Third Lane Magazine

ছদ্মজীবনী (পর্ব ৬/ অন্তিম পর্ব) ~ দিলীপ কুমার ঘোষ

 এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।

এবারে ষষ্ঠ তথা অন্তিম পর্ব 

 আমরা ছাড়িয়ে গিয়েছি স্কুলের গন্ডি। আমাদের পা পড়েছে কলেজে। দু’জনেই কলকাতার কলেজ-পড়ুয়া। যদিও কলেজ আলাদা। বিষয় আলাদা। আমার ফিজিওলজি, চিত্রার সাইকোলজি। তা হোক। আমরা যেন এখন ক্রমশ দুই থেকে এক হয়ে উঠছি। সব জায়গায় আমাদের এখন যুগল-উপস্থিতি। আমাদের মধ্যে যেন আর নেই কোনও ব্যবধান। নেই কোনও সঙ্কোচ। অপরে কী জানল, অন্যে কী ভাবল— সেসব নিয়ে আমরা আর এতটুকু ভাবিত নই। কোনও কিছুকে পাত্তা দিতে আমাদের বয়েই গেছে! আমাদের এখন আর পায় কে!

 জীবনে এই প্রথম আমার মধ্যে ধৈর্য-স্থৈর্য এসেছে। এই প্রথম আমি যেন কোনও বিষয়ের গভীরে ঢুকতে-ডুবতে পারছি। ধীর-স্থির-অচঞ্চল আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি। সাফল্যের বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে দেখতে শিখছি, বুঝতে পারছি, উপলব্ধি করছি। আর সেই উপলব্ধি-কুসুমকে আমার নিজস্ব লেখনীর মাধ্যমে শব্দমালায় গেঁথে রাখছি। সৃজনের যে ফল্গুস্রোত এতদিন আমার মধ্যে তিরতির করে বইত, তা যেন কূলপ্লাবী হয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমার মধ্যে যেন ঘটতে চলেছে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। প্রবল সৃষ্টিস্রোতকে নিয়ন্ত্রিত-শৃঙ্খলিত করতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু অনেক প্রচেষ্টার পর আমি তাকে বেড়ি পরিয়ে সাহিত্য অঙ্গণে এনে ঠিক হাজির করতে পারছি। চিত্রা এখনও পর্যন্ত আমার সেই প্রচেষ্টা এবং সাফল্যের খবর জানে বলে মনে হয় না। অবশ্য এ সংবাদে ওর যে খুব একটা আগ্রহ আছে তা-ও নয়।

 শীতের গোধূলি বেলায় আমরা দু’বছর আগের মতো সেদিনও মাকড়দহ থেকে ফিরছিলাম— দু’জনে দু’টি সাইকেলে। চিত্রাকে হঠাৎ বললাম, আজকের দিনটা আমাদের আনঅফিসিয়াল লাভ অ্যানিভারসারি।

 চিত্রা মুচকি হেসে বলল, কে বলেছে, আনঅফিসিয়াল? ইট’স্ অফিসিয়াল, অফিসিয়াল, অফিসিয়াল। আজকের দিনেই আমাদের মধ্যে প্রকৃত প্রেমের সঞ্চার ঘটেছিল। জানো, আমি বাড়ি ফিরে কেমন ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিলাম!

 আর আমার তো বাড়ি ফিরে নিজেকে ভীষণ দায়িত্ববান পুরুষ বলে মনে হচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল, তুমি যে কেন চিন্ময়ের বোন হতে গেলে!

 আমারও দাদাকে নিয়ে একটু টেনশন হচ্ছিল। জানতে পারলে যে কী ভাবে নেবে? বছর দেড়েক কিছুই বুঝতে দিইনি। শুধু তোমার পাকামির জন্য শেষ পর্যন্ত জেনে গেল।

 পাকামি বলছ কেন? জলপাইগুড়ি থেকে যখন চিঠি লিখে বলল, আমি কাছে নেই, তুই চিত্রাকে একটু দেখিস। আমি শুধু উত্তরে লিখেছিলাম, তুই ভাবিস না, চিত্রার দায়িত্ব আমার।

 হ্যাঁ, আর সেটা দাদা মাকে জানাবে না! মা বলল, চিত্রা মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর শুভকেও পড়াশোনায় মন দিতে বল। দাদা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ফিরে যদি দেখে তোরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিসনি, তাহলে কিন্তু বন্ধু আর বোন বলে রেয়াত করবে না।

 তুমি এটা জানো কি, তারপর থেকে চিন্ময়ের চিঠির ভাষাও যেন কেমন ফর্মাল হয়ে গেছে? ভুলেও তোমার প্রসঙ্গে আমাকে আর একটা কথাও লেখে না!

 একই ব্যাপার দাদার আমাকে দেওয়া চিঠিতেও। সেখানে তোমার কোনও অস্বিস্তই নেই।

 জয়চন্ডীতলা মাঠের কাছে যেখানে আমি সোয়েটার তুলে দিয়েছিলাম চিত্রার হাতে, সেখানে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালাম। চিত্রাও থেমে গেল। উচ্চ মাধ্যমিকের পর সাইকেল চাপা শিখে চিত্রা সাইকেল চালানো ভালই রপ্ত করেছে। দু’দিকে পা ঠেকিয়ে সাইকেলে বসেই বলল, কী ব্যাপার, থামলে কেন?

 চিত্রা, তোমার জন্য একটা উপহার আছে। এই বলে ‘অভিযান’ নামাঙ্কিত স্বরচিত একটা গল্প, যা সাদা কাগজে যত্ন করে ধরে ধরে লিখেছিলাম, চিত্রার হাতে তুলে দিলাম; সেই ২ ফেব্রুয়ারির দু’বছর পর আর এক ২ ফেব্রুয়ারি। বললাম, এটা এক্সক্লুসিভলি তোমার, এর কপিরাইটও তোমার। এটা চিরকালের সম্পদ। যদিও এরপর থেকে এটা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে।

 খামটা নিয়ে চিত্রা জানতে চাইল, কী আছে এর মধ্যে?

 এর মধ্যে আমি আছি। আমার স্বপ্ন-বাস্তব-কল্পনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের ভবিষ্যৎ এখানে উঁকি মারছে।

 পরের দিনই পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় চিত্রা বলল, গল্পের তিনটে চরিত্রকেই তো আমার তুমি বলে মনে হচ্ছিল। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।

 লেখকের সৃষ্টি করা সব চরিত্রের মধ্যেই কমবেশি লেখকের প্রতিফলন ঘটে। অপরের মন পড়ার ক্ষমতা আজ পর্যন্ত কোনও লেখকের হয়নি। নিজের মনকে কিছুটা হলেও জেনে তাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা যদি কারও মধ্যে থাকে, সে-ই লেখক হয়ে উঠতে পারে।… আমি যদিও লেখক নই, লেখক হওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।

 তুমি সত্যি এমন অভিযান করেছিলে?

 তোমাকে কে বলেছে, সাহিত্য করতে গেলে সত্য লিখতে হয়? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী বলছে শোনো। কিছুদিন আগে প্রত্যয়ের, মানে আমার বন্ধু প্রত্যয়ের, একটা কবিতা প্রকাশিত হয় একটা ভীষণ নামি পত্রিকায়। লেখাটা পড়ে আমি প্রত্যয়ের কাছে জানতে চাইলাম, হ্যাঁ রে, তুই কবে দার্জিলিং গেলি, যে কবিতায় দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিস! দেখলাম আমার কথাটা ওর ঠিক পছন্দ হল না।

 তোমার এই গল্পের মধ্যে কিন্তু কোথাও আমি নেই।

 তুমি নিজেই কী আর ভবিষ্যতে থাকবে! তুমি তো আমার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।

 খালি ফাঁকি দেওয়া কথাবার্তা।… একটা জিনিস কিন্তু জেনে রেখো, বাড়ি থেকে খুব বেশি সময় আমাকে দেবে না। বড়জোর পড়া শেষ করা পর্যন্ত। তার মধ্যেই কিন্তু তোমাকে দাঁড়াতে হবে। লেখার ভূত তুমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। চাকরির চেষ্টা করো।

 আমিও যে প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করছি, সেকথা চিত্রাকে আর বললাম না। উল্টে আমার দ্বিতীয় সত্তা বলে উঠল, জীবনে চেষ্টা করে কিছু করতে হবে ভাবলেই আমি ভিতর থেকে বিরক্ত হয়ে পড়ি। জীবনে একটু চমক থাকবে না, কোনও ঘটনা সারপ্রাইজ বলে মনে হবে না, নাটকীয় কিছু ঘটবে না, তাহলে আর কষ্ট করে এই পাতি জীবন বহন করে কী লাভ?

 কী এত নাটক নাটক করো বলো তো! সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনযাপনে তোমার এত অনীহা কেন?

 বুঝলে চিত্রা, জীবনটা এত সাধারণ কাটিয়েছি এবং এত সাধারণ কাটাই যে মাঝে মাঝে দুর্মর সব আকাঙ্ক্ষা, অদম্য সব বাসনা ডানা ঝাপটাতে থাকে। আমার কেমন মনে হয়… অনেক… অনেক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে যেতে না-পারলে এ জীবনের কোনও সার্থকতা নেই।

 কেন তুমি এমন করে নিজের সুখটা নষ্ট করছ? তোমার তো দেখছি সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়! আসলে তোমার মাথা থেকে লেখালিখির ভূতটা না-নামলে দেখছি তোমার পাগলামি যাবে না।

 আজকে তিনটে পত্রিকার অফিসে খোঁজ করে জেনেছি, কোথাও কোনও লেখা মনোনীত হয়নি।

 তা এই ভাল খবরটা এতক্ষণ জানাওনি কেন? লেখা প্রকাশ নিয়ে একেবারে হেদিয়ে মরছ!

 প্রত্যয়ের আরও দু’টো লেখা এ-মাসেই প্রকাশিত হতে চলেছে!

 আচ্ছা, প্রত্যয়দার কোনও প্রেমিকা আছে?

 মানে…! এ আবার কী প্রশ্ন? হঠাৎ এ কথা জানতে চাইছ কেন বলো তো!

 তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। আগে আছে কি না বলো না?

 না, নেই। তাতে কী হয়েছে?

 আবার প্রশ্ন!

 আরে বাবা, বলো না কী বলতে চাইছ!

 বলছি এই তো তুমিই বললে যে, প্রত্যয়দার কোনও প্রেমিকা নেই। কিন্তু একটু ভেবে দেখো— তোমার জীবনে প্রেম আছে, প্রেমিকা হিসাবে আমি আছি— এ-সব থাকা বুঝি কিছু নয়?

 তোমাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না, চিত্রা। তোমাকে আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু… তোমার এই থাকাটা এত স্বাভাবিক মনে হয় যে, আমি এর মধ্যে ঠিক অভাবনীয় কিছু… মানে… যাকে বলে কিনা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, তেমন কিছু উপলব্ধি করি না।

 আমি বোধহয় তোমার জীবনে না এলেই ভাল হত। তুমি আসলে আমাকে ভালবাস না। তোমার স্বপ্ন-কল্পনা-আকাঙ্ক্ষাকেই ভালবাস।

 আমি ভীষণ কনফিউজড চিত্রা। তোমাকে হারানোর কথাও কিন্তু আমি কল্পনা করতে পারি না। অথচ তোমাতেই যে বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারি, তা-ও নয়।

 আচ্ছা, তোমার কাছে ভালবাসার গুরুত্ব এত কম কেন?

 আসলে ভালবাসা জিনিসটা আমি ঠিক বুঝি বলে মনে হয় না। আমার খালি মনে হয় আমাকে কেউ ভালবাসেনি, কেউ ভালবাসে না।

 তোমার মা কিন্তু তোমাকে ভীষণ ভালবাসেন। সেই ভালবাসার মধ্যে কোনও দেখানেপনা নেই, কিন্তু গভীরতা আছে। আসলে তুমি সবসময় কোনও জিনিসের প্রকাশকে যত বেশি গুরুত্ব দাও, পছন্দ করো, সেই বিষয়কে তত মান্যতা দাও না— সে তোমার লেখালিখিই হোক, আর আমাদের ভালবাসাই হোক। কিসের মোহে যে তুমি এমন করো, তা বুঝি না বাপু!

 তুমি এটা একদম ঠিক কথা বলেছ। আমি মোহিত হতে চাই, মোহের টানে ভেসে যেতে চাই। যদি আমাকে সত্যি কোনও কিছু ভিতর থেকে টানে তা হল এই মোহ।

 কিন্তু এর ফল কখনও ভাল হতে পারে না। না তোমার পক্ষে, না তোমার জীবনের সঙ্গে জড়িত মানুষদের পক্ষে।

 আমিও সেটা বুঝি, কিন্তু তা সত্ত্বেও মিথ্যা এ মোহের আবরণ সরিয়ে বেরিয়ে আসতে পারি না। আমি কি অসুস্থ, চিত্রা? তোমার সাইকোলজি কী বলে?

 দ্যাখো, কমবেশি আমরা সবাই মনোরোগী। তুমি তো তবু বুঝছ বা বোঝার চেষ্টা করছ তোমার মনকে। আমরা কতজন সারাজীবন নিজেকে না-বুঝেই কাটিয়ে দিই!… কিন্তু যা-ই বলো, তুমি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিচ্ছ।

 চলো চিত্রা, আজ আমরা ঈশান পাড়ুইয়ের পোল দিয়ে ফিরি। তোমার ভয় করবে না তো?

 তুমি থাকতে আমার ভয় কিসের!

 আমাকেই তো বেশি ভয়।

 কী আজেবাজে বকছ! চলো তো।

 কালীতলা হয়ে মাটির রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ঈশান পাড়ুইয়ের পোলে এসে উঠলাম। ব্রিজটা সদ্য কংক্রিটের হয়েছে। এখনও নতুনের গন্ধ লেগে রয়েছে। পাশেই ঈশান পাড়ুইয়ের শ্মশান। পুরনো। মড়া প্রায় পোড়ে না বললেই চলে। মৃত শ্মশানের কোনও গন্ধও থাকে না বোধহয়।

 নতুন আর পুরাতনের মাঝে আমরা এসে দাঁড়ালাম শাশ্বত হওয়ার অপেক্ষায়, না, নশ্বর জীবনের প্রাত্যহিকতায়? হঠাৎই মনে এল মা বলেছিল, আমার প্রপিতামহকে এই শ্মশানে দাহ করে ভোরের আলো ফোটার আগে যখন শ্মশানযাত্রীরা বাড়ি ফিরেছিল তখন আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম।

(সমাপ্ত)

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি 

Related Posts