়েছিল অনেকটা।

রমা বালিশ থেকে মাথা তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, এখনই, না ব্রেকফাস্ট টেবিলে?

তুমি যখন চাইবে।

তাহলে এখনই, আবার বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলে রমা।

আমি খুশি হয়ে বলি, কই, তোমার হাতটা দেখি। ওর হাত বাড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি না। নিজেই ওর ডান হাতটা টেনে নিয়ে সোনালি ব্যান্ডটা আটকে দিই। পলক ফেলতে ভুলে যায় রমা। অবাক চোখে— যেন ভূত দেখছে— তাকায় আমার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বিছানা থেকে নামে। হাত থেকে ঘড়িটা খুলে আস্তে করে টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢুকে যায়। ঘড়ি নিয়ে একটাও কথা বলে না। আমি কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করি।

সকালের সেই ঘড়ি এই জ্যোৎস্না রাতে আমাকে টানতে থাকে। সেই নিষিদ্ধ টানকে কিছুতেই এড়াতে পারি না। মিসেস চৌধুরী আমাকে ঘড়িটা সম্পর্কে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। সিদ্ধান্ত আমার নেওয়াই আছে। শুধু সেই মোতাবেক কাজটা এখন করে ফেলতে হবে। কেন আমি এ কাজটা করব তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আর পরিষ্কার নয় বলেই কাজটা করতে আমি ভিতর থেকে অদ্ভুত এক সাড়া পাচ্ছি।

রমা আমাকে কী ভেবেছে? অস্বাভাবিক মনে করছে নাকি! কিন্তু আমি তো এটা চাই না। আমি শুধু ওকে ভাবাতে চাই। আমি চাই ও শুধু আমাকে নিয়ে ভাবুক। আমার জন্য কেউ ভাববে না!

আমরা কেন এ বার দীঘা এসেছি? রমা জানে, ওরই স্বাস্থ্যের কারণে আমি ডাক্তারের পরামর্শে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। ভুল জানে ও। আমার মন ওর জন্য এখনও এতটা উদ্বিগ্ন নয়। তা হলে…

আমি নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামি। এই ঘড়িটা মিসেস চৌধুরীর ভীষণ প্রিয়। এটা একই সঙ্গে তার নির্লজ্জতা এবং গর্বোদ্ধত অহঙ্কারের প্রতীক। সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যারাতে আমাকে পাক দিয়ে অজগরের মতো গিলে নেওয়ার সময় সমস্ত খোলস ছেড়ে ফেলে দিলেও ঘড়িটা কিন্তু ওর মণিবন্ধে ঠিক আটকানো ছিল। ডায়ালের ভিতর থেকে রেডিয়ামের প্রলেপ লাগানো কাঁটা কেমন হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলছিল। তারপর থেকে যতবার এই ঘড়িটা আমি মিসেস চৌধুরীর হাতে দেখেছি আমার বিবমিষার উদ্রেক হয়েছে।

ঘড়িটাকে ধ্বংস করে ফেলতে না-পারলে আমি যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না। বিশেষ করে আমার সন্তান নতুনের বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসছে, এখনও আমার কি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা শোভা পায়! তাই আমি পুরনো ঋণ শোধ করে দিতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছি। আগে থাকতে সিদ্ধান্ত নিয়ে মিসেস চৌধুরীকে এ বার আমাদের সফরসঙ্গী হওয়া থেকে বিরত রেখেছি। পরিকল্পনামাফিক কিছুদিন পূর্বে রমার মাধ্যমে এই ঘড়িটা আমি কব্জায় নিয়ে এসেছি। আর আজ তার অস্তিত্ব বিলোপের দিন।

গতরাতে চেষ্টা করেও পারিনি। রমা উশখুশ করছিল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়নি। আমি দু’-একবার উঠে বসলে ও চোখ মেলে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তারপর আমি নিজেই কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম খেয়াল ছিল না। চিত্রাকে ডাকতে গিয়ে ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় বুঝতে পারি ঘুম নেমে এসেছিল দু’চোখে। ফেরিঘাটের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল চিত্রা। সিঁথির সিঁদুর আর পশ্চিম আকাশের অস্তমিত সূর্যের সিঁদুরে আলো যেন একে অপরকে আরও বেশি মায়াবী করে তুলছিল। দেখতে দেখতে ফেরিঘাট বদলে গেল গঙ্গার ঘাটে। সিঁড়ি ধরে ধীর পদক্ষেপে জলে নেমে যেতে লাগল চিত্রা। যখন গলা জলে চলে গেল আমি শুকনো গলায় ভয়ার্ত কণ্ঠে ‘চিত্রা’ বলে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম। কিন্তু কিছুতেই আমার গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরল না। ঘুমটা ভেঙে যেতে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলাম বিছানায়। দেখলাম ভোরের আলো ফুটে উঠছে।

সফল যখন হলাম না, তখন নাটক করার জন্য ঘড়িটা রমাকে সকালে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর শীতল প্রতিক্রিয়া আমাকে ভীষণ হতাশ করেছে। ও এতদিন আমাকে বিকৃত চরিত্রের জানত, কিন্তু আজ থেকে ও কি আমাকে বিকৃত মস্তিষ্কও ভাবতে শুরু করল।

না, চরিত্র নিয়ে আমার আদৌ কোনও মাথাব্যথা নেই, কিন্তু মস্তিষ্ক নিয়ে আমি অসম্ভব সংবেদনশীল। কারণ আমার মনে হয় এ পৃথিবীতে মস্তিষ্ক দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চরিত্র দিয়ে নয়। মস্তিষ্ক চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে পারে, কিন্তু চরিত্রের কোনও ক্ষমতাই নেই মস্তিষ্ক সংগঠনের। তাই আমার মস্তিষ্ক নিয়ে রমার মনে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেওয়াকে আমার পক্ষে কোনও মতেই রেয়াত করা সম্ভব নয়।

আর দেরি করা ঠিক হবে না! রমা গভীর নিদ্রাভিভূত।… ধীর পায়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিই।… গ্রিল টপকে রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে থাকি। শূন্য রাস্তা। চাঁদের আলোয় ইলেকট্রিকের আলো কেমন ম্লান হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা কুকুর ডাকতে ডাকতে পিছু নিয়েছে। অদূরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ কানে আসছে। স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে চলেছি আমি। আমার আচরণে কোথাও কোনও অস্বাভাবিকত্ব, কোথাও কোনও ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু এ কী! হিটলারের মুখটা চেষ্টা করেও আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। একটা শিশু যেন আমার সামনে এগিয়ে আসছে। আমি হাত বাড়াতে গিয়েও হাত বাড়িয়ে উঠতে পারছি না। আমি বুঝতে পারি না—  স্বপ্ন দেখছি, না, জেগে আছি। একমাত্র স্বপ্নেই তো দেখি অনেক চেষ্টা করেও হাত-পা নাড়াতে পারি না। কাউকে আঘাত করতে চাইলেও খুব জোরে আঘাত করতে পারি না। ঘড়িটার দিকে একবার তাকাই। তারপর মুখ তুলে এগিয়ে আসা শিশুটাকে আর দেখতে পাই না। পায়ে এসে লাগে সামুদ্রিক ঢেউয়ের জল। ঘড়িটা ছুঁড়ে ফেলার সময় আমার মাথাটা কেমন ফাঁকা বোধ হতে থাকে। শূন্য মস্তিষ্কে কলঙ্কিত অতীত বিসর্জন দিয়ে আমার মনে হয় আমি যেন গঙ্গাস্নান সেরে উঠলাম। সোনালি ঘড়ি গর্ভে ধারণ করে সমুদ্রতরঙ্গ সোনালি ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়তে থাকে তীরে। সেই সোনালি ঢেউ আমার চোখে কেমন যেন আকটিদেশলম্বিত হাঙরের চোয়াল বলে প্রতীয়মান হয়। এত সহজে মুহূর্তের মধ্যে গঙ্গাস্নানের পুণ্য কীভাবে বিসর্জিত হল আমার মাথায় ঢোকে না। আমি ঘোরের মধ্যে সমুদ্রে আসতে আসতে নেমে যেতে থাকি। একটা বিশাল, কালো অন্ধকার ঢেউ আমাকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে দেখে আমার টনক নড়ে। ভীষণ ভয় পেয়ে,আচমকা আমি পিছন ফিরি এবং জল থেকে হাঁচড়পাচড় করে উঠে আসার মর্মান্তিক চেষ্টা শুরু করি। 

(ক্রমশ)

******

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি

Related Posts