Third Lane Magazine

ছদ্মজীবনী (পর্ব ৪) ~ দিলীপ কুমার ঘোষ

 এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।

এবারে চতুর্থ পর্ব 

 

   গ্রীষ্মদিনের কালবৈশাখী।। রাহুগ্রাস

 ৬ ডিসেম্বর। হ্যাঁ, সালটা ১৯৯২। আমার সত্তায় ঘাই হরিণীর প্রবেশ। পরিচয় অবশ্য এপ্রিলে। আচমকা।

 বেশ কিছুদিন ধরেই সলতে পাকানো চলছিল। ডিসেম্বর পড়তে না-পড়তেই খবরের কাগজের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম— রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ। বিষয়টি যে ক্রমশ সংবেদনশীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সংবাদ প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রাত্যহিক তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ভারতবাসী রোটি, কাপড় অউর মকান ছেড়ে অন্য বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ল। এর আগে কতজন বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাত বা গুরুত্ব দিয়ে ভাবত তা অনুমান সাপেক্ষ।… ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই রেডিও এবং দূরদর্শন জানিয়ে দিল করসেবকদের হাতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত।…

বিধ্বস্ত আমিও অপ্রত্যাশিত অভিঘাতে সেদিন রাতে বিপর্যস্ত বোধ করছিলাম।

 কার জীবনে কোথা দিয়ে কালসাপ প্রবেশ করবে আগে থাকতে কেউ অনুমান করতে পারে না। প্রত্যেক লখিন্দরের জীবন-বাসরে কালনাগিনীর আগমন অবশ্য সুনিশ্চিত। আমারই যেমন কী প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্যচর্চায় রত হওয়ার! উনিশ পর্যন্ত কোথাও তো কোনও বিশেষ অসুবিধা ঘটেনি। কিন্তু ওই যে, তা হলে তো জীবনে আর সর্পদংশন ঘটে না!

 আমি ছোটবেলায় স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম না। স্বাস্থ্য সচেতনতা! খিদের জ্বালায় যাকে সাবু দিয়ে রুটি, গাছের পেয়ারা— তা-ও নিজেদের গাছের নয়— চিবিয়ে মুড়ি খেতে হয় তার আবার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা! সুস্বাস্থ্য তো দূর কি বাত, নিজেকে কোনও মতে টিকিয়ে রাখাই ছিল দুষ্কর। তবে খিদে পেত খুব। বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার করে বলতাম, মা, কী খাব? বাচ্চাবেলায় অবশ্য একদম খেতে চাইতাম না। তার মূল কারণ— কৃমি। পেটের সেই কুচো কৃমি তো বেশ বড়সড় কেঁচো হয়ে দু-দু’বার আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। এটুকু মনে আছে দু’বারই মলত্যাগের জন্য উঠোনে বসেছিলাম। তখনও স্কুলে যেতে শুরু করিনি। আর তা থেকে মনে হয়, বয়স তখন আমার পাঁচের এদিক-ওদিক ছিল।

 স্কুলে আমাকে নিয়ে গিয়ে কেউ ভর্তি করায়নি। মা-বাবার পক্ষে আমাকে ভর্তি করাতে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তারা নিজেরা পড়াশোনা জানত না বলে পড়াশোনার ব্যাপারে সবসময় কেমন সঙ্কুচিত হয়ে থাকত। বাবা অবশ্য প্রথম ভাগ শেষ করে দ্বিতীয় ভাগ ধরেছিল। কিন্তু সেই দ্বিতীয় ভাগ-ই তার কাল হয়। বাবাকে পড়াত মেজো জেঠামশাই। একদিন দ্বিতীয় ভাগ-এর ‘শীঘ্র’ বানানটা বাবা ঠিকঠাক বলতে পারেনি। তার জন্য মেজদার হাতে একটা গাঁট্টা খেতে হয় বেচারাকে। অবশ্য সেই যাত্রায় বাবার পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় দাদু। দাদু বলেছিল, তোকে আর পড়াশোনা করতে হবে না। মাঠে চাষবাস করবি চল। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সেই যে মাঠে গেল বাবা, তারপর থেকে সরস্বতীর সঙ্গে স্থায়ী আড়ি হয়ে গেল বাবার।

 মায়ের ঘটনাটা অবশ্য আরও এককাঠি সরেস। মা স্কুলে গিয়ে অনেক মাজাঘষার পর সবে গোটা-গোটা করে ‘অ-আ-ক-খ’ লিখতে শিখছে, সেই সময় মায়ের থেকেও খাজা এক ছেলে পিছনে বসে মায়ের স্লেট দেখে নিজের স্লেটে পেন্সিল দিয়ে ‘অ-আ-ক-খ’ আঁকার এক অক্ষম অনুকরণ চালিয়ে যাচ্ছিল। আর মায়ের স্লেটটা যখন দেখতে পাচ্ছিল না, মাকে ঠেলে সরিয়ে স্লেটটা দেখতে চাইছিল। সেটা চোখে পড়ায় মাস্টারমশাইয়ের রাগ গিয়ে পড়ল ছেলেটার উপর। তিনি বেত নিয়ে ধেয়ে গেলেন ছেলেটার দিকে। এই সামান্য অপরাধে ছেলেটাকে এমন বেত্রাঘাত করা হল যে তার সামনে বসা মা ভয়ে কেঁপে উঠল। বাড়ি ফিরে আতঙ্কিত মা কান্নাকাটি শুরু করল এবং পরদিন আর স্কুলে যেতে চাইল না। তারপর থেকে অবশ্য মাকে আর কেউ কোনও দিনই জোর করে স্কুলে পাঠায়নি।

 এক জেঠতুতো দিদির সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে আমি ইনফ্যান্টের ক্লাসে বসতাম। আর প্রায় প্রত্যেক দিনই পেটে লাগার অজুহাতে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে ছুটি আদায় করে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। এরই মাঝে কবে একদিন দেখি ক্লাস ওয়ানে উঠে গেছি। খাতায় নাম উঠে ক্লাসে আমার নামডাকাও শুরু হয়েছে। সেই নামডাকা এবং নিজের নাম প্রত্যেক দিন নিয়ম করে অন্যের মুখে শুনে ‘উপস্থিত’ বলে নিজের উপস্থিতি জানানো আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। এমন নেশা যে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত ভালরকম শরীর খারাপ ছাড়া আমি কখনও স্কুল কামাই করিনি। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলেও স্কুলে গিয়েছি। ক্লাস সেভেন আর ক্লাস এইটে দু’দিন এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, প্রবল বৃষ্টির কারণে স্কুল চত্বরে আর কারও পা পড়েনি অথচ মায়ের বারণ সত্ত্বেও আমি ঠিক ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে গেটবিহীন হাইস্কুলে ঢুকে নিজের ক্লাসের সামনে হাজির হয়েছি।

 প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয়ে গেছে। স্কুলে না গেলেও চলে। শরীরটা ভালও ছিল না। কিন্তু ওই যে স্কুলে যাওয়ার নেশা! যথারীতি স্কুলে গিয়েছি। এবং যা হওয়ার সেটাই হল, আরও অসুস্থ হয়ে স্কুলেই বমি করে ফেললাম। খবর দেওয়া হল মাকে। বমি পরিষ্কার করার সময় মাকে শুনতে হল, অসুস্থ ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছেন কেন? স্কুলে পাঠিয়ে দিতে পারলেই হল! আমাদের প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভ ছিল। ফোরের রেজাল্ট আউটের পর মাস্টারমশাইয়েরা খুব চেয়েছিলেন ক্লাস ফাইভটা আমি যেন প্রাইমারি স্কুলে থেকেই পড়াশোনা করি। কিন্তু আমি ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি এই স্কুলে আর নয়।

 ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম গ্রামেরই হাইস্কুলে। ফাইভে অঙ্ক করাতেন প্রসূনবাবু। হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার আগে উনি ক্লাসে এসে বললেন, অঙ্কে যে একশো পাবে, তাকে আমি এক বাক্স চক দেব। এক বাক্স চক! এ তো আমার কাছে স্বপ্ন। অঙ্ক পরীক্ষা খুব মন দিয়ে দিলাম। সবকটা অঙ্কই ঠিকঠাক কষেছি বলে মনে হল। কিন্তু শুনেছি প্রসূনবাবু বিন্দুমাত্র ভুলচুকেও নাম্বার কাটেন। তাই ফল কী হবে জানি না। অঙ্ক খাতা দেখানোর দিন দেখি প্রসূনবাবু  খাতার বান্ডিলের সঙ্গে এক বাক্স চক নিয়ে ক্লাসে ঢুকছেন। আমার আগ্রহ যেন বাঁধ মানছিল না। স্যর সকলকে খাতা দিচ্ছেলেন আর দুরুদুরু বক্ষে আমার অপেক্ষা বাড়ছিল। সবার শেষে উনি আমার খাতা হাতে তুলে নিলেন। খাতাটা আমার হাতে বাড়িয়ে দেওয়ার আগে বললেন, আমি ভেবেছিলাম এবারেও আমাকে আর চকের বাক্স কিনতে হবে না। কিন্তু দেখলাম শুভ আমাকে চকের বাক্স কিনিয়েই ছাড়ল। এই বলে তিনি প্রথমে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন একশোয় একশো পাওয়া অঙ্ক খাতা। তারপর আমাকে ডেকে সকলের সামনে আমার হাতে তুলে দিলেন এক বাক্স চক। এত বড় পুরস্কার এর আগে আমি জীবনে পাইনি। পরবর্তীকালেও পেয়েছি কি! অ্যানুয়ালে অঙ্কে নব্বই পাওয়ায় উনি জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার, শুভ, এবার একশো হল না কেন? আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলাম আর মনে মনে বললাম, স্যর, এবারে তো আর আপনি অঙ্কে একশো পেলে চকের বাক্স দেওয়ার কথা বলেননি।

 ক্লাসে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করার সূত্রে কখন যে  নিজেই নিজের উপর এক অসম্ভব চাপ তৈরি করে ফেলেছিলাম তা বুঝতে পারিনি। পরীক্ষার সময় এই চাপ আরও বেশি অনুভূত হত, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তাম। ক্লাসে পড়াশোনায় আমার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, মনে হত পরীক্ষার সময় তাদের শরীর খারাপ হলে ভাল হয়। এমনকী, হাফ ইয়ারলিতে কেউ যদি কোনও সাবজেক্টে আমাকে টপকে যেত, অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় মনে মনে তার মৃত্যুকামনা করতেও আমি কসুর করতাম না। সাফল্য এবং ধারাবাহিক সাফল্য, এটাই যেন হয়ে উঠেছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। এবং তার জন্য প্রয়োজনে ফাউল প্লেতেও আমার কোনও আপত্তি ছিল না। তখন থেকেই যেন-তেন প্রকারেণ সাফল্য এবং কার্যসিদ্ধি হয়ে উঠেছিল আমার পরম গন্তব্য এবং চরম লক্ষ্য।

 পরাশরবাবুর গন্তব্য এবং লক্ষ্য ছিল অন্যরকম। ক্লাস নাইনে বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন পরাশরবাবু। উনি আসতেন সেই সুদূর মেদিনীপুর থেকে। শুনতাম উনি ভোরবেলায় উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। তারপর পায়ে হেঁটে, বাস-ট্রেন ঠেঙিয়ে এবং শেষে সাইকেল চেপে প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের পথপরিক্রমা সেরে স্কুলে পৌঁছান। কিন্তু দেখতাম প্রত্যেক দিন উনি সকলের আগে স্কুলে আসেন এবং পড়ানোতেও ওঁর উৎসাহের কোনও অভাব নেই। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। সেদিন ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাসে ঢুকতে-ঢুকতেই উনি বলে উঠেছিলেন, বুঝলি শুভ, ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম। আজও মনে আছে সেদিন উনি ক্লাসে শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। স্যরকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যর, প্রত্যেক দিন আপনার এতটা রাস্তা আসতে কষ্ট হয় না? এতটা রাস্তা এসেও আপনি পড়ানোর উৎসাহ পান কী করে? পরাশরবাবু বলেছিলেন, এখন ঠিক বুঝবি না, পরে বুঝবি। গন্তব্য যতদূরই হোক, মানুষ ভিতর থেকে সেখানে পৌঁছনোর চেষ্টা করলে ঠিক পৌঁছে যায়। স্কুল তো আমার কাছে গন্তব্য, তা-ই আমার পৌঁছতে খুব অসুবিধা হয় না। আর গন্তব্যে পৌঁছে মানুষ তো স্বস্তির শ্বাস ফেলে, তার পক্ষে তখন কর্তব্য-কর্ম পালন করাটা অনেক সোজা হয়ে যায়। সে কারণেই মনে হয় আমিও তোদের পড়াতে উৎসাহে কোনও ঘাটতি বোধ করি না।

 স্কুল এবং কিছু স্যরের অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা ছাড়া পাশে সেভাবে কাউকে পাইনি। নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়েছে। কেউ হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়নি কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। কেউ ভালবেসে কাছে এসে দাঁড়ায়নি, বাড়িয়ে দেয়নি প্রসারিত করতল— যার হাত ধরে বলতে পারি, হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ জানি না। কত বেচারাকে দেখেছি অভিভাবকের চাপে নাস্তানাবুদ, আর আমার কিনা কোনও অভিভাবকই ছিল না! ছিল সবাই— দাদু-ঠাকুরমা-বাবা-মা-জেঠা-জেঠাইমা-কাকা-কাকিমা-পিসি-জেঠতুতো-খুড়তুতো দাদা-দিদি-ভাই-বোন— কিন্তু কারও আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথা-স্বপ্ন-কল্পনা-পরিকল্পনা কিসসু ছিল না। আমি অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে বড় হয়ে উঠছিলাম।

 কেউ আমাকে কোনও কিছু দেখিয়ে দেওয়ারও ছিল না, বারণ করারও ছিল না। আমার অস্তিত্ব নিয়ে কেউ এতটুকু ভাবিত ছিল বলে মনে হয় না। আমিও যেন মানুষজনের সামনে কেমন গুটিয়ে থাকতাম।

 আমার গড়ে তোলা নিজস্ব জগতে আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম। সেখানে ছিল খবরের কাগজ-বই-রেডিয়ো-টিভি। আট-ন’বছর বয়স থেকে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েছি— এক নয়, একাধিক— এর ডাক্তারখানায় গিয়ে, ওর বাড়িতে গিয়ে। যেখানে যে বই পেয়েছি গোগ্রাসে গিলেছি। পাঠ্যপুস্তক, গল্পের বই, পত্র-পত্রিকা— কিচ্ছু বাদ দিইনি। নিজেদের বাড়িতে, অন্য কারও বাড়িতে, লাইব্রেরিতে— বই একটা পেলেই হল। ডুবে যেতে আর কতক্ষণ!

 ইংরেজি এবিসিডি শিখেছি ক্লাস সিক্সে। সৌজন্যে সরকারি শিক্ষানীতি। হিন্দি আলাদা করে শিখিনি। তা সত্ত্বেও রেডিয়োতে ক্রিকেট-হকির হিন্দি-ইংরেজি আঁখো দেখি হাল-রানিং কমেন্ট্রি মন দিয়ে শুনে কেমন বল বাই বল বা ড্রিবল আফটার ড্রিবল খেলাটাকে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখেছি। জ্বরে ঘরে শুয়ে খেলার ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে জ্বরের কষ্ট ভুলে গিয়েছি। আর টিভিতে খেলা দেখার জন্য দুপুর নেই, সন্ধে নেই এর-ওর বাড়ি ঘন্টার পর ঘন্টা গিয়ে বসে থেকেছি। খুব একটা বিরক্ত হতে কাউকে দেখিনি। আসলে আমার কোনও কিছুকেই কেউ কখনও ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি।

 ক্লাস এইট পর্যন্ত আমার জীবনে দাদু ছিল। দাদু আমাকে যথেষ্ট ভালবাসত। দাদুকে দুপুরবেলায় ভাত দিত মেজো জেঠাইমা। যেদিন পাতে মাছ পড়ত সেদিন দাদু সব ভাত খেত না। দাদু অর্ধেক মাছ ভেঙে ভাত চাপা দিয়ে আমার জন্য রেখে দিত — সেটাই আসলে পুরো ভাত না খাওয়ার কারণ। দাদুর খাওয়ার থালা-বাসন মা ধুত। তাই এতে কখনও কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি। দাদুর পাশে বসে দাদুর যে আট-দশটা বই ছিল সেগুলো আমি পড়তাম। রামায়ণ-মহাভারত-বত্রিশ সিংহাসনের গল্প-বেতাল পঞ্চবিংশতি-অন্নদামঙ্গল-ঠাকুর মহাশয়ের সংসার-সচিত্র শিশুদের রামকৃষ্ণ-গোপাল ভাঁড়ের গল্প এবং আরও দু’-একটি।

 আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক দাদুকে ‘রাম’নাম লিখতে দেখেছি। লাল মলাটের  বারো নম্বর মোটা বাঁধাই খাতায় দাদু রামনাম লিখত। প্রত্যেক পাতায় ন’টা স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে বারোটি লাইন। প্রতি লাইনে লেখা থাকত ‘শ্রীরামরামরাম’। প্রত্যেক পাতায় তিনশো চব্বিশ বার রামনাম। এ রকম করে লিখে দাদু বিরাশিটা খাতা শেষ করেছিল। শেষ বয়সের এই অভ্যাসে দাদু সারাদিন নিজেকে রামনাম লিখনে নিয়োজিত রাখত। লেখা নিয়েই থাকত। রামনাম লেখার একটা নিজস্ব পদ্ধতিও তৈরি করে নিয়েছিল। প্রত্যেক পাতায় একবারে সমস্ত রামনাম লিখত না। বেশ কয়েকটা পাতায় প্রথমে লাল কালিপেনের নিব বসিয়ে একশো আটটা বিন্দু তৈরি করে রাখত। তারপর তার মধ্যে প্রথম কয়েকটা পাতায় সেই বিন্দুগুলিতে শুধু ‘শ্রী’ লিখে রেখে দিত। তৃতীয় ধাপে ‘শ্রী’র সঙ্গে যুক্ত হত ‘বামবামবাম’। আর শেষ ধাপে সেই ‘বামবামবাম’ হয়ে উঠত ত্রিবিন্দুরঞ্জিত ‘রামরামরাম’। এইভাবে একাধিক ধাপ টপকে পাতা সজ্জিত হয়ে উঠত তিনশো চব্বিশ রামনামে।

 দাদু দুপুরে খেয়ে যখন একটু ঘুমিয়ে নিত আমাকে মাঝে মধ্যে বলত বিন্দু বসিয়ে ‘বামবামবাম’-কে ‘রামরামরাম’ করে দেওয়ার জন্য। গল্প বই পড়ার সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য আমি দ্রুত গতিতে পেনের নিব বসিয়ে তুলির শেষ টানে এঁকে ফেলতাম ‘শ্রীরামরামরাম’। এর ফলে আশা করা যায় রামনাম লিখনের পুণ্য দাদু থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কিছুটা হলেও আমার মধ্যে এসেছে। দেশবাসী যদি সেই পুণ্যের ভাগ কিছুটা পেত!

  হারিকেনের আলোয় দাদুর পাশে রাতে পড়তে বসতাম। সাড়ে সাতটায় দাদু রেডিয়ো চালাত। সাতটা পঞ্চাশের স্থানীয় সংবাদ মাঝে মাঝে শোনা সম্ভবপর হত না অদ্ভুত এক কারণে। একজন বিশেষ সংবাদ পাঠক, সংবাদ পাঠের শুরুতে ‘খবর পড়ছি ব’… বলার সাথে সাথে দাদু রেডিও বন্ধ করে দিত। দাদুর ধারণা ছিল ভদ্রলোক পান গালে পুরে খবর পড়েন, সুতরাং সেদিন যত গুরুত্বপূর্ণ খবরই শোনার থাক না কেন, আর খবর শোনা যাবে না। জানি না পান গালে পোরার খবর দাদু কোথা থেকে জেনেছিল! আর তার সঙ্গে সংবাদ পাঠের সম্পর্কই বা কী? আসলে সংবাদ পাঠক ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর কোনও কারণে দাদুর ঠিক পছন্দ ছিল না। তাই সেই কণ্ঠে সংবাদ পাঠ শুনবে না বলে দাদু বোধ হয় নিজের মনেই এমন যুক্তিজাল খাড়া করে তুলেছিল।  অনেকেই অনেকের অনেক জিনিস ভীষণ পছন্দ করে, কিন্তু কারও কোনও বিষয় যে এই মাত্রায় অপছন্দ করা সম্ভব তা দাদুর সংস্পর্শে না এলে জানতেই পারতাম না।

 রাতে দাদুর পাশে বিছানায় শুতাম। দাদু গায়ে গা ঠেকানো একদম পছন্দ করত না। ঘুমের ঘোরে একটু পা ঠেকলেও চটাস চটাস করে মেরে পা সোজা করে দিত। পাশ ফিরে গুটিসুটি মেরে বেঁকে শোওয়াও ছিল দাদুর না-পসন্দ। ফলে বাচ্চাবেলা থেকে আমার কাউকে স্পর্শ না-করে সোজা শোওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। অভ্যাসটা সু, না কু, বুঝি না। একই ঘরে নীচে মেঝেতে শুয়ে থাকত মা-বাবা। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পেতাম মা কোনও বিষয়ে বিরক্ত হয়ে অসম্মতি প্রকাশ করছে অথচ বাবা সেই আপত্তি শুনতে চাইছে না। কখন আবার ঘুমিয়ে যেতাম বুঝতে পারতাম না। কিন্তু বাবার উপর কেমন যেন একটা রাগ তৈরি হত।

 দাদু একটা গানের কলি মাঝে মাঝে গুনগুন করত। ‘আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি/ তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরাগলি।’ জানি না দাদু সত্যিই চলার পথ খুঁজেছিল কি না, কোনও বিশেষ বক্তব্যও দাদুর ছিল কি না, বা কাকে সামনে পেয়েও মনের চোরাগলিতে তার সন্ধান চালাতে হয়েছিল? জানি শুধু এটুকুই— জীবনের শেষ ছ’মাস দাদু প্রকৃতিস্থ ছিল না। রামনাম লেখার খাতা রাখার স্টিলের বাক্সে রামনামের খাতার সঙ্গে হাওয়াই চটি সহাবস্থান করত এবং সেটাই দাদুর মাথার বালিশ হয়ে উঠেছিল। চুরাশি বছর বয়সে মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে দাদু আমার হাফ প্যান্ট ধরে টেনে কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু… শেষ পর্যন্ত আর বলতে পারেনি।

 আর দাদু চলে যাওয়ার পর থেকে আমি যেন আরও বন্ধনহীন হয়ে গেলাম। জীবনে রামনামও রইল না আর ভাতচাপা মাছের আঘ্রাণও চলে গেল। অবশ্য লাইব্রেরিতে তখন পেনের কালি দাগানো কিছু বইয়ের মধ্যে আমি অন্য রকম ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছি। অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, ইয়ান ফ্লেমিং, নিক কার্টার, জেমস হেডলি চেজ পড়তে শুরু করার পর কিছুদিনের মধ্যেই যেন বড় হয়ে গেলাম। মানুষের জীবনে যে খাওয়া-শোওয়া-কাজকর্ম-চাকরিবাকরি-পড়াশোনা-খেলাধুলোর বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, সেগুলি সম্পর্কে অবহিত হতে লাগলাম। ক্লাসে এই প্রথম বান্ধবীদের দিকে আড়চোখে তাকালাম। তারা যে দেখার মতো বস্তু, তাদের যে মনোযোগ সহকারে দেখতে হবে এই বোধ তৈরি হল। এতদিন সরাসরি তাদের মুখের দিকে চেয়ে, চোখে চোখ রেখে কথা বলেছি। কিন্তু এখন তাদের চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি হল, ভীরু লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম।

জেমস হেডলি চেজ-নিক কার্টাররচনার পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় অনুধাবন করলাম নারীশরীর সৌন্দর্যের আধার। আর তা সরাসরি নয়নগোচর করলাম পলাশ স্যরের কাছে বাংলা পড়তে গিয়ে। আমি তখন নবম শ্রেণি। সোনিয়াদি ক্লাস টুয়েলভ—স্যরের কাছে পড়তে আসত ফ্রক পরে। মুখোমুখি বসতাম আমরা। সোনিয়াদি আমাদের পাশের পাড়া সিনেমাতলার গৌতমদার প্রেমিকা। গৌতমদা দু’বৎসর আগে কি একটা বড় সরকারি চাকরিতে অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। সবাই গৌতমদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উনি পলাশ স্যরের কাছে পড়তেন। স্যরও মাঝে মাঝে ওঁর কথা বলেন। শুনেছি গৌতমদা নাকি সোনিয়াদিকে বাড়িতে পড়াতে যান। সোনিয়াদিও পড়াশোনায় ভাল। সব কিছু মিলিয়ে সোনিয়াদির প্রতি আমার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিলই। সেই চোরাটানের কারণে আমি সব সময় সোনিয়াদিকে খেয়াল করতাম। একদিন সোনিয়াদি পলাশ স্যরের কাছে পড়ার সময় ঝুঁকে কিছু লিখছিল। আমিও কিছু একটা লিখছিলাম। হঠাৎ মুখ তুলেই আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ততক্ষণে আমার সদ্য পাপী চোখ ফ্রকের ফাঁক দিয়ে পৌঁছে গিয়েছে জেমস হেডলি চেজ বর্ণিত গোলাপি নিটোল টিলায়। আমি চেষ্টা করেও সেখান থেকে আর নেমে আসতে পারছিলাম না। জানি না সত্যিই আমার সেই প্রচেষ্টার মধ্যে সততা ছিল কি না! কিন্তু শারীরিক সৌন্দর্য যে এত অনিন্দ্যসুন্দর, মনোমুগ্ধকর, আকর্ষণীয় এবং একই সঙ্গে এত উত্তেজক হতে পারে তা আমার কল্পনাতীত ছিল। কতদিন শুধু চোখ বুজলে এই উত্তাল সৌন্দর্য আমার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠেছে!  কিন্তু কখনও এ স্বর্গীয় শোভা গ্রহণ করার জন্য হাত বাড়ানোর কথা ভাবিনি, বা এ-স্বর্গসুষমা যে হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে হয় এমন ভাবনায়-ও জাগেনি। অবচেতনে পর্যন্ত এ রম্যাণি বীক্ষ্য অধরা মাধুরী হিসাবেই থেকে গিয়েছে।

 পলাশ স্যরের সাহিত্য আলোচনা আমি না থাকলে জমাটি হয়ে উঠত না। আমি না পড়তে গেলে উনি পড়াতে বসতে উৎসাহ পেতেন না। অনেক সকালে এমন হয়েছে স্যরের ছেলে প্রকাশদা— আমার পড়তে যেতে দেরি হচ্ছে দেখে— স্যরের নির্দেশে আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। কোনও প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে স্যরের বোঝানোকে আমি এমন ভাবে খাতায় উপস্থাপিত করতাম, স্যর আমার খাতায় লেখা উত্তর অন্যদের খাতায় লিখে নিতে বলতেন। স্যরের কাছে ক্লাস নাইন থেকে পার্ট ওয়ান পর্যন্ত পড়েছি। আমাদের আর্থিক দুরবস্থা বিবেচনা করে বামপন্থী স্যর আমার কাছ থেকে এই ছ’বছরে এক টাকাও মাইনে নেননি।

 একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। স্যর প্রকাশদা এবং আমাকে ইডেনে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শীতের ইডেনের দ্বিপ্রহরে স্যর নিদ্রা সংবরণ করতে পারেননি। এদিকে পেটুক প্রকাশদা টুকটাক চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি মনোযোগ সহকারে টেস্ট ক্রিকেটের মৌতাত পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করছিলাম। খেলা শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেক আগে স্যরের ঘুম ভাঙল। আর ঘুম থেকে জেগে উঠেই বললেন, চল বেরিয়ে পড়ি। বললাম, স্যর এখনও তো খেলা শেষ হয়নি! স্যর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, খেলা ভাঙার খেলা দেখার এই আগ্রহ তোর চিরকাল বজায় থাকবে তো?… এর কয়েক বছর পরে এক শীতের সকালে মা যখন ডেকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিল, পলাশ স্যর গলায় দড়ি দিয়েছে, বাড়ি থেকে হেঁটে দু’মিনিট হলেও আমি আর স্যরকে দেখতে যাইনি।

 বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ইলেভেন-টুয়েলভে ফিজিক্স পড়তে যেতাম। ফিজিক্স আমি ভাল বুঝতে পারতাম না। পদার্থ বিদ্যায় আমার অপদার্থতা ক্রমশ আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। সেই সময়েই জীবনে সুমিতবাবুর আবির্ভাব। স্যরের পড়ানোর গুণেই হোক বা আন্তরিক ব্যবহারের সূত্রেই হোক স্যরের বিষয় ফিজিক্সকে আমারও ভাল লেগে গেল। পরে যে একবার জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসে মেডিক্যালে পড়ার যোগ্যতামান টপকাতে পেরেছিলাম তার পিছনে ফিজিক্সের অবদান ছিল অনেকখানি।

 স্যরের কাছে পড়তে গিয়ে আমি নিজেকে চিনতে পেরেছিলাম। যে সৌন্দর্য আমার মনে স্বর্গীয় আস্বাদন আনয়ন করে, তা আবার আমাকে কেমন বিকৃত রুচির শয়তান বানাতে পারে তা আমার কাছে স্পষ্ট হল একটা ঘটনায়। নন্দিতা বলে একটি মেয়ে স্যরের কাছে পড়তে আসত। ধনীঘরের আদরের দুলালী। স্মার্ট অথচ এমনই ন্যাকা যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না! কিন্তু তা বললে কী হবে, দেখতে ভীষণ সুন্দরী। জানিনা সেই বয়সে সকলকেই এমন সুন্দর লাগে কি না! সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যাকে বলে— ঢলো ঢলো কাঁচা অঙ্গের লাবণী। তাকে প্রথম দেখে একটা মিশ্র অনুভূতি মনে জেগেছিল। তার স্বর্গীয় দ্যুতি মুগ্ধ করলেও এক ঝলকেই বুঝেছিলাম আমার কপালে এ জিনিস জুটবে না। আমার জীবনে আমি যা অপ্রাপণীয় ভাবতাম, তা যে আমার মধ্যে এমন জ্বালা ধরাতে পারে এর আগে তা জানা ছিল না। মাস ছয়েক লাজুক চোখে তাকিয়েও এক পা এগোতে পারলাম না। উল্টে আমার দিকে নন্দিতার তাকানো দেখে আমার মনে হত ও যেন আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। তা-ও না হয় সহ্য করা যেত। কিন্তু একদিন সকলের সামনে ও সরাসরি বলল, তুই আমার দিকে ওমন করে তাকাস কেন রে? বেমক্কা ওর এ কথা শুনে সকলে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি চরম অস্বস্তি এবং লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিচ্ছি এমন সময় স্যর এসে প্রবেশ করলেন। সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? আমি ভেবেছিলাম কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। নন্দিতা বলে উঠল, স্যর, শুভকে আমার দিকে ওমন করে তাকাতে বারণ করে দেবেন। আমার মনে হল স্যর নিজেও একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।… আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শুভ, পড়াশোনায় মন দে।

 সরস্বতী পুজোর পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় স্যরের বাড়িতে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। স্যরের কাছে যতজন পড়তাম সকলে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। সব ব্যাচ মিলিয়ে তা প্রায় একশোর উপর ছাত্রছাত্রী। ইলেভেন-টুয়েলভ এবং হায়ার ক্লাসের। খাওয়ার আগে একটা বড় হলঘরে ভিডিয়ো-তে সিনেমা দেখছিলাম আমরা। ঘরে কোনও আলো জ্বলছিল না। শুধু ভিডিয়ো চলছিল। সেই স্বল্প আলোয় চোখ সয়ে যাওয়ায় কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম আমার সামনে বসে রয়েছে নন্দিতা। পিছন থেকে দেখা তার সেই অপরূপ অঙ্গ-সৌষ্ঠব আমার মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত জ্বালা ধরিয়ে দিল। একই সঙ্গে বিমুগ্ধতা এবং পূর্ব-অপমানের স্মৃতি আমাকে কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। ভাবলাম উঠে চলে আসি। বেরব বলে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় ইলেকট্রিক চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সচেতন ভাবে ফুটবলে লাথি মারার মতো পা চালালাম নন্দিতার পশ্চাদ্দেশ লক্ষ করে। নিশানা যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি তা নন্দিতার আর্তনাদই জানিয়ে দিল। আমি আর সেখানে একমুহূর্ত অপেক্ষা করিনি। জেনারেটর কানেকশন চালু হওয়ার আগেই সেখান থেকে ধাঁ। মাথায় রইল খাওয়া, সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম।

 কাপুরুষের মতো পলায়নের দিন পনেরোর মধ্যে একটা আকস্মিক আবেগের ফলস্বরূপ জীবনে প্রথম ভালবাসা এল। চিত্রা ছিল আমার বন্ধু চিন্ময়ের বোন। ওরা দু’জনে পিঠোপিঠি। একই ক্লাসে পড়ত ভাইবোনে। স্কুল অবশ্য আলাদা। চিন্ময় পড়ত আমার সঙ্গে কো-এড স্কুলে। আর চিত্রা গার্লস স্কুলে। মাধ্যমিকের পর আমি আর চিত্রা এক স্কুলে ভর্তি হলাম। আমি সায়েন্সে, ও আর্টসে। চিত্রার সঙ্গে আমার আলাপ চিন্ময়ের সূত্রে। চিত্রা আমাকে ‘শুভদা’ বলে সম্বোধন করত, আমি ওর নাম ধরেই ডাকতাম। তবে আমরা পরস্পরকে ‘তুমি’ বলতাম। একই স্কুলে পড়লেও আমাদের দু’জনের যাত্রাপথ ছিল আলাদা। আলাদা স্ট্রিম বলে স্কুলেও দেখা-সাক্ষাৎ হত না বললেই চলে।

 ফেব্রুয়ারির দু’তারিখ ছিল স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস। সেই উপলক্ষে স্কুলে আয়োজিত অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল ইন্টার-ক্লাস ক্যুইজ কম্পিটিশন। চিত্রা আমার কাছে এসে হাজির। বলল, চলো না শুভদা, নাম দিই। আমার এমনিতে ক্যুইজ বিষয়টা পছন্দের। দীর্ঘদিন ধরে খবরের কাগজ-রেডিয়ো-টিভি-বিভিন্ন ধরণের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটির কারণে অনেক কিছু বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম। আর জাগতিক সমস্ত বিষয়ে আমার ছিল অপার কৌতূহল। এর বাইরেও আমার মতো মনোযোগী শ্রোতা, একনিষ্ঠ দর্শক এবং তন্নিষ্ঠ পাঠক খুব সুলভ ছিল না। আমারও ক্যুইজে বসতে ইচ্ছা করছিল। শুধু পার্টনারের অভাবে বসা হচ্ছিল না। আমি তাই চিত্রার প্রস্তাবে সাগ্রহে সম্মতিজ্ঞাপন করলাম।

 ক্যুইজ কম্পিটিশন শুরুই হল দেরিতে। তিনটের পর। যখন শেষ হল প্রায় ছ’টা বাজে। আমরাই চ্যাম্পিয়ন হলাম। জয়ের আনন্দের থেকেও তখন আমাদের বেশি ভাবিয়ে তুলেছে ফেরার চিন্তা। স্কুল থেকে যখন বেরলাম, অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে নেমে এসেছে। আমি সাইকেলে যাতায়াত করতাম, মাঠের রাস্তা দিয়ে। আধঘণ্টাটাক লাগত। অন্ধকার হলেও এবং সাইকেলে ডায়নামো লাগানো না-থাকলেও চেনা রাস্তা ধরে আমার ফেরাটা খুব সমস্যা নয়। সমস্যা হল চিত্রার ফেরা। চিত্রা বাসে যাতায়াত করত। একটা বাসে হত না। মাঝরাস্তায় বাস পাল্টাতে হত। বাসে ফিরতে গেলে শীতের রাতে কমসেকম এক ঘন্টার ধাক্কা। তার উপরে বাস ভোগালে তো আর কথাই নেই। চিত্রা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে দেখে আমি প্রস্তাব দিলাম, আমার সঙ্গে সাইকেলে চলো। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ার ছিল না। ও বলল, সামনে তো বসা যাবে না। আমি দেখলাম ঠিক কথা। তাহলে উপায়? চিত্রা বলল, হেঁটে ফিরলে কেমন হয়? আমি বললাম, এতটা রাস্তা হাঁটতে পারবে? বলল, কেন পারব না? জয়চন্ডীতলা মাঠের পাশ দিয়ে কয়েকবার তো হেঁটে ফিরেছি। বললাম, চলো তাহলে হাঁটা শুরু করা যাক।

 আমাকে বাধ্য হয়ে একবারই হেঁটে ফিরতে হয়েছিল। সাইকেলের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল। পকেটে সাইকেল সারানোর দু’টাকাও ছিল না। অগত্যা হাওয়া-পড়া সাইকেল টেনে মেঠো রাস্তা ধরে চার কিলোমিটার হন্টন! চিত্রাকে নিয়ে অবশ্য যে রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম সেটা ইটপাতা রাস্তা। চিত্রাদের বাড়ি থেকে এটাও প্রায় চার কিলোমিটার। কিন্তু আমি এটা দিয়ে যাতায়াত করতাম না। কারণ এটা দিয়ে যাতায়াত করলে আমাকে চিত্রাদের বাড়ি ফেলে রেখে আরও এক কিলোমিটার যেতে হত। দ্বিতীয়ত মেঠো রাস্তা ধরে প্রকৃতির বুক চিরে যাতায়াত আমার মধ্যে একটা আলাদা নিবিড় ইন্দ্রিয়ঘন ভাললাগার সঞ্চার করত।

 এতক্ষণ ঘরের মধ্যে ছিলাম এবং প্রতিযোগিতার উষ্ণতায় সময় কেটে যাচ্ছিল। স্কুল থেকে বেরনোর পর থেকেই বেশ শীত করছিল। এমনিতেই আমি শীতকাতুরে। আমার একটু বেশিই ঠান্ডা লাগে এবং সর্দি-কাশিতে ভালরকমই ভুগি। বাচ্চাবেলায় আমাদের পাঁচ ইঞ্চি দেওয়ালের খোলার চালের ঘরে শীতের রাতে ভীষণ শীত করত। রেগে একদিন মাকে বলেছিলাম, বাইরে শোব। ঘরে শোওয়া আর বাইরে শোওয়া একই ব্যাপার। আমার বাবা আসলে এমন একজন মানুষ যে কোনও কিছুই খুব উদ্যোগ নিয়ে করে উঠতে পারত না। চলে যাচ্ছে, চলে যাবে — সবকিছুতেই এমন একটা গা-ছাড়া ভাব। না হলে অন্যদের টালির চালের ঘর হলেও যেখানে ঠান্ডা আটকানোর জন্য শীতকালে চাল এবং ঘরের দেওয়ালের মাঝে খড় দেওয়া থাকত বা দরমা লাগানো হত, সেখানে আমাদের ঘরে সে সবের বালাই থাকবে না-ই বা কেন!

 গায়ে শুধু একটা সোয়েটার— তা-ও হাত কাটা। চিত্রার গায়ে সোয়েটারও নেই। শাড়িতেই যতটা সম্ভব ঢাকাঢুকি দিয়ে শীত আটকানোর চেষ্টা করছে বেচারা। দূরে দূরে একটা-দুটো বাড়ি। অন্ধকারে নিমজ্জিত রেল লাইন। ইলেকট্রিকের লাইন ঢোকেনি। সবে দু’-একটা পোস্ট পড়েছে। আমরা অন্ধকারে হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে এগিয়ে চলছিলাম। প্রায় অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে এসেছি শুনতে পেলাম চিত্রা কাশছে। ওর ঠান্ডায় যে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে সেটা একটু আগে থাকতেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ওকে কাশতে শুনে আমার ভিতরে যেন কী একটা ঘটে গেল। গা থেকে সোয়েটার খুলে চিত্রার হাতে দিয়ে বললাম, এটা গলায় জড়িয়ে নাও। ও প্রথমে নিতে চাইছিল না। একটু জোর করতে সোয়েটারটা গলায় জড়িয়ে নিল চিত্রা।

 এর কয়েকদিন পর চিন্ময়ের সঙ্গে দেখা করতে ওদের বাড়ি গেলাম। অন্যদিন আড্ডার মাঝে চিত্রা হাজির হয়। আজ তার টিকি খুঁজে পাওয়া গেল না। ওঠবার আগে আমি জানতে চাইলাম, চিত্রা বাড়ি নেই নাকি? চিন্ময় বলল, এ ঘরেই তো ছিল। তুই ঘরে ঢোকার জাস্ট আগে ‘কাজ আছে’ বলে উঠে গেল।

 আমাকে দেখেনি বোধহয়।

 না না, তোকে দেখেছে। আমাকে বলে গেল, তোমরা গল্প করো, আমি আসছি।

 গেটের দরজা ঠেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসার আগে কী মনে করে একবার মুখ ফেরালাম। দেখলাম ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চিত্রা। চোখে চোখ পড়তে লজ্জারুণ চোখ নামিয়ে নিল। আমার কাছে এক নতুন আলোয় সব স্পষ্ট হয়ে গেল। সন্ধে নামতে বাকি ছিল না। কনে দেখা আলো কথাটা এতদিন শুধু শুনেইছিলাম, কখনও অনুভব করিনি। আর আজ মনে হল কথাটার যদি এ পৃথিবীতে কোনও অস্তিত্বই না থাকত তবে আমি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতাম, যে আলোয় আমি আজ সলাজ কিশোরীর নবপ্রেমরাগ অনুভব করেছি সে আলোর নাম হওয়া উচিত কনে দেখা আলো।… এর মাসখানেক-মাসদেড়েকের মধ্যে চিত্রার কাছে আমি ‘শুভদা’ থেকে একান্তে ‘শুভ’ হয়ে গেলাম।

 উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হতে দেখা গেল আমি স্টার পেয়েছি। তা পেলে কী হবে, সবাই যখন জানতে চাইল, আমার জয়েন্ট কেমন হয়েছে, আমি জানালাম, আমি জয়েন্ট দিইনি। প্রত্যেকে অবাক হল। উচ্চমাধ্যমিকে সায়েন্সে স্টার পেয়েছে অথচ জয়েন্টে বসেনি এমন দেখা যায় না। ধারণাটা যে কতটা সত্য বুঝলাম যখন আমার সঙ্গেই স্টার পাওয়া স্কুলের চার সহপাঠীর মধ্যে দু’জন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং একজন মেডিক্যালে চান্স পেল, আর সুজন তো আইআইটি ক্রাক করল। ঘটনা হল, অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলেও এটা সত্যি যে, জয়েন্টের বিষয়ে আমি প্রায় কিছুই জানতাম না এবং এ বিষয়ে কেউ আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি। আসলে যাদের জীবনে প্রকৃত অভিভাবক থাকে না তাদের জীবনে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

 জেদ চেপে গেল। কলেজে ভর্তি হলাম ফিজিওলজি অনার্সে। সাথে সাথে নিজেই বইপত্র জোগাড় করে শুরু করলাম জয়েন্টের পড়াশোনা। এদিকে বয়স আঠারো পেরল। কাগজে একদিন দেখলাম পিএসসি ক্লার্কশিপ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে। যোগ্যতামান মাধ্যমিক পাশ এবং বয়স হতে হবে কমপক্ষে আঠারো। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফর্ম কিনে ফিল-আপ করে পোস্ট অফিসে জমা করলাম। নভেম্বরে ক্লার্কশিপের প্রিলিমিনারি এবং এপ্রিলে মেন দিলাম। এপ্রিলে জয়েন্টেও বসলাম। জয়েন্টের রেজাল্ট বেরতে দেখলাম মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি কিন্তু কলকাতার কোনও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার মতো র়্যাঙ্ক হয়নি। মাধ্যমিকের পর থেকে ছেলে পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাই। এখন কলকাতার বাইরে গিয়ে সেখানে থেকে কীভাবে পড়াশোনার খরচ-খরচা সামলাব ভেবে পেলাম না। আমাদের সামাজিক পরিচিতি ছিল না বললেই চলে। বাড়ি, পাড়া বা গ্রামে আমাদের কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনত না। খুব কম অনুষ্ঠান বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ হত। এমনকী হালখাতাতেও আমাদের কেউ ডাকত না। মামার বাড়ি থেকে ক্যালেন্ডার এনে ঘরে টাঙাতাম। আমরা কেমন দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের মতো বাঁচতাম। আমার মাকে সরাসরি অন্য বাড়িতে কাজের মহিলা হিসাবে রান্না করার প্রস্তাব দেওয়া যেত। কী ভাবে মানুষের হাতে টাকা-পয়সা আসে—এটা আমি বাচ্চাবেলা থেকে অনেক ভেবেছি। কিন্তু উত্তর খুঁজে পাইনি। ভাবনাই সার হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে টাকা কী ভাবে জোগাড় হবে, ভেবে পেলাম না। উপায়ান্তর না-দেখে মা দু’-একজনের কাছে আমাকে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে যেতে বলল। কিন্তু আমার মন মানল না। কোনও দিন নিজে কারও কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে যাইনি। অবশ্য কেউ নিজে থেকে কোনও সহায়তা প্রদান করলে সেটা নিতে অস্বীকার করিনি। আমাদের তিন জনের পরিবারের মধ্যে এই বিষয়টা রয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে ইন্দিরা আবাসন যোজনার সরকারি বারো হাজার টাকায় আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই, জীবন ধারণের বিপিএল রেশন কার্ড— এ-সবের জন্য আমরা কোনও দিন কাউকে ধরা-করা করিনি। পার্টির বাবুরা নিজেদের গরজেই সব করে দিয়েছে।

 হাত থেকে টাকা হারানো, টাকা হাতে পেয়ে হারানো, আরও বেশি টাকা হাতে পাওয়ার সুযোগ হারানো— তিনটে ঘটনা অবশ্য শৈশব-কৈশোরে আমার সঙ্গে ঘটেছে। একবার, যতদূর মনে পড়ে তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি, কেরোসিন তেল আনতে যাচ্ছিলাম। হাতে ছিল কেরোসিনের ড্রাম, রেশন কার্ড আর দশ টাকার একটা নোট। বিকেল তখন সন্ধের দিকে গড়াচ্ছে। গরমকাল। হঠাৎ ঝোড়ো-হাওয়া বইতে শুরু করল। সেই হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি একছুটে মিনিট দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কেরোসিন তেল নেওয়ার দোকানে। রেশন কার্ডটা এগিয়ে দিলাম। দোকানদার রেশন কার্ড-এর একটা পাতায় তারিখ দিয়ে প্রাপ্য কেরোসিন তেলের পরিমাণ লিখে হাত বাড়িয়ে বলল, কই, টাকাটা দে। আমার হাতে তখন শুধু কেরোসিন তেলের দাম। পকেট বিহীন হাফপ্যান্ট, খালি গা। সুতরাং হাতে না থাকলে নোটটা আর কোথাও থাকা সম্ভব নয়। সেদিন কেরোসিন তেলের খালি প্লাস্টিকের ড্রাম নিয়ে ফিরতে ফিরতে পিচরাস্তার প্রতি সেন্টিমিটারে জরিপ করছিলাম। কিন্তু যথারীতি দশ টাকার নোটটাকে আর ফিরে পাইনি। যে রাস্তা পাঁচ মিনিট আগে ছুটে দু’মিনিটে পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেই রাস্তাই ফিরে আসতে মনে হয় মিনিট কুড়ি সময় লেগেছিল। বাড়ি ঢোকার আগে সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাথায়, মোড়ের মাথায় বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। লিটার খানেক তেল এবং গোটা আষ্টেক টাকা না নিয়ে ফিরব কীভাবে সেটাই মাথায় ঢুকছিল না। ওই দশ টাকার নোটে শুধু ঘরের অন্ধকার দূর করার দিশা ছিল না, ছিল পরবর্তী কয়েকদিনের পেট ভরানোর ঠিকানাও।

 এবার আর দশ টাকা হারিয়ে আসিনি, দশ টাকা নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরেছিলাম। কিন্তু অতিরিক্ত দশ টাকা হাতে পাওয়ার আনন্দে দ্রুত বাড়ি ফেরার রাস্তাতেই মনে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি শুরু হল। চেনা দোকানদার ভুল হিসেব করে আমার হাতে অতিরিক্ত দশ টাকা না হয় দিয়েইছে, তা বলে জেনেশুনে সেটা নেওয়া কি আমার ঠিক হবে! গলায় মাছের কাঁটা আটকালে যেমন গলার মধ্যে খিচখিচ করে, আমার মনটাও তেমন খিচখিচ করতে লাগল। দোকানে ফিরে গিয়ে পঙ্কজকাকার হাতে তুলে দিলাম দশ টাকা। পঙ্কজকাকা প্রথমে একটু অবাক, তারপর খুশি হয়ে বলল, তুই সমরদার ছেলে না? তুই এখন কীসে পড়িস? আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললাম, ক্লাস সিক্সে। এই নে, বলে পঙ্কজকাকা আমার হাতে একটা দশ পয়সা দামের লজেন্স তুলে দিল।

 ‘হু ওয়ান্টস টু বি এ মিলিয়নিয়ার’ তখন ভবিষ্যতের গর্ভে, এর-ই হিন্দি সংস্করণ ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ স্টার প্লাস-এ সম্প্রচারিত হতে তখনও বছর আষ্টেক বাকি, চিত্রাদের পাড়ার নীতিনদার মাথায় এল এক অদ্ভুত আইডিয়া। তিনি যুবক সঙ্ঘের জগদ্ধাত্রী পুজোয় এক অন্য রকম প্রতিযোগিতা নিয়ে হাজির হলেন। জিতে দেখাও হাজার টাকা। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের দশটা প্রশ্ন করা হবে। উত্তরের দু’টো করে অপশনও দেওয়া হবে। তার মধ্যে ঠিকটাকে বেছে নিয়ে সঠিক উত্তর দিলে জেতা যাবে নগদ একশো টাকা, আর ভুল উত্তর দিলে প্রতিযোগীকে দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা। কোনও উত্তর না দিলেও প্রতিযোগীকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে। আর কোনও অবস্থাতেই প্রতিযোগিতার মাঝপথে, প্রতিযোগিতা শেষ না করে প্রতিযোগী উঠে যেতে পারবে না। চিত্রার উপস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় নাম দিলাম আমি। চিত্রাও দিল। সব মিলিয়ে বাইশ জন প্রতিযোগী। প্রতিযোগিতার দশম তথা শেষ প্রশ্ন ছিল, নবাব সিরাজদ্দৌলাকে কে হত্যা করেছিল? অপশন ‘এ’— মোহম্মদ আলি বেগ, অপশন ‘বি’— মীর মীরন। আমার জানা ছিল মীরজাফরের ছেলে মীরনের নির্দেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেই হত্যাকারীর নাম যে মোহম্মদ আলি বেগ, তা জানা ছিল না। তাই দ্বিধা সত্ত্বেও আমি উত্তর দিলাম অপশন ‘বি’— মীর মীরন। প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা গেল একজনের ছ’টা উত্তর ঠিক হওয়ায় তাকে শুধু কর্তৃপক্ষকে টাকা দিতে হচ্ছে না। বাকি সকলকেই কর্তৃপক্ষকে টাকা দিতে হবে। সেখানে আমার ন’টা উত্তর ঠিক হওয়ায় আমার পাওনা হচ্ছে সাড়ে আটশো টাকা। মীর মীরন না বলে যদি মহম্মদ আলি বেগ উত্তর দিতাম, তাহলে ‘জিতে দেখাও হাজার টাকা’য় আমি জিতে নিতাম হাজার টাকা। কিন্তু সাড়ে আটশো টাকাও কম ছিল না। এর আগে জীবনে কখনও একসঙ্গে এত টাকা আমি হাতে ধরিনি, অর্জন করা তো দূরের কথা! এর আগে হাইস্কুলে, প্রত্যেক বছর ক্লাসে প্রথম হওয়ার সুবাদে, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে খামে ভরে পঞ্চাশ টাকা অবশ্য আমার কাছে নিয়মিত এসেছে, যা দিয়ে ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমি গ্রামীণ ব্যাঙ্কে প্রথম বইও করি। হ্যাঁ, এটাও মনে আছে, নীতিনদা প্রতিযোগীদের কাছ থেকে টাকা নেননি, কেবল আমাকে সাড়ে আটশো টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করে পিঠ চাপড়ে ‘সাবাশ’ বলেছিলেন।

 শৈশব থেকেই খবরের কাগজ পড়ায় এবং কাগজ খুললেই প্রথম পাতায় রাজনৈতিক সংবাদ থাকার কারণে না-চাইতেই রাজনীতি নিয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে ইতিহাস বইয়ে পড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম, ফরাসি বিপ্লব, বিশ্বযুদ্ধের কাহিনি যেন ঠিক মেলাতে পারতাম না। এমনিতেই স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আমার মনে একটা আবেগ কাজ করত। ভাবতাম, দেশের স্বাধীনতা আসার আগে যদি জন্মগ্রহণ করতাম, তা হলে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারতাম।

 সমকালীন রাজনীতি আমাকে কোনও প্রণোদনা জোগাত না। দেখতাম আমাদের গ্রামাঞ্চলে যারা রাজনীতি করত তাদের না-আছে রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, না-আছে ব্যক্তিগত সততা আর না-আছে চারিত্রিক দৃঢ়তা। এদের দেখে আমার রাজনীতিতে অসূয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরেও আমার মনে হত রাজনীতির প্রয়োজন হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা আনার জন্য। স্বাধীন দেশে আবার রাজনীতির কী প্রয়োজন? সবাই তো দেশের ভাল চায়। স্বাধীন দেশে সবাই তো একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। আলাদা করে রাজনীতি করে এক শ্রেণির মানুষের আবার অপর মানুষের ভাল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে কেন?

 এমন একটা সময় বড় হচ্ছিলাম যখন দেশ স্বাধীন, নকশাল আন্দোলনকে অতীত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, রাজ্যে বামপন্থী সরকার নির্বিকল্প হয়ে ওঠার সাধনায় রত। বিপ্লব, আদর্শ সব কেমন সাত দরিয়া পারের গল্প বলে মনে হত। জীবনে মহৎ হয়ে ওঠা, মহান কিছুর ভাবনা ক্রমশ সুদূরপরাহত হয়ে উঠছিল। একটা ভোগবাদী জীবন-দর্শন সর্ব অর্থে থাবা গেড়ে বসছিল। তারপরে তো এসে গেল মুক্ত অর্থনীতি— খোলা বাজারের হাওয়া। দেখতে দেখতে বৈচিত্র্যময় পৃথিবী বদলে গেল ভুবনগ্রামে। পুরোহিততন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র মন্থন করে উঠে এল একমেবাদ্বিতীয়ম ধনতন্ত্র— পুঁজিবাদ। বাকিগুলো কমবেশি রয়ে গেল। কিন্তু বকলমে সেগুলো ধনতন্ত্রেরই অনুসারী শিল্প হয়ে উঠল। পুঁজিবাদের হাত ধরে বাজার অর্থনীতি হয়ে উঠল একমাত্র নিয়ন্ত্রক শক্তি। বাজার মানুষকে শেখাল স্বার্থপর, ভোগ-সর্বস্ব হয়ে উঠতে, না ভোগী স্বার্থান্বেষী মানুষ বাজারকে কাজে লাগাল নিজের আখের গোছাতে, তা নিয়ে অবশ্য অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েই গেল।

 টাকা-পয়সার সংস্থান না-হওয়ায় আমার ডাক্তারি পড়া হবে না শুনে চিত্রা বলল, ডাক্তারিতে সুযোগ পাওয়াই কত বড় আ্যাচিভমেন্ট। আর তুমি সেই সুযোগ পেয়েও কিনা আর্থিক কারণে ডাক্তারি পড়বে না…! আমি একবার বাড়িতে বলে দেখি। আমি বললাম, চিত্রা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! দেখছ, আমি কাউকে বলছি না, সেখানে তুমি বলবে! আর… একদিক থেকে এটাই ভাল, ডাক্তারি পড়তে গেলে লেখালিখি এবং তোমাকে ছেড়ে আমাকে অনেক দূর চলে যেতে হবে। আমার লেখালিখি রইল, তুমিও রইলে, না-ই বা হল ডাক্তারি। চিত্রা কোনও কথা না বলে চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পর আমি চিত্রার পাশ থেকে উঠে চলে এলাম।

  আমার পক্ষে কলেজে সপ্তাহে দু’-একদিনের বেশি যাওয়া সম্ভব হত না। টিউশন পড়ানোর চাপ ছিল। তবুও চেষ্টা করতাম প্র্যাকটিক্যালের দিনগুলো যাওয়ার। তা-ও সব পেরে উঠতাম না। কলেজে গিয়ে দেখতাম মেধা-বুদ্ধিবৃত্তির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রূপ-শারীরিক সংগঠন। অন্তত অধিকাংশের কাছে। ল্যাকপ্যাকে আমি মনোযোগী হলাম শরীর গঠনে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যুবক সঙ্ঘে জিম করার কিছু সরঞ্জাম ছিল। ওখানে গিয়ে বিনা খরচেই শরীর চর্চা করা যেত। এক কিলোমিটারের মতো সাইকেল চালিয়ে সেখানে গিয়ে প্রতিদিন গোধূলিবেলায় আমি আরও কয়েকজনের সাথে শারীরিক কসরৎ শুরু করলাম।

 শেষ চৈত্রের কোনও একটা দিন হবে। দুপুরের পরই প্রকৃতি যেন বজ্রনির্ঘোষের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে শেষ বিকেলে এল মরশুমের প্রথম কালবৈশাখী। সেদিন আমি একাই জিম করছিলাম। আর কেউ হাজির হয়নি। প্রাকৃতিক আঁধারে চারিদিক ঢেকেছিল। কালবৈশাখী শুরু হতে ইলেকট্রিকও পগার পার। অন্ধকারে ক্লাবঘরে বসে ঝড়-বৃষ্টি একটু কমার অপেক্ষায় সময় গণছিলাম। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের পরে পরেই বজ্রপাতের আওয়াজে শিহরণ জাগছিল শরীরে-মনে।

 ঝড়ে কখন ক্লাবের দরজাটা খুলে হাঁ হয়ে রয়েছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখলাম দরজার মধ্যে দিয়ে আলো এসে ক্লাবের মেঝেতে পড়ল। ভাবলাম আকাশ থেকে নেমে আসা বিদ্যুৎ চমক। কিন্তু দেখলাম এ চকিত চমক নয়, স্থির ম্রিয়মাণ। আলোর উৎস সন্ধানে মুখ তুলে তাকিয়ে বুঝলাম আলোটা আসছে রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ক্লাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়ির গেটের দরজা থেকে। আমি বেরিয়ে ক্লাবের দরজায় এসে দাঁড়াতে টর্চের আলোটা সরাসরি আমার গায়ে এসে পড়ল। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে ভেসে এল এক ভয়ার্ত মহিলা কণ্ঠ, ভাই, একবার এদিকে আসবে। মহিলা সমস্যায় পড়েছেন বুঝতে পেরে ক্লাবের দরজা টেনে বন্ধ করে শিকল তুলে দু’হাতে মাথা চাপা দিয়ে দৌড়ে গেলাম উল্টোদিকের দরজায়। দেখলাম শাড়ি পরিহিতা এক দীর্ঘাঙ্গী ভদ্রমহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা বললেন, কী করা যায় বলো তো?… ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…! আমি বললাম, কী হয়েছে সেটা বলবেন তো? ভদ্রমহিলা যা বললেন তা থেকে বুঝলাম— ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ার পর দোতলা থেকে নীচে নেমে উনি নীচের ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা ঠিকঠাক দেওয়া আছে কি না ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। এমন সময় ইনভার্টারে ‘কঁ কঁ’ করে আওয়াজ শুরু হওয়ায় ওঁর খেয়াল পরে ইনভার্টারের ব্যাটারিটা কিছুদিন ঠিকমতো চার্জ হচ্ছে না। উনি ব্যাটারিটা পাল্টানোর কথা গতকালই ভাবছিলেন। তাই সমস্ত আলো নিভে যাওয়ার আশঙ্কায় উনি ঘর থেকে টর্চলাইটটা নিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন। সবে তিনি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন সমস্ত বাড়ি অন্ধকারে ডুবে যায়। উনি বাইরে বেরনোর দরজার খিলটা এঁটে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবেন এমন সময় কানে আসে ফোঁস ফোঁস গর্জন। আওয়াজটা লক্ষ করে টর্চের আলো ফেলতেই ওঁর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়! একটা বিষধর সাপের ক্রুদ্ধ ছোবল আলোটার উপর আছড়ে পড়তেই উনি পড়িমরি করে দরজা খুলে, গেটের বাইরের কাঠের দরজা আটকে আমাকে ডাকছিলেন। উনি এখন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন… উপরে অন্ধকার ঘরে আটকে থাকা ওঁর মেয়ে যদি নীচে নামতে যায় তাহলে কী সর্বনাশ যে ঘটতে পারে!

 আমি বললাম, ঘাবড়াবেন না। আপনি গেটের দরজাটা খুলুন। ভিতরে না-ঢুকে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না।

 দেখলাম ভদ্রমহিলা কাঁপা হাতে দরজাটা ঠেলে খোলার মতো জোরটুকুই আর পাচ্ছেন না।… ঠিক আছে, আপনি টর্চটা জ্বেলে রাখুন… নেভাবেন না। আমি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। ভদ্রমহিলা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে শান বাঁধানো লন বরাবর ঘরের দরজা পর্যন্ত টর্চের আলো ফেললেন। আমি একটু এগোতে উনি আলোটা দোতলায় ওঠার সিঁড়ি যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে ফেললেন। আলোটা পড়তেই ঝলসে উঠল কুলোপনা চক্কর। ক্রুর নৃশংসতার ভয়াল রূপ নিয়ে তা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে আছড়ে পড়ল পাথরের মেঝের উপর। আমি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় দু’পা পিছিয়ে এলাম। উপর থেকে ওঁর মেয়ে কী বলছিল, তা বোধে পৌঁছল না। কানে এল উনি আমার পাশ থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, তুই একদম বেরবি না… ঘরের ভিতরে যা… দরজাটা ভাল করে দিয়ে দে…

 আমি এর আগে কখনও সাপ মারিনি, তবে সাপ মারতে দেখেছি। আমাদের পাশের বাড়ির পুকুরের পাড়ে একবার শিবতলার হেমন্ত একটা চামরকোষা মেরেছিল। সদ্য কাটা বাঁশের বাখারি হেমন্ত বসিয়ে দিয়েছিল চামরকোষাটার চওড়া তেশিরে মাথায়। কিন্তু আমি এখন কী করি…! একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার, এই অন্ধকারে সাপটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলে কোথায় গিয়ে ঢুকবে, তাতে হিতে বিপরীত! কাউকে ডাকব? কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টিতে কেউ কি সহজে আসতে চাইবে! আর তার উপর ভদ্রমহিলা এমন আতঙ্কিত হয়ে রয়েছেন যে ওঁকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। অগত্যা…

 শক্ত একটা লাঠি বা মজবুত লম্বাটে কিছু এই মুহূর্তে দরকার। ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলাম, লাঠি জাতীয় কিছু আছে? ভদ্রমহিলা মুখে কিছু না বলে গেটের পাশে একটা গন্ধরাজ ফুলগাছের গোড়ায় আলোটা ফেললেন। দেখলাম একটা সাত- আট ফুট লম্বা বাঁশের টুকরো। হাতে নিয়ে বুঝলাম যথেষ্ট মজবুত। একটু একটু করে দু’পা এগোলাম। অনুসরণরত ভদ্রমহিলা আলোটা ঘুরিয়ে ফেললেন সিঁড়ির প্রথম ধাপে। নিজের ছায়ার উপর বিষধর কেউটের কুলোপনা চক্কর বিদ্যুৎ গতিতে নেমে এল। আমিও কোনও সময় নষ্ট না করে ফণীর নমিত মস্তকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাঁশ দিয়ে আঘাত করলাম। মারটা মোক্ষম হয়েছিল। সাপটাকে আর ফণা তুলতে না দেখে বুঝলাম কাজ হয়েছে, আর বিপদের আশঙ্কা নেই। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও ঘা কতক বসিয়ে দিলাম।

 সাপটাকে একটু চেষ্টা করে বাঁশে পাক দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বাইরে বের করে নিয়ে এলাম। তারপর ভদ্রমহিলার কাছ থেকে কেরোসিন তেল চেয়ে নিয়ে মৃত সাপের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন করে দিলাম।

 আসি, বলে যখন বেরতে যাচ্ছি ভদ্রমহিলা বললেন, এত বড় উপকার করলে… যদি কিছু মনে না করো আর একটা কাজ তোমাকে একটু করে দিতে হবে… আমাকে এক প্যাকেট মোমবাতি আর দেশলাই একটু এনে দাও। পঞ্চাশ টাকার নোট আমার হাতে দিলেন। আমি পাশের দোকান থেকে মোমবাতি-দেশলাই কিনে এনে দিলাম। উনি বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। আর আজ… এই অন্ধকারে তোমাকে বসার জন্য বলবও না। কিন্তু আগামীকাল সন্ধ্যাবেলায় তুমি অবশ্যই একবার আসবে।

 পরের দিন সন্ধ্যায় তো গেলামই, তারপর থেকে ওই বাড়িতে যে কতবার গিয়েছি। আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন মিসেস চৌধুরী এবং ওঁর মেয়ে রমা।

 মিসেস চৌধুরীর বাজারে যথেষ্ট দুর্নাম ছিল। আমার অবশ্য বাইরের কারও কাছ থেকে ওঁর সম্পর্কে কিছু জানার প্রয়োজন পড়েনি। উনি এত আন্তরিক ভাবে আমার সঙ্গে মিশতেন, কথায় কথায় নিজেই আমাকে সব জানিয়ে দিলেন। ডাক্তার রমেন চৌধুরীর উনি দ্বিতীয় পক্ষ। ডাক্তার চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন ওঁর বড়দিদি। সেই দিদির সঙ্গে ওঁর বয়সের পার্থক্য প্রায় পনেরো বছর। দিদি আকস্মিকভাবে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান— একমাত্র সন্তান উনিশ বছরের রমিতকে রেখে। এই মৃত্যুকে আত্মীয়-অনাত্মীয় কেউ-ই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মানতে রাজি হয়নি। তার মূল কারণ দিদি বেঁচে থাকাকালীনই ডাক্তার চৌধুরীর সঙ্গে মিসেস চৌধুরীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর তা নিয়ে দিদির মনে অশান্তির শেষ ছিল না। এদিকে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর বছর না-ঘুরতেই ডাক্তার চৌধুরী ওঁকে বিয়ে করেন। আর পরের বছরই রমার জন্ম। ডাক্তার চৌধুরী গত ডিসেম্বরে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যান। কেউ অবাক হয়নি। বরঞ্চ বলেছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পাপের সাজা পেতে একটু দেরি হল বটে তবে তা সুদে-আসলে ভাল রকমই পেয়ে গেল রমেন চৌধুরী। কিন্তু ডাক্তার চৌধুরীর আত্মহত্যার ঘটনাটা আজও মিসেস চৌধুরীর অবিশ্বাস্য মনে হয় এবং এর কোনও কারণ তিনি এই একবছরে খুঁজে বের করতেও পারেননি। তিনি অবশ্য খেয়াল করে দেখেছেন চৌধুরী পরিবারে শেষ দু’-তিন প্রজন্মে নানা অদ্ভুত জিনিস ঘটতে দেখা যাচ্ছে। চৌধুরীরা এক সময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার। সেই পরিবারে ইদানীং বাসা বেঁধেছে পাগলামির বীজ। কেউ গুম মেরে থাকে। কেউ রাস্তাঘাটে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। কেউ ছিটিয়াল টাইপের। কেউ কেউ আবার দুম করে রমেন চৌধুরীর মতো আত্মহত্যা করে। সকলে বলে এ হল পুরনো দিনের অত্যাচারী জমিদারির পাপের ফল। কম পাপ তো একসময় চৌধুরী পরিবার করেনি।

 রমিত ডাক্তার। লন্ডনে থাকে। আগে মাঝে মধ্যে আসত। কিন্তু ডাক্তার চৌধুরী মারা যাওয়ার পর সে মিসেস চৌধুরীকে জানিয়ে দিয়েছে, হয়তো আর দেশে ফিরবে না। এখন এই এতবড় দোতলা বাড়িতে মিসেস চৌধুরী ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট চোদ্দো বছরের রমাকে নিয়ে থাকেন। উনি যে খুব খারাপ রয়েছেন তা ওঁকে দেখে মনে হয় না। উল্টে বরং মনে হয় উনি বহাল তবিয়তেই আছেন।

 মিসেস চৌধুরীর বাপের বাড়িও বনেদি পরিবার। একসময়ের জমিদার। পিতামহ-প্রপিতামহ একসময় নাকি শিকারি হিসাবে বেশ নাম করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শিকার করে বেড়িয়েছেন। তা নিয়ে মিসেস চৌধুরীর মধ্যে একটা চাপা অহঙ্কারও লক্ষ্য করেছি। ওঁর ব্যক্তিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য যে-আগ্রাসী মানসিকতা এবং প্রবল আত্মবিশ্বাস তা বোধ হয় জমিদারি রক্ত থেকেই এসেছে।

 কোনও নারী যে এমন রূপসী হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। সুরূপা সুদর্শনা নারী বিরল নয়। কিন্তু এমন নারীসৌন্দর্য শুধু বিরল নয়, অপার্থিব। এমন গোলাপি গাত্রবর্ণ, এমন শিল্পিত অঙ্গ-সংস্থান  কোনও প্রথম সারির চিত্রশিল্পী-ভাস্করের কল্পনাকেও হার মানায়! সত্যি বলতে কী, ওই বাড়িতে এত ঘন ঘন যাওয়ার কারণ মিসেস চৌধুরীকে কেন্দ্র করে আমার মনে তৈরি হওয়া রূপমোহ, রূপের নেশা। আমার আগে কোনও নেশা ছিল না। কিন্তু নেশা যে কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।

 আমি মিসেস চৌধুরীকে দেখতাম আর নিজের মায়ের কথা ভাবতাম। যত দেখতাম নিজের কাছে দু’জনের পার্থক্যটা তত প্রকট হয়ে উঠত। দু’জন একই বয়সী মহিলা, সন্তানের মা— অথচ… কতই না অমিল! একজনের স্বামীর আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে নিজের ননদ— ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্য ভাজদের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেও—এই ভাজকে যেন দেখতেই পায় না। আর একজন স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু হওয়ার পরও নিজের মোহিনী রূপে এতটুকু ছাপ পড়তে দেয় না। একজন কারও কাছে কোনও অপরাধ না করেও দরিদ্র হওয়ায় সবসময় কেমন গুটিয়ে থাকে, অপরাধ বোধে ভোগে। অন্যজন নিজের অভিধানে অপরাধ বোধকে স্থান না দিয়ে বহাল তবিয়তে প্রাচুর্যের জীবন ভোগ করে যায়। একজনকে দেখলে মনে হয় শাশ্বত মা, আর একজনকে দেখলে চিরন্তন নারী ছাড়া কিছু মনে হয় না।

 মিসেস চৌধুরী আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তার মূল কারণ ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও অভাবের তাড়নায় আমার ডাক্তারি পড়তে না-পারা। উনি মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করে বলতেন, ইস্, কেন এক বছর আগে তোমার সাথে আলাপ হল না। তা হলে আমি তোমার ডাক্তার হওয়ার সমস্ত ব্যয় বহন করতাম। উনি নিজে কেমিস্ট্রি নিয়ে কলেজের পড়া শেষ করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল রিসার্চ করবেন। কিন্তু ডাক্তার চৌধুরীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ওঁর এডুকেশন-কেরিয়ার সব চিরকালের মতো থেমে যায়।

 মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্য ওঁর। উনি যে আমার দ্বিগুণ বয়সী অথবা আমি যে ওঁর অর্ধেক বয়সী একথা উনি মনেই রাখতেন না বা ইচ্ছা করে ভুলে থাকতেন। আমি আমার স্বল্পকালীন জীবনে এমন কোনও মহিলার সংস্পর্শে আসিনি বা আসার কথা কল্পনাই করিনি। মিসেস চৌধুরীকে আমার কেমন পূর্ণাঙ্গ নারী মনে হত। সে তুলনায় চিত্রাকে মনে হত দুগ্ধপোষ্য শিশু। দু’জনের কোনও তুলনাই হয় না। মিসেস চৌধুরীর প্রতি কেমন এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ আমার মনে তৈরি হচ্ছিল। অনেক সময় চিত্রার সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও ওর সঙ্গে দেখা না-করে অদ্ভুত এই টানের কারণে আমি মিসেস চৌধুরীর কাছে অকারণেই পৌঁছে যেতাম।

 একদিন মিসেস চৌধুরী— আমার চৌধুরী বাড়িতে পদার্পণের প্রথম দিনের ঘটনার উল্লেখ করে— সাপ মারার জন্য আমি যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলাম তার খুব প্রশংসা করলেন। অবশ্য কালবৈশাখীর পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় যখন হাজির হয়েছিলাম তখন উনি কেজো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন এবং সেদিন আমাকে দেখে ওঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আমার মনে হয়েছিল উনি আসতে বললেও পরের দিনই আমাকে ঠিক প্রত্যাশা করেননি। যাই হোক ওঁর সেই আনুষ্ঠানিকতা কয়েক দিন পরেই আন্তরিকতায় বদলে গিয়েছিল। আমার সাপ মারার প্রশংসা করে উনি বললেন, এর আগে কত সাপ মেরেছ? আমি বললাম, একটাও না। ওটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম সাপ মারা।

 রিয়েলি? ভাবাই যায় না! ফার্স্ট শটেই এই পারফেকশন! এই ট্যালেন্ট তুমি পেলে কোথা থেকে?

 আসলে আমি জানতাম প্রথম মারটা ভীষণ ভাইটাল। ওটা ফসকালে যে কোনও কিছু ঘটতে পারে। হয়তো এই সিরিয়াস সিচুয়েশনই আমাকে টার্গেট মিস করতে দেয়নি।

 ওহ্, তা হলে তুমি তো দেখছি ভীষণ টার্গেট ওরিয়েন্টেড?

 তা জানি না, তবে লক্ষ্য স্থির করলে আমি আদা-জল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং লক্ষ্যে না-পৌঁছনো পর্যন্ত প্রচেষ্টায় কোনও খামতি রাখি না।

 তোমার মধ্যে তো দেখছি শিকারির গুণ রয়েছে যথেষ্ট। তবে আমারও কিন্তু শিকারির রক্ত, এটা ভুলো না। কেমন একটা চাপা গলায় কথাগুলো বলে আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালেন মিসেস চৌধুরী। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বললেন, আমি কিন্তু সত্যিই সে দিন মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওই একটি জিনিসকেই বড় বেশি ভয় পাই। ওই দিনের আগে-পরে কতবার যে শুধু ওর ভয়েই চারিদিকে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়েছি তুমি ভাবতে পারবে না!

 আমি বললাম, আর ভয় পেতে হবে না। এখন তো আমি আছি। সাপের ফোঁসফোঁসানি শুনতে পেলেই আমাকে খবর দেবেন। আমি এসে ঠিক খুঁজে বের করে মেরে যাব। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

 মিসেস চৌধুরী আমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, না সেটা আমার মনে হল বুঝতে পারলাম না।

 মিসেস চৌধুরীর মুখ থেকে আমার সাহসের প্রশংসা শোনার পর থেকে আমার নিজেকে কেমন পুরুষ পুরুষ মনে হতে লাগল। ওঁর রূপে তো প্রথম থেকেই মোহিত ছিলাম। কিন্তু এখন অন্য এক মৌতাত আমাকে মাতিয়ে তুলল। ওঁকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত এক শিরশিরে রোমান্স আমাকে পেয়ে বসল।

 মেয়ে তো, চিত্রা ঠিকই বুঝেছিল! বারংবার সাবধানবাণী শুনিয়েছিল, মোহের বাঁধনে নিজেকে বেঁধো না শুভ। আমি হেসে ঠাট্টা করতাম, ওহ্, তোমরা মেয়েরা পারোও বটে! একজন চল্লিশ বছরের মহিলার বাঁধনে নাকি আটকা পড়ব!

 কিন্তু কতটা আটকে পড়লে যে শিকার বনে যেতে হয় সেটা বুঝলাম ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের খবর রেডিয়োতে শুনেছি, টিভিতে দেখেছি; ঘটনা যে মনে খুব রেখাপাত করেছে এমন নয়। সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে বসেছি মিসেস চৌধুরীর ড্রয়িং রুমে। অন্যদিন আমরা গল্প শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই রমা আসে, একটু বসে, তারপর উঠে পাশে পড়ার ঘরে চলে যায়। দু’জনে বসে গল্প করছি বেশ কিছুক্ষণ। রমার পাত্তা নেই দেখে জানতে চাইলাম, রমা বাড়ি নেই নাকি? মিসেস চৌধুরী অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর সহজ ভাবে বললেন, স্কুল থেকে এক্সকারশনে শান্তিনিকেতনে গিয়েছে, আগামীকাল সন্ধ্যায় ফিরবে।

 ওঠার সময় হয়ে এল। বললাম, উঠি।

 এত তাড়া কিসের? তোমার জন্য আজ একটা স্পেশাল ডিশ আছে। একটু টেস্ট করে যাও।

 … ঘন্টা দুয়েক পরে যখন মিসেস চৌধুরীর বাড়ি থেকে শেষ পর্যন্ত বেরতে পারলাম তখন সম্পূর্ণ ঘেঁটে যাওয়া মাথায় কয়েকটা বিক্ষিপ্ত ভাবনা জট পাকাচ্ছিল।… আচ্ছা, আমরা এই যে এত সৌন্দর্য ভালবাসি, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই, সৌন্দর্য উপভোগ করি, কিন্তু সৌন্দর্য যদি আমাদের শিকার করে—শিকারির ভূমিকা পালন করে, তাহলে আমাদের কি সত্যি খুব ভাল লাগত!… সূক্ষ্ম ভাল লাগা-স্বপ্ন-কল্পনা যদি বাস্তবের স্থূল হস্তাবলেপনে লাঞ্ছিত হয়, তা হলে সেটা কি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে না!— একই নারী শরীর অথচ কোনওটা ভালবাসার স্বামী সহবাসেও কেমন নিষ্ক্রিয়, অনিচ্ছুক আর কোনওটা কেমন পরপুরুষ গমনেও অতি সক্রিয়, পারঙ্গম!… জৈবিক চাহিদা বা প্রবৃত্তি মানুষকে কি এমন ভাবে শিকার করতে পারে, যেখানে তার আর নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না— স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সে নিজেকে বিলিয়ে দেয়,বিকিয়ে দেয়!

 পরের দিন চিত্রার সঙ্গে দেখা হতে অন্য দিনের মতো আর ওর হাত ধরতে পারলাম না‌। মনে হল চিত্রা যে পবিত্র ধামে অবস্থান করে, তা আমার জন্য অনতিক্রম্য দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছে। এ জীবনে সে ব্যবধান হয়তো চিরন্তন হয়ে গেল।

 ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলাচলে ব্যবহৃত হতে হতে কোথায় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। অদ্ভুত একটা রাগ, প্রতিশোধস্পৃহা মনের মধ্যে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলত। সেই তুষানল দাউদাউ করে জ্বলে ওঠার জন্য শুধু একটু ইন্ধনের অপেক্ষায় ছিল। চার মাস পরে ‘৯৩-র ১২ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল আমার কী করা উচিত। নিজে শিকার বনে যাওয়ার পরও নিজেকে ক্রমশ শিকার থেকে শিকারিতে উন্নীত করাই যে আমার পরবর্তী কর্তব্য হওয়া উচিত সেটা উপলব্ধি করে চৌধুরী পরিবারে আমি মোহনজাল বিছোতে লাগলাম। সেই বিস্তৃত বীতংসে সকন্যা ঘাই হরিণীরূপী মিসেস চৌধুরী রজ্জুবদ্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করে উঠল, আমি শুধু কর্তব্য পালনকারী শয়তানের মতো মুচকি হাসলাম।

 কিন্তু ক্ষত? তার উপশম কি আদৌ কখনও হওয়া সম্ভব? তা যদি সম্ভব হত, তাহলে তো দাঙ্গার আগুন নিভে যাওয়ার পরে সংঘটিত মুম্বাইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণ মিথ্যা হয়ে যেত!

 ২০০১-র ১১ সেপ্টেম্বর, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্রেকিং নিউজ-এর দিনে আমার মনে এক অদ্ভুত আক্ষেপ-বোধ তৈরি হয়েছিল। কেন আমি তার অনেক আগেই  আমার জীবনের দুই টুইন টাওয়ারকে ধ্বংস করেছিলাম! কেন আমি ৯/১১ পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি! আর্থিক সক্ষমতা এবং স্বৈরাচারিতার প্রতীক মিসেস চৌধুরী আর নিজেকে নিয়ন্ত্রক এবং শাসনের অধিকারী ভাবতে থাকা রমাকে আমি কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একই বেডরুমে চরম রিরংসার লেলিহান শিখায় ভস্মীভূত করেছিলাম। অগ্নিবলয়ের গ্রাস থেকে চিত্রার শুভও অবশ্য নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। অগ্নিশুদ্ধ হয়ে আমার পক্ষে আর নরোত্তম থাকা সম্ভব হয়নি, নিজের দহন-জ্বালা জুড়ানোর জন্য সুরম্য লঙ্কা বারে বারে দহন করতে হয়েছে।

 আর হ্যাঁ, সেই ৬ ডিসেম্বর রাতে বাড়ি ফিরে, বিছানায় শুয়ে, বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত আমি সম্যক উপলব্ধি করেছিলাম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের নিগূঢ় বেদনা।

(ক্রমশ)

*****

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি

Related Posts