Third Lane Magazine

ছদ্মজীবনী (পর্ব ৫) ~ দিলীপ কুমার ঘোষ

 এ উপাখ্যানের কাহিনি চেনা ছকে এগোয়নি। কাহিনি শেষ থেকে শুরু করে সামনের দিকে এগিয়েছে। মানুষের জীবনে ষড়রিপুর মতো ষড়ঋতুর আবর্তনও সত্য। তারই অনুষঙ্গে ছ’টি পর্বে গ্রথিত এই কাহিনি। যে কোনও পর্ব থেকেই এই কাহিনি শুরু হতে পারে। যে কোনও পর্বের পর যে কোনও পর্বে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে, কাহিনির গতি এবং বোধগম্যতা তাতে ব্যাহত হয় না।

এবারে পঞ্চম পর্ব 

 স্বপ্নিল বসন্ত।। সবুজের অভিযান

 চিত্রার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের পর প্রায় বছর দুয়েক কাটতে চলেছে। বছর দেড়েক চিত্রা এবং আমার প্রেমজ সম্পর্কের কথা কেউ সেভাবে জানতে পারেনি। বুঝতে পারলে তো জানবে! চিত্রা গোড়া থেকেই অন্তর্মুখী-আত্মকেন্দ্রিক মেয়ে। ওর খুব একটা বন্ধু-বান্ধব নেই। আর আমার বড় হওয়ার মধ্যে জীবন্ত কোনও কিছুকে জড়ানো;  কোনও মানবপ্রাণের আমাকে সচেতনভাবে জড়িয়ে থাকা অথবা নিঃসঙ্গ আমাকে সদা-সর্বদা সঙ্গ দেওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না! তাই চিত্রা এবং আমি খুব সহজেই একে-অপরের মনোজগতে ডুবে যেতে পেরেছিলাম। দু’জনে দু’জনের মধ্যে এমনভাবেই ডুবেছিলাম যে, মুক্ত শ্বাসবায়ুটুকু বেরিয়েও জলের উপরে বুড়বুড়ি কাটতে পারেনি— যা থেকে অপরের পক্ষে আমাদের এই সম্পর্ক অনুধাবন করা সম্ভব। আর কথাতেই তো আছে— ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাবাও টের পায় না।

 শিবের কথা এসে পড়ায় একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। জানি না সেদিন আমি কোনও অন্যায় করেছিলাম কি না! তবে এটুকু জানি, সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার পক্ষে সাধারণ প্রবৃত্তি বা বেসিক ইন্সটিংটিক্ট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলছি কেন, বলা উচিত— নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় তো বটেই, উল্টে বেসিক ইন্সটিংক্ট-ই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং করবে।

 শিবচতুর্দশী ছিল আমাদের গ্রামীণ জীবনে ‘চৈতালি রাতের স্বপ্ন’। শিবদুর্গা পুজোর এই রাতে— ভিসিআর ভাড়া করে এনে— বিভিন্ন জায়গার পুজো-চত্বরে, সারারাতব্যাপী কমপক্ষে তিনটে সিনেমা দেখানোর আয়োজন ছিল পুজোর আবশ্যিক শর্ত। কোন কোন সিনেমা চালানো হবে তা নিয়ে অনেক দিন আগে থাকতেই আলাপ-আলোচনা জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকত। ‘গুরুদক্ষিণা’-‘অমরসঙ্গী’র মতো একটা বাংলা সিনেমা চালানো ছিল মাস্ট। মিঠুন-জিতেন্দ্র-শ্রীদেবী-জয়াপ্রদার ‘গুরু’-‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’-‘তোফা’ জাতীয় হিন্দি সিনেমাকে রাখতেই হত; অমিতাভ অথবা রজনীকান্তের অ্যাকশান সিনেমা না-দেখলে ঠিক ঘুম ছাড়ত না। ‘পুরানি হাভেলি’-‘ভিরানা’ কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী রাতকে আরও ভয়াল-ভয়ঙ্কর করে তুলতে সহায়ক হত। শিবরাত্রির ব্রত পালন করা বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের সমাবেশে শুধু শিবদুর্গা পুজোর স্থান নয়, ভিসিআর চলার জায়গাও একটা আলাদা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠত। বয়স নির্বিশেষে অনেক পুরুষ মানুষই ভিসিআর-এ চলা সিনেমায় মনোনিবেশ না-করে জুলজুল করে চেয়ে থাকত তার আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের নারীর দিকে। সে চোখে যে শুধু মোহাঞ্জন লেগে থাকত তা নয়। কামনা-বাসনা-লালসার খার তাদের চোখে শ্বাপদের দৃষ্টি এনে দিত। জানি না তার পিছনে তাদের অবদমিত যৌনতা কাজ করত কি না! অবশ্য এ দোষে শুধু পুরুষকে দায়ী করলে প্রকৃত সত্যের অপলাপ করা হবে। কারণ বিপরীত ঘটনা যে একদমই ঘটত না, তা-ও নয়। কিন্তু শতাংশ বিচারে তা ছিল হাতে গোণা। অবশ্য উঁকিঝুঁকি মারা এমন নারী-পুরুষের বাইরে বাকি সকলে যে সিনেমাতেই নিমজ্জিত থাকত তা নয়। মাঝে মাঝে দু’-চার জোড়া নারী-পুরুষ সামনের কোনও মাঠে যুগলমূর্তিতে আবিষ্কৃত হত। অনুসন্ধানী খর-চোখের দৃষ্টি প্রগলভ অবস্থায় তাদের পক্ষে এড়ানো সম্ভব হত না। আর তা নিয়ে বেশ হই-হই পড়ে যেত। আমার অবশ্য নারী-পুরুষের এমন আচরণে একটুও অবাক লাগত না। তার কারণ সম্ভবত লাইব্রেরি থেকে আনা কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের বাংলা অনুবাদ পড়ে ফেলা। সেখানে সুতনুকা পার্বতীর রূপবর্ণনা এবং শিব-পার্বতীর মিলন-রভসের কাছে এ সমস্ত আমার বরঞ্চ খুব জোলো মনে হত।

একাদশে পাঠরতা চিত্রা তার আগে কোনও দিন শিবরাত্রির ব্রত পালন করে শিবের মাথায় জল ঢালার প্রয়োজন বোধ করেনি। ওদের বাড়ি, বিশেষ করে ওর মা চিত্রাকে কখনও এসব ব্যাপারে উৎসাহিত করেনি। উৎসাহিত করা তো দূরের কথা, সযতনে ওকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। চিত্রা আমার কাছে জানতে চাইল, শুভ, আমি শিবরাত্রি করলে তোমার খারাপ লাগবে না তো? চিত্রার সেই প্রথম ‘শুভ’ সম্বোধনে আমার ভিতরে যেন কী একটা ঘটে গেল। বেশ কিছুটা সময় আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না। তারপর সেই প্রথম লাইব্রেরি রুমের টেবিলের আড়ালে ওর দু’টো হাত আমার দু’টো হাতের মধ্যে নিয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। মনে মনে চিত্রাকে বলে উঠলাম, বলো, চিত্রা, একবার বলো, ‘মম করতল তব করতলে হারা।’ চিত্রা হাতটা ছাড়িয়ে নিল না, কিন্তু আমার চুপ করে থাকার ভুল ব্যাখ্যা করে হাতটা কঠিন করে বলল, ঠিক আছে, তুমি যখন চাও না, আমি শিবরাত্রি করব না। আমি অবশেষে বাস্তবে ফিরে এসে বললাম, কই, আমি তো তোমাকে শিবরাত্রি করতে বারণ করিনি!

 বাড়ি ফিরে সেদিন রাতে আমার ঘুম এল না। শিবরাত্রিতে সারারাত ধরে চিত্রাকে দেখতে পাব, শুধু এটুকু ভেবেই আমি সুখের সাগরে ভেসে যেতে লাগলাম। মাঝখানের তিনটে দিন যেন আর কাটতে চাইছিল না।

 অবশেষে এল সেই প্রতীক্ষিত শিবরাত্রি। আমার কাছে এ পুজোর আকর্ষণ দিন নয়, রাত। অন্যবার আকৃষ্ট হতাম চলচ্চিত্রে, আর এবারের আকর্ষণ বাস্তবের চালচিত্র।

 রাত তখন ক’টা বাজে খেয়াল নেই। দেখলাম সিনেমা দেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল চিত্রা। আমার চোখ তো সেরাতে আর সিনেমায় ছিল না। চিত্রার উঠে দাঁড়ানোটা তাই প্রথমেই চোখে পড়ল। মিঠুনের অ্যাকশানে বুঁদ হয়ে থাকা চিন্ময়ের চিত্রার উঠে দাঁড়ানো চোখে পড়েনি। আমিই ওকে বললাম, চিত্রা মনে হয় বাড়ি যাবে? ও ঘোর লাগা গলায় বলল, যা না… তুই ওকে একটু বাড়ি দিয়ে আয় না!

 কৃষ্ণা-চতুর্দশীর রাতে পথে আমরা দু’জন। জানি না সারাজীবন একই পথের পথিক হয়ে আমরা হাঁটতে পারব কি না! জীবনপথ কোন রাস্তায় আমাদের নিয়ে ফেলবে, তা কি আমরা কেউ আগে থাকতে জানতে পারি! হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা বলল, আজ শিবরাত্রির ব্রত পালন আমার সার্থক। আমি বললাম, কীভাবে?

 এই যে আমার শিব শিবচতুর্দশীর রাতে আমার সঙ্গে রয়েছে! এ কী কম কথা!

 চিত্রার পাশাপাশি আমি হেঁটে চলেছি। আমার ডান হাতে ধরা সাইকেল। বাঁ দিকে চিত্রা। অন্ধকার রাতে খানাখন্দময় পিচরাস্তায় হাতে ধরা সাইকেল ঠিকমতো সামলাতে গিয়ে মাঝেমাঝে চিত্রার গায়ের উপর এসে পড়ছি। বাসন্তী রাতের মাদকতা আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। আর আমি কোনও কথা না বলে মধুক্ষরা সময়ের সবটুকু যেন সংশ্লেষ করে নিতে চাইছিলাম।

 সমস্ত পথই একসময় শেষ হয়। অবশ্য সেটা যে সবসময় চিত্রনাট্য অনুযায়ী হবে, তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ‘সুহানা সফর’-এর শেষে পৌঁছে গেলাম চিত্রাদের বাড়ির দোরগোড়ায়। চিত্রা দরজার কড়া নাড়বে বলে হাতটা বাড়িয়েছে, আমি সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে আমার ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। ওর ডান হাত দরজার কড়া স্পর্শ না করে আমার কম্পিত ডান হাত আলতো করে ধরল। ওর সেই ধরা-হাতের স্পন্দন আমাকে অভিভূত করল। আমি চিত্রাকে বাঁ হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে আমার উষ্ণ অধরোষ্ঠ ওর অধরে স্থাপন করলাম। অনুভূত হল ওর কম্পিত অধরের সমর্পণ। ও বোধহয় চোখ বুজে ছিল। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ও আলতো করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে যেতে গেল। সেই সময় প্রবৃত্তিতাড়িত আমার ডান হাত ছুঁয়ে গেল ভীরু কিশোরীর কোমল বক্ষ। মুহূর্তমাত্র। তৎক্ষণাৎ সচেতন প্রয়াসে আমি নিজেকে সামলে নিলাম।

 কিন্তু সাইকেল চেপে ফেরার পথে আমার খালি মনে পড়ছিল বিস্ময়বিমূঢ় চিত্রার দৃষ্টিপাত। পরের দিন স্কুল ছুটি ছিল। তার পরের দিনও চিত্রা যখন স্কুলে এল না আমি এক অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। বসন্তের বিকাল, যা আমার অত্যন্ত প্রিয়, কেমন ভার হয়ে আমার ওপর চেপে বসতে লাগল। মাঠে একজায়গায় চোখে পড়ল লাল চামাটি পিঁপড়ের মাদা। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। নিজের পাপী ডান হাতখানা সেই পিঁপড়ের চাকে চেপে ধরলাম। পিঁপড়ের বিষজ্বালায় হাতটা জ্বলতে লাগল। আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলে আমি আমার প্রথম প্রায়শ্চিত্তের আচমন সারতে লাগলাম।

 পরদিন চিত্রাকে স্কুলে আসতে দেখলাম। ও-ও দেখতে পেল আমাকে। আর ওর প্রথম নেত্রপাত আমাকে আশ্বস্ত করল। ওর দৃষ্টিতে কোথাও কোনও মালিন্য ছিল না। সেই স্নিগ্ধ শীতল চাহনি!

 চিত্রার বিষয়টা কতটা খারাপ লেগেছিল তা জানি না। তবে ঘটনাটা ওর মধ্যে যে অভিঘাত তৈরি করেছিল সেটা কয়েক দিন পর লাইব্রেরি রুমে বসে বলা ওর কথা থেকে বুঝতে পারলাম। আমি যখন ওকে বললাম, বুঝলে চিত্রা, এবার দোলে তোমাকে রং মাখাতে যাব ভাবছি। শুনেই ওর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, আদিখ্যেতা! তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, সেটা ঠিক হবে না বোধহয়। এর আগে দোলে তুমি কোনও দিন আমাদের বাড়ি আসোনি। এবার হঠাৎ উপস্থিত হলে এবং বিশেষ করে আমাকে রং মাখালে সবার সেটা চোখে পড়বে।… তার ওপর তোমাকে আমার একটুও ভরসা নেই, বাপু!

 কেন, আমাকে ভরসা নেই কেন?

 সলাজ চোখে আমার দিকে তাকাল চিত্রা। তারপর চোখে একটা দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুলে নিজের ডান মুঠি দিয়ে আমার পিঠে আলতো করে ঘুঁষি মারতে মারতে বলল, তুমি তো একটা ডাকাত, তোমাকে আবার ভরসা করা যায় নাকি!

  দোলের দিন আমি ঘর থেকে আর বেরোলামই না। না বেরোলে কী হবে, সন্ধ্যাবেলায় চিত্রা আমাকে এমনভাবে টানতে লাগল যে, লজ্জার মাথা খেয়ে আমি পৌঁছে গেলাম ওদের বাড়িতে। গিয়ে ভাব দেখালাম যেন চিন্ময়ের কাছে এসেছি। কিন্তু সবসময় আমি চিত্রাকে চোখে হারাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম চিত্রা আমার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। তা হাসুক গে, আমি যে আমার চোখের স্পর্শে ওর দু’গালে আলতো করে গোলাপি আবীর লাগিয়ে দিচ্ছিলাম, তা কি আর ও টের পাচ্ছিল!

 উচ্চ মাধ্যমিকের আগে পর্যন্ত আমাদের প্রেম লাইব্রেরি রুমেই আটকে ছিল। স্কুলে যাতায়াতের পথে মাঝেমধ্যে দেখা হত। কথা বিশেষ হত না। স্কুলেও আমরা সেভাবে কথা বলতাম না। আমাদের যত কথা, সব ছিল লাইব্রেরি রুমেই।

 আর ছিল বিভিন্ন ক্যুইজ কম্পিটশনে যাওয়া। স্কুল থেকে অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যেতাম। কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে পাশাপাশি বসা আমরা দু’টিতে মাথা এক করে আলোচনা করে নিতাম। এইসময় গলা এবং মুখের বিভিন্ন জায়গায় একে অপরের ঘ্রাণ স্পর্শ করে যেত। আর অনাঘ্রাত আঘ্রাণে মাতোয়ারা দু’টি প্রাণে প্রথম প্রেমের অমরাবতী নেমে আসত। অনেক সময় প্রতিযোগিতায় আমরা জিততাম— চ্যাম্পিয়ন হতাম, পোডিয়াম-ফিনিশ করতাম; অনেক সময় প্রতিযোগিতায় একদম দাঁড়াতেই পারতাম না— ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছতে পারতাম না, হেরে ভূত হতাম। কিন্তু প্রতিযোগিতার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে জয়মাল্য আমাদের গলাতেই উঠত। নব অনুরাগাবিষ্ট প্রেমে— এমন সম্মানজনকভাবে কিশোর-কিশোরীকে কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিয়ে— ক্যুইজ আমাদের যে বরাভয় প্রদান করেছিল, অনেক প্রেমিক যুগলই এমন আশীর্বাদ কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না।

 মাঝে কেটেছে আরও একটা মনখারাপের শিবরাত্রি, এক বিরহবিধুর একক দোলপূর্ণিমা; দু’টো সরস্বতীপুজো এবং দু’বৎসরের দুর্গাপুজো। কিন্তু এইসব উৎসবের দিনে আমাদের কেউ-ই খুব একটা বাইরে একত্রে ঘোরাঘুরি করতে দেখতে পায়নি।

 সবে কিছুদিন হল আমরা লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। দু’জনে দু’টি সাইকেলে চেপে সময়-সুযোগ পেলেই প্যাডলে চাপ দিয়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলছি প্রকৃতিরাজ্যে। অনেক সময়ই বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যায়। ভাবখানা এমন— যেন এখন আমাদের আটকায় কে! আমরা আর কচি খোকাখুকি নই, আমরা আঠারো। আমরা নবীন, আমরা সজীব, আমরা সবুজ।

 নবীন সজীব-সবুজ সদ্য-প্রেমরাগাবিষ্ট প্রাণে মৃত্যুর অভিঘাতও বড় তীব্রভাবে বাজে বোধ হয়! নাহলে অপরিচিত-অনাত্মীয় বিয়োগে এমন কষ্ট হয় কেন? সে মৃত্যু ঠিক কেন বিশ্বাস্য মনে হয় না? মৃত্যু পরবর্তী বেশ কয়েকদিন কেন মনে হতে থাকে তিনি যদি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন! এতদিন হয়ে যাওয়ার পরও সে মৃত্যুবীণা আজও কেন করুণ সুরে বেজে ওঠে! কই, নিজের অত প্রিয় দাদুর মৃত্যুও তো এভাবে আমাকে ছুঁতে পারেনি, ছুঁয়ে যায়নি আমার কোমল তন্ত্রীকে! অথচ তার সংবেদন তো আমার উপর আরও অনেক বেশি গভীর হওয়া উচিত ছিল। কারণ সেটাই ছিল আমার জীবনে কাছ থেকে দেখা কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু।

 উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে মাসখানেকের উপর। মে মাস। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ। গরমে প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। টি এস এলিয়ট তাঁর মাস্টারপিস ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর শুরুতে ভিন্ন প্রসঙ্গে যতই বলুন না কেন, এপ্রিল ইজ্ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ, মে-র কাঠফাটা গরমের অভিজ্ঞতা যে তাঁর ছিল না, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকা যায়। আমাদের প্লাস্টারবিহীন পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেওয়ালের ঘরে দক্ষিণ দিকে কোনও জানলা ছিল না। পূর্ব ও পশ্চিমে মুখোমুখি দুটো ঘুপচি জানলা। গরমের দিন-রাতে ঘরে টেকা যেত না। দিনের বেলা নাহয় স্কুলে অথবা মাঠেঘাটে ঘুরে কাটিয়ে দিতাম কিন্তু রাতের বেলা তো আর সে সুযোগ ছিল না! অগত্যা দাদুর পাশে শুয়ে গরমে ছটফট করতে করতে বিনিদ্র রাত্রিযাপন। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে যেতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পারতাম না।

 সেরাতেও নিশ্চয়ই ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। নাহলে সমবেত হইচই শুরুর পর ঘুম ভাঙবে কেন! ঘুম ভাঙতে কানে এল নীপাদির গলা, সবাই বলছে, বোমার আঘাতে নাকি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে! প্রথমে আমার সদ্য ঘুমভাঙা মাথায় কিছু ঢুকল না। কার বোমার আঘাত লেগেছে? কে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে? কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর এবং আরও দু’-চারটে কথা কানে আসার পর ঘুম ভাঙা চোখে, চোখ রগড়াতে রগড়াতে পৌঁছে গেলাম নেতাজি সঙ্ঘে। আর সেখানে গিয়ে দেখি প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষের জটলা। তাদের কথাবার্তা থেকে আমার কাছে পুরো ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ভারতের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গত রাতে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুরে নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখার আগেই আত্মঘাতী বোমার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনাটা কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছিল না সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে বলে।

 ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়, টিফিনে বাড়িতে ভাত খেতে এসে, রেডিওতে দিল্লি থেকে সম্প্রচারিত দুপুরের খবরে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিজস্ব দেহরক্ষীর হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদে ঠিক এমনই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে ফিরে দু’একজনকে কথাটা বলতে তারাও বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসে সত্য তো আর টলে না! ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছিলেন। মনে আছে সেদিন রাতে রেডিওতে সংবাদপাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কান্নাভেজা গলায় ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুসংবাদজ্ঞাপন আমাদের বাড়ির অনেকজনের চোখ ভিজিয়েছিল। পরের দিন পয়লা নভেম্বর মোড়ের মাথায় অশোকদার দেওয়া খবরের কাগজের জন্য সকাল ন’টা থেকে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিন আমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুপুর দেড়টায় অশোকদা কাগজ দিয়ে যায়।

 রাজীব গান্ধীর মৃত্যু কেন আমায় এত বেজেছিল সেটা আজও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু আমার মন এই মৃত্যুকে কিছুতেই সহজে মেনে নিতে পারেনি। রাজীবের মৃত্যুর কয়েক দিন পর প্রকাশিত ফ্রন্টলাইন-এ মৃত্যু বিভীষিকার ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভারী হৃদয়ে আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল উনি যদি এই বিস্ফোরণে মারা না যেতেন! একটা ছবিতে ছিটকে অনেকটা দূরে পরে থাকা একপাটি স্নিকারের ছবি অদ্ভুত এক কষ্ট এবং অসহায়তা তৈরি করেছিল আমার মধ্যে।

 আমি সহজেই এমন কিছু জিনিস বুঝতে পারছিলাম, যা প্রেমে না পড়লে বোধহয় বোঝা সম্ভব নয়। যেমন মৃন্ময়ের আচরণে অনিমার প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা, যার মর্ম এমনকি মৃন্ময়ও বুঝে উঠতে পারেনি। আর বুঝে উঠতে পারেনি বলেই সে আমার কাছে এসে চিন্তিত গলায় সহজে বলে বসেছিল, ব্যাপারটা কী হল বলতো?

 মৃন্ময় এবং অনিমার সম্পর্কটা সকলেই কমবেশি জানত। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে ওদের সম্পর্ক।

 আমি জানতে চাইলাম, কোন ব্যাপার?

 আমি অনিমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে গেলাম…  এটা যে প্রথমবার তাও নয়… কিন্তু ও আমাকে সেই সুযোগ না দিয়ে কেমন একটা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল। তারপর থেকে ওর আর দেখাসাক্ষাৎ নেই।

 হঠাৎ দুম করে চুম খেতে গেলি কেন?

 হঠাৎ নয় রে! ব্যাপারটা তাহলে বলি শোন। অনিমার দূর সম্পর্কের এক দাদা বছর দুয়েক হল হুগলীর একটা কলেজে চাকরি পেয়েছে।

 পার্বতীপুরের অনিমেষ বসু?

 হ্যাঁ। তা, তুই জানলি কী করে?

 কেন আবার, আমার মিহিরদা তো ওখানে পড়তে যায়, ওর মুখে শুনেছি।

 ওহ্!… হ্যাঁ, যা বলছিলাম… সেই অনিমেষের কাছে অনিমা সপ্তাহে দু’দিন পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়তে যেত। তবে অনিমার প্রথম থেকেই অনিমেষের হাবভাব, চোখের চাউনি ভাল লাগেনি। ব্যাটার কথাবার্তার মধ্যেও সবসময় একটা অন্যরকম ইঙ্গিত থাকত।

 অন্যরকম মানে?

 অন্যরকম বুঝতে পারছিস না! খারাপ ধান্দা আর কী। অবশ্য অনিমা প্রথম দিকে সেসব গা করেনি। কিন্তু গান্ডুটা একদিন ঠারেঠোরে নিজের নোংরা ইচ্ছার কথা জানাল অনিমাকে। সেটা শুনেও অনিমা রা কাড়েনি। জাস্ট হজম করে নিয়েছিল।… অনিমা যে কেন সেদিন প্রতিবাদ করেনি কে জানে! এমনকি আমাকেও কিছু জানায়নি।

 তারপর?

 তারপর আর কী! একদিন রাস্কেলটা মাত্রা ছাড়াল। চরম বাড়াবাড়ি করে ফেলল। লজ্জার মাথা খেয়ে অনিমার দিকে হাত বাড়াল।

 কী বলছিস রে! তা, অনিমা টেনে একটা থাপ্পড় মারতে পারল না জানোয়ারটাকে।

 তা পারলে তো আর কথাই থাকত না! জানোয়ারটার হাত ছাড়িয়ে অনিমা ছিটকে চলে এসেছিল। বাড়ির কাউকে কিছু বলেনি। কাঁদতে কাঁদতে শুধু আমাকে সব বলেছিল।

 শুনে তুই কী বললি?

 শুনেই প্রথমে আমার মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে গেল। মনে হল গান্ডুটাকে ধরে দু’-চার ঘা দিয়ে দিই। তারপর রাগটা গিয়ে পড়ল অনিমার ওপর। ওকে অন্যায় দোষারোপ করে বললাম, তোমার প্রশ্রয়ে আর চুপ করে থাকার কারণেই বিষয়টা এতটা বাড়তে পেরেছে।… তোমাকে আর ওর কাছে পড়তে যেতে হবে না। অনিমা জানতে চাইল, বাড়িতে কী বলব? আমি বললাম, বলবে, পলিটিক্যাল সায়েন্স আমি নিজেই বাড়িতে পড়ে নেব, টিউটর লাগবে না। আর জানিস… ওর আর অনিমেষের কাছে পড়তে না যাওয়ার কথা বলতে বলতে আমি অনিমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে গেলাম। তাতে অনিমা কেমন গুটিয়ে গেল আর তারপর… অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সেই যে গেল…! মেয়েদের মরজি বোঝা ভার!… কেন যে ছাই চুমু খেতে গেলাম! এখন হাত কামড়ে মরছি।

 মৃন্ময় বুঝতে না পারলেও আমি কিন্তু অনিমার আচরণ পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। অনিমা খুলে বলেনি বলে মৃন্ময় বুঝতে পারেনি। যেটাকে মৃন্ময়ের অনিমার প্রশ্রয় মনে হয়েছিল, সেটা আসলে প্রশ্রয় ছিল না, ছিল সিদ্ধান্তহীনতা। কী করবে, কাকে কী জানাবে, সেটা অনিমা ঠিক করে উঠতে পারেনি। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল যে ও ঠিক তাল রাখতে পারেনি। ঘটনার স্রোত ওকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে দেইনি। ওর ওই মানসিক অবস্থায় মানসিক সান্নিধ্যের পরিবর্তে অনিমেষের শারীরিক সান্নিধ্য তা-ই ওকে ধাতস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা তো করেইনি, বরঞ্চ বিধ্বস্ত করেছে।

 মন খুব সংবেদনশীল হয়ে থাকলে অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপারও বোধগম্য হয়, সন্ধান মেলে এমন অনেক কিছুর যা আগে দেখলেও উপলব্ধি করা যায় না। এই সংবেদনশীলতাই আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মায়ের অন্য এক রূপ, পরবর্তীতে যে রূপ আমি নিজের মধ্যেও উপলব্ধি করেছি। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু দেখি প্রয়োজনে অত্যন্ত স্নেহশীল মানুষও কেমন কঠোর-কঠিন হয়ে উঠতে পারে এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নিজের মানবিক সত্তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে!

 আমাদের টালিছাওয়া এককামরা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের দক্ষিণদিকে বিশু দাসের একটা বড় তেঁতুল গাছ ছিল। সেই গাছে সর্বক্ষণ হনুমানের উপদ্রব লেগে থাকত। আমাদের টালির চাল ছিল স্বাভাবিকভাবেই ওদের দাপাদাপির জায়গা। তেঁতুল গাছ থেকে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-দোল খেয়ে ওরা এসে পড়ত চালে। প্রায়শই টালি ভাঙত, একাধিক। উঁচু খাড়াই চালে টালি পাল্টানোর লোক অনেক সময় পাওয়া যেত না। বর্ষার সময় বেশ অসুবিধা হত। বৃষ্টির জলে ঘর ভাসত। বিশু দাস অথবা ওর বাড়ির লোককে, ওদের পাঁচিল ঘেরা বিঘে তিনেক বাগানে আমের মরশুমে অথবা অন্য সময় দেখতে পেয়ে, মা বেশ কয়েকবার তেঁতুল গাছ কাটার কথা বলেছিল। কিন্তু ওরা সে কথায় কান দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি। মা একদিন আমাকে বলল, বুঝলি শুভ, তেঁতুল গাছটাকে অ্যাসিড দিয়ে মারতে হবে। আমি তো শুনে অবাক। এতবড় তেঁতুল গাছ, তাকে কিনা অ্যাসিড দিয়ে মারা হবে! তাও আবার গাছটাকে মারবে কে? না, আমার মা! যার স্নেহ-ভালবাসার কথা সকলে খুব প্রশংসার সুরে বলে। আমি কেমন অবিশ্বাসভরা চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম।

 মাস তিনেকের মধ্যে তেঁতুল গাছটাকে ক্রমশ শুকিয়ে যেতে দেখলাম। মাস ছয়েকের মাথায় দেখলাম গাছটার কঙ্কাল। জানি না মা কোথা থেকে কীভাবে অ্যাসিড জোগাড় করেছিল আর সেটার প্রয়োগই বা কীভাবে হয়েছিল!

 মাকে দেখতাম আশেপাশের বাড়িতে আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং বুক দিয়ে সবকিছু করতে, কিন্তু সেই মা-ই নিজের বাড়ি ফিরে একদম নির্লিপ্ত হয়ে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে ঘরকন্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। যে বাড়িতে এতক্ষণ থেকে তাদের কষ্টে চোখের জল ফেলে এল, সেই বাড়ির সবকিছু মা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যেতে পারত।

 শুধু বর্তমান নয়, অতীত নিয়েও মায়ের মধ্যে কোনও আবেগের বাড়াবাড়ি দেখিনি। দাদুর একটা পুরনো শাল ছিল। দাদু মারা যাওয়ার পর সেটা স্থান পেয়েছিল আমাদের টিনের বাক্সে। এক দুপুরে হাজির এক ফেরিওয়ালা। সেসময় আমাদের বেশ টানাটানি চলছিল। কথায় কথায় সেই ফেরিওয়ালা জানাল পুরনো জিনিসপত্রও নাকি সে কেনে। আমাদের কাছে সেরকম কোনও পুরনো জিনিস থাকলে সে কিনতে পারে। মা মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে টিনের বাক্স খুলে বের করে নিয়ে এল দাদুর সেই পুরনো শাল। তিনশো টাকার বিনিময়ে অতীত বিসর্জন দিতে মা দু’বার ভাবল না।

(ক্রমশ)

*****

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জি

Related Posts