Third Lane Magazine

ছদ্মজীবনী (পর্ব ২) ~ দিলীপ কুমার ঘোষ

 এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।

এবারে দ্বিতীয় পর্ব 

শারদীয় নস্টালজিয়া।। আলম্বন

  কেমন আছেন?

  জানি না।

 কেন?

 কেন আছি, তাই তো ছাই বুঝতে পারছি না!

 বোঝার কি খুব দরকার আছে?

 বুঝতে না পারলে যে অস্বস্তি বোধ হয়, ভাল লাগে না।

 তাহলে ভাল লাগার প্রয়োজন আছে বলছেন?

 তা যে আছে সেটা অস্বীকার করতে পারছি কই?

 কিন্তু নতুন করে জানা-বোঝা থেকে যে খারাপ লাগা তৈরি হয়, সেটা তো বেশ কিছুদিন বুঝছেন!

 ওই আমার বয়সের ব্যাপারটা বলছেন?

 হ্যাঁ।

 কী গেরো বলুন তো! আমি জানতাম কাগজে-কলমে আমার বয়স চল্লিশ হলেও আসলে আমি একচল্লিশ। কিন্তু কে জানত আমার সে-জানা সঠিক ছিল না। এই বয়সে পৌঁছে হঠাৎ কিনা জানতে পারলাম এতদিন আমি নিজের বয়সের হিসাব ভুল জেনে এসেছি। এখন আমার বয়স আসলে বিয়াল্লিশ, একচল্লিশ নয়। আর এটা যখন জানলাম তখন যে এমন মন খারাপ হয়ে যাবে, সেটা কি আগে থাকতে ভাবতে পারা সম্ভব বলুন?

 না, সত্যিই সেটা আগে থাকতে ভাবা সম্ভব নয়।

 আমিও ভাবিনি। কেউ কি ভাবে? কিন্তু গতমাসে বাজারে দেখা হওয়ায় ছোটকাকার কাছ থেকে যখন রমেনের মৃত্যু-সংবাদ পেলাম, তখন ওর কত বয়স হয়েছিল জানতে চাইলাম। ছোটকাকা জানাল, বিয়াল্লিশ। এবং রমেন নাকি আমার সমবয়সী। আমার বয়স বিয়াল্লিশ শুনেই আমার মনে কেমন একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা তৈরি হল। আর তারপর থেকে কিছুতেই এই মন খারাপটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারছি না।

 এতেই যদি এই হয়, তাহলে ভেবে দেখুন এরপর অস্তিত্বের কারণ জানতে পারলে কী হতে পারে! তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম শুধু মন খারাপ হবে। কিন্তু যদি মন খারাপই হয়, তাহলে তার মাত্রা এবং গভীরতা কেমন হবে ধারণা করতে পারছেন? থাক না ওসব কেন আছেন, না আছেন নিয়ে ভাবনা। তার চেয়ে বরং কেমন আছেন সেটা একটু ভেবে দেখুন।

 আপনি কে বলুন তো?

 আমাকে চিনতে পারছেন না?

 না তো!

 ঠিক করে দেখুন।

 নাহ্…! ঠিক চিনতে পারছি না। ইদানীং অবশ্য কিছুই মনে রাখতে পারি না।

 উঁহু, কথাটা ঠিক বললেন না।

 কোন কথাটা?

 এইমাত্র বললেন না, কিছুই মনে রাখতে পারছেন না।

 কেন, কী ভুল বললাম? সত্যিই তো আজকাল অনেক কিছু মনে পড়তে চায় না।

 হ্যাঁ, এবার একদম নির্ভুল বলেছেন। অনেক কিছুই আপনার আজকাল মনে পড়ে না। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, কোন বিষয়গুলি আপনার মনে পড়ে না?

 না।… আর অত ভাবার সময়ই বা কোথায় বলুন?

 সময় নেই বলছেন?

 সময় একদম নেই বলাটা মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভাবার অত সময় নেই।

 বেশ বলেছেন…! ভাবার সময় নেই!… অথচ আপনার দুশ্চিন্তারও শেষ নেই।

 হ্যাঁ, সেই জন্য ঘুম ছুটে গেছে দু’চোখ থেকে।

 ঘুমের আর দোষ কী… যা অত্যাচার চালাচ্ছেন ঘুমের ওপর!

 কিছু বললেন?

 হ্যাঁ, বলছিলাম, নিশ্চিত ঘুমের দফারফা করলে কি আর ঘুম আসতে চায়! অথচ… এই আপনিই একসময় কী ভীষণ ঘুমকাতুরে ছিলেন। সকালে আপনাকে ঘুম থেকে তোলা যেত না।

 সে যা বলেছেন… বাবা তো ডেকে ডেকে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিত… ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব শেষে চাপত মায়ের উপর।

 মা-ও অনেক সময় হাল ছেড়ে দিত নিশ্চয়ই?

 হ্যাঁ, সে আর বলতে! আসলে দিনের বেলা কখনও আমার দু’চোখের পাতা এক হত না। মা দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর সব কাজ মিটিয়ে গা-ধুয়ে এসে আঁচল পেতে রান্নাঘরের মেঝেতে শুত। আমি অনেক সময় মায়ের পাশে শুতাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসত না। মা ঘুমিয়ে পড়লে আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করত না। বেরিয়ে পড়তাম আর সারা দুপুর মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিতাম। স্কুলে যেতে শুরু করার পর ছুটির দিনে দুপুরে বাড়িতে আমার টিকিটি পাওয়া যেত না। শরীর খারাপ থাকলে, আমি যাতে দুপুরে রোদে ঘুরে না বেড়াই তার জন্য মা করত কী— ভীষণ কড়া বড় জেঠামশাইয়ের পাশে দুপুরবেলায় শুইয়ে দিত। কিন্তু আমি চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারতাম না, আর বকুনি খাওয়ার ভয়ে উঠতেও পারতাম না। তখন শিয়াল-কুমীরের গল্প না জানলেও ঘুমোনোর ভান করে গল্পের সেই কুমীরের মতোই পড়ে থাকতাম। এই নিয়ে জেঠতুতো-খুড়তুতো দাদা-দিদিরা হাসাহাসি করত, ভাই-বোনেরা মজা পেত।… একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল জানেন। তখন আমাদের বারোয়ারিতে দু’রাত্তির যাত্রা হত। প্রথম রাতে কেষ্টযাত্রা। আর দ্বিতীয় রাতে স্থানীয় ক্লাবের অ্যামেচার যাত্রাপালা। প্রথম রাতে কেষ্টযাত্রা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। দ্বিতীয় রাতে না-ঘুমিয়ে যাত্রাপালা যাতে পুরোটা দেখতে পারি, তার জন্য নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে সে-দিন দুপুরে ঘুমোনার চেষ্টা করি এবং ঘুমিয়েও পড়ি। এদিকে প্রত্যেক দিন সকালে তো ঘুম ভাঙলেই ব্রাশ করার অভ্যাস! ঘুম ভাঙতে যখন ব্রাশে মাজন লাগাতে যাচ্ছি, মা বলল, এখন দাঁত মাজবি কিরে! মায়ের কথা শুনে খেয়াল হল তাই তো, এখন তো বিকালবেলা!

 এই তো কত কথা আপনার মনে পড়ছে! একটু আগেই বলছিলেন না, কিছুই মনে পড়ে না। আচ্ছা… একটু ভেবে দেখুন তো, মা-বাবার মুখগুলো মনে পড়ছে কি না?

 নাহ্…পরিষ্কার মনে পড়ছে না। তবে… আবছা… আবছা মুখের কিছু-কিছু অংশ…

 মনের চোখে ভেসে উঠছে?

 হ্যাঁ, একদম তাই। একটু… একটু করে সব যেন কেমন… মনের চোখে ভেসে উঠছে!

 হ্যাঁ, এরকম হয়। আসলে অনেক দিন মা-বাবার কথা ভাবেননি তো! তা… শুনুন না, বলছি কী… আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

 না।

 না-তো? তাহলে তো একথা আপনি স্বীকার করতে বাধ্য— মা-বাবার মাধ্যমেই এ পৃথিবীতে আপনি এসেছেন? আপনার পৃথিবীতে আগমনের কারণ আপনার বাবা-মা?

 আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো?

 আমি বলতে চাইছি, আপনি যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, আপনি নিশ্চিত ঈশ্বর আপনাকে সৃষ্টি করেননি। তাহলে বাবা-মা-ই আপনার সৃষ্টিকর্তা, তাই তো?

 হ্যাঁ, এ আর নতুন কথা কী! প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টিকর্তা তো তার বাবা-মা-ই।

 না-না, আমি নতুন কথা বলতে আসিনি। শুধু পুরনো কথাগুলিই আমি একটু মনে করিয়ে দিতে এসেছি।

 আপনি কে বলুন তো!

 দেখুন, সেটা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। আমার পরিচয় না জানলেও কিছু যাবে-আসবে না। আর আপনি নিজেই পরে সব বুঝতে পারবেন।… আচ্ছা, আপনি নিজে কখনও কিছু সৃষ্টি করেছেন?

 সৃষ্টি…! তা, সৃষ্টি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন বলুন তো?

  সৃষ্টি মানে… ধরুন, আপনি যা তৈরি করেছেন। মানে… আপনি না থাকলে যার নির্মাণ সম্ভব হত না, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কখনও তৈরি হত না।

 তা… সন্তানকে কি আমার নিজের সৃষ্টি বলতে পারি?

 অবশ্যই। হ্যাঁ… সন্তান হয়তো আপনার একক সৃষ্টি নয়। কিন্তু এ কথাও সত্য, আপনাকে বাদ দিলে আপনার সন্তান কখনও আপনার হত না, অন্য কারও হত। অবশ্য এরকম ঘটনাও বিরল নয় যেখানে আপনি জানেন-ই না, আপনি যাকে নিজের সন্তান মনে করেন, সে আসলে আপনার সন্তান নয়। আবার এমনও অনেক সময় ঘটে আপনি হয়তো জানেন-ই না কোন মানবপ্রাণের পিতা আপনি।

 এমন অনেক ঘটে বলুন!

 আকছার না ঘটলেও এমন যে ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয় সে কি আর আপনি বোঝেন না। আপনার বিষয়টা অবশ্য অন্য। আপনি জাতে মাতাল কিন্তু পা টলে না। কিন্তু সকলে তো আর আপনার মতো সাবধানী নয়। ছাড়ুন এসব… সন্তান ব্যতিরেকে আপনার নিজস্ব কিছু সৃষ্টির কথা বলুন।

 সৃষ্টি মানে কি… সবসময়… পজিটিভ কিছু হতে হবে?

 সেটা হলেই ভাল হয়। কিন্তু… ব্যাপার কী মশাই, সৃষ্টির ক্ষেত্রে পজিটিভ-নেগেটিভ— এসব কী বলছেন?

 আসলে পজিটিভ কিছু তৈরি করেছি কিনা, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! তবে… অনেকের জীবনে যে বিস্তর সমস্যা তৈরি করেছি, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

 সেই অনেকের মধ্যে নিজেকেও রাখছেন তো?

 তা আর বলতে!

 হ্যাঁ,যা বলছিলেন… তা আপনার মনে হচ্ছে, আপনি কোনও পজিটিভ সৃষ্টি করেননি। আচ্ছা, ভেবে দেখুন তো, কখনও কোনও পজিটিভ সৃষ্টির কথা ভেবেছেন কি না?

 জানেন, ছেলেবেলায় ভীষণ কল্পনার জগতে বিচরণ করতাম… ওই যে বলছিলাম না, দুপুরগুলো সব না-ঘুমিয়ে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম… বাস্তব আর স্বপ্ন কেমন মিলে মিশে যেত।… কিছু মনে করবেন না, আমি বোধ হয় প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি।

 একদম না, আপনি সৃষ্টির উৎসে পৌঁছে গেছেন।

 সেই সময় মনে কত নতুন বিষয়… কত নতুন ভাবনা ডানা মেলত। খুব মনে হত তাদের রঙে-রেখায় অথবা লেখায় ধরে রাখি।

 ধরে রেখেছিলেন?

 রং-তুলিতে ধরে রাখতে পারিনি… ছবি আঁকার প্রতিভা আমার ছিল না। লেখায় অবশ্য ধরে রাখার চেষ্টা করতাম।

 কতদিন?

 তা অনেকদিন। কলেজ লাইফ পর্যন্ত তো বটেই। তার পরেও কয়েক বছর… জানেন, অনেক লিখেছি, কত জায়গায় কত লেখা পাঠিয়েছি। কিন্তু এমন কপাল! একটা লেখাও কোথাও প্রকাশযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি।

 তারপর? প্রকাশযোগ্যতাকেই সৃষ্টির একমাত্র মাপকাঠি ভেবে সৃষ্টিস্রোতেই একেবারে বাঁধ বেঁধে দিলেন!

 হ্যাঁ। আসলে ততদিনে প্রত্যয়ের লেখা কবিতা-ছোটগল্প বিভিন্ন নামিদামি পত্র-পত্রিকায় বেরতে শুরু করেছে। যখনই ওর লেখা কোনও জায়গায় দেখতে পেতাম মনটা কেমন তিতকুটে হয়ে যেত, অদ্ভুত একটা হীনমন্যতা গ্রাস করত।

 ষড়রিপুর কোনও রিপুই আপনাকে ছাড়েনি দেখছি! মশাই, লোকে আপনাকে ঈর্ষা করে। আর সেই আপনি কিনা এমন মাৎসর্যতাড়িত! ছাড়ুন। লেখা আপনি নিজে ছাপানোর বন্দোবস্ত করেননি কেন?

 কারণ আমি লেখালিখি শুরুর প্রথম দিনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনে কোনও দিন কোথাও লেখা ছাপানোর জন্য তদ্বির করব না এবং নিজে খরচ করে কখনও সৃজনশীল লেখা ছাপাব না।

 তাহলে আপনার যাত্রাপালা?

 দেখুন, যাত্রাপালাগুলো আমার লেখা হতে পারে, কিন্তু ওগুলো যে উদ্দেশ্যে রচিত তাতে ওগুলোকে আমি নিজেই কখনও শুদ্ধ সৃজনশীল সাহিত্য বলে মনে করি না।

 আচ্ছা,আপনি লেখা প্রকাশকে খামোখা এত গুরুত্বই বা দিতে গেলেন কেন, যেখানে আপনি জানতেন আপনার রচনার মনোনয়ন কোনও ব্যক্তি-মানুষের ইচ্ছা বা বিবেচনাবোধের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল?

 প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু হেঁয়ালি থাকে জানেন, যার সমাধান সে নিজেই করতে পারে না। আমার জীবনে এই লেখা প্রকাশ না হওয়া নিয়ে অতৃপ্তিবোধ তেমনই এক প্রহেলিকা। জীবনে যা কিছু পেয়েছি— চাকরি, নারী, অর্থ, সন্তান, পদমর্যাদা, খ্যাতি, প্রেম— কোনও কিছুকেই অর্জন ভাবতে পারিনি। এমনকি মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রতিভা—এ সবও ভেবেছি জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত। সব— সব মনে হয়েছে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। কেন জানি না, লেখা, শুধু লেখা মনোনীত হয়ে প্রকাশিত হওয়াকেই ভেবে বসেছিলাম বেঞ্চমার্ক— দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার— নিজের যোগ্যতার একমাত্র পরিচায়ক।

 তারপর?

 তারপর আর কী! যখন নিজের তৈরি করে দেওয়া ইয়ার্ড স্টিক নিজেই পেরতে পারলাম না তখন হঠাৎ একদিন লেখা পুরো ছেড়ে দিলাম। তারপর আর ফিরেও তাকাইনি সৃজনশীল সাহিত্য রচনার দিকে।

 এ কি অভিমান?

 বলতে পারেন। আজ বুঝতে পারি, লেখার থেকে লেখা প্রকাশিত হওয়াকেই আমি বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম। ভাবলে অবাক লাগে একসময় কী ভাবে চাইতাম একটা লেখা অন্তত প্রিয় পত্রিকায় প্রকাশিত হোক! ভাবতাম এটাই জীবনের একমাত্র মোক্ষ। আমার প্রথম অবতারে একমাত্র যে মেয়েটি আমাকে প্রকৃত ভালবেসেছিল…

 প্রথম অবতার বলতে?

 দালালি শুরু করার আগে যে আমি, সে-ই আমার প্রথম অবতার।

 বুঝলাম। হুঁ, যে আপনাকে প্রকৃত ভালবেসেছিল…

 হ্যাঁ, তার সেই ভালবাসাকে একটা সময় পর্যন্ত উপেক্ষা করেছি লেখা প্রকাশ নিয়ে পাগলামিতে। লেখা প্রকাশিত না হওয়ার বেদনা আমাকে এমন বিষণ্ণ করে রাখত আমি তার আবেশমুগ্ধ উপস্থিতিকে পর্যন্ত প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ভুলে থাকতাম। সে এ কথা বুঝত, কষ্ট পেত, অথচ আরও— আরও বেশি ভালবাসত। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।

 লেখা তো একসময় ছেড়ে দিলেন। সে কোথায় গেল?

 দেখুন প্রত্যেক অপেক্ষারই তো একটা শেষ থাকে। অপেক্ষা করতে— করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর তাছাড়া আমি ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলাম, মানে… যাকে বলে কিনা— পয়েন্ট অব নো রিটার্ন… আমিও আর তাই তাকে ধরে রাখতে চাইনি।

 সে আপনার জীবন থেকে চলে গেছে?

 হ্যাঁ।

 আপনি নিশ্চিত সে আপনার জীবনে আর নেই?

 তা বলতে পারেন। কিন্তু জানেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত যখন মন খারাপ হত, শুধু তার কথাই মনে পড়ত।

 কিছুদিন আগে পর্যন্ত মানে! এখন কি আপনার মন খারাপ হয় না, না, তার কথা মনে পড়ে না?

 আসলে কিছু দিন হল বুঝলেন… আমাকে যেন কেউ আবার ভালবাসছে। সে ভালবাসা কেমন অদ্ভুত নিঃস্বার্থ। আপনভোলা সেই ভালবাসা আমাকে যেন আবার আমার প্রথম অবতারে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও দীর্ঘদিন পর এই প্রথম বেশ ভাল আছি। আমার মধ্যে কোথাও যেন একটা দাঁড়ি টানার ইচ্ছা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। আমি অনুধাবন করতে পারছি এতদিন কেমন ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকেই মোক্ষ ভেবেছি। এই প্রথম তার সান্নিধ্যে উপলব্ধি করছি প্রেম-ই একমাত্র মোক্ষ। আমার সেই প্রেমময়ীর শ্রীচরণে নিজেকে নিঃশর্তে সমর্পণের জন্য প্রাণের মধ্যে কেমন একটা তীব্র আকুলি-বিকুলি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে তার প্রেমের পুণ্য সলিলে নিজের সমস্ত পাপ ধুয়ে নিই।

 তার ফল কী হতে পারে ভেবে দেখেছেন?

 কী ফল হতে পারে বলুন তো?

 সে সময় এলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন!… আচ্ছা, আপনার জীবনে কোনও আক্ষেপ নেই?

 এ আপনি কী কথা বলছেন! এ জগতে এমন কোনও মানুষ আছে নাকি যার কোনও আক্ষেপ নেই?

  না, মানে আপনি তো আর সাধারণ মানুষ নন। বিশেষ করে আপনার বিচারে আপনি তো একজন সফল মানুষ। তাই জানতে চাইছিলাম আর কী!… কিন্তু এখন দেখছি আমার আগেই বুঝে নেওয়া উচিত ছিল যে, এই ঈর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও আপনার আক্ষেপ আছে। তা, আপনার আক্ষেপটা কি লেখা প্রকাশ না-হওয়া!

 উত্তরটা একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না।

 মানে!

 আমি দেখেছি আমার ক্ষেত্রে কিছু জিনিস বারে বারে বদলে যেতে থাকে। এই ধরুণ, বাচ্চাবেলায় আমার মুগের ডাল খুব ভাল লাগত। কিন্তু বড় হওয়ার পর মুগের ডাল মোটেই ভাল লাগে না। একটা সময় পর্যন্ত খিচুড়ির পয়ম ভক্ত ছিলাম আমি। কোনও জায়গায় খিচুড়ি খাওয়ানোর খবর পেলে সেখানে পৌঁছে পাত পেড়ে বসে যেতাম। আর এখন খিচুড়ি মুখে তুলতেই ইচ্ছা করে না। একসময় বচ্চনের সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখার জন্য আগের দিন রাত থেকে সিনেমা হলের বাইরে লাইন দিয়েছি। পরে ঘরে বসে নিজের ইচ্ছা-খুশিমতো ফিল্ম দেখার সুবর্ণ সুযোগ এলেও একসময়ের সেই হার্টথ্রবের সিনেমা দেখার আর রুচি হয়নি।… এই খিচুড়ি-ভোগের পঙক্তি-ভোজন এবং অমিতাভের কথা বলতে গিয়ে জানেন আমার বাবা সম্পর্কে দু’টো অদ্ভুত কথা মনে এসে গেল…

 বাবা সম্পর্কে! চমকপ্রদ ব্যাপার তো। কত সহজে, কত অনায়াসে আপনার কত কথা মনে আসছে দেখেছেন!… আরে এখনও চুপ করে আছেন কেন? যা মনে আসছে বলে ফেলুন।

 বাবার পাতি লেবু এত পছন্দ এবং সেটা এমন অভ্যাস যে কোথাও খিচুড়ি খেতে গেলেও বাবা ট্যাঁকে করে পাতি লেবু কেটে নিয়ে যায়। আর ভূ-ভারতে বা ভারতের বাইরেও অমিতাভ বচ্চনকে যে নামে কেউ কখনও ডাকেনি বা ডাকার কল্পনাও করেনি বাবা সেই নামে ওঁকে সম্বোধন করে। বাবার কাছে অমিতাভ বচ্চন হলেন অমিতা বচ্চন। বাবার আর একটা কথা মনে এসে গেল। বলে ফেলি?

 হ্যাঁ, আপনার এসব মনে পড়বে বলেই তো আমার এই উপস্থিতি।

 বাবার ধারণা ইংরেজি আর ইংলিশ দু’টো আলাদা ভাষা এবং ইংরেজি সহজ আর ইংলিশ শক্ত।

 আপনার বাবার এই ধারণা সত্যিই কি মিথ্যা বলে মনে হয়? একটু তলিয়ে ভেবে দেখবেন আপনারা বাবা কিন্তু নিজের অজান্তেই কত সহজে কত গভীর এক সত্য প্রকাশ করে ফেলেছেন!

 কী বলছেন কী আপনি? আপনি মনে হয় আমার সঙ্গে মশকরা করছেন।… সত্যি আপনার মনে হচ্ছে আমার বাবার এই হাস্যকর ধারণার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে গভীর সত্য!

 একদম তাই। এই ধারণার থেকে নির্জলা সত্য আর কিছু হয় না।… তা ছাড়ুন ওসব। হ্যাঁ… মনে পড়েছে… আপনার আক্ষেপ নিয়ে কী যেন বলছিলেন?

 ওহ্ হ্যাঁ, কলেজ লাইফের আগে পর্যন্ত আমার ভীষণ আক্ষেপ ছিল তিরাশিতে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার সময় কেন আমি ক্রিকেট বুঝতাম না। চাকরি করার সময় আক্ষেপ হত রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিওলজিতে এমএসসি পড়া হল না বলে। দালালি শুরু করার পর আক্ষেপ বদলে গেল সাহিত্যিক হতে না-পারার ব্যর্থতাকে ঘিরে।

 এখন আপনার আক্ষেপ কী?

 জীবন আমাকে ‘এট টু ব্রুট’ বলার সুযোগ দিল না বলে।

 সৃষ্টিকর্তার আক্ষেপ কী, আপনার জানা আছে?

 না, জানা নেই। তবে বেশ কিছু নিকটাত্মীয় এবং বন্ধুজনের আক্ষেপ আমার জানা আছে।

 যেমন?

 যেমন, আমার মায়ের আক্ষেপ বৌমা তাকে একদিনও মা বলে ডাকল না; বাবার আক্ষেপ ভাইয়ের কাছে বোম্বে যাওয়া হল না। আমার স্ত্রীর আক্ষেপ আমি কেন শুধুমাত্র তাকেই পাখির চোখ করতে পারলাম না। নারীবাদী বান্ধবী মধুর আক্ষেপ তার স্বামীটাই কেন এমন ম্যাদামারা হল!

 খুব ইন্টারেস্টিং তো! কিন্তু সৃষ্টিকর্তার আক্ষেপ বোধ হয় আরও ভাবিয়ে তোলার মতো।

 সৃষ্টিকর্তার আক্ষেপ কী?

 সৃষ্টিকর্তার আক্ষেপ হল তিনি সৃষ্টি করলেন কেন!

 আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?

 কিছু ধারণা নিশ্চিত না হলে উপলব্ধি করা যায় না বলে।

 আপনি বড় শক্ত শক্ত কথা বলছেন। মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু আদৌ কিছু বুঝছি কি না জানি না।

 আমার বক্তব্য নিয়ে এত মাথা খারাপ করার কিছু নেই। আমরা বরং পুরনো কথায় ফিরে যাই… আপনার সেই প্রথম প্রেমিকাকে হারানোর বেদনা আপনি অনুভব করেন?

 ঠিক বেদনা কি না জানি না! কেননা, যে ধরণের প্রত্যাশা জীবনে বেদনা আনে আমার এ জীবনকে তেমন প্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি আমি। এ জীবনে তেমন প্রত্যাশা আর বোধ হয় ফিরে আসবে না!

 প্রত্যাশা…! ঠিক বলেছেন। প্রত্যাশা থেকে কারও মুক্তি নেই। আর… আর এই প্রত্যাশাই বোধ হয় মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।

 অথচ এই প্রত্যাশাগুলো মানুষের জীবনে কেমন বদলে বদলে যেতে থাকে।

  হ্যাঁ, সে তো বটেই। এই দেখুন না, এক সময় আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল আপনার লেখার প্রকাশ, যার জন্য আপনি আপনার প্রথম প্রেমিকার উপস্থিতিকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করে বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত থেকেছেন, তার স্নিগ্ধ ভালবাসাকে পর্যন্ত উপেক্ষা করেছেন।

 অস্বীকার করি না।

 আসলে যে কোনও সৃষ্টিই আমাদের মনে প্রত্যাশার জন্ম দেয়। সৃষ্টি সবসময়ই স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে। কথাটা ঠিক হল না বোধ হয়! সৃষ্টি নয়… আসলে সৃষ্টিকর্তাই স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে।

 আমাকে বলছেন?

 না না, কথাটা শুধু আপনাকে শোনাচ্ছি ভাববেন না। আপনি তো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে আপনার সৃষ্টি, মানে আপনার লেখাকে মনেই রাখতে চান না। আপনার প্রত্যাশা তো তবু বোঝা যায়। অথচ কত প্রত্যাশা আছে, যেগুলোকে আমরা প্রত্যাশা বলে বুঝিই না! এই ধরুণ না কেন— রাতের শেষে সকাল হবে-সূর্য উঠবে-আলো ফুটবে— এ সব-ই এত স্বাভাবিক যে, এগুলোও যে এক ধরণের প্রত্যাশা তা কেমন আমরা ভুলে যাই!

 অথচ প্রত্যাশা পূরণ না হলেও আমরা কেমন ভেঙে পড়ি!

 শুধু ভেঙে পড়ি না, অদ্ভুত একটা অসহায়তা গ্রাস করে। কিন্তু মজা কী জানেন, যে সৃষ্টি ঘিরে আমরা এত প্রত্যাশা করি, সেই সৃষ্টি কিন্তু স্রষ্টার এই প্রত্যাশা… প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতায় যে অসহায়তা সেসব উপলব্ধি করে না।

 প্রত্যয়ও ঠিক এমন কথা বলে,জানেন।

 প্রত্যয়ের সঙ্গে  আপনার এখনও যোগাযোগ আছে?

 নিয়মিত যোগাযোগ নেই। তবে অনিয়মিত… আনুষ্ঠানিক একটা যোগাযোগ এখনও রয়ে গেছে। এই তো গতমাসেই ওর ছেলের অন্নপ্রাশনে ওর বাড়ি ঘুরে এলাম।

 কথাবার্তা কিছু হল?

 খুব বেশি কিছু নয়। তবে কলেজে পড়ার সময় যে জিনিসটা কয়েকবার আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সেই কথাটা আবার আমাদের আলাপচারিতায় ফিরে এসেছিল।

 কী কথা?

 সফল পিতা কে? আসলে হয়েছে কী জানেন, প্রত্যয় আর আমার বাবা দু’জনেই নিরক্ষর। আমার বাবা খেতমজুর আর ওর বাবা চটকলের শ্রমিক। কিন্তু দু’জনেই শত অভাব সত্ত্বেও সন্তান মানুষ করেছেন। আর আমরা মানুষ হিসাবে সফল হয়েও হয়তো সন্তানকে সেভাবে মানুষ করতে পারব না। সুতরাং… সফল পিতৃত্বের গৌরব গোজ টু দোজ পুয়োর ফাদার্স।

 প্রত্যয়ের সঙ্গে এই যে প্রত্যেক ব্যাপারে আপনি নিজের মিল খুঁজে বেড়ান— তা নিজেদের বাবা নিয়ে হোক বা সন্তান নিয়ে— এর কারণ কিন্তু আপনার অদ্ভুত সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব। আচ্ছা, আপনি যে প্রত্যয়কে ঈর্ষা করেন, সেটা বোঝেন?

  ঈর্ষা…! তা-ও আবার প্রত্যয়কে? কিসের জন্য করব বলতে পারেন? করে তো সামান্য ইস্কুল মাস্টারি! বউটাও তো জাস্ট হোম মেকার। লেট ম্যারেজ… ছেলেকে মানুষ করতে করতেই ব্যাটার আয়ু শেষ হয়ে যাবে!

 ওর লেখালিখির ব্যাপারটা বাদ দিচ্ছেন কেন?

 দেখুন, ওর লেখালিখি নিয়ে আমি আর কোনও খোঁজ রাখি না, ওসব নিয়ে আমি আর বদারও নই। লেখক হিসাবে খুব বেশি এগোতেও পারেনি বোধহয়। আর এগোলে এগোবে। অন্য কারও সাফল্যে আমার আর ঈর্ষা হয় না, কারণ… আমি আজ নিজে ভীষণ সফল।

 কিন্তু আপনার সৃষ্টি তো আপনাকে সাফল্য এনে দিতে পারেনি! সৃষ্টি যে-সাফল্য নিয়ে আসে সেই সাফল্যই তো ব্যক্তিকে চিরসফল করে রেখে দেয়।

 একসময় আমিও এমন ভাবতাম। এখন আর ওসব ভাবিই না। এখন সাফল্য বলতে বুঝি বিলাস-ব্যসনে ডুবে থাকার মতো আর্থিক এবং শারীরিক সামর্থ্যকে।

 অপর্যাপ্ত ভোগ, নিত্য-নতুন মনহীন দেহসম্ভোগ, শাসকের রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে থাকতে পারা, যথেচ্ছাচারের অধিকার— এই তাহলে এখন আপনার কাছে চরম সফলতা!

 চরম কিনা জানি না, কিন্তু এই সাফল্য এখন আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি।

 কখনও ক্লান্তি গ্রাস করে না? মন বিষাদে অবসন্ন হয় না?

 হয় তো। হয় না কে বলেছে! কিন্তু কখনওই আর মন খারাপকে চেপে বসতে দিই না। মন খারাপের মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই আরও বেশি ভোগে লিপ্ত হয়ে মন খারাপকে গুড বাই করে দিতে চাই।

 সফল হন? পান? পান… ভোগেই খুঁজে সকল পরিতৃপ্তি?

 না পেলে না পাই। কিন্তু ওসব নিয়ে আর ভাবি না।

 এমন ভাবেই চলবে?

 চলবে মানে! দেখছেন দৌড়চ্ছে। আর আপনি জানতে চাইছেন, চলবে কি না!

 তাহলে কিসের এত দুশ্চিন্তা? কিসের এত নির্ঘুম সময়যাপন?

 জীবনে দুশ্চিন্তা থাকবে না, তা আবার হয় না কি?

 তা বলে এমন দুশ্চিন্তা, যা জীবন থেকে ঘুম কেড়ে নেবে? মানসিক ভাবে এত ক্লান্ত করে তুলবে?

 আরে বাবা, ঘুমটা আমার এমনিতেই সমস্যা। যখন লেখালিখি করতাম রাতে ঘুম আসত না, মাথায় খালি কিলবিল করত বিভিন্ন প্লট আর ইউনিক আইডিয়া।

 কিন্তু সেগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে লিখে ফেলতে পারলেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তেন।

 হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু… আপনি জানলেন কী করে?

 আমি কী করে জানলাম, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি যা বলছি, তা শুনুন।… রাতে বারবার বিরক্ত করা শিশুকে মা যেমন নিশ্চিন্তে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়, আপনিও তেমন লেখাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতেন।

 একদম তাই।

 আসলে নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্য যা প্রয়োজন, সেই—আঁকড়ে ধরার মতো— অবলম্বন আপনার জীবনে আর নেই। নেই যে শুধু তাই নয়, আপনি আর তাকে খোঁজারও চেষ্টা করেন না।

 পাব না বুঝে গেছি। পাথর খুঁড়ে জল বের করার চেষ্টাকে আমার বাতুলতা মনে হয়।

 আপনি জানেন নিশ্চয়ই বটগাছ তার প্রধান শিকড় নষ্ট হয়ে গেলেও ঝুড়ি নামিয়ে স্তম্ভমূল তৈরি করে নেয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়ে দেয়। আপনার সমস্যা হচ্ছে মূল শিকড়কে আপনি ইচ্ছা করে ভুলেছেন, আবার এদিকে কোনও শিকড় নামাতে পারেননি বা চাননি।

 এখন আর এসব ভেবে কী হবে!

 আচ্ছা ধরুণ, এখন আপনার কোনও লেখা প্রকাশিত হল?

 ওঃ, আবার সেই লেখা প্রকাশের চক্কর!

 আরে, হাইপোথেটিকালি ধরতে আপনার অসুবিধা কোথায়? ধরুণ না, আপনার লেখা প্রকাশিত হল… তাহলে কি আপনি আবার লেখার কাছে ফিরে যাবেন?… পুরনো লেখাগুলোকে সার্থক সৃষ্টি বলে স্বীকৃতি দিয়ে নাড়াচাড়া করবেন?

 স্রষ্টা বলে স্বীকৃতি পেলে সেগুলোকে আর সৃষ্টি না বলে যাই কোথায়!

 তাহলে নিজেই বিবেচনা করে দেখুন, সৃষ্টিকে আপনি পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারছেন না! অথচ সৃষ্টিকে ঘিরে আপনার তীব্র অভিমান। এই অভিমান তৈরি হয়েছে, কারণ আপনার সৃষ্টি আপনাকে স্রষ্টার স্বীকৃতি এনে দিতে পারেনি। কিন্তু ভাবুন তো, সৃষ্টি যদি স্রষ্টাকে তোয়াক্কা না করে বা অস্বীকার করে?

 তা কী করে সম্ভব? স্রষ্টা না থাকলে তো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। স্রষ্টার সৃষ্টি কখনও স্রষ্টাকে অস্বীকার করতে পারে!

 তাহলে পারে না বলছেন? সৃষ্টির স্রষ্টার কোলছাড়া হওয়া কেমন বিসদৃশ লাগছে?

 ঠিক তাই।

 অথচ সৃষ্ট কোটি-কোটি প্রাণ কেমন স্রষ্টার কথা ভুলে আপন-আপন জীবনলীলায় মেতে রয়েছে!

 মশাই, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার ধর্মস্থানে যাতায়াত আছে!

 কেন, সেখানে যাওয়া কি বারণ নাকি? আর… আমি তো পরম পিতার কথা সরাসরি বলছি না। আপনার মতো নাস্তিকের কাছে এই স্রষ্টা তো বায়োলজিকাল পেরেন্টস। তাহলে আর আপত্তি কোথায়!

 না, তাহলে আপত্তি নেই। বায়োলজিকাল পেরেন্টসকে মানুষের স্রষ্টা বলে মেনে নিতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

 কিন্তু শুধু এটুকু জানাতেই কি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ?

 আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, বলুন তো?

 আমি একটা খুব সহজ জিনিস বলতে চাইছি। এই যে স্রষ্টাকে জানলাম, তা সেই স্রষ্টার শুধু সৃষ্টি করার কারণেই একটা স্বীকৃতি… একটু গুরুত্ব— এগুলো তো প্রাপ্য, নাকি? তা তার প্রাপ্য দিলাম না, বরং পারলে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করলাম। শুধু স্বীকার করলাম না, তা নয়, এক প্রকার ভুলে থাকলাম, বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলাম না।

 এসব কী ছাইপাঁশ বকছেন বলুন তো?

 হ্যাঁ, এসব তো ছাইপাঁশ মনে হবেই! বলতে পারেন, সন্তান কেন বাবা-মা-র কাছে ফিরে যাবে না? কেন যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই সময় পাশে থাকবে না? কেন তাদের ঘিরে সব সময় ছায়া দেবে না?

 এটা কি ব্যক্তিগত আক্রমণ?

 কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আপনি তো এক বিপুল বস্তুপুঞ্জের ক্ষুদ্র অণুমাত্র! কিন্তু জানবেন, অণু হলেও একক। আর আপনার মতো এই ব্যষ্টি এককই এক এক করে গড়ে তুলেছে সমষ্টি। এবং চিরকালই সমষ্টির জোর মারাত্মক। কিন্তু মজা কী জানেন, সমষ্টির বক্তব্য যতই জোরালো হোক না কেন— তা অনেকাংশে ভ্রম উৎপাদকও বটে!

 একটু বুঝিয়ে বললে সুবিধা হয়।

 কেন, সমষ্টি কেমন নিজের মতকে প্রামাণ্য মনে করে মান্যতা দেয়, তা কি দেখেননি? আমার বক্তব্য, এ ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটে চলেছে। দায়িত্বকে অস্বীকার করার ফাঁকিবাজিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে এবং আসলে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সমষ্টি স্লোগান তুলেছে— জীবনে উন্নতির জন্য, বিকাশের জন্য, সমৃদ্ধির জন্য বাবা-মাকে ত্যাগ করা যেতেই পারে।… আর নিজের এই দাবির পিছনে সুকৌশলে কী অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করেছে! জীবন তো আপনারই, সুতরাং সেই জীবনকে নিয়ে কী করবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

 কথাটা তো অস্বীকার করার মতোও নয়।

 অস্বীকার করতে তো বলছি না। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন-অসমর্থ-অক্ষম বৃদ্ধ বাবা-মাকে অস্বীকার করাও তো কাজের কথা নয়!

 কিন্তু, বিকল্প কী?

 বিকল্প? বিকল্প— একটু ত্যাগ স্বীকার;একটু কম সুখভোগ; বিলাসে একটু দাঁড়ি টানা।

 বিনিময়ে কী পাওয়া যাবে?

 যার অভাব আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি, সেই আনন্দ। আর… মানুষ হিসাবে এই অন্যতম দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে পাওয়া যাবে এমন এক সুদৃঢ় ভিত যা বর্তমানের সুনিশ্চিত অবলম্বন, ভবিষ্যতের নিশ্ছিদ্র আশ্রয়।

 আর কিছু?

 দিশাহীন ঘেঁটে যাওয়া জীবনে প্রকৃত অভিভাবকত্বের ঘেরাটোপ, যার প্রসারিত ছায়া আবার আপনাকে নিশ্চিন্তে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আবার আপনি খুঁজে পাবেন শিকড়— সেই শিকড়, যার টানে সব শৈশব স্মৃতি আপনার মনে পড়ে যাবে এবং দেখবেন, যা আপনার মনে রাখা উচিত আপনি তার আর কিছুই ভুলছেন না।

 প্লি… ই… জ, আপনি যাবেন না। আর একটু অপেক্ষা করুন। আপনার মুখটা কেমন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে… মনে হচ্ছে যেন চিনতে পারছি।… ছেলেবেলায়… হ্যাঁ, ছেলেবেলাতেই তো এই মুখটা যেন খুব দেখেছি মনে হচ্ছে।

 দেখুন, আমার যাওয়া, না যাওয়ার উপর কিছু নির্ভর করছে না। আপনি চিনতে চাইলেই আমাকে পরিষ্কার চিনতে পারবেন। এতদিন চিনতে চাননি বলেই চিনতে পারেননি। আর আজ চিনতে যখন চাইছেন, তখন চিনে যে যাবেন, এটুকু নিশ্চিত।

(ক্রমশ)

 

******

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি

Related Posts